'উপাচার্য সৎ হলে বিশ্ববিদ্যালয় ভালো চলে' বলে সম্প্রতি এমন মন্তব্য করেছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ। মোক্ষম কথা। তার কথায় অনুপ্রাণিত হলাম, সেই সঙ্গে সত্যযুগের প্রসঙ্গ মনে পড়ে গেল।
হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী, চার যুগের প্রথম যুগ হলো সত্যযুগ। অন্য যুগগুলো হলো ত্রেতা যুগ, দ্বাপর যুগ ও কলি যুগ। এখানে আমি সত্যযুগের প্রসঙ্গ একটু টানতে চাই। বৈশাখ মাসের শুক্ল পক্ষে তৃতীয়া তিথিতে রবিবারে সত্যযুগের উৎপত্তি। এর পরিমাণ সতের লক্ষ বছরের উপরে। এর অবতার সংখ্যা চার। মৎস্য (মাছ), কূর্ম (কচ্ছপ), বরাহ (শুকর), নৃসিংহ (মানুষ ও সিংহের সমন্বিত রূপ)। সত্যযুগের শাসকের সংখ্যা ছয়: বলি, বেণ, মান্ধাতা, পুরোরবা, ধুন্ধুমার, কার্তবীর্যার্জুন।
সত্যযুগের শুধু পুণ্য ছিল, পাপ বলে কিছু ছিল না। প্রাণ ছিল মজ্জায়। মৃত্যু ছিল মানুষের ইচ্ছাধীন। এখন আমাদের দেশের একশ্রেণির হাইব্রিড সফল মানুষদের হাবেভাবে মনে হয় সবকিছুই তাদের মর্জিমাফিক ঘটবে। আদতে ঘটেও তাই। কিন্তু খটকা বাদে একটু খুক খুক কাশি হলেই সিঙ্গাপুর ব্যাংকক বিলেত উড়াল মারেন। কারণ মৃত্যুকে না পারলেও রোগবালাইকে টাকার জোরে ঠেকাইতে চেষ্টা করেন। মন্দ না।
সত্যযুগের প্রসঙ্গ সামনে কেন নিয়ে এলাম? কবিকে মনে করা হয় সত্যপ্রকাশের প্রতিবিম্ব। যে শহরে কবি থাকে না, সে শহরে সত্যও থাকে না। আমাদের এক বুদ্ধিজীবী বইয়ের ফ্ল্যাপে নিজেকে সত্যযুগের একজন মানুষ হিসেবে বিজ্ঞাপন করেছেন। এই পর্যায়ে বলে নিতে চাই, আমরা এই যুগের বাঙালিরা কি সত্য মেনে নিতে অভ্যস্ত? আমাদের স্বভাব মিথ্যা যত সহজে গ্রহণ করতে পারি, সত্যকে তত প্রশ্নের মুখে ফেলি।
এবার মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানী সম্পর্কে প্রচলিত একটা গল্প বলতে চাই। তিনি তার জীবদ্দশায় টাঙ্গাইলের সন্তোষের বাড়িতে বসে মানুষকে বিন্যমূল্যে চিকিৎসাসেবা দিতেন। সেই সঙ্গে 'পানিপড়া'ও দিতেন। একবার তার একজন সাগরেদ জিজ্ঞেস করেছেন, হুজুর আপনি 'পানিপড়া'ও দিলেন, আবার ওষুধের বন্দোবস্তও দিলেন, কোনটার কী কার্যকারিতা? ভাসানীর জবাব, 'শুনো, কাজটা করবে ওষুধে। আর পানিপড়া হলো বিশ্বাস। আমি যদি শুধু পানি পড়া দিই, তাহলে রোগ সারবে না। আর যদি শুধু ওষুধের কথা বলি, তাহলে মানুষ আমার কাছে আসবে না। তাই আমি পানিপড়াও দিই, ওষুধও দিই।'
এটা ছিল ভাসানী–বঙ্গবন্ধু যুগের রাজনীতি। এবার তার পরের রাজনীতির একটা গল্প বলি। গত শতকের ক্ষমতাসীন দলের এক কেন্দ্রীয় নেতা ও মন্ত্রীর বাসার এক সকালের দৃশ্য। একদল লোক বাসায় বেশিরভাগ লোক তার নির্বাচনী এলাকার। আরেক দল অল্প কয়েকজন শহুরে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ধরনের। আর তৃতীয় দলে কয়েকজন সাংবাদিক। শহুরে ব্যবসায়ী দলটি অল্প কয়েকজনের। প্রথমে ব্যবসায়ীরাই নেতার সঙ্গে দেখা করার ডাক পেলেন। এরপর সব সাধারণ দর্শনার্থী নেতার দেখা পেলেন। আর সবশেষে সাংবাদিকদের ডাক পড়লো। নেতা আগেই সাংবাদিকদের বলে রেখেছিলেন, "আপনাদের সঙ্গে আমার কথা আছে, আপনাদের আমি সবার শেষে ডাকছি।" এবার নেতা শুরু করলেন কৈফিয়ত দেবার মতো করে, "শুনুন আপনাদের কেন সবার শেষে ডেকেছি। প্রথম দলটি যে দেখলেন, ওনাদের কাছ থেকে পকেট ভরেছিলাম। আর এরপরে যাদের দেখলেন তাদের মাধ্যমে পকেট খালি করে ফেললাম।" এই হলো রাজনীতি, জনসেবা। কী বুঝলেন?
