আজকের জগত শেঠরা কোথায় পালালো?

শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকশামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক
Published : 30 June 2022, 04:02 AM
Updated : 30 June 2022, 04:02 AM

কথিত আছে, বরগির হাঙ্গামা রোধকল্পে  প্রচুর পয়সার প্রয়োজন হলে আলীবর্দি খান এবং পরে নবাব সিরাজ উদ দৌলা জগত শেঠসহ অন্যান্য পুঁজিপতিদের সাহায্য চাইলে তারা আত্মগোপনে চলে গিয়েছিল। আজকের জগত শেঠরাও তাই করছে। কোভিড-১৯ সংক্রমণের মাধ্যমে প্রকৃতির বিষাক্ত দংশনে গোটা বিশ্বের মতো বাংলাদেশও জর্জরিত হওয়ার পরেই শুরু হলো মানবসৃষ্ট দুর্যোগ ইউক্রেইন যুদ্ধ। তার জের শেষ না হতেই আবার প্রকৃতির ছোবল, অভূতপূর্ব বন্যায় ভাসছে সারাদেশ। বন্যার সাথে সম্পৃক্ত সব ধরনের জনদুর্ভোগই বিরাজ করছে। হতাহতের সংখ্যা তেমন না হলেও, খাদ্যদ্রব্যের অভাব স্বভাবতই প্রকট হয়ে উঠছে। চলাচলের পথ এক রকম বন্ধ বন্যার পানির কারণে। ত্রাণ বিতরণও কঠিন হয়ে পড়েছে। এমনকি আশ্রয়স্থলগুলোও পানিতে নিমজ্জিত।

এই দুর্ভোগ নিরসনে সরকার যা পারছে, করে যাচ্ছে। নামানো হয়েছে সেনাবাহিনী, বিজিবি-সহ সকল শক্তি, যারা আপ্রাণ চেষ্টা করছে বানভাসি মানুষের জন্য কিছু করার। সরকার যথাসাধ্য ত্রাণও দিচ্ছে, হেলিকপ্টারেরও সাহায্য নিচ্ছে। কিন্তু এ ব্যাপারে সরকারের সীমাবদ্ধতা অবশ্যই ভুলে গেলে চলবে না। এ ধরনের পরিস্থিতিতে বিশ্বের বহু দেশে এগিয়ে আসেন সে সব দেশের ধনিক শ্রেণি। কিন্তু আমাদের ধনকুবেরদের মোটেও মাঠে দেখা যাচ্ছে না।

এক শ্রেণির লোক এ বন্যার জন্য মিথ্যা গল্প বানিয়ে ভারতের উপর দোষ চাপানোর চেষ্টায় ব্যস্ত। ভারত বিরোধিতা এদের মজ্জাগত এবং উদ্দেশ্যমূলক ষড়যন্ত্রের অংশ। এদের কথায় মনে হচ্ছে বন্যায় তারা খুশি, কারণ বন্যার অজুহাত দেখিয়ে তারা ভারতবিরোধী প্রচারণার একটি হাতিয়ার পেল। অথচ তারা দেখছে না যে এ বন্যায় ভারতের আসাম রাজ্যও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। সেখানে বেশ কিছু লোকের মৃত্যু হয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে লক্ষাধিক লোক। আমাদের নদী ও বন্যা বিশেষজ্ঞরা পরিষ্কার বলছেন, এ অভূতপূর্ব বন্যার জন্য মূলত ভারতের চেরাপুঞ্জি অঞ্চলে ঘটে যাওয়া অতি অধিক বৃষ্টি দায়ী, যা গত ১২০ বছরে ঘটেনি। আরো দায়ী বিশ্ব আবহাওয়ায় পরিবর্তন। অতীতে যখনই এ ধরনের প্রকৃতি সৃষ্ট দুর্যোগ ঘটেছে তখনই পৃথিবীর

