ইউক্রেইনে রুশ আগ্রাসন কি বিশ্বে মার্কিন প্রভাব খর্ব করবে?

সাঈদ ইফতেখার আহমেদসাঈদ ইফতেখার আহমেদ
Published : 1 July 2022, 00:19 AM
Updated : 1 July 2022, 00:19 AM

ইউক্রেইনে রুশ আগ্রাসন পঞ্চম মাসে গড়িয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সবচেয়ে বড় যুদ্ধ চলছে ইউরোপে। যুদ্ধ দুটো রাষ্ট্রের মধ্যে হলেও—মার্কিন নেতৃত্বে পশ্চিমা দুনিয়া একে দেখছে- শীতল যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তারা বিশ্বে যে একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তার করতে সমর্থ হয়েছে, তার প্রতি চ্যালেঞ্জ হিসেবে। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে পশ্চিমা দুনিয়ার সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দেয় সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আস্তে আস্তে পশ্চিমের নেতৃত্ব ব্রিটেন থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে চলে যায়। 

পশ্চিমা বিশ্ব তাদের উত্থানের সাথে সাথে বিশ্বের একটা বড় অংশে উপনিবেশ স্থাপন করে। এর বিপরীতে রাশিয়া উপনিবেশ নয়, আশেপাশের অঞ্চল দখল করে রাষ্ট্রের সীমানা বাড়াতে থাকে। 

রাশিয়ার সব জারই রুশ সাম্রাজের বিস্তৃতি ঘটিয়েছেন। নতুন জার হবার পর তাদের প্রথম কাজই ছিল সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটানো। একজন জারের সফলতা মাপা হতো তিনি সাম্রাজ্যের কতটা বিস্তার ঘটাতে পেরেছেন, তার উপর।

এ ধারা অব্যাহত থাকে ১৯১৭ সালের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পরেও। লেনিনের মৃত্যুর পর স্তালিন ক্ষমতায় এসে এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুনিয়া এবং মলদোভা সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত করেন। এছাড়া পোল্যান্ডের পূর্বাঞ্চলের একটা বড় অংশ দখল করে জুড়ে দেন ইউক্রেইনের সাথে। 

মানবিক সমাজ এবং রাষ্ট্র গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে কমিউনিস্টরা ক্ষমতা দখল করলেও, ক্ষমতায় এসে তারা জারদের মতোই স্বৈরাচারী একনায়ক হয়ে উঠেন। তাদের কারো কারো, বিশেষত স্তালিনের নির্মমতা, জারদের স্বৈরশাসনকেও হার মানিয়েছে।   

পশ্চিমা দেশগুলোর স্থাপন করা উপনিবেশ এবং রুশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হওয়া অঞ্চল বা দেশগুলোর মাঝে একটা মৌলিক পার্থক্য ছিল। কাগজে কলমে হলেও প্রথমে রুশ সাম্রাজ্য এবং পরে সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হওয়া অঞ্চলের জনসাধারণ, একজন রুশ নাগরিকের সমান অধিকার ভোগ করতেন। উদাহারণস্বরূপ বলা যায়, স্তালিন নিজে রুশ ছিলেন না। তিনি ছিলেন জর্জিয়ার অধিবাসী—যা কিনা জার প্রথম আলেকজান্ডারের সময় ১৮০১ সালে রুশ সাম্রাজ্যের অধীনস্ত হয়।  

স্তালিন পরবর্তী সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ ছিলেন ইউক্রেইনের অধিবাসী। অর্থাৎ সোভিয়েত ব্যবস্থায়, কমিউনিস্ট পার্টি তথা সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধান হবার জন্য, জাতিগত পরিচয় অন্তরায় হয়ে উঠত না। উল্লেখ্য, সোভিয়েত ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপ্রধান নয়, কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদকই ছিলেন রাষ্ট্রের মূল হর্তাকর্তা। অপরদিকে, পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো ব্যাপক গণতন্ত্রায়নের কথা বললেও, এটি কল্পনার বাইরে ছিল যে, ঔপনিবেশিক আমলে কোন ভারতীয় ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হবেন।   

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে একের পর এক রাষ্ট্র ঔপনিবেশিক শাসন থেকে বেরিয়ে আসতে থাকলে, পশ্চিমা দুনিয়া এ সমস্ত দেশে হয় তাদের মতাদর্শিক অর্থাৎ পুঁজিবাদী-গণতান্ত্রিক সরকার, অথবা পশ্চিমাপন্থি স্বৈরতান্ত্রিক সরকার দেখতে চায়। এ দুই ধরনের সরকারই ঔপনিবেশিকোত্তর সময়ে, বিশ্বে তাদের স্বার্থ ও প্রভাব রক্ষা করবে বলে তারা মনে করে। কিন্তু, পশ্চিমা স্বার্থ ও প্রভাব রক্ষা করবার প্রধান অন্তরায় হয়ে উঠে সোভিয়েত ইউনিয়ন। 