এবার হাল আমলের 'সত্যযুগে'র রাজনীতির একটা গল্প বলি। একজন প্রভাশালী নেতা। তার নির্বাচনী এলাকার কোনো নিয়োগের আগে যেসব প্রার্থী তার কাছে যায় তিনি সবার কাছ টাকা নেন। নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষে যে প্রার্থীর চাকরি হয় সেই প্রার্থীর টাকাটা রেখে বাকিদের টাকা ফেরত দিয়ে দেন। এই নীতি অবলম্বন করে তিনি বেশ টাকাকড়িও করেছেন সেই সঙ্গে সুনামও অর্জন করেছেন। তিনি কারো টাকা মেরে খান না। টাকা নিলে কাজটা করে দেন। আদতে তিনি কারো জন্যেই সুপারিশ করেন না। ফাঁকতালে যার চাকরি হয় তার কাছ থেকে কিছু টাকা পেয়ে যান। তাকে আমরা অসৎ বলি কিভাবে? সত্যযুগের রাজনীতিবিদ বলে কথা!
এবার সত্যযুগের বুদ্ধিজীবী আর বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাদের প্রসঙ্গে আসি। দেশের একটি শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শীর্ষ কর্তা তার এলাকার বাইরের কোনো প্রার্থী না থাকলে তিনি সেই নিয়োগ প্রক্রিয়ার ফাইল অবমুক্ত করেন না, নিয়োগের উদ্যোগ আর অগ্রসর হয় না । সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঘা বাঘা অধ্যাপক ভয়ে মুখ খোলার সাহস করেন না। এরা সকলেই সৎ ভাবমূর্তির অধিকারী। বিশ্ববিদ্যালয়ের এসব শীর্ষকর্তারা নিজের বিপক্ষে গেলে শিক্ষকদের যেমন দেখে নেন, বা দেখে নেবার হুমকি দেন। আবার তার বিপক্ষে কোনো লেখাজোকা ছাপা হলে তার বিরুদ্ধেও দেখে নেবার হুমকি দেন, এমন কি মামলা করার হুমকিও দেন। যে কারণে ডাকসাইটে অধ্যাপকরাও ভয়ে গুটিয়ে থাকেন।
এবার বইয়ের ফ্ল্যাপে সত্যযুগের মানুষ বলে নিজের পক্ষে বিজ্ঞাপন করা বুদ্ধিজীবীর বেলায় ফিরে আসি। তিনি একবার তরুণ বয়সে একতলার একটি অপেক্ষাকৃত উন্নত বাসার বরাদ্দ নেবার অনুকূলে একটি চিঠি লিখলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে, চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী তার সিঁড়ি ভাঙা নিষেধ। সেই তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তা হয়ে বৃদ্ধ বয়সে একতলার বাসা ছেড়ে এখন দিব্যি বাংলোর উপরতলা আর নিচতলা করে রাতদিন সিঁড়ি ভাঙছেন সমস্যা হচ্ছে না।
সত্যযুগের মানুষ বলে বিজ্ঞাপনকারী এই বুদ্ধিজীবীর পারিবারিকভাবে ঢাকায় বড়সড় একটা জমি থাকার পরও উত্তরার মতো জায়গায় সরকারি দুটি প্লটের ভাগিদার হয়েছেন, মালিক হয়েছেন রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় একটি ফ্ল্যাটের। থাকেন বরাদ্দকৃত একটি বাংলোতে। অথচ এই তিনি নিজেকে শহরের একজন সৎ এবং গরীব মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করেন। কেমনে কী?
