নিশ্চিন্তপুরে চিতা, ‘নিশ্চিন্তপুরে’ ঘুম

আহমেদ মুনীরুদ্দিন তপু
Published : 4 Dec 2012, 02:57 PM
Updated : 4 Dec 2012, 02:57 PM

নিশ্চিন্তপুর 'হত্যাকাণ্ডে'র নয়দিন পরও আমরা কি জানি ঠিক কতোজন শ্রমিককে তালাবদ্ধ রেখে ওই আগুনে পুড়িয়ে মারা হল? সরকারি হিসেবে বলা হয়েছে ১১১ জন শ্রমিক নিহত হওয়ার কথা, কিন্তু আগুনের সময়ে কারাখানায় কতোজন শ্রমিক কাজ করছিলেন? কতোজন শ্রমিক আহত হয়েছেন আগুন থেকে বাঁচতে গিয়ে? ওই কারখানার 'ডে কেয়ারে' থাকা শ্রমিকদের কয়টা শিশু মারা গেল আগুনে? ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে 'ডিএনএ নমুনা সংগ্রহের' পর জুরাইনে 'বেওয়ারিশ' হিসেবে কবর দেওয়া হল যে ৫৩ শ্রমিককে তাদের পরিবার পরিজনদের জড়ো করে সেই নমুনা মিলিয়ে সনাক্ত করা হল কি?

এমন আরো অনেক অত্যন্ত জরুরি প্রশ্ন আমরা ইতোমধ্যেই ভুলতে বসেছি, গণমাধ্যমে ফিকে হয়ে যাচ্ছে তাজরিন ফ্যাশনসের অগ্নিকাণ্ড…আশুলিয়া, ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে শ্রমিকদের অব্যাহত বিক্ষোভ, শ্রমিক আন্দোলনকর্র্মীদের মিছিল-সমাবেশ-দাবিদাওয়া, এ 'হত্যকাণ্ডের' যথাযথ তদন্ত, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও নিহত-আহত শ্রমিকদের যৌক্তিক ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি।

পাঠক, ওপরের আলোচনা এ লেখার উদ্দেশ্য নয়, এ আলোচনা আরো বিস্তৃত পরিসরে করাটা জরুরি, এখানে এটা পটভূমি মাত্র। আমি কথা বলতে চাই নিশ্চিন্তপুর 'হত্যাকাণ্ডে'র পর নাগরিক প্রতিক্রিয়া নিয়ে। কি অদ্ভূত নির্লিপ্ততায় আমরা মেনে নিলাম সব! এমন একটি হত্যাকাণ্ডের পরও রাজধানীসহ দেশের কোথাও এক ঘণ্টার জন্যও থমকে দাঁড়ালো না নাগরিক জীবন! হাতেগোনা কয়টি প্রতিবাদ সমাবেশ ছাড়া বুদ্ধিজীবী-শিক্ষক-পেশাজীবী- ছাত্র-তরুণ-লেখক-শিল্পী-সংস্কৃতিকর্মীদের কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না কোথাও! কেমন সমাজে, কেমন সংস্কৃতিতে, কেমন রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে নাগরিক সমাজের এমন নির্লিপ্ততা সম্ভব সেই বোঝাপড়া জরুরি মনে করছি। বিদ্বানরা সে আলোচনা করবেন বলে আশা রাখি, আমি কেবল কয়েকটি পর্যবেক্ষণ তুলে ধরব।