স্তালিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত ইউনিয়ন হিটলারের বাহিনীর সামনে খুব বড় জোড় ছয় থেকে আট সপ্তাহ টিকে থাকতে পারবে বলে ব্রিটেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ধারণা করেছিল। সবার হিসেবকে ভুল প্রমাণ করে, সোভিয়েত বাহিনী যখন নাৎসি জার্মানদের মূল ভূখণ্ড থেকে হটিয়ে পোল্যান্ডে প্রবেশ করা শুরু করে, তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রমাদ গোণে। তারা এটা বুঝতে পারে যে, সোভিয়েত বাহিনীর হাতে নাৎসি বাহিনীর পরাজয় ঘটলে, পুরো ইউরোপ সোভিয়েত ইউনিয়নের করতলগত হয়ে পড়বে। এ উপলব্ধি থেকে যুদ্ধের একটা দীর্ঘ সময় পর, সোভিয়েত বাহিনী যখন পোল্যান্ড মুক্ত করা শুরু করে, আমেরিকা তখন পশ্চিম ইউরোপে সৈন্য নামায়। উদ্দেশ্য, পুরো ইউরোপ যাতে সোভিয়েতের অধীনে চলে না যায়।  

সোভিয়েত বাহিনী একের পর এক পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলিকে মুক্ত করে সেখানে কমিউনিস্ট পার্টিকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেয়। একমাত্র পূর্ব জার্মানি ছাড়া, বাকি প্রায় সবগুলো দেশেই কমিউনিস্ট পার্টি ছিল অত্যন্ত দুর্বল এবং গণবিচ্ছিন্ন। এ সমস্ত দল ক্ষমতায় এসে, দেশগুলোতে সমাজতন্ত্রের নামে একনায়কতান্ত্রিক স্বৈরশাসন কায়েম করে। 

সোভিয়েত-নির্ভর এসব একনায়করা সোভিয়েত স্বার্থের বাইরে যেয়ে স্বাধীনভাবে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন না। ফলে পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলি নাৎসি বাহিনী মুক্ত হলেও জনগণের বৃহত্তর অংশটিই মনে করতো তারা এক প্রকার সোভিয়েত উপনিবেশে পরিণত হয়েছে। এ অবস্থার পরিবর্তনের চেষ্টার ফলে ১৯৫৬ সালে ক্রুসচেভ হাঙ্গেরিতে এবং ১৯৬৯ সালে ব্রেজনেভ তৎকালীন চেকোশ্লোভাকিয়াতে সৈন্য পাঠিয়ে পরিস্থিতি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখে। 

ব্যতিক্রম ছিল যুগোশ্লাভিয়া এবং আলবেনিয়া। যথাক্রমে মার্শাল টিটো এবং আনোয়ার হোজ্জার নেতৃত্বে তারা একই সাথে সোভিয়েত কর্তৃত্ব এবং পশ্চিমা প্রভাব- এ দুটোর বিরুদ্ধেই দাঁড়ায়। তবে পূর্ব ইউরোপের অন্য সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর মতো, এ দেশ দুটিতেও কঠোর একনায়কতান্ত্রিক শাসন থাকবার ফলে জনগণ সেখানে নিষ্পেষিত বোধ করত।  

এ নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে ব্যাপক অসন্তোষ পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে ছিল। অসন্তোষ ছিল খোদ সোভিয়েত ইউনিয়নেও। ফলে পোল্যান্ডের শ্রমিক নেতা লেস ওয়ালেসার নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যে বিক্ষোভ শুরু হয়, তার রেশ ধরে পূর্ব ইউরোপসহ খোদ সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতান্ত্রিক ধারার অর্থনীতির অবসান ঘটে। সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি হলো, যে শ্রমিক শ্রেণির শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য এ আন্দোলনের জন্ম, সে শাসনের বিরুদ্ধে সেই শ্রমিক শ্রেণির বিদ্রোহের ফলেই এর অবসান ঘটে। 

সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে শুধু সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থারই অবসান ঘটেনি, খোদ সোভিয়েত ইউনিয়নেরই বিলুপ্তি ঘটে দেশটি ১৫ খণ্ডে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এ বিভক্তিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে রুশরা বা খোদ রাশিয়া। ১৫টি সোভিয়েত রিপাবলিকের মধ্যে সবচেয়ে বড় ছিল রাশিয়া- মোট ভূখণ্ডের ৭৬ শতাংশ। 

