পদ্মা সেতু: স্বর্ণালী সম্ভাবনার যুগে

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 24 June 2022, 06:58 PM
Updated : 24 June 2022, 06:58 PM

মহাকালের বিচ্ছিন্নতা ঘুচিয়ে প্রমত্তা পদ্মার বুকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে পদ্মা বহুমুখী সেতু, বাংলাদেশের মর্যাদা ও গর্বের প্রতীক। সেতুর সড়ক পথ মোটর গাড়ির জন্য, রেলপথ নির্মিত হয়েছে মিটার ও ব্রড গেজের উপযোগী করে। রাজধানী ঢাকা এবং আরও অনেক জেলার সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বেশিরভাগ জেলার সড়ক পথে দূরত্ব অন্তত ১০০ কিলোমিটার কমিয়ে দেওয়া দৃষ্টিনন্দন সেতুটি গ্যাস এবং টেলিযোগাযোগ-ইন্টারনেট সুবিধা স্থানান্তরেও ব্যবহার হবে। এ সেতু বাংলাদেশের স্থল পথে বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ বন্দর বেনাপোল ও ভোমরার সঙ্গে ঢাকার দূরত্ব অনেকটাই কমিয়ে আনবে। পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতা থেকে এখন বেনাপোল-যশোর-আরিচা-মানিকগঞ্জ হয়ে ঢাকায় আসতে অতিক্রম করতে হয় চারশ' কিলোমিটার পথ। পদ্মা সেতু কমিয়ে দেবে ১৫০ কিলোমিটার। ফেরির জন্য ঘাটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা এমনকি কখনও কখনও কয়েক দিন অপেক্ষার দুঃসময় পরিণত হবে অতীতের বিষয়ে। সাতক্ষীরার ভোমরা থেকে ৫-৬ ঘণ্টাতেই পৌঁছানো যাবে ঢাকা। পদ্মা সেতু, মংলা ও পায়রা বন্দর এবং অত্যাধুনিক সড়ক পথ ব্যবহার করে ভারতের পাশাপাশি নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়বে এ অঞ্চলের জেলাগুলোর। এ সেতু সড়ক ও রেল পথে এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সঙ্গ সরাসরি সংযোগ ঘটানোর ক্ষেত্রেও মাইলফলক হয়ে থাকবে।

বাংলাদেশে শত শত নদনদী রয়েছে। নদীগুলোর মধ্যে অন্তত ২০টিতে বড় সেতু রয়েছে, যা পথের বাধা বিপুলভাবে কমিয়ে দিয়েছে, অর্থনীতিতে সুফল বয়ে এনেছে এবং উপশম করেছে জনদুর্ভোগ। পদ্মা সেতুর মতো ব্যয়বহুল এবং এমনকি আরও বেশি ব্যয়ের অবকাঠামো প্রকল্পও গড়ে উঠেছে কিংবা উঠছে। কিন্তু সামাজিক-অর্থনৈতিক, ভৌগলিক ও পরিবেশগত তাৎপর্য বিবেচনায় পদ্মা সেতু অনন্য, অতুলন।

'Gap of South Bridged'- রাজধানী ঢাকাসহ অনেক জেলাকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিশাল জনপদকে কার্যত পড়শীতে পরিণত করা সেতুটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বাংলাদেশের মর্যাদা বিপুলভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশ্বব্যাংক এবং তার সহযোগী আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক দশকের পর দশক ধরে বিপুল সংখ্যক স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের ওপর অর্থনৈতিক-সামাজিক এবং ক্ষেত্র বিশেষে রাজনৈতিকভাবে যে অন্যায় প্রভাব বিস্তার করে চলছে, নিজের অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ ও দূরদর্শী সিদ্ধান্ত তা উপেক্ষায় প্রেরণা জোগাবে, সন্দেহ নেই। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সশস্ত্র পর্যায়ে উত্তরণের প্রাক্কালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে উচ্চারণ করেছিলেন– 'সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না।' এর চার দশক অতিক্রান্ত হতে না হতেই শেখ হাসিনা পশ্চিমা উন্নত বিশ্বের নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যাংক এবং তার সহযোগীদের জানিয়ে দেন– ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তে অর্জিত বাংলাদেশ কারও অন্যায় দাবির কাছে মাথা নত করে চলবে না। পদ্মা সেতু বাংলাদেশকে এবং বিশেষভাবে দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলকে কীভাবে বদলে দেয়, গোটা বিশ্ব সেটা দেখবে অবাক বিস্ময়ে। তিনি বিশ্বকে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন– বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিত দৃঢ় হচ্ছে। এ দেশকে বাস্কেট কেস কিংবা বটমলেস বাস্কেট বলে অপবাদ দেওয়ার দিন শেষ। অপমান কিংবা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হলে সেটাও মেনে নেওয়া হবে না।