বিভিন্ন দেশের বেশ কিছু ধনকুবের সহায়তা দানের প্রথম সারিতে দাঁড়িয়েছেন। এর ফলে জনমানুষের পয়সা লুট করে পুঁজিপতি হওয়ার বদনাম থেকে তারা কিছুটা হলেও মুক্তি পেয়েছেন।কোভিড মহামারীর সময় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ পৃথিবীর সম্পদশালী দেশসমূহের কয়েকজন বিত্তশালী তাদের দানছত্র নিয়ে নেমে পড়েছিলেন এই কথা বলে যে একা সরকারের পক্ষে এ ধরনের পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। পৃথিবীর ৭টি দেশের ৮৩ জন ধনকুবের নিজ নিজ দেশের সরকারকে অনুরোধ করেছেন- তাদেরসহ সব ধনী সংস্থা ও ব্যক্তিদের আয়কর বাড়িয়ে দেওয়া হোক, চলতি আর্থিক সংকট মেটানোর জন্য। পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার কুৎসিত রূপ বলে যে কথাটি প্রচলিত তার কিছুটা লাঘব করেছেন এসব পুঁজিপতিরা তাদের মানবিকতা প্রদর্শন করে।  '১০২ মিলিয়নিয়ারের গ্রুপ' নামে পরিচিত সংস্থার সদস্যরা শুধু দানই করেননি, বরং বলেছেন তাদের আয়কর বাড়ানো হোক। এরা হলেন ডিজনির উত্তরাধিকারি এবিগেইল ডিজনি, নিক হেনাউয়ের, গেমা ম্যাকগেট, মুনাক এবং তার স্ত্রী অক্ষত মূর্তি, জুলিয়া ডেভিস।

দানশীলতার জন্য এই ধরণীর শীর্ষ ধনীদের অন্যতম বিল গেইটস এবং তার সাবেক স্ত্রী মেলিন্ডা গেইটসের খ্যাতি বিশ্বময়। কোভিড মহামারীর শুরুতেই এই দম্পত্তি (তখনো বিচ্ছেদ হয়নি) তাদের সাহায্যের দ্বার খুলে দেন সব দেশের জন্য। এই দম্পতি যে শুধু দরিদ্র দেশেই সহায়তা পাঠিয়েছেন, তা নয়, অর্থ মার্কিন মুল্লুকের মানুষও পেয়েছেন।

গেইটস দম্পতি ছাড়াও আরও যার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তিনি হচ্ছেন, যুক্তরাজ্যভিত্তিক সেইনসব্যারি চেইনের মালিক লর্ড সেইনসব্যারির উত্তরাধিকারী এবং কন্যা ফ্রেন প্যারিন। তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া তার সমস্ত সম্পদ দান করেই ক্ষান্ত হননি, সকল সম্পদশালীদের বলেছেন "এতোদিন তোমরা সমাজ থেকে যা নিয়েছো এখন সময় এসেছে তা সমাজকে ফিরিয়ে দেয়ার।"

যুক্তরাষ্ট্রের 'প্যাট্রিয়টিক মিলিয়নিয়ারের' আদলে যুক্তরাজ্যের কিছু বিবেকবান ধনী গড়ে তুলেছেন 'মিলিয়নিয়ার ফর হিউমেনিটি', নামক সংস্থা যার অন্যতম উদ্ভাবক, চিত্র পরিচালক রিচার্ড কার্টিস তার আয়ের বিরাট অংশ দান করে বলেছেন, "আমাদের যে সম্পদ আছে, তা বিশ্বে ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য প্রয়োজন।"

গেমা মেকগাও নামক আর এক মিলিয়নিয়ার নারী বলেছেন, "যে সব মানুষ বিশ্বব্যাপী রাস্তায় ঘুমায়, তাদের কথা ভাবলে নিজের বিলাস জীবনে ধিক্কারই আসে।" তিনি দরিদ্র ঘরে জন্মেছিলেন। দরিদ্র পিতা-মাতার সন্তান গ্যারি স্টিভেনসন তার প্রাচুর্যের বিরাট অংশ দানের সময় বলেছিলেন পৃথিবী থেকে কিভাবে সম্পদের অসম বণ্টন দূর করা যায় তা জানার জন্য তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি পড়তে গেলে তার জবাব পাননি। তার মতে ধনীদের উপর অধিক কর আরোপেই উত্তর রয়েছে। যুক্তরাজ্যের অন্যতম বিত্তশালী দানবীর জন ক্লেডওয়েল অর্থ দান করে বলেছেন, অর্থ সুখ দিতে পারে না, দানেই আনন্দ। তাই তিনি তার তিন ভাগের এক ভাগ সম্পদ দানশীলতার কাজে ব্যয় করেন। তিনি বলেন, "রোলস রয়েস গাড়িতে চড়লে তিনি নিজেকে অপরাধী মনে করেন, মনে হয় সাধারণ মানুষ যেন তার চোখ খুলে ফেলতে চাচ্ছে। ২০১১ সালে বিল এন্ড মেলিন্ডা গেইটসের অর্থায়নে বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয় 'সুখ এবং সম্পদের দ্বন্দ্ব' নামে এক জরিপের সময় বহু মিলিয়নিয়ার বলেছিলেন তাদের মনের দ্বন্দ্ব এই যে তারা দরিদ্রের সম্পদ লুট করছেন, তারা অকৃতজ্ঞ।

