বেপরোয়া মোটরসাইকেলের বিপদ

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 6 July 2022, 03:45 PM
Updated : 6 July 2022, 03:45 PM

সড়ক দুর্ঘটনা এমনিতেই আমাদের দেশে একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। এর মধ্যে নতুন বিপদ হয়ে দেখা দিয়েছে বেপরোয়া মোটরবাইক বা মোটরসাইকেল। রাস্তায় বেরোলেই বুক দুরুদুরু করে। শহরের ব্যস্ততম সড়কে ভিড়ের মধ্যেই তিরবেগে ছুটে আসতে পারে মৃত্যুবাণ! অলিতে-গলিতে, শহর-গ্রামের বড় রাস্তায়, মহাসড়কে রোজই দেখা যায়, মোটরবাইকে উদ্দাম গতিতে চলেছে কিশোর-তরুণ-যুবকেরা। গতি, গতি, এবং আরও গতি– এই তাদের আদর্শ। এই গতির মোহই যে বিপদ ডেকে আনছে, তা-ও ভুলতে বসেছে এই মোটরসাইকেল-চালকেরা। এখন শহর ও শহরতলীতে চলাফেরা করাই দায়। সাপের মতো এঁকে বেঁকে তড়িৎ গতিতে ছুটে চলে অসংখ্য মোটরসাইকেল। বাইকের জ্বালায় সামনের পথচারী, মোটরসাইকেল আরোহী, অটো-চালকদের নাভিশ্বাস! এই বুঝি ধাক্কা মারে মারে! ধাক্কা মারছেও। নিয়মিত দুর্ঘটনা ঘটছে। দিন দিন সড়ক দুর্ঘটনা বেড়ে চলেছে– এটা আশঙ্কার। নানা কর্মসূচি, হাজার সচেতনতামূলক প্রচারেও রাশ টানা যাচ্ছে না দুর্ঘটনায়। সবচেয়ে চিন্তার যেটা, সেই দুর্ঘটনায় হতাহতদের বেশির ভাগই কমবয়সি। মোটরসাইকেল নিয়ে ছেলেছোকরাদের বেপরোয়া গতি এবং দুর্ঘটনা এখন প্রায় সমার্থক হয়ে গেছে।

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন– এই ৬ মাসে দেশে সড়ক-মহাসড়কে প্রাণ হারিয়েছেন ৩ হাজার ৩০৯ জন। যাদের মধ্যে নিহত মোটরসাইকেল চালক বা আরোহীর সংখ্যা ১ হাজার ৩১৩। অর্থাৎ মোট নিহত ব্যক্তির ৩৯ দশমিক ৬৭ শতাংশই মোটরসাইকেলের চালক-আরোহী। ছয় মাসের এ গড় হিসাবের বাইরেও প্রতি মাসেই সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই থাকছেন মোটরসাইকেলের আরোহী।

এমন মর্মান্তিক দুর্ঘটনার খবর সংবাদমাধ্যমে বড় করে বেরোলেও বেপরোয়া চালকদের অধিকাংশই গতিতে লাগাম দেওয়া কিংবা হেলমেট পরে মোটরসাইকেল চালানোর কথা ভাবেন না কিছুতেই। ভাবতেও খারাপ লাগে যে, তরতাজা যে প্রাণগুলো অসময়ে দুর্ঘটনার বলি হচ্ছে শুধু গতির নেশায় বা নিয়মভঙ্গের কারণে, তারা শুধু আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছে, তাই নয়। একরাশ শূন্যতা রেখে যাচ্ছে তাদের পরিবারে। কত বাবা-মা তাদের যোগ্য সন্তানকে অসময়ে হারিয়ে দিশাহারা। আরও বৃহত্তর দৃষ্টিতে দেখলে মানবসম্পদের এই ক্ষয় সমাজের এক বিশাল ক্ষতি।

আমাদের দেশে কিশোর বয়স থেকেই এখন দু-চাকার প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ ছেলেদের। তাদের শখ-আহ্লাদ মেটাতে অনেক বাবা-মা বয়সের আগেই সন্তানের হাতে তুলে দিচ্ছেন মোটরবাইকের চাবি। লাইসেন্স নেই, হেলমেট পরার বালাই নেই– দু-চাকায় স্টার্ট দিয়ে সেই যে গতির নেশা পেয়ে বসল, সেটাই যে এক দিন বিপদ ডেকে আনবে, সে হুঁশ থাকে না কারো। এই সৌখিন মোটরসাইকেল চালকেরাই এখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে শহর। তারা দল বেধে বিভিন্ন অলি-গলিতে কে কত বেশি দ্রুত গতিতে মোটারসাইকেল চালাতে পারে, তার প্রতিযোগিতা করে। বেপরোয়া গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শব্দদূষণের মাত্রাও। নানা রঙের হেডলাইট, মিউজিক্যাল হর্নের ব্যবহার ছাড়াও এখন কেউ কেউ মোটরসাইকেল নিয়ে শব্দ-তাণ্ডব চালাতে খুলে ফেলছেন বাইকের সাইলেন্সারই! এসব মোটরসাইকেল আরোহী তীব্র হর্ন বাজিয়ে পরস্পরকে জানান দেয়। ফুটপাতের ওপরেও মোটরসাইকেল দৌড়াচ্ছে। বাইকের কান ফাটানো আওয়াজে সাধারণ মানুষের প্রাণান্তকর অবস্থা হচ্ছে।