১৯৮৫ সালে মিখাইল গর্বাচেভ কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক তথা সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধান হন। তিনি ক্ষমতায় আসবার পর গ্লাসনস্ত এবং পেরেস্ট্রয়কা- এ দুটো রুশ শব্দ- তার কল্যাণে বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত হয়ে উঠে। 

গ্লাসনস্ত মানে হলো 'মতপ্রকাশের মুক্ত পরিবেশ' আর পেরেস্ট্রয়কা মানে হলো 'অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থার পুনর্গঠন'। যড়যন্ত্র তত্ত্ব, অর্থাৎ গর্বাচেভ পশ্চিমা এজেন্ট, এ আলোকে না দেখে, তার বিভিন্ন কাজ, বক্তৃতা এবং লেখালিখিগুলো অনুসরণ করলে যেটা প্রতীয়মান হয় সেটা হলো- তিনি আন্তরিকভাবে চেয়েছিলেন, স্বৈরতন্ত্রের কবল থেকে বের করে এনে, একটি মানবিক, গতিশীল, গণতান্ত্রিক-সমাজতন্ত্র সোভিয়েত ইউনিয়নে বিনির্মাণ করতে। কিন্তু তিনি বুঝতে পারেননি যে, রাজনীতি হলো একই সাথে ক্ষমতা দখল এবং আধিপত্য বিস্তারের এক জটিল সমীকরণ। এটা বুঝতে না পারার চরম খেসারত শুধু তাকে নয়, তার দেশকেও দিতে হয়। 

গর্বাচেভের খোলামেলা রাজনৈতিক পরিবেশ জনগণকে তাদের পুঞ্জিভূত ক্ষোভের প্রকাশ ঘটাতে উৎসাহিত করে। জনগণ বিক্ষোভ শুরু করে দীর্ঘদিনের স্থবির অর্থনীতির কারণে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের প্রবল ঘাটতির বিরুদ্ধে। তারা আরো অধিক গণতন্ত্রের দাবি করতে থাকে। এর পাশাপাশি জর্জিয়া, এস্তোনিয়া, লিথুনিয়া, লাটভিয়াসহ কয়েকটি রিপাবলিকে জনগণ স্বাধীনতার দাবিতে রাস্তায় নেমে আসে। 

এসবের সাথে মস্কোর মেয়র বরিস ইয়েলিৎসিনের নেতৃত্বে একটা অংশ কমিউনিস্ট পার্টি থেকে বের হয়ে যেয়ে গর্বাচেভের ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করা শুরু করে। গর্বাচেভ বুঝতে পারেন আস্তে আস্তে সবকিছু তার হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। 

পশ্চিমা বিশ্ব উল্লসিত হয়ে উঠে—যা ছিল তাদের এতদিনের কল্পনার বাইরে, সেসবই যেন ঘটছে সোভিয়েত ইউনিয়নে। তারা শুধু সমাজতন্ত্রের পতন নয়, সোভিয়েত ইউনিয়ন দেশটিই খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে কিনা, সেদিকে অধিক আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকে। এসময় তারা তাদের বিশেষজ্ঞদের দিয়ে, ইয়েলিৎসিনকে কীভাবে গর্বাচেভের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত করা যাবে, সে পরামর্শ দিতে থাকে। একই সাথে তারা স্বাধীনতাকামী বিভিন্ন রিপাবলিকের নেতাদের বুদ্ধি দিতে থাকে, কী করে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া যাবে।    

গর্বাচেভের উপর একদিকে পার্টির মধ্যে এবং বাইরে উদারপন্থি হিসেবে যারা পরিচিত ছিল-  তাদের চাপ যেমন বাড়ছিল, তেমনি বাড়ছিল রক্ষণশীল বা কট্টরপন্থিদের চাপ। উদারপন্থিরা পুরোপুরি পশ্চিমা ধাঁচে মুক্তবাজার অর্থনীতি নির্ভর পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক রূপান্তর চাচ্ছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের। অপরদিকে, কট্টরপন্থিরা স্বৈরতান্ত্রিক-রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত রাজনীতি এবং অর্থনীতি পরিচালনার দীর্ঘ ঐতিহ্যের ধারা অটুট রাখতে চাচ্ছিলেন। এমন পরস্থিতিতে ভাইস প্রেসিডেন্ট গেন্নাদি ইয়ানায়েভের নেতৃত্বে আট সদস্যের একটা দল, যারা 'gang of eight' নামে পরিচিত হয়েছিলেন, তারা গর্বাচেভের বিরুদ্ধে ক্যু করে বসে। তাকে তখন গৃহবন্দি করা হয়।  