শ্রেণীচেতনার নগ্ন প্রকাশ:
মীরসরাইয়ে খেলা দেখতে যেয়ে ট্রাক উল্টে অন্তত ৪৪ স্কুলশিশুর মৃত্যুর কথা আমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে! আচ্ছা, একবার ভাবুন তো ওই দুর্ঘটনায় যদি ঢাকার নামকরা কোনো স্কুলের সমসংখ্যক শিশু নিহত হত তাহলে সামাজিক প্রতিক্রিয়া কী হতো। খেলা দেখতে বা  বনভোজনে যাওয়ার বা ফেরার পথে 'ভিকারুননিসা' কিংবা 'স্কলাসটিকা'র শিশুরা এভাবে মারা যেতো তাহলে আমাদের গণমাধ্যম-সমাজ-সরকার কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতো? একবার ভাবুন আজ যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ছাত্র বা ছাত্রী হলে আগুন লেগে ৫০ জন ছাত্র/ছাত্রী নিহত হত তাহলে রাজধানীতে, সমাজে এর প্রতিক্রিয়া কী হতো? এসব প্রশ্ন নিয়ে ভাবলে বোঝা যাবে 'নিশ্চিন্তপুরের হত্যাকাণ্ড' আমাদের তথাকথিত সুশীল সমাজসহ নাগরিক মধ্যবিত্তের মুখোশটা খুলে ফেলে তার মগজ-মজ্জায় জারি থাকা শ্রেণীচেতনার নগ্ন চেহারাটা উন্মোচন করে দিয়েছে।

অদৃশ্য শ্রমিকশ্রেণী ও বাজারি-সংস্কৃতি:
দীর্ঘদিন ধরে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন প্রবাসী শ্রমিক ও পোশাক কারখানার শ্রমিকরা। আমাদের অর্থনীতিতে এই দুই শ্রমিক শ্রেণীর ভূমিকা নিয়ে কোনো গবেষণা হয়েছে কি না আমার জানা নাই। কিন্তু খোলা চোখে তাকালেই আমরা বুঝতে পারবো কীভাবে প্রাণান্তকর পরিশ্রম করে তারা আমাদের অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছেন। অবদান এবং সংখ্যা দুই বিচারেই এই দুই জনগোষ্ঠী বিশাল। কিন্তু পাঠক মনে করে দেখুন তো শেষ কবে এবং কীভাবে আপনি গল্প-উপন্যাস-সিনেমা-নাটক-কবিতা-গান-চিত্রকলা-ভাস্কর্যে পোশাক কারখানার শ্রমিক বা প্রবাসী শ্রমিকের চরিত্রটি পেয়েছেন এবং কী চেহারায় পেয়েছেন। অল্পকিছু ব্যতিক্রম ছাড়া শ্রমিক শ্রেণীর প্রতি আমাদের সমাজে বিদ্যমান সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে এ বিষয়ে আমাদের লেখক-শিল্পী-নির্মাতাদের কাজ কোথায়?

রাজধানী এবং আশপাশের শিল্পাঞ্চল মিলিয়ে আনুমানিক তিরিশ লাখ শ্রমিক পোশাক কারখানায় কাজ করছেন। ভোরে উঠে কাজে যাওয়া আর কাজশেষে ফেরার সময় ছাড়া এ বিশাল নগরের আর কোথাও তো তাদের দেখি না! কারাখানায় যেমন করে তাদের তালাবদ্ধ করে রাখা হয় সে পরিবেশ থেকে তাদের প্রাপ্ত নামমাত্র মজুরির বিনিময়ে জোগাড় করতে পারা মাথা গোঁজার ঠাইঁটুকুও কোনো অবস্থাতেই কম দমবদ্ধ করা নয়। যেখানে ছোট্ট একেকটা ঘরে গাঁদাগাঁদি করে আট/দশজন থাকেন, তিরিশ/চল্লিশ জনের জন্যেও যেখানে একটা টয়লেট বা রান্নাঘর থাকে না। দু'মুঠো ভাতের জন্য গ্রাম থেকে আসা এই মানুষগুলোকে আমরা এমন পরিবেশে রাখি আর নাগরিক জীবনে তাদের অংশগ্রহণের কোনোই ব্যবস্থা থাকে না।