গেইটস দম্পতি ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কিছু বিলিয়নিয়ার কোভিড সৃষ্ট পরিস্থিতিতে বিশ্বব্যাপী অর্থ দান করে মানবতায় অংশ নিয়েছেন, গড়ে তুলেছেন 'প্যাট্রিয়টিক মিলিয়নিয়ার' নামক সংস্থা। এদের মধ্যে ওয়ারেন বাফেট দান করেছেন ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, মানবতার জন্য বিখ্যাত, জেফ বেজোসের প্রাক্তন স্ত্রী ম্যাকেঞ্জি স্কট মোট ৪ বিলিয়ন ডলার দান করে দানের সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছেছেন। ফেইসবুকের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ডাসটিন মস্কোভিচ এবং তার স্ত্রী কেরি টুনা এবং ম্যাকেঞ্জি স্কট এর প্রাক্তন স্বামী, আমাজনের সাবেক প্রধান জেফ বেজোস ২০২১ সালে ১ বিলিয়ন ডলার দান করেছেন। জর্জ মবোস ৩ বিলিয়ন,  নিউ ইয়র্কের সাবেক মেয়র মাইকেল ব্লুমবার্গ গত বছর দেওযা ১ বিলিয়নসহ গত কয়েক বছরে মোট ১২ বিলিয়ন ডলার দান করেছেন। চার্লস ফিনসি বস্তুত তার সব সম্পদই দান করেছেন যার পরিমাণ ৮ বিলিয়ন, ইনটেল- এর মালিক গর্ডন মুর এবং স্ত্রী বেটি মুর সব মিলে দিয়েছেন ৫ বিলিয়ন। ফেইসবুক- এর প্রধান মার্ক জাকারবার্গ এবং তার স্ত্রী প্রিসিলা চেন দিয়েছেন ৩ বিলিয়ন, প্রয়াত ইন্স্যুরেন্স মালিক এলি মোট ১৩৬ মিলিয়ন দান রেখে গেছেন। ডেল কম্পিউটার মালিক মাইকেল ডেল এবং স্ত্রী সুসান ডেল ১৯৯৯ থেকে দান করেছেন ২ বিলিয়ন, ক্রেডিট কার্ড মালিক ডেনি সেনফোর্ড দান করেছেন ২২ বিলিয়ন, প্রয়াত তেল সম্পদের মালিক চার্লস সুস্টারম্যানের স্ত্রী লিন দান করেছেন ২ বিলিয়ন, মাইক্রোসফটের প্রাক্তন প্রধান স্টিভ বলসার এবং তার স্ত্রী দান করেছেন ২ বিলিয়ন, পে প্যাল প্রধান পিয়ার ওমিদিয়ার এবং স্ত্রী দান করেছেন দেড় বিলিয়ন। এস্টি লোডার পারফিউম কোম্পানির মালিক দান করেছেন দেড় বিলিয়ন।  

বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ধনী, হিলটন হোটেলসমূহের প্রতিষ্ঠাতা কনরেড হিলটনের পুত্র ব্যারন হিলটন উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত গোটা সম্পদের শুধু ৩ শতাংশ নিজের উত্তরাধিকারীদের জন্য রেখে বাকি ৯৭ শতাংশ দান করে দিয়ে বিশ্বে চমক লাগিয়েছেন।

ডিজনিল্যান্ডের অন্যতম যুগ্ম প্রতিষ্ঠাতা, রয় ডিজনির দৌহিত্রী আবিগেইল ডিজনি, যিনি যুক্তরাষ্ট্রে আয়ের বৈষম্যকে দুঃস্বপ্ন তূল্য বলে আখ্যায়িত করেছেন, তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পদের বিরাট অংশ দান করেছেন। ভারতীয় বংশোদ্ভুত গুগল- এর বর্তমান সিইও সুন্দর পিচাই, যিনি দরিদ্র পরিবারে বড় হয়েছেন, তার সম্পদের উল্লেখযোগ্য অংশ দান করেছেন। এমনকি চীনের ধনকুবের জ্যাক মা-ও প্রচুর দান করেছেন।