বিশ্বে অন্তত শ' দেড়েক স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ রয়েছে। এর অনেকগুলো উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন এবং এমনকি খাদ্য ও জ্বালানি তেলসহ বহু ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের চাহিদা মেটাতে 'সাহায্যদাতা বিভিন্ন সংস্থা এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ কতিপয় উন্নত দেশের ওপর' নির্ভরশীল। বাংলাদেশে একটা সময় ছিল যখন এমনকি কালভার্ট ও ছোট-বড় সেতু, মাটির রাস্তা কিংবা ধান-চাল-আলুর গুদাম নির্মাণে 'দাতাদের' দ্বারস্থ হতে হতো। এ ধারণাও বদ্ধমূল করার চেষ্টা ছিল– 'বিশ্বব্যাংক কিংবা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল কর্মকর্তারা বাংলাদেশ প্রসঙ্গে যা কিছুই বলুক, সেটাই শত ভাগ সত্য'। তারা বলেছে– আদমজী পাটকল বন্ধ করে দিতে হবে, রেশন ব্যবস্থা তুলে দিতে হবে, ধান-চালের ব্যবসা ও অন্য ব্যবসায় বড় বড় কোম্পানিকে সুবিধা দিতে হবে, ব্যাংক-বীমা ব্যক্তি খাতে দিতে হবে– সব আমরা মেনে নিয়েছি। এমনকি কোনও দম্পতি কতটি সন্তান নেবে এবং জন্ম নিয়ন্ত্রণে কোন পদ্ধতি ব্যবহার হবে, সেটাও তারা বলে দিয়েছে। প্রতি বছর জাতীয় বাজেটের আগে প্যারিসে বিশ্বব্যাংক 'সাহায্যদাতাদের' নিয়ে সভা করে বলে দিত বাংলাদেশ কী কী করবে এবং কী কী করবে না। প্যারিস কনসোর্টিয়াম নামে পরিচিত এই বৈঠক থেকে যে বরাদ্দ দেওয়া হতো, তার ভিত্তিতেই প্রণীত হতো বাংলাদেশের উন্নয়ন বাজেট। পদ্মা সেতু এপিসোড এই অন্যায় ধারায় ছেদ টেনে দিয়েছে এবং এর কৃতিত্ব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। তিনি পদ্মা সেতু চেতনার স্রষ্টা। অভিবাদন তাকে।

'সাহায্য' কেবল সুদসহ আসল পরিশোধের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এর সঙ্গে থাকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শর্ত, যা অনেক ক্ষেত্রে অপমানজনক এবং জাতীয় সার্বভৌমত্বে প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপের সামিল। অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়ে কিংবা দুর্বল রাজনৈতিক নেতৃত্বের কারণে অনেক দেশ তা মানতে বাধ্য হয়। কিন্তু বাংলাদেশ পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রক্রিয়ায় প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও দৃঢ়তা দেখাতে পারে, পরাক্রমশালী বিশ্বব্যাংককে বলে দিতে পারে– 'আমরা মাথা নত করব না।'

জননেত্রী শেখ হাসিনা ২০১২ সালের ৮ জুলাই জাতীয় সংসদে ঘোষণা দিয়েছিলেন– 'বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণ করবে। বিশ্বব্যাংক ২৯ জুন, ২০১২ তারিখ দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হচ্ছে– এমন ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলে এ গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে প্রতিশ্রুত ১২০ কোটি ডলার বন্ধ করে দিলে বাংলাদেশ এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।' দুর্ভাগ্য, দেশের একটি 'প্রভাবশালী মহল' বাংলাদেশের মর্যাদা সমুন্নত রাখার পক্ষে সোচ্চার হয়নি, সমর্থন দিয়েছে বিশ্বব্যাংকের অন্যায় কাজে।

তবে প্রধনমন্ত্রী আন্তর্জাতিক রীতি-নীতি ও অনুশাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। বিশ্বব্যাংকের সে সময়ের নেতৃত্ব ভুল করলেও তিনি সেতু নির্মাণে যুক্তদের বিশ্বব্যাংকের ডিজাইন এবং পরিবেশ-পুনর্বাসন বিষয়ে তাদের পরামর্শ-নির্দেশনা কঠোরভাবে মেনে চলার নির্দেশ দিয়েছেন। পরিবেশবিদরা বলেছিলেন, ইলিশের প্রজনন মৌসুমে চলাচলের পথ বিঘ্নিত করা যাবে না। আমেরিকান একটি এনজিও বলেছিল– পদ্মা সেতুর পিলার বসবে, এমন একটি স্থানে বিরল প্রজাতির কচ্ছপ ডিম পাড়ে। সেখানে পিলার নির্মিত হলে পরিবেশের ক্ষতি হবে। প্রধানমন্ত্রী দ্রুত এ দুটি সমস্যার সমাধান করে দেন।

পদ্মা সেতু নির্মাণের কারণে বাংলাদেশের দেশজ উৎপাদনে স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বাড়তি সংযোজন হবে, বিশেষভাবে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বৃহত্তর বরিশাল, খুলনা ও যশোর অঞ্চলের জেলা-উপজেলায়। অর্থনীতিতে গতি আসবে, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হবে।