এ ক্যুর বিরুদ্ধে সোভিয়েত জনগণ ইয়েলেৎসিনের নেতৃত্বে রাস্তায় নেমে আসে। জনগণের প্রবল বিক্ষোভের মুখে ক্যু ব্যর্থ হয়ে যায়। গৃহবন্দি অবস্থা থেকে গর্বাচেভ বের হয়ে আসেন। বের হয়ে তিনি বুঝতে পারেন, তার হাতে কোন ক্ষমতা নেই—একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠেছেন, তার প্রতিদ্বন্দ্বী ইয়েলেৎসিন। 

রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষী ইয়েলেৎসিনের ছিল প্রজ্ঞা এবং দূরদর্শিতার প্রবল অভাব। যেকোনও মূল্যে গর্বাচেভকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল ছিল তার মূল লক্ষ্য। স্তালিন ১৯৩৬ সালে সোভিয়েত সংবিধানে সংশোধনী এনে জুড়ে দিয়েছিলেন- ১৫টি রিপাবলিকের যেকোন একটা যদি সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে যেয়ে স্বাধীন হতে চায়, তারা সেটা করতে পারবে। 

সংবিধানের এ সংশোধনী কাজে লাগিয়ে ১৯৯১ সালের ডিসেম্বর মাসে ইয়েলেৎসিন ইউক্রেইনের নেতা লিওনিদ ক্রাভচুক এবং বেলারুসের স্তানিস্লাভ শুশকেভিচের সাথে এক গোপন চুক্তি করে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে যাবার ঘোষণা দেন। সারা বিশ্ব এ ঘোষণায় হতভম্ব হয়ে লক্ষ্য করল, যে প্রবল পরাক্রমশালী সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে মার্কিন নেতৃত্বে পশ্চিমা দুনিয়া দীর্ঘ শীতল যুদ্ধ করলো, সে দেশটিকে বাইরের কেউ নয়, খোদ রুশ নেতৃত্ব ১৫ ভাগে বিভক্ত করে ফেলল।       

গর্বাচেভকে হটিয়ে রুশ প্রধান হবার নেশায় মত্ত ইয়েলেৎসিন খেয়াল করেননি যে, সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধান নৌঘাঁটি ইউক্রেইনের ক্রিমিয়াতে। ক্রিমিয়া এক সময় রাশিয়ার অংশ ছিল। ক্রুসচেভ ক্ষমতায় এসে একে তার মাতৃভূমি ইউক্রেইনের সাথে জুড়ে দেন। শুধু তাই নয়, পারমাণবিক অস্ত্র, গোলাবারুদ এসবের বড় অস্ত্রাগার ইউক্রেইনে। ইউরোপের সবচেয়ে বড় পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রও ইউক্রেইনে। যে মহাকাশ অভিযান নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের গর্ব, সে মহাকাশ যান উৎক্ষেপণ কেন্দ্র কাজাখাস্তানের বাইকানুরে।

ইয়েলেৎসিন ক্ষমতায় আসবার পর খুব দ্রুত রুশ জনগণের মোহ ভঙ্গ ঘটে। তারা দেখতে পায়, অসুস্থ এবং মদ্যপ ইয়েলেৎসিন কয়েকশ বছরের রুশ ইতিহাসে তাদের রাষ্ট্রটিকে পরিণত করেছেন অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু এবং সামরিকভাবে দুর্বল। তারা আরো বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলে ক্ষমতায় আসা ইয়েলেৎসিনের দায়িত্বজ্ঞানহীন কার্যকলাপের বিরুদ্ধে রুশ সংসদ দুমাতে যখন অনাস্থা প্রস্তাব আনা হয়, তখন  ইয়েলেৎসিনের নির্দেশে সেই দুমাতে ট্যাঙ্ক থেকে গোলাবর্ষণ করা হয়। জনগণ আরো বেশি বিস্মিত হয়, যখন গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী পশ্চিমা দেশগুলো এ গোলাবর্ষণকে সমর্থন করে।

পশ্চিমা দেশগুলো সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গনসহ পূর্ব ইউরোপ থেকে সমাজতন্ত্রের বিদায়কে পুঁজিবাদ এবং গণতন্ত্রের চিরস্থায়ী বিজয় বলে মনে করে। শীতল যুদ্ধে তারা নিজেদের বিজয়ী পক্ষ ভাবে। অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু এবং সামরিকভাবে দুর্বল সোভিয়েত ইউনিয়নের খণ্ডিত অংশ রাশিয়ার পক্ষে আর কোনদিন মাথা তুলে দাঁড়ানো সম্ভব হবে না বলে তারা ধরে নেয়। 

পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক কাঠামোর সাথে রাশিয়ার অর্থনীতির সমন্বয় ঘটাবার লক্ষ্যে রুশ সরকারের পরামর্শক হিসেবে কাজ করবার জন্য এ সময় বিপুল সংখ্যক মার্কিন অর্থনীতিবিদ, আমেরিকার মানদণ্ডেই অত্যন্ত উচ্চ বেতনে, মস্কোতে কাজ করতে আসেন। দেখা গেল, তারা যত পরামর্শ দিচ্ছেন, রুশ অর্থনীতি ততই তলানিতে গিয়ে ঠেকছে। ফলে পশ্চিমা তাত্ত্বিকরা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছে যান, রাশিয়াতে যে পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটবে, সেটা হবে পশ্চিমানির্ভর পুঁজিবাদ। রুশ সরকারগুলো হবে পশ্চিমা অনুগত সরকার। যে হিসেবটা তখন তাদের দূরকল্পনাতেও ছিল না সেটা হলো, রাশিয়া এবং গণচীনের মতো বৃহৎ অর্থনীতি পুঁজিবাদী পথ গ্রহণ করবার ফলে, একদিন তারা পুঁজিবাদী দুনিয়ার নেতৃত্ব নিজের হাতে নিয়ে নেওয়ার জন্য, পাশ্চাত্যকেই  চ্যালেঞ্জ করে বসতে পারে। 

সমাজতন্ত্রের বিদায়ের পরে ওয়ারশ জোট বিলুপ্ত হয়ে গেলেও ন্যাটো জোটকে শুধু সক্রিয় নয়, পূর্ব ইউরোপে বিস্তার ঘটিয়ে একের পর এক সাবেক সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোকে এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। দুই জার্মানি একত্রিত হবার পর, ন্যাটোর সীমানা আর পূর্ব দিকে সম্প্রসারণ করা হবে না বলে গর্বাচেভকে যে ওয়াদা করা হয়েছিল, সেটা বেমালুম ভুলে যাওয়া হয়। 

২০০৪ সালে এসে তিনটি প্রাক্তন সোভিয়েত রিপাবলিক- এস্তোনিয়া, লিথুনিয়া এবং লাটভিয়াকে ন্যাটো সদস্য করা হয়। ইয়েলিৎসিনের অনুরোধ উপেক্ষা করে, বসনিয়ার গণহত্যার বিষয়কে কেন্দ্র করে, রুশ মিত্র সার্বিয়ার রাজধানী বেলগ্রেডে ১৯৯৯ সালে ব্যাপক বোমাবর্ষণ করে ন্যাটো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটি ছিল ইউরোপের ভূমিতে প্রথম বোমাবর্ষণের ঘটনা। পরবর্তীতে ন্যাটো বাহিনীর সহায়তায় সার্বিয়া থেকে কসোভোকে আলাদা করে স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা করা হয়। দুর্বল রাশিয়ার পক্ষে সবকিছু নিরবে দেখা ছাড়া আর কোন ভূমিকা পালন করবার অবকাশ ছিল না। 

এসময় সন্ত্রাস নির্ভর 'ইসলামপন্থা'র রাজনীতিকে পশ্চিমের মূল শত্রু ধরে নীতি প্রণয়ন করা হয়। অদূর ভবিষ্যতে গণচীন পশ্চিমের স্বার্থের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে পারে, এটা বিবেচনায় রাখা হয়। কিন্তু বাস্তবে 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' শুধু  সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সীমাবদ্ধ না রেখে, রুশপন্থি হিসেবে পরিচিত মুসলিম প্রধান রাষ্ট্র, ইরাক এবং লিবিয়ার সরকার পরিবর্তন বা পশ্চিমের ভাষায়, 'রেজিম চেঞ্জ' করতে ব্যবহার করা হয়। এসব দেশে সরকার প্রধানদের হত্যা করা হয়। আরেক 'রুশপন্থি' রাষ্ট্র সিরিয়ার বিষয়ে এমন নীতি নেওয়া হয়, যাতে আসাদ সরকারের পতন ঘটে এবং ইসলামিক স্টেট ক্ষমতাসীন হয়।    

ইয়েলিৎসিনের নেতৃত্বে রাশিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থা যখন একেবারে তলানিতে, চেচনিয়ায় বিদ্রোহসহ রাষ্ট্র হিসেবে রাশিয়া নিজেই তার অখণ্ডতা ধরে রাখতে পারবে কিনা- এ প্রশ্ন যখন সামনে, রুশ জনগণই যখন দেশটির আর কোন ভবিষ্যত দেখতে পাচ্ছে না- ঠিক এ অবস্থায় ইয়েলিৎসিন পুতিনের হাতে ক্ষমতা দিয়ে রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ান। সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবির উত্তরসূরি এফএসবি প্রধান পুতিন ক্ষমতাসীন হবার পর সবাই ধরে নেয়, তিনিও হয়তো ইয়েলিৎসিনের পদাঙ্কই অনুসরণ করবেন। 