অন্যদিকে, পাসপোর্ট-অফিস থেকে রিক্রুটিং এজেন্সি, বিমানবন্দর থেকে বিদেশি দূতাবাসে আমাদের প্রবাসী শ্রমিকরা কতোবার কতোভাবে প্রতারিত হন এবং কেমন আচরণের শিকার হন তার কিছুটা ধারণা বোধকরি আমাদের অনেকেরই আছে। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের নানাপ্রান্তে আনুমানিক ৬০ লাখ বাংলাদেশী অবস্থান করছেন পরিশ্রমের টাকা দেশে পাঠাচ্ছেন, যাদের বেশিরভাগই শ্রমিক। পরিবার-পরিজন ছেড়ে প্রবাসে তাদের সংগ্রাম আর স্বামী/সন্তান/ভাই/বোন যখন দূরেদেশে থেকে শুধুই টাকা পাঠানোর মেশিন, তখন দেশে প্রবাসী শ্রমিকদের পরিবার-পরিজনের জীবন সংগ্রাম কতোটা গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে আমাদের সমাজ-শিল্পকলা?

শিল্পকলা ও নাগরিক সংস্কৃতিতে যেমন এই শ্রমিক অনুপস্থিত থাকে তেমনি অন্যদিকে বাজারি-সংস্কৃতিতে এই শ্রমিক চরিত্রের অন্য এক রূপায়ন ঘটতে দেখি আমরা। উত্তরবঙ্গ থেকে আসা মৌসুমী শ্রমিকরা রাজধানীর নাগরিক সংস্কৃতিতে 'মফিজ' হয়ে যায়। গণমাধ্যমে এই 'মফিজ' চরিত্র নিয়ে তৈরি বিজ্ঞাপন দেখানো হয়। টেলিভিশন নাটক ও অনুষ্ঠানে 'দুবাই ফেরৎ' চরিত্রটি সবার কাছে 'হাস্যস্পদ' হিসেবেই উপস্থিত থাকে, তার 'অসংস্কৃত সাজ পোশাক' থেকে শুরু করে তার কথাবার্তা চলন-বলন সবই যেন নাগরিক সংস্কৃতিতে বেমানান ও হাস্যকর!

আর পোশাক শ্রমিকরা সমাজে কতোটা মর্যাদা পান তা বোঝার জন্য স্মরণ করতে চাই ২০০২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলে পুলিশি নির্যাতনের পার সংঘটিত আন্দোলনের কথা। বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী যখন এর প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে এসেছিল তখন আমাদের মন্ত্রী-উপাচার্যরা বলেছিলেন, এটা ছাত্রীদের নয় 'গার্মেন্টসের মেয়েদের' মিছিল। তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে 'গার্মেন্টসের মেয়ে' কথাটা এ সমাজেরই সৃষ্টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে মন্ত্রীর মুখে তা উচ্চারিত হওয়ার পরই বোধহয় অপমানটা বোঝা গিয়েছিল!

সাংস্কৃতিক নেতৃত্ব:
সংস্কৃতিকর্মীরা যখন রাজনৈতিক দলের কাছে মগজ বন্ধক রাখেন আর ক্ষমতার লেজুড় হয়ে নানা সুযোগ সুবিধা ভোগে কামড়াকামড়ি শুরু করেন তখনই কেবল সমাজে এমন অচলায়তন সৃষ্টি হওয়া সম্ভব। নইলে আশির দশকে সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনের মধ্যে জন্ম নেওয়া সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো গত এক-দেড় দশক ধরে বাঁধা ছকের জাতীয় দিবস পালন আর কেবলমাত্র কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শোকসভা করে নিজেদের 'সম্মিলিত শব-সৎকার জোট'-এ পরিণত করতো না। এই সাংস্কৃতিক নেতৃত্ব একদিকে যেমন মাঠে ময়দানে শাসকদের লেজুড়বৃত্তি করেছে অন্যদিকে 'তিরিশটি টেলিভিশন/বত্রিশটি পত্রিকার' চেহারা কণ্ঠস্বরও অনেকটাই তাদের হাত ধরে তৈরি। ফলে আজকের বাজারি-সংস্কৃতিও তাদেরই অবদান! এ কারণেই সম্ভবত নিশ্চিন্তপুরে শতাধিক শ্রমিকের পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া লাশ দেখেও এই 'শিল্পী' নেতাদের মন একটুও কাঁপে না। এই 'সম্মিলিত শব-সৎকার জোট' এ ঘটনার তদন্ত-বিচার দাবিতে একটি বিবৃতি পর্যন্ত দেয় না। আর যেহেতু শ্রমিকের লাশ সৎকার 'জাতীয় দায়িত্ব' পালনের মধ্যে পড়ে না তাই শহীদ মিনারে শোকসভারও কোনো প্রয়োজন হয় না তাদের।

