বাঙলাদেশের নাড়ীর স্পন্দনে আজ যা ধ্বনিত হচ্ছে, তার সুরটি আন্তর্জাতিক। তার নিজের যা আছে তাই নিয়ে বিশ্বের সামনে তাকে দাঁড়াতে হবে। তাতে পাকিস্তানী সমাজ বা বাঙলার কৃষিনির্ভর সামন্ত সমাজের কোনো স্থান যদি থাকে, থাকবে স্মৃতি হিসেবে, কখনও তা প্রধান ধারা নয়। তার প্রধান ধারাটি হবে এ দেশীয় হয়েও আন্তদেশীয়, বাঙলাদেশের মানুষের হয়েও হবে সর্ব মানুষের। এই ধারাটি এখন প্রমত্তা পদ্মার মতো ফুলে ফুলে উঠার কথা- এবং এই ধারাতে অবগাহিত হয়ে বাঙলার এই অংশে জন্ম নেবে নতুন কালের রবীন্দ্রনাথ, নতুন কালের বিদ্যাসাগর, নতুন কালের জগদীশচন্দ্র বসু এবং নতুন কালের নজরুল ইসলাম।
এই কথাগুলো আমাদের আহমদ ছফা বলে গেছেন আজ থেকে তিন দশকের বেশি সময় আগে ১৯৯১ সালে। ওই সময় ইন্টারনেটের জন্ম হলেও ফেইসবুকের জন্ম হয়নি। ফেইসবুকের আবির্ভাব আরো অনেক পরে ২০০৪ সালে। আজকে আমাদের চারপাশে আগামাথাহীন ফেইসবুক বুদ্ধিজীবীদের খপ্পরে আছি। এই খপ্পরে আছেন পরলোকগত আহমদ ছফাও। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় না, ভক্তরাও আহমদ ছফাকে খুব একটা চিনতে পেরেছেন। আবার যারা তার বিরোধিতা করার জন্যে ঢাল তলোয়ার নিয়ে ফেইসবুককে অনেকটা যুদ্ধের ময়দান মনে করছেন, তারাও যে আহমদ ছফাকে পড়েছেন বা চিনতে পেরেছেন তাও মনে হয় না।
এই দ্বিবিধ গোষ্ঠী সম্পর্কেই আমার কিছু পর্যবেক্ষণ আছে, যা আমি এই লেখার পরের দিকে তুলে ধরবো। তার আগে আহমদ ছফা কে এবং কী বা তার কাজ- সেই বিষয়ে একটু আলোচনা করে নেওয়া দরকার। আহমদ ছফার জন্ম ১৯৪৩ সালে চট্টগ্রামে, মারা যান ঢাকায় ২০০১ সালে।
আটান্ন বছরের এই সংক্ষিপ্ত জীবনে তার প্রবন্ধগ্রন্থের সংখ্যা কুড়ির কাছাকাছি, উপন্যাস ৮টি, গল্পগ্রন্থ ১টি, শিশুতোষ ছড়ার বই ১টি, অনুবাদগ্রন্থ ৩টি।, লিখেছেন শ দুয়েক গান। লিখেছেন কাব্যনাটকও। এর পাশাপাশি রয়েছে তার লেখা চিঠিপত্র, পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত বেশকিছু সাক্ষাৎকার এবং প্রতিবেদনধর্মী কিছু লেখা। সাংগঠনিক কার্যক্রম, গবেষণা এবং জনহিতকর কাজেও নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন। বিয়েশাদি করেননি। তাই বলে জীবনবিমুখ কৃত্রিম সময়ও যাপন করেননি। চেষ্টা করে গেছেন সময়কে কানায় কানায় বুঝতে এবং ধরতে। যে কারণে বিতর্ক তার পিছু ছাড়েনি। তাকে সমীহ করার মানুষ যেমন ছিলেন, একইভাবে তাকে ভুল বোঝার মানুষেরও কমতি নাই। একই ধারা তার মৃত্যুর দুই দশক পরেও চলমান। এই ধারা চলতে থাকবে তা ধারণা করা যায়। আর এখানেই নিহিত আহমদ ছফার গুরুত্ব এবং তার লেখার ক্ষমতা ও প্রাসঙ্গিকতা।
এই পর্যায় আহমদ ছফার ভক্তদের একটা কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। 'জাতির পিতা' ধারণায় তিনি বলেছেন, " . . . 'জাতির পিতা' বা 'বঙ্গবন্ধু' বললে যে শেখ মুজিবকে অধিক সম্মান দিয়ে ফেলব এটা ঠিক নয়। বাংলার গত তিন হাজার বছরের ইতিহাসে তার তুলনা নাই।" এই আহমদ ছফার ভক্তরা ছফার নামের আগে কোন বিবেচনায় 'মহাত্মা' শব্দটি জুড়ে দিতে চান? এতে প্রশ্ন ওঠে, তার ভক্তরাও ঠিক ঠিক আহমদ ছফাকে চিনতে পেরেছেন কি?