পুতিন ক্ষমতায় এসে দ্রুত রাশিয়াকে সামরিক এবং অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করবার উদ্যোগ নেন। রাজনৈতিক বিশ্বাসের দিক থেকে পুতিন একজন রুশ জাতীয়তাবাদী। যা কিছু রাশিয়ান, তার সবকিছুকেই তিনি ধারণ করেন। ফলে তাত্ত্বিক আলেক্সজান্ডার দুগিনের কট্টর রুশ অর্থোডক্স খ্রিস্টান জাতীয়তাবাদে যেমন তার আস্থা আছে, আবার একই সাথে দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম হিসেবে ইসলাম এবং মুসলমানদের ভূমিকাও রাশিয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে তিনি মনে করেন। জারদের আমল এবং কমিউনিস্টদের শাসনকাল—দুটো সময়ই পুতিনের মতে রাশিয়ার  গৌরবজনক অধ্যায়। 

সোভিয়েত ইউনয়নের পতন নিয়ে পুতিনের বিখ্যাত উক্তি: "সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গনে যিনি দুঃখ পান না তিনি হৃদয়হীন আর এর পুনর্গঠন নিয়ে যিনি স্বপ্ন দেখেন তিনি বুদ্ধিহীন।" পশ্চিমের 'উদারনৈতিক গণতন্ত্রের' ধারণার বিপরীতে তিনি হাজির করেন 'সার্বভৌম গণতন্ত্রের' ধারণা। এ তত্ত্বের মূল কথা হচ্ছে, বাইরের হস্তক্ষেপ ব্যতিরেকে, প্রতিটি  রাষ্ট্রের অধিকার রয়েছে, স্বাধীনভাবে নীতি প্রণয়ন করবার। 

রাশিয়ার উত্থান পশ্চিমকে অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। প্রথমদিকে তাদের অ্যাপ্রোচ ছিল বিষয়টাকে উপেক্ষা করবার। কেননা, যাদের সাথে শীতল যুদ্ধে তারা জয়ী হয়েছে, সেই রাশিয়া আবার বিশ্বমঞ্চে ফিরে আসছে, বিষয়টা তাদেরকে অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। কিন্তু তারপরেও তারা বিষয়টাকে উপেক্ষার দৃষ্টিতে দেখে 'সন্ত্রাস বিরোধী' যুদ্ধকেই প্রাধান্য দেয়, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ক্ষমতায় আসবার আগ পর্যন্ত, যা রাশিয়াকে উত্থানে কৌশলগত সুবিধা দেয়। পাশাপাশি, আফগানিস্তান এবং ইরাকে বিপুল অর্থ ব্যয়, এবং আফগানিস্তানে আমেরিকার শোচনীয় পরাজয়, পশ্চিমের বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটা দুর্বল ইমেজ রাশিয়ার সামনে তুলে ধরে। 

২০০৮ সালের বুখারেস্ট কনফারেন্সে জর্জিয়া এবং ইউক্রেইনকে ন্যাটো জোটভুক্ত করা হবে এ মর্মে ঘোষণা পুতিন সরকারকে উদ্বিগ্ন করে তোলে। তারা বিষয়টাকে দেখে রাশিয়াকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরে স্ট্র্যাটেজিকভাবে দুর্বল করে দেবার কৌশল হিসাবে। ইউক্রেইন ন্যাটোভুক্ত হলে, রাশিয়া ইউরোপে একেবারে কোণঠাসা হয়ে পড়বে বলে তারা মনে করে। 

ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিকভাবে রাশিয়ার সাথে যুক্ত থাকবার ফলে ইউক্রেইন রুশদের কাছে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। ইউক্রেইন এক সময় রাশিয়ার অংশ ছিল। ভ্লাদিমির লেনিনের নেতৃত্বে কমিউনিস্টরা ক্ষমতায় আসবার পর ১৯২২ সালে ইউক্রেইনকে রাশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে আলাদা রিপাবলিক করা হয়। অর্থাৎ, আজকে ইউক্রেইনকে ঘিরে রাশিয়ার যত সমস্যা, তার সবগুলো তৈরি করেছে রুশ এবং কমিউনিস্টরা।

রুশদের তৈরি করা সমস্যার ধারাবাহিকতার সূত্র ধরে আজকে যখন ইউক্রেইনের ন্যাটো জোটে যোগদানের বিষয়কে কেন্দ্র করে রাশিয়ার ইউরোপে কোণঠাসা হয়ে পড়বার উপক্রম হচ্ছিল, তখন সমস্ত আন্তর্জাতিক আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে, নিজেদের 'সার্বভৌম গণতন্ত্রের' ধারণাকে লঙ্ঘন করে, পুতিন ইউক্রেইন আক্রমণ করে বসেন। এর মধ্য দিয়ে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে বড় যুদ্ধে রাশিয়া জড়িয়ে পড়ে। 