একইভাবে নিশ্চুপ জড় পদার্থের মতো স্থবির হয়ে থাকে জাতির মেধা মননের প্রতীক (!) আমাদের বিদ্যায়তনগুলো। প্রগতিশীল কিছু ছাত্র সংগঠন ছাড়া সেখানে আর কাউকেই আমরা নড়াচড়া করতে দেখি না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলির একেকজন 'উপাশ্চার্য'সহ নীল-সাদা-হলুদ-বেগুনি সব শিক্ষক সমিতি মুখে কুলুপ এঁটে থাকেন। অথচ খালেদা জিয়ার না শেখ হাসিনার কার শাড়ী বেশি নান্দনিক, কারটা দেশজ কারটা বিলেতি এমন সব ইস্যু নিয়ে আমরা পত্রপত্রিকায় প্রায়শই ১০১জন কিংবা ৩০৩জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক/বুদ্ধিজীবীর একদলীয়/দ্বিদলীয় কিংবা বহুমুখী সমিতির যুক্ত/বিযুক্ত/নিযুক্ত বিবৃতি, সভা-সমাবেশ দেখতে পাই।

নিশ্চিন্তপুরের হত্যাকাণ্ড নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটে থাকে আমাদের তথাকথিত 'সুশীল সমাজ'। পোশাক শ্রমিকরা যখন পুড়ে কয়লা হয়ে জ্বলছে তখন তারা আরো 'সুশীল' আরো 'সংস্কৃত' হওয়ার লক্ষ্যে কেবলই সেনাবাহিনীর মাঠে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের আসরে চৌরাশিয়ার বাঁশিতে মগ্ন থাকেন। পাঠক, ক্ষমা করবেন ওই সঙ্গীতাসরের সমালোচনা এখানে উদ্দেশ্য নয়, আমি যাইনি বলে হয়তো জানি না! কিন্তু আপনারা জানাতে পারেন কি ওই আসরের আয়োজকরা কি নিশ্চিন্তপুরের ঘটনায় শোকপ্রকাশ কিংবা ওই ঘটনার তদন্ত ও বিচার দাবি করে একটা বিবৃতিও দিয়েছিল? বা ওই আসরের কোনো শ্রোতার হাতে নিশ্চিন্তপুর নিয়ে একটা ব্যানার/প্ল্যাকার্ড ছিল? আমাদের তরুণ ক্রিকেটাররা কিন্তু খুলনায় তাদের বিজয়ের পর অন্তত শোকপ্রকাশ করে কথা বলেছিলেন গণমাধ্যমের সামনে।