এইবার আহমদ ছফার বিরোধিতাকারীরা ফেইসবুক জুড়ে তার বিরুদ্ধে লম্বা এক ফর্দ হাজির করেছেন। তাদের উদ্দেশে বলতে চাই, আহমদ ছফার লেখাজোকা পড়ে কেউ তার সঙ্গে একমত হতে পারেন, দ্বিমত করতে পারেন। এটা পাঠকের স্বাধীনতা। তবে বাঙালি বুদ্ধিবৃত্তিক জগৎকে বুঝতে হলে, স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক জমিনের মানচিত্রের তত্ত্বতালাশ করতে হলে- আহমদ ছফাকে উপেক্ষা করার উপায় নাই। কেউ যদি কাকের মতো চালাকি করে চোখ বন্ধের অভিনয় করে যান, তা ভিন্ন কথা। আহমদ ছফার বিরোধিতায় যারা নেমেছেন তাদেরকে একটা প্রশ্ন করি, আহমদ ছফার কোন সাক্ষাৎকার, কোন প্রবন্ধ, কোন গল্প, কোন উপন্যাস, কোন অনুবাদ বা কোন গানটি বাতিল করতে চান? সেইটা নিয়েই আলোচনা হতে পারে, বিতর্ক হতে পারে। তর্কের খাতিরে বাকি সব পাশে সরিয়ে রাখি না হয়।
এই পর্যায়ে তার 'বাঙালি মুসলমানের মন' প্রবন্ধগ্রন্থের কথা উল্লেখ করতে চাই। এই বই পড়ে আমার মনে একটা আগ্রহ জন্মেছে জানার জন্যে। আচ্ছা, আমাদের সামনে কি, 'বাঙালি হিন্দুর মন', 'বাঙালি খ্রিস্টানের মন', 'বাঙালি বৌদ্ধের মন', 'বাঙালি আদিবাসীর মন' বা 'বাঙালি নাস্তিকের মন' নামে বা এই মেজাজের বই বা লেখাজোকা আছে? আহা থাকলে কতই না ভালো হতো!
তিনি জীবনী লিখেছেন একটিই। জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাককে নিয়ে, 'যদ্যপি আমার গুরু' নামে। এরকম সৃজনশীল জীবনীগ্রন্থ রচনার উদাহরণ আর কয়টা আছে? কোথায় আছে? এমন কি আন্তর্জাতিক দুনিয়ায়ও কি খুব বেশি আছে?
তার লেখার এবং বলার একটা বড় ক্ষমতা ছিল- পুনরাবৃত্তি ও চর্বিতচর্বণ থেকে মুক্ত থাকা। এটাকে কেউ যদি বলেন উনি বছরে বছরে তার বক্তব্য/ মত পাল্টিয়েছেন বলতেই পারেন। বলার স্বাধীনতা আছে, সেই সঙ্গে আছে ফেইসবুক নামের অবারিত মাঠ।
ফেইসবুকে একেকজন এমনসব কথাবার্তা বলেন, অনেক সময় প্রকৃত বুদ্ধিজীবীকে মনে হয় এক একটা ভাঁড়, আবার একেকটা ভাঁড়কে মনে হয় বিরার বিরাট বুদ্ধিজীবী। এখানে বড় ঝুঁকি হলো, সত্য-মিথ্যা আর আংশিক বক্তব্য জুড়ে এমন সব প্রচার প্রচারণা শুরু হয়ে যায়, যার কূল-কিনারা খুঁজে পাওয়া কঠিন।
আল মাহমুদকে যদি আহমদ ছফা কোথাও 'ধর্মের লাঠিয়াল' বলে থাকেন, তাহলে ভুলটা কোথায়?