বিভিন্ন উৎসবে-অনুষ্ঠানে মোটরসাইকেল চালকদের দৌরাত্ম্য আরও বেড়ে যায়। এক বাইকে তিনজন বসে বিপজ্জনক গতিতে তারা ছুটে চলে। হেলমেটের বালাই নেই। আইন মেনে চলারও কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। অনেকে রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে, আত্মীয়দের ক্ষমতার দাপটে ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করে। ট্রাফিক পুলিশও তাদের খুব একটা ঘাটাতে সাহস পায় না। ফলে অনিয়ম আরও বাড়ে।

প্রশ্ন উঠছে, কেন পুলিশ এই সব মোটরসাইকেল আরোহীদের পাকড়াও করছে না। এমন নয় যে শহরে পুলিশ নেই। পুলিশের সামনেই ট্রাফিক সিগন্যাল অমান্য করে এই সব ছেলেরা পালাচ্ছেও। অথচ পুলিশ কিন্তু বসে নেই। তারা ঠিকই বিভিন্ন চালককে থামিয়ে মোটরবাইকের কাগজ, আরোহীর লাইসেন্স দেখছেন। কাদের লাইসেন্স ও কাগজ দেখা হচ্ছে? অভিযোগ, যারা নিরীহ, গোবেচারা ধরনের তাদেরই মূলত ধরা হচ্ছে। নিয়মভঙ্গকারী বেপরোয়াদের কেন ধরা হয় না? পুলিশের অভিযোগ, শহরের কাউকে ধরলেই একগুচ্ছ নেতার ফোন আসবে। অনেক মাদকাসক্ত যুবকও রয়েছে। তাদের ধরে নিয়ে গেলেও বিপত্তি। কে এ সব অশান্তি সামলাবে!

সম্প্রতি মহাসড়কে বেপরোয়া মোটরসাইকেলের চলাচল নিয়ন্ত্রণে সরকার বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। এরই মধ্যে নতুন উদ্বোধন করা পদ্মা সেতু দিয়ে সাময়িকভাবে মোটরসাইকেল চালানো নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যদিও মোটরসাইকেল চালকেরা সরকারের এমন সিদ্ধান্তের সমালোচনা করছে। তারা বিক্ষোভও দেখাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরাও সরকারকেই দুষছেন। তাদের মতে, সরকার মোটরসাইকেলকে সহজলভ্য করেছে, উৎসাহ দিয়েছে। কিন্তু মোটরসাইকেল চলার উপযুক্ত সড়ক করেনি, আলাদা লেন করেনি। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। এই মোটরসাইকেল এখন যাতায়াতব্যবস্থার অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ হয়েছে ও জীবিকার পথ তৈরি করেছে। রাজধানীর যানজট এড়িয়ে কর্মক্ষেত্রে মানুষকে দ্রুত পৌঁছে দেওয়ার জন্য প্রায় ৪-৫ বছর ধরে অ্যাপভিত্তিক মোটরসাইকেল চালু হয়। কর্মজীবীরাও দ্রুত কর্মস্থলে পৌঁছতে এসব ভাড়ায়চালিত মোটরসাইকেল বেছে নেয়। ফলে যানটি বেশ জনপ্রিয়তা পায়। তবে এসব মোটরসাইকেল যারা চালায়, তারা যাত্রীকে সময় বাঁচিয়ে দ্রুত গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দিতে বেপরোয়া হয়ে ওঠে।

মোটরসাইকেলের সংখ্যা ও চাহিদা বর্তমানে এতটাই বেড়েছে যে, চাইলেই এখন মহাসড়কে মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ করা যাবে বলে মনে হয় না। তবে সড়ক ও মহাসড়কে মোটরসাইকেল চলাচলের ওপর কঠোর নজরদারী প্রয়োজন। কঠোর নিয়মকানুন এবং তা মেনে চলার বাধ্যবাধকতা আরোপ করে সীমিত আকারে মোটরসাইকেল চলাচলের অনুমতি দেওয়া যেতে পারে। এ এক্ষেত্রে বাস্তবতার আলোকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