আমরা এমন হাইব্রিড সত্যযুগে বাস করছি, এক রুমের অফিসে একটা কম্পিউটার নিয়ে বসে ব্যবসা শুরু করে রাতারাতি শত শত কোটি টাকার মালিক হয়ে যাওয়া যায়। বই বিক্রি করে বা বই ছাপিয়ে কয়েক কোটি টাকা সদস্য ফি দিয়ে রাজধানীর অভিজাত ক্লাবগুলোর সদস্য হবার যোগ্যতা অর্জন করা যায়। আমাদের সত্যের পালে হাওয়া লেগেছে। আর আমাদের ঠেকায় কে?
আমাদের দুর্নীতি দমন কমিশন বা 'সত্যকমিশন' এর যেমন বাছির–মিজান কেচ্ছা আছে তেমনি দুদক কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিনকে চাকরিচ্যুত করার উদাহরণও আছে। তাই সত্য কমিশন, যেমন ঠিক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালও কি প্রশ্নের উর্ধ্বে আমাদের এই সত্যযুগে? তবে দুদকের কাছে প্রত্যাশা এখানকার মহান শীর্ষকর্তারা দেশের রাজধানীর যেকোনো একটা ওয়ার্ড এর অথবা দেশের সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এবং বর্তমান কর্তাদের অথবা বর্তমান এবং সদ্য অবসরে যাওয়া সচিবদের অথবা যেকোনো একটা অধিদপ্তরের যেমন শিক্ষা অধিদপ্তর বা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কিংবা ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সকলের সম্পদের হিসেবের তত্ত্বতালাশ করে দুর্নীতি দমনের একটা নমুনা হাজির করতেন, তাহলে আমরা এই সত্যযুগের সত্যের পাহারাদারদের নিয়ে বড়ই গর্ব করতে পারতাম।
আমার মনে একটা প্রশ্ন। ঘুষ কি দুর্নীতির পর্যায়ে পড়ে না? বিবিধ কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে বলা হয় দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স বা শূন্য সহিষ্ণুতা। এ ব্যাপারে আমার অভিজ্ঞতা বা পর্যবেক্ষণ সুখকর না। ঘুষ ছাড়া কোন কোন দপ্তরে কাজ হয় তার হাদিসগুলো কি কেউ দিতে পারবেন?
দেশে বিদেশে রাজনীতিবিদদের নানা বয়ান শুনতে শুনতে একটা ধারণা আমার মাথায় কাজ করে রাজনৈতিক নেতাদের কথার আক্ষরিক অর্থ খুঁজতে নাই সবসময়। মাঠের বক্তৃতায় অনেক কথাই মুখ ফসকে বা বা মুখ ফসকিয়ে বের হয়ে আসে। সব কথা ধরতে নাই।
রাজনীতিবিদরা নিজেরা অপকর্ম করে চেপে যান। অথচ অন্যদলকে একই অপকর্ম নিয়ে দোষারোপ করতে ছাড়েন না। এটা রাজনীতির চাল বটে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর পদ্মাসেতু ঘিরে বড় রকমের দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছেন। আমার মনে প্রশ্ন মির্জা সাহেবের কি ওইসময় তাদের সরকারের আমলে খাম্বা প্রকল্পের কথা মনে ছিল? তাদের নেতা কী সব কারণে বিলেতে তীর্থ যাপন করে যাচ্ছেন? এইবার সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বিলম্ব না করে, ফখরুল সাহেবের কাছে দুর্নীতির প্রমাণ চেয়েছেন। আর প্রমাণ না দিতে পারলে ক্ষমা চাওয়ার জন্যে বলেছেন। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের পরও আমরা অপেক্ষায় থাকলাম ফখরুল সাহেব এবং কাদের সাহেবের বাহাস কি কেবল 'কথার কথা' হিসেবেই আটকে থাকে নাকি প্রমাণাদির দিকে গড়ায়?