সামরিক শক্তিমত্তার দিক থেকে বিশ্বের প্রথম ১০/১২ টি দেশের পরেই ইউক্রেইনের অবস্থান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এত শক্তিশালী কোন রাষ্ট্রের সাথে সংঘাতে জড়ায়নি। সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং রাশিয়া, জর্জিয়া বাদে যেসব জায়গায় সৈন্য পাঠিয়েছে, যেমন হাঙ্গেরি, চেকোশ্লোভাকিয়া, আফগানিস্তান, সিরিয়া—তার সব জায়গাতেই তাদের 'অনুগত' সরকার আগে থেকেই ক্ষমতায় ছিল। 

যুদ্ধ রাশিয়া এবং ইউক্রেইনের মধ্যে হলেও, পশ্চিমা বিশ্ব এটিকে দেখছে, তাদের স্বার্থের উপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে বড় আঘাত হিসেবে। শীতল যুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন যে সমস্ত রাষ্ট্রে সৈন্য পাঠিয়েছে, তার সবই ছিল তার নিজস্ব প্রভাব বলয়ের দেশ। ইউক্রেইন সাবেক সোভিয়েত রিপাবলিক হলেও, পশ্চিমা দুনিয়া একে তাদের প্রভাব বলয়ের রাষ্ট্র মনে করে। তারা ভেবেছিল, রাশিয়া আর যাই করুক, পশ্চিমা প্রভাব বলয়ভুক্ত ইউক্রেইন আক্রমণের সাহস পাবে না। 

অভিনয় জগত থেকে উঠে আসা, রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিও এরকমই মনে করেছিলেন। কিন্তু সব হিসেব নিকাশকে ভুল প্রমাণ করে শীতল যুদ্ধে পরাজিত রাশিয়া যখন ইউক্রেইন আক্রমণ করে বসে, পাশ্চাত্য এটাকে সরাসরি তাদের প্রতি আক্রমণ হিসেবে ধরে নেয়। ফলে রাশিয়াকে শায়েস্তা করবার জন্য, অভাবনীয় অর্থনৈতিক এবং অন্যান্য নিষেধাজ্ঞা দেশটির উপর আরোপ করা হয়। 

রাশিয়াকে অনেকটা উত্তর কোরিয়া বা ইরানের মতো করে একইভাবে অবরোধ দেওয়া হয়। রাশিয়ার বৈদেশিক রিজার্ভের ৪৫ শতাংশ, অর্থাৎ ৩৬৫ বিলিয়ন ডলারের মতো মুদ্রা আটকানো হয়। শুরুতে যেটা ছিল শুধু সামরিক যুদ্ধ, পশ্চিমা দুনিয়া সেটাকে অর্থনৈতিক যুদ্ধেও রূপান্তরিত করে। শুধু তাই নয়, যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন 'মত প্রকাশ' এবং 'মিডিয়ার স্বাধীনতায়' সদা সোচ্চার, সেই ইউনিয়নের দু-একটি বাদে প্রায় সবগুলো রাষ্ট্র, রাশিয়ার বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম অপতথ্য প্রচার করছে অভিযোগ এনে নিষিদ্ধ করে দেয়। সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যম যেখানে উন্মুক্ত প্লাটফর্ম হবার কথা, সেখানে তারা এ বিবাদে সরাসরি পশ্চিমা পক্ষ নেয়। 

এসবের ফলে মনে করা হয়েছিল, অর্থনৈতিকভাবে রাশিয়া দুর্বল হয়ে পড়বে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে এর উল্টো চিত্র- যেটা পশ্চিমা নীতিনির্ধাকদের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে, রুশ মুদ্রা এবং অর্থনীতি দুটোই শক্তিশালী হতে শুরু করে। শুধু রুশ মিত্র চীন এবং ভারত নয়, খোদ ন্যাটো সদস্য তুরস্কও অবরোধে অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানায়। 

রাশিয়া জানত তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আসবে, কিন্তু এতটা ব্যাপক মাত্রায় হবে সেটা তাদের হিসেবের বাইরে ছিল। দীর্ঘ সামরিক এবং অর্থনৈতিক যুদ্ধের বিষয়ে একটা প্রস্তুতি তাদের ছিল। এখন তারা সেটাকে কাজে লাগিয়ে, ডলার-কেন্দ্রিক মার্কিন অর্থনৈতিক ব্যাবস্থার বিপরীতে, রুবল-কেন্দ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দাঁড় করাবার পাল্টা অর্থনৈতিক যুদ্ধ শুরু করেছে।