দক্ষ চালক ও মোটরসাইকেলের চলাচল উপযোগী সড়ক আগে করতে হবে। পৃথক লেনের ব্যবস্থা করতে হবে। আইনভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর হতে হবে। ফুটপাতে মোটরসাইকেল চালানো বন্ধে উচ্চ আদালতের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। ওই নির্দেশনায় বলা হয়েছে, কোনো অবস্থায়ই হাঁটার পথে মোটরসাইকেল চালানো যাবে না। এছাড়া ফুটপাতে মোটরসাইকেল চালালে সর্বোচ্চ ৩ মাসের কারাদণ্ড এবং ৩৫ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮-তে। আইনগুলো বাস্তবায়ন হলে ফুটপাতে মোটরসাইকেলের দৌরাত্ম্য অনেকাংশেই কমে যাবে।

লাইসেন্সবিহীন চালকদের ক্ষেত্রে প্রশাসনিক চাপ থাকা দরকার। আঠারো বছরের নিচে দেখা যায় অনেকেই চালকের আসনে। তাদের কড়া হাতে দমন করতে হবে। শহরের রাস্তায় যেখানে সেখানে বা জাতীয় সড়কে স্পিডব্রেকার দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। দূর থেকে, বিশেষ করে রাতে সেগুলো বুঝতে না পারার ফলে শেষ মুহূর্তে ব্রেক কষায় দুর্ঘটনা আকছারই ঘটছে। এ ক্ষেত্রে যাদের হেলমেট থাকে, তারা কিছুটা হলেও কম বিপদগ্রস্ত হন। কিন্তু হেলমেট থাকে কজনের?

প্রথমেই যা প্রয়োজন তা হলো হেলমেট ও লাইসেন্স বাধ্যতামূলক করা। এ দুটো না থাকলে বড় অংকের টাকা জরিমানা করা দরকার। আর স্পিডব্রেকারগুলি এমন ভাবে মার্কিং করা দরকার, যেন দূর থেকে নজরে আসে। সঙ্কীর্ণ রাস্তায় গতি নিয়ন্ত্রণেরও ব্যবস্থা করতে হবে। মোটরসাইকেলে দুইয়ের অধিক সওয়ারি হলেই ধরে জরিমানা করা হোক।

তবে প্রশাসনের ওপর সব দায় ঝেড়ে ফেলে দেওয়া বোধহয় সমীচীন নয়। সাধারণ মানুষকেও এগিয়ে আসতে হবে। সাবধান হতে হবে চালক-আরোহীদের। বড় ভূমিকা রয়েছে পরিবারের। 'চ্যারিটি বিগিনস অ্যাট হোম'– এই আপ্তবাক্য মানলে ছেলেমেয়েদের বাড়ি থেকে মোটরমোটরসাইকেল নিয়ে বেরোতে দেখলেই সতর্ক করা দরকার এই বলে যে, 'কোথায় যাচ্ছ? হেলমেট নিয়েছে তো? কখন ফিরবে?' জানতে চাওয়া দরকার, তারা লাইসেন্স নিয়েছে কিনা। এবং সব শেষে বারবার বলে দেওয়া, ''সাবধানে চালাবি কিন্তু। তাড়াহুড়ো করিস না।'' অনেকই বলবেন, আজকের ছেলেমেয়েরা এত কথা শোনেই না! তবু চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। বারবার 'হ্যামার' করতে হবে গতির ভয়াবহতা। নিয়মাবলি মেনে চলা। অর্থাৎ বাড়ির অভিভাবকত্ব থাকতেই হবে এবং শৃঙ্খলা পাঠ দিতেই হবে। সাধারণ নাগরিক হিসাবে যার যেটুকু দাযিত্ব-কর্তব্য আছে, সেগুলোকে কাজে লাগানো যায়। দোষ না চাপিয়ে আমরা যদি প্রশাসনের সঙ্গে সহযোগিতা করি, তা হলে এ ধরনের দুর্ঘটনা কমানো যেতে পারে। সমাজের একটা অংশ হিসাবে অত্যন্ত জরুরিও সেটা।

নিয়ম-নীতি ভঙ্গ করে বেপরোয়া গতিতে মোটরসাইকেল চালনাকে সামাজিক ব্যাধি হিসেবে চিহ্নিত করাই ভালো। এই ব্যাধি দূর করতে প্রশাসন ও পুলিশকে একটু কঠোর হতেই হবে। নয়তো আগামী দিনে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি তৈরি হবে।