ভারতের সম্পদশালীরা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের ধনীদের সমকক্ষ না হলেও সে দেশের ধনী ব্যক্তিরাও  করোনাকালে দানের রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন। ভারতীয় দানশীলদের মধ্যে প্রথম যে নাম আসে তা আজিম প্রেমজির। অতি সাধারণ জীবন যাপনকারী এই শীর্ষ ধনী ৯ হাজার ৭০০ কোটি টাকার সমমূল্য পরিমাণ দান করেছেন। শিব নাদারের দান করা অর্থ ছিল ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা। মুকেশ আম্বানি দান করেছেন ৫৫৭ কোটি টাকা। কুমার বিরলার দানের অর্থ ছিল ৩৭৭ কোটি টাকা, অদিত্য বিরলা গ্রুপ দিয়েছে ৪০০ কোটি টাকা, হিন্দুজা পরিবার দিয়েছে ১৬৬ কোটি টাকা। দানশীলতার জন্য প্রসিদ্ধ বাজাজ পরিবার দিয়েছেন ২৩৩ কোটি টাকা। তাছাড়া গৌতম আদানি, অনিল আগারওয়াল, ডাবুর গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা বুরমান পরিবার, টাটা কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতার পুত্ররা দান করেছেন দেড় হাজার কোটি টাকা।

চলচ্চিত্র এবং সঙ্গীত জগতের ধনী ব্যক্তিরাও পিছিয়ে ছিলেন না। অভিনেতা শাহরুখ খান এবং তার স্ত্রী গৌরী তাদের সম্পদের বিরাট অংশ ছাড়াও তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা বাড়িঘর প্রদান করেছেন কোভিড আক্রান্ত রোগীদের আশ্রয় দিতে। তাছাড়া স্বাস্থ্যসেবিদের দিয়েছেন স্বাস্থ্য সরঞ্জাম। অক্ষয় কুমার ২৭ কোটি টাকা, শাবানা আজমি দশ লক্ষ লোককে তৈরি খাবার, রেশন এবং স্বাস্থ্য সামগ্রী দিয়েছেন। সালমান খান কয়েক শত ট্রাক বোঝাই খাবার দিয়েছেন, ঋত্বিক রোশান মুম্বাই পুলিশসহ হাজার হাজার লোককে স্বাস্থ্য সামগ্রী দিয়েছেন। সাধ্যমতো দান করেছেন প্রিয়াংকা চোপরা, সনু সুদ, সুস্মিতা সেন, আলিয়া ভাট, শিল্পা শেঠী, অজয় দেবগান, জন আব্রাহাম, লতা মুঙ্গেশকর (জীবিত থাকাকালে), সনু নিগাম, আল্কা ইয়াগনিক, ক্যাটরিনা কাইফ, গোবিন্দ প্রমুখ। খেলাধুলার জগতের ধনীরাও পিছিয়ে থাকেননি। দানের খাতায় নাম লিখিয়েছেন বিরাট কোহলি, শচীন টেন্ডুলকার, সানিয়া মির্জা।

বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য বা এমনকি ভারতের মতো ধনকুবেরদের মতো ধনী লোক কম আছে বটে, কিন্তু স্বাধীনতার পর, স্বাধীনতার সুযোগেই যে একটি ধনিক পুঁজিপতি গোষ্ঠির সৃষ্টি হয়েছে তাতো অনস্বীকার্য। একটি শ্রেণি বেসরকারি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে দরিদ্র রোগীদের থেকে প্রচুর টাকা হাতিয়ে নিয়ে রাতারাতি বনে গেছেন কোটিপতিতে। বেশ কিছু ধনকুবের যে প্রচুর টাকা বিদেশে পাচার করেছেন তা এখন প্রমাণিত। এদের মধ্যে এমনও রয়েছে যারা গোটা বিমান ভাড়া করে, বাড়ির কাজের লোকসহ বিদেশে পাড়ি জমাতে পেরেছেন। কিন্তু দেশের এই দুঃসময়ে তাদের দেখা যাচ্ছে না। অন্যদিকে এমন সব মানবিক মানুষ এগিয়ে এসেছেন যাদেরকে পুঁজিপতি হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় না। এদের তালিকায় যারা রয়েছেন তাদের মধ্যে সর্বাগ্রে উল্লেখ করতে হয় উভয় বাংলার অতি জনপ্রিয় তারকা জয়া আহসানের নাম, যিনি শুধু দুঃখী মানুষের বন্ধুই নন, একজন নিরলস পশুপ্রেমী হিসেবেও যার খ্যাতি  অক্ষয় হয়ে থাকবে। বানভাসি মানুষের আর্তনাদের কথা উল্লেখ করে তিনি ফেইসবুকে যা লিখেছিলেন, যা কোলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায়ও ছাপা হয়েছে, তা বহু মানুষকে কাঁদিয়েছে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতের লোকেরা মুম্বাইয়ের চিত্রশিল্পীদের মতো বিত্তশালী নন, আর তাই শাহরুখ , শাবানা, ঋত্বিক, সালমান বা অক্ষয়ের মতো তারা দান করবেন তা আশা করা যায়নি। কিন্তু তারপরও দেখা গেল বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন চিত্রতারকাই দানের জগতে অগ্রণী ভূমিকায় নেমে সাধ্যমতো দান করে দেশ এবং মানবপ্রেমের দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছেন। কয়েকজন ব্যবসায়ী/ শিল্পপতি এগিয়ে এসেছেন, কিন্তু তাদের সংখ্যা নগন্য, অথচ তাদের বিলাস জীবনে কোন ঘাটতি হচ্ছে না। জনগণের এই দুঃসময়ে বিলাসিতায় গা ভাসাতে তাদের মনে কোন অপরাধ বোধও নেই। ধর্মান্ধদের একটি মহল ভিডিও তৈরি করে মানুষের মনে এমন বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করছে যে তারাই ত্রাণ কার্য চালাচ্ছে। কিন্তু তাদের তৈরি ছবিতে কিছু মাদ্রাসা ছাত্র এবং কয়েকজন সাধারণ মানুষকে দেখা যাচ্ছে ত্রাণসামগ্রী কাঁধে বহন করতে। যারা 'ওয়াজ বাণিজ্য' করে, আয়কর না দিয়ে, কোটি কোটি টাকার বস্তা তৈরি করেছে, হেলিকপ্টার ভ্রমণসহ বিলাসিতায় গা ভাসানোর মতো পুঁজি গড়েছে, তাদের দেখা যাচ্ছে না, বা তারা দান করেছে এমনটিও শোনা যাচ্ছে না।