বাংলাদেশ গার্মেন্টশ্রমিক কাবাব কারখানা সমিতি:
নিশ্চিন্তপুর হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়া যেমন নাগরিক সমাজের চেহারাটা খুলে দিয়েছে তেমনি এই পুরো রাষ্ট্রের প্রতীকী প্রতিচ্ছবি হয়ে রাজধানীর বুকে উদ্ধত মাথা তুলে আমাদের কাচকলা দেখাচ্ছে 'বাংলাদেশ গার্মেন্টশ্রমিক কাবাব কারখানা সমিতি' ওরফে বিজিএমইএ'র ভবন। রাজধানীর হাতিরঝিলে সরকারি খাস জমিতে অবৈধভাবে নির্মিত এবং আদালতের আদেশের পরও ভেঙে না ফেলা ওই বাড়ীকে প্রশ্ন করলেই বোঝা যায় পোশাক কারখানাগুলোর অবকাঠামো কতোটা আইন মেনে তৈরি আর সেখানে শিল্প, শ্রম ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বা পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সরকারি নজরদারি কতোটা থাকবে। এ ঘটনার পর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে এক আলোকচিত্রী বন্ধু বলছিলেন, "বিজিএমইএ ভবনটা জাতীয় সংসদের সামনের সবুজ চত্বরে হলে আরো ভাল হত! এই রাষ্ট্রের চেহারাটা বোঝার জন্য সেটা আরো যথাযথ হত! আমি চাই এই ভবনটা ভাঙা না হোক, রাষ্ট্রটা বদলাতে না পারলে এই ভবন ভেঙে কী লাভ?"

মগজের নিশ্চিন্তপুর:
আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে যখন মানুষকে দাস বানিয়ে রাখার কারখানায় তালাবদ্ধ রেখে চিতা জ্বালিয়ে হত্যার উৎসব চলছে তখন আমাদের মগজের নিশ্চিন্তপুরে চলছে ঘুম। এই রাজনীতিক-ব্যাবসায়ী/ব্যবসায়ী রাজনীতিকের আর বেসামরিক-সামরিক আমলাদের হাতে এই দেশ-রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক হবে, এখানে মানুষের অধিকার, শ্রমিকের অধিকার রক্ষা করা হবে এমন এক আফিমে বুদ হয়ে আছি আমরা। গত মাসের ১০ ডিসেম্বর আমরা গণতন্ত্রের জন্য নূর হোসেনের আত্মাহুতির পঁচিশ বছর উদযাপন করলাম। কিন্তু গণতন্ত্র কোথায়? আওয়ামী লীগের দুই আমল, বিএনপির ও বিএনপি-জামাতের দুই আমল আর এর মাঝে আবার সেনাসমর্থিত সুশীলদের দুইবছরও আমরা দেখলাম। এতো বছরেও আমাদের ঘুম ভাঙলো না!

আমার কৈশোর কেটেছে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের মধ্যে। ফেব্রুয়ারি/মার্চে/ডিসেম্বরে মাইকে মুক্তিযুদ্ধের গান না বাজলে আমার এখনো ভাল লাগে না। তখন থেকেই শুনে আসছি "পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে রক্তলাল রক্তলাল রক্তলাল…" কিন্তু আদৌ পরিবর্তনের কোনো নতুন সকাল এলো কি? একদিকে বাঁধা মঞ্চে বাঁধা ছকে বাঁধা শিল্পীরা এই গান গাইছেন, দলীয় সংস্কৃতিকর্মীরা বিজয় উৎসব করছেন অন্যদিকে শ্রমিকের-কৃষকের সাধারণ মানুষের অসহায়ত্ব কতোটা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে নিশ্চিন্তপুরের চেয়ে তার আর কী ভাল উদাহরণ হতে পারে।

নিশ্চিন্তপুর থেকে ফুলবাড়ী:
এতো এতো হতাশা আর এতোটা অবরুদ্ধ সমাজেও দেশের মানুষ প্রতিবাদ করছে, প্রতিরোধ গড়ে তুলছে। প্রাণ-প্রকৃতি-প্রতিবেশ-জীবন ও সংস্কৃতি রক্ষার লড়াইয়ে আলোর মশাল হয়ে ফুলবাড়ী আমাদের পথ দেখাচ্ছে। আলোর ঝলক ছিটিয়ে বারুদ স্ফুলিঙ্গের মতো গর্জে উঠছে কানসাট, আড়িয়ল বিল, আশুলিয়া, নারায়ণগঞ্জ, কখনো কখনো একেকটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। পুলিশ-র‌্যাব-গোয়েন্দা বাহিনীর তথাকথিত 'ক্রসফায়ার', গুমখুন, অপহরণ আর শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরীতে ভেসে ওঠা নাম-পরিচয়হীন লাশের মিছিলের ত্রাসের রাজত্বেও মানুষ পথ খুঁজে বেড়াচ্ছে পরিত্রাণের, পরিবর্তনের।