পশ্চিমের সাথে রাশিয়ার যুদ্ধে দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে ইউক্রেইন। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ডিসিপ্লিনের সবচেয়ে প্রভাবশালী তত্ত্ব হচ্ছে বাস্তববাদী তত্ত্ব। এ তত্ত্ব অনুযায়ী আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অঙ্গন লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড না। এটি 'জোর যার মুল্লুক তার'- নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। ফলে দুর্বল রাষ্ট্রগুলো এখানে সব সময় চেষ্টা করে, নানা কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় নিজেদের প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোর লক্ষ্যবস্তু হওয়া থেকে রক্ষা পেতে। 

আন্তর্জাতিক রাজনীতির এ সমস্ত জটিলতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল না থাকবার ফলে জেলেনস্কির পক্ষে বুঝে ওঠা সম্ভব হয়নি যে, রুশ আক্রমণ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে। আবার আক্রমণ শুরু হবার পর ক্রিমিয়া রাশিয়ার অংশ এবং দনবাসের স্বাধীনতা স্বীকার করে নেবার যে শর্ত রাশিয়া ইউক্রেইনের উপর আরোপ করে, তা মেনে নেওয়া কোন রাষ্ট্রপ্রধানের পক্ষে সম্ভব নয়। ফলে আলোচনার পরিবর্তে পশ্চিম থেকে আরো অধিক অর্থ এবং অস্ত্র সাহায্য চাওয়া ছাড়া, জেলেনস্কির সামনে আর কোন বিকল্প খোলা থাকে না। 

ইউক্রেইনকে ঘিরে রাশিয়ার লক্ষ্য কী বা রাশিয়া কতদূর যাবে, এটা এখনো পরিষ্কার নয়। শুরু থেকেই ইউক্রেইন নিয়ে রাশিয়ার কথা এবং কাজের মধ্যে মিল নেই। রাশিয়া একে যুদ্ধও বলছে না, বলছে 'বিশেষ সামরিক অভিযান'। এর অংশ হিসেবে রাশিয়া প্রথমে কিইভের দিকে অগ্রসর হলেও আবার হঠাৎ করে সৈন্য সরিয়ে নেওয়ায়- 'রাশিয়া ইউক্রেইনের সাথে যুদ্ধে পেরে উঠছে না'- এ ধরনের জোর প্রচারণা চালান হয়। কিন্তু এখন যখন রাশিয়া ধীর গতিতে ইউক্রেইনের পূর্ব এবং দক্ষিণের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলো একের পর এক দখলে নেওয়া শুরু করেছে, সেটা পশ্চিমা দুনিয়াকে শঙ্কিত করে তুলছে। 

মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটের ইরাক বা আফগানিস্তানে অভিযান চালাবার সময় বিশ্বব্যাপী যেমন ব্যাপক প্রতিবাদ হয়েছিল, ইউক্রেইনে রুশ হামলার সময় তেমনটা হয়নি। বামপন্থিরা চুপ করে থাকবার নীতি নিয়েছেন। তারা অনেক কিছু বুঝে উঠতেও পারছেন না। আবার কেউ কেউ রাশিয়া এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন এক নয় এটা বুঝেও, সোভিয়েত যুগের রোমান্টিসিজমে ভুগছেন। 'ইসলামপন্থিরা' সবাই সোভিয়েত বিরোধী হলেও, এদের অনেকে আজকে রাশিয়ার আক্রমণকে সমর্থন করছেন, পশ্চিমের বিরুদ্ধে রুশ ভুমিকার কারণে। 

ভিয়েতনাম, আফগানিস্তান, ইরাকে মার্কিন সামরিক অভিযানকে যদি 'নব্য ঔপনিবেশিক আগ্রাসন' বলা যায়, ইউক্রেইনে রুশ আগ্রাসন নিঃসন্দেহে 'নব্য মধ্যযুগীয় আগ্রাসন'। আমেরিকার সামরিক লক্ষ্য ছিল মার্কিনপন্থি সরকার ক্ষমতায় বসানো, ভূমি দখল নয়। অপরদিকে, রুশ আগ্রাসনের লক্ষ্য হচ্ছে, একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের ভূমি দখল করে, নিজ রাষ্ট্রের সীমানা বাড়ান। এটি মধ্য যুগের মতো শুধুই ভূমি দখল। কোন নীতি, আদর্শ বা মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা এখানে লক্ষ্য নয়। এ ভূমি দখল প্রক্রিয়ায় রাশিয়া যদি সফল হয়, তাহলে সেটি বর্তমান মার্কিন-কেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থার যে আমূল পরিবর্তন আনবে, সেটা নিঃসন্দেহে বলা যায়।