শামসুর রাহমানকে নিয়ে আহমদ ছফার মূল্যায়ন ছিল এরকম: 'আমার কাছে আমাদের সংস্কৃতির প্রিয়তম ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক। তার পরেই রয়েছেন শামসুর রাহমান। উদারতা, প্রসন্নতা গ্রহণশীলতায় তিনি তার প্রজন্মের ব্যতিক্রম। . . . তিনি আমাদের আধুনিক কাব্যভাষা নির্মাণ করেছেন।' এই কথাগুলো বলেছেন মারুফ রায়হানের সঙ্গে একটি সাক্ষাৎকারে।
অন্যদিকে এই একই আহমদ ছফা তার আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস 'অর্ধেক নারী আর অর্ধেক ঈশ্বরী'তে কবি হুমায়ুন কবিরের হত্যাকাণ্ডের পেছনে ফরহাদ মজহারের নাম উল্লেখ করে তার দিকে আঙ্গুল তুলেছেন। আহমদ ছফার প্রতিটি উপন্যাস আলাদা বিষয়, আলাদা আঙ্গিক আর আলাদা মেজাজের। এরকম 'অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী' কিংবা 'পুষ্প-বৃক্ষ-বিহঙ্গ পুরান' এর মতো আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস আর কয়টা আছে আছে বাংলা সাহিত্যে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতালিপ্সু ধান্দাবাজ মাস্টারদের চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে তিনি লিখেছেন 'গাভী বিত্তান্ত' উপন্যাস। এরকম শক্তিশালী প্রাসঙ্গিক কথাসাহিত্য আর কয়টি আছে আমাদের? কে লিখেছেন?
হুমায়ুন আহমেদকে উনি 'বাজারি লেখক' বলেছেন। এখানেও ভুলটা কী? হুমায়ুন আহমেদ কি বাজারি লেখক ছিলেন না? এই পর্যায়ে আপনাদের মনে করিয়ে দিতে চাই, হুমায়ুন আহমেদের প্রথম বই প্রকাশ করার জন্যে পাণ্ডুলিপি নিয়ে প্রকাশকের দরজায় দরোজায় ঘুরেছেন আহমদ ছফা। এক জায়গায় আহমদ ছফা উল্লেখ করেছেন, "সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বইয়ের সংখ্যা ৪০০। অন্যদিকে মার্কেজের বইয়ের সংখ্যা ৬, হেমিংওয়ের ৯। হুমায়ূন আহমেদ পয়দা করেন গণ্ডায় গণ্ডায়।"
হুমায়ুন আজাদকে নাকি উনি 'সজারু'র সঙ্গে তুলনা করেছেন। আমরা যদি ভুলে না যাই, আহমদ ছফা এবং হুমায়ুন আজাদের সঙ্গে দীর্ঘদিন একটা বাহাস চলছিল। এর মধ্যে কুৎসিত শব্দ এবং পদবাচ্যও চলে আসে তাদের বাহাসে। পরে আহমদ ছফা এটা বুঝতে পেরেছিলেন যে কাজটা ঠিক হয়নি। উনি উপলদ্ধি করেছিলেন, এটি পরের প্রজন্মের লেখকদের জন্যে একটা বাজে নজির হিসেবে থেকে যাবে। এই উপলদ্ধি থেকে তিনি দৈনিক মানবজমিনে একটা লেখা প্রকাশ করে ভুল স্বীকার করেছিলেন এবং তরুণদের কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন। কাজ করলে মানুষের ভুল হবে। সেই ভুল থেকে শিখতে হবে। যাদের কোনো কাজ এই, তাদের কোনো ভুলও নাই। এরকম কথা বঙ্গবন্ধু তার 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী'তে বলে গেছেন। একজন বুদ্ধিজীবীও কিন্তু মানুষ। তিনি অন্য গ্রহ থেকে আসেননি। আহমদ ছফাও তাই। মানবজন্ম ভুলের উর্ধ্বে নয়। সেই আহমদ ছফার মৃত্যুর পর হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন, "ঝগড়া করার মানুষটিও চলে গেলো।"