নিশ্চিন্তপুরের চিতাকে ফুলবাড়ীর আলোর মশালের কাছে নিয়ে যাওয়ার পথ নিশ্চয়ই অনেক দুরূহ, বন্ধুর। একদিনে তা আমরা পারবো না। তবে আজকে দেশের শ্রমিক শ্রেণীকে 'দাস' থেকে 'মানুষে'র মর্যাদা দেওয়ার ন্যূনতম কাজটা করতে শিল্পী-সংস্কৃতিকর্মীরা এগিয়ে আসতে পারেন। নিশ্চিন্তপুর ট্র্যজেডির সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারে একটি সত্যিকারের গণ তদন্ত কমিশন গঠন এবং দোষীদের বিচারের দাবি, প্রত্যেক নিহতের পরিবারকে ১০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার যে দাবি শ্রমিক আন্দোলনকর্মীরা করেছেন তার পক্ষে সমর্থন জানানো এর  প্রথম ধাপ হতে পারে।

বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোতে এ পর্যন্ত আগুনে পুড়ে ও অন্যান্য দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা আসলে কতো? সরকার-বিজিএমইএ'র হিসেবেই তা পাঁচ'শর মতো, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অধিকার সংগঠনের হিসেবে তা আরো কিছু বেশি। যেহেতু তাজরিনের মতোই অগ্নিকাণ্ডের এমন সব ঘটনাকেই 'হত্যাকাণ্ড' না বলে নিছক 'দুর্ঘটনা' বলা হয়েছে এবং কোনো ক্ষেত্রেই প্রকৃত সংখ্যা প্রকাশ করা হয়নি তাই এটা বলা মুশকিল। তবে, শ্রমিক আন্দোলনকর্মীরা বলছেন এ সংখ্যা দুই হাজারের কম হবে না। এতো গেল আগুনে পুড়িয়ে হত্যা। আর গত দুই দশকে ন্যূনতম মজুরিসহ অন্যান্য ন্যায্য দাবি দাওয়ার আন্দোলনে পোশাক কারখানার কতোজন শ্রমিক নিহত হয়েছেন? সংশ্লিষ্টরা বলছেন সংখ্যাটা প্রায় তিনশ'র কাছাকাছি। বাংলাদেশের সমাজ কি কোনো সামাজিক উদ্যোগের মধ্য দিয়ে আগুনে নিহত পোশাক শ্রমিকদের স্মরণ করছে?

দ্বিতীয় ধাপ হিসেবে শিল্পীরা পারেন নাগরিক উদ্যোগের মধ্য দিয়ে জনসমাগমের উন্মুক্ত কোনো স্থানে একটা ভাস্কর্য তৈরি করে তাদের স্মরণ করতে। সংস্কৃতিকর্মীরা এটা করলে তা শ্রমিক শ্রেণীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে ভূমিকা রাখবে, অধিকার আদায়ের সংগ্রামে শ্রমিকদের আন্দোলনের প্রতি নৈতিক সমর্থনের প্রতীক হয়ে থাকবে। এমন উদ্যোগের মধ্য দিয়ে শ্রমিককে 'দাস' থেকে 'মানুষের' মর্যাদায় নিয়ে আসার, নাগরিক সমাজে অন্তর্ভূক্ত করার লড়াইয়ে কি সংস্কৃতিকর্মীরা এগিয়ে আসবেন?

আহমেদ মুনীরুদ্দিন তপু: সংস্কৃতিকর্মী, সাংবাদিক।