এসব অমানুষদের পর্বতপ্রমাণ সম্পদ থেকে সামান্য দান করলেও তাদের বিত্ত বৈভবে ঘাটতি দেখা দিতো না। অন্যদিকে দেশের লক্ষ লক্ষ দুস্থজন উপকৃত হতো। যেসব ধনী ব্যক্তি এই দুর্দিনে মানুষের দুরাবস্থা দেখেও অঢেল পয়সায় উড়োজাহাজ ভাড়া করে বিদেশ যাওয়ার মতো মানবতা-বিবর্জিত কাজ করতে পারেন, একমাত্র কারুনের* সাথেই তাদের তুলনা করা যায়। দেশে এমন অনেক ধনী রয়েছেন, প্রমাণিতভাবেই যাদের অফুরন্ত সম্পদ বিদেশে পাচার হয়েছে। কোন দলে বেশি বিত্তবান সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হলো- কে এই দুর্যোগে দানের হাত বাড়িয়ে দিলেন আর কে কচ্ছপের মতো মুখ বন্ধ করে আছেন অথবা বিদেশে চলে গেছেন। বেশ কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকের অবদান সন্তোষজনক। গুটিকয়েক শিল্পমালিকও অবদান রেখেছেন। যদিও বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে মুনাফার বাণিজ্য করার জন্য লাইসেন্স দেয়া হয় না, দেয়া হয় রোগীসেবার জন্য তারপরও বেআইনিভাবে রোগীদের গলা কেটে পুঁজিপতি বনে যাওয়া এসব হাসপাতাল মালিকদেরও দেখা যাচ্ছে না। এই জাতীয় দুর্যোগের সময়ে মানুষের পাশে না দাঁড়িয়ে তারা প্রমাণ করলো নিজেদের সুখ-সাচ্ছন্দ ছাড়া কিছুই বোঝে না। অনাদিকাল থেকে মহামানবরা বলে এসেছেন আশেপাশের লোককে খুশি করতে না পারলে কখনো সুখি হওয়া যায় না। তবে এই মহান বাণী শুধু বিবেকবান মানুষরাই বুঝতে পারেন। যারা নিজেদের সম্পদ নিজেদের মধ্যেই কুক্ষিগত করে রাখছেন, মানুষের হাহাকার যাদের কানে পৌঁছায়নি, তারা কি কখনো এসব মহামানবদের বাণী উপলব্ধি করতে পারছেন না? 

(কারুন- নবী মুসা (আ.) এর আমলের একজন দাম্ভিক ধনী। যার দাম্ভিকতার জন্য আল্লাহর দেওয়া শাস্তির কথা মুসলিমদের ধর্মগ্রন্থ কোরআনের সুরা কাসাসে উল্লেখ আছে।- মতামত সম্পাদক)