চিত্রশিল্পীদের নিয়ে তার মন্তব্য সরস এবং সুদূরপ্রসারী। অন্যদের অন্যরকম মত থাকতে পারে। সুলতানের কাজ সম্পর্কে তিনি বলেছেন, একটি দুটি ছবি বাদে সুলতানের ছবি ব্যক্তিগতভাবে তাকে টানে না। তিনি শাহাবুদ্দিন এবং মারুফ আহমেদের কাজের প্রতি তার অনুরাগ প্রকাশ করেছেন। নির্মোহ পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন কামরুল হাসান, কাইয়ুম চৌধুরী এবং রফিকুন নবীর কাজ সম্পর্কে।
আহমদ ছফা মানুষকে বুঝতে বা বোঝাতে ঈশ্বরের প্রসঙ্গ টেনেছেন। তার মতে, ঈশ্বরের 'ভ্যারাইটি' হচ্ছে মানুষ। মানুষের একটা না একটা বাতিক থাকবেই। আহমদ ছফার বাতিক ছিল অসংখ্য। তাকে বুঝতে হলে তার বাতিককেও বুঝতে হবে।
আহমদ ছফা প্রতিষ্ঠানঘেঁষা ছিলেন না। ছিলেন প্রতিষ্ঠান বিদ্রোহী একজন বুদ্ধিজীবী। দলীয় খোলনলচে ফেলে তাকে চিহ্নিত করার মতো বড় আত্মঘাতী প্রবণতা ফেইসবুক বুদ্ধিজীবীর অভাব আমাদের নাই। তার ৫৮ বছরের জীবনে বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদের পুরস্কার ছাড়া আর কোনো পুরস্কার তিনি গ্রহণ করেননি। অথচ তার ভক্ত, শিষ্যতুল্য এবং তার বিরোধীরা অনেকেই কত কত পুরস্কার নিয়েছেন। তাতে তার বয়েই গেছে!
তিনি সময়কে চিহ্নিত করেছেন তার কথা, কাজ ও লেখায়। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবার হিসেবে হুমায়ুন আহমেদদের পরিবার যখন মোহাম্মদপুরের বরাদ্দকৃত বাড়ি থেকে উৎখাত হয়েছেন, তিনি কেরোসিনের ডিব্বা নিয়ে নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেবার জন্যে গণভবনের উদ্দেশে যাত্রা করেছিলেন। খালেদা জিয়ার প্রথম সরকার সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, "তার মন্ত্রিসভায় একজনও মাথাওয়ালা মানুষ নেই, যিনি বাংলাদেশের সামগ্রিক অবস্থাটা সামলে দিতে পারেন।" এই একই ছফা এস এম সুলতানকে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে দেখা করার ব্যবস্থা করেছিলেন। তার সম্পর্কে বলা হয়, তিনি জিয়াউর রহমানের কাছে শিল্পী সুলতানকে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং একটা বাড়ি পাইয়ে দিয়েছিলেন।
এখানে কয়েকটা ঘটনা বলে নিতে চাই, রামেন্দু মজুমদার ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউটের (আইটিআই) বাংলাদেশ কেন্দ্র খোলার প্রয়োজনে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে দেখা করে তার সহযোগিতা নিয়েছিলেন। নির্মলেন্দু গুণ খালেদা জিয়ার হাত থেকে একটা পুরস্কার গ্রহণ করেছিলেন। এরকম আরো আরো উদাহরণ আছে। তাই বলে কি আমরা এখন রামেন্দু মজুমদার এবং নির্মলেন্দু গুণকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো শুরু করে দেব?
লেখালেখির ব্যাপারে আহমদ ছফার পর্যবেক্ষণ ছিল সৎ এবং তীক্ষ্ণ। তিনি শওকত ওসমানের 'ক্রীতদাসের হাসি' বই, এবং সেলিনা হোসেনের মুক্তিযুদ্ধের উপর উপন্যাসের কথা গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করেছেন। কবিতা প্রসঙ্গে আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী, নির্মলেন্দু গুণ এবং হেলাল হাফিজের কবিতার প্রসঙ্গ টেনেছেন। তিনি রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ-র প্রতিভার ছায়া হিসেবে নিজেকে হাজির করেছেন। রুদ্রর অকাল প্রয়াণে তার যাবতীয় লেখা 'বাংলা-জার্মান সম্প্রীতি' থেকে প্রকাশের উদ্দেশ্যে কবির চৌধুরী, আনিসুজ্জামান এবং অসীম সাহাদের নিয়ে উপকমিটি করেছিলেন। তিনি বিপদে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। এরকম অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। তিনি একবার ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত দুর্গত মানুষদের ঘরবাড়ি বানিয়ে দেবার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সফলও হয়েছিলেন।
আহমদ ছফার যে কথা দিয়ে এই লেখা শুরু করেছিলাম- 'বাঙলাদেশের নাড়ির স্পন্দনে আজ যা ধ্বনিত হচ্ছে, তার সুরটি আন্তর্জাতিক'- তিনি নিজে সেই আন্তর্জাতিক সুরটি ধরতে পেরেছিলেন, চিনতে পেরেছিলেন। একটি নতুন স্বাধীন দেশের সুর ও সময়কে ধরার যে নিজস্ব স্বর আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের সমান্তরালে সেই কল্পনাশক্তি, মেধা, প্রতিভা পঠন ও প্রস্তুতি তা তার মধ্যে ছিল। সুইডেনের আধুনিক সাহিত্যের পথিকৃৎ অগাস্ট স্ট্রিন্ডবার্গের নিয়তিও অনেকটা আহমদ ছফার মতো। তার পক্ষে-বিপক্ষের কণ্ঠস্বর তার মৃত্যুর শতবর্ষ পরেও বিতর্ক জিঁইয়ে রেখেছে। এই স্ট্রিন্ডবার্গ অনেকটা ছফার মতো চাঁছাছোলা শব্দচয়নে সত্যকে উন্মোচন করেছেন। স্ট্রিন্ডবার্গ সম্পর্কে সুইডিশ কবি লার্স হ্যাগার বলেছেন, "আমাদের এখন দরকার একশোটা স্ট্রিন্ডবার্গ, কিন্তু দুঃখের বিষয় নাই একটাও।" এই একই কথা আহমদ ছফার বেলায়ও বলা যায়।
লালন এবং রবীন্দ্রনাথকে তিনি এককথায় তুলে ধরেছেন এভাবে, "… আল্লাহকে আমি ঘরের লোক হিশেবে দেখতে অভ্যস্ত। পৃথিবীর নির্মাতা হিশেবে নয়। আল্লাহকে নিয়ে আমার কোন কাজ নেই। রবীন্দ্রনাথ লালনেরা বুঝতেন এই ঘরের ব্যাপারটি।"
নারীবাদীদের গলদ নিয়ে তার পর্যবেক্ষণ ছিল ধারালো। তিনি বলেছেন, "নষ্ট মেয়েরা নষ্টামির ছাড়পত্র হিশেবে নিয়েছে নারীবাদকে।" এরকম মোটাদাগের উদাহরণের কি অভাব আছে?
আহমদ ছফাকে মফস্বলীয় বা প্রাদেশিক ধ্যানধারণার মধ্যে ফেলে বুঝতে গেলে সবকিছু গুবলেট হয়ে যাবে। আমাদের ফেইসবুক বুদ্ধিজীবীদের হয়েছে গুবলেট দশা। তিনি ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক মানের পথিকৃৎ বুদ্ধিজীবীদের একজন। তাকে বোঝার জন্যে এই সত্যটুকু মেনে নেয়া দরকার।