বাংলাদেশে এখন তিনটি সমুদ্র বন্দর রয়েছে– চট্টগ্রামের কর্ণফুলী, বাগেরহাটের মংলা ও পটুয়াখালীর পায়রা বন্দর। কক্সবাজারের মাতারবাড়িতে নির্মিত হচ্ছে নতুন গভীর সমুদ্র বন্দর। বর্তমানে আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের তিন-চতুর্থাংশ সম্পন্ন হয় চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের দূরত্ব প্রায় আড়াইশ' কিলোমিটার। কিন্তু পদ্মা সেতু পথে রাজধানী ঢাকা থেকে মংলা বন্দরের দূরত্ব দাঁড়াবে ১৭০ কিলোমিটার। বিভাগীয় শহর বরিশাল থেকে পায়রা সমুদ্র বন্দরের দূরত্ব মাত্র ১০০ কিলোমিটার। বরিশাল থেকে মংলা বন্দরের দূরত্ব মাত্র ১১৫ কিলোমিটার। অন্যদিকে, বরিশাল শহর থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের সড়ক পথে দূরত্ব এর অন্তত তিন গুণ। যদি মংলা ও পায়রা নৌ বন্দরের সুবিধা বাড়ানো যায়, তাহলে বরিশাল অঞ্চলের শিল্প ও বাণিজ্যের উদ্যোক্তারা আমদানি-রফতানির জন্য এ দুটি বন্দরই ব্যবহার করবেন, তিন গুণ পথ ব্যবহার করে চট্টগ্রাম বন্দরে যাবেন না। এমনকি ঢাকার ব্যবসায়ীদের কাছেও চট্টগ্রাম বন্দরের পাশাপাশি মংলা ও পায়রা বন্দর আকর্ষণীয় হবে। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থার অনুমান এক দশকে কেবল বরিশাল বিভাগের ৬টি জেলায় ৫০০ থেকে ১০০০ শিল্প স্থাপিত হবে, যেখানে ১০ থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হবে।

বিশ্বব্যাংক কেবল নিজের প্রতিশ্রুত অর্থ প্রদান বন্ধ করেনি। পদ্মা সেতু নির্মাণে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ৬১.৫ কোটি ডলার, জাইকা ৪৩ কোটি ডলার এবং ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক ৬১.৭ কোটি ডলার ঋণ প্রদানের অঙ্গীকার করেছিল। বিশ্বব্যাংক এ সব ঋণ বাতিলে প্ররোচনা প্রদান করে এবং সফলও হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ প্রসঙ্গের উল্লেখ করে বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রচেষ্টায় unnecessary obstacles সৃষ্টি না করার জন্য ঋণ প্রদানকারী দেশ ও সংস্থাসমূহের প্রতি আহ্বান জানান।

তবে বিশ্বব্যাংক যে ভুল করছে সেটা স্বীকার করে নেন সংস্থার ভাইস-প্রেসিডেন্ট ড. কৌশিক বসু। তিনি ২০১৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেন, 'মাত্র ১০ বছর আগেও কেউ ভাবতে পারেনি বাংলাদেশ নিজের অর্থে এত বড় একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারবে। এখন বিশ্বব্যাংকের ওপর নির্ভরতা ছাড়াই তারা এটা করতে পারছে।' পদ্মা সেতু নিয়ে তিক্ততার পর বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে আর কম সুদে ও দীর্ঘমেয়াদে ঋণ দেবে না, এমন শঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছিল। কিন্তু ড. কৌশিক বসু স্পষ্ট জানিয়ে দেন, 'বিশ্বব্যাংক আগামীতে এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নে বাংলাদেশকে সহায়তা দেবে'।

ড. কৌশিক বসুর সফরের ১০ মাস পর ২০১৬ সালের ১৬-১৭ অক্টোবর বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম বাংলাদেশ আসেন। তিনি বাংলাদেশে নাটকীয়ভাবে দারিদ্র্য বিমোচনের হার কমিয়ে আনায় শেখ হাসিনার সরকারের সফলতাকে বিশ্বের অন্যান্য দেশের জন্যও অনুকরণীয় বলে অভিমত প্রকাশ করেন। প্রকৃতপক্ষে তার এ সফর ছিল সংস্থার পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্ট রবার্ট বি জোয়েলিক পদ্মা সেতুর জন্য প্রতিশ্রুত ঋণ বাতিল করে যে গুরুতর ভুল করেছিলেন সেটা সংশোধন এবং বাংলাদেশের ক্ষোভ প্রশমনের চেষ্টা।

বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাইকো ২২ জুন ঢাকায় বলেছেন, পদ্মা সেতুতে জাপান অংশ নিতে না পারা দুর্ভাগ্যজনক। তিনি প্রতিশ্রুতি দেন– দ্বিতীয় পদ্মা সেতু নির্মিত হলে জাপান অবশ্যই তাতে সহায়তা দেবে। রাশিয়াও পদ্মা সেতু নির্মাণের বিষয়টিকে বাংলাদেশের অনন্য অর্জন হিসেবে উল্লেখ করেছে।

পদ্মা সেতুর কাজে বিশেষজ্ঞ হিসেবে শুরু থেকেই যুক্ত ছিলেন দুই খ্যাতিমান প্রকৌশলী অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী ও অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত। ড. আইনুন নিশাত বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পদ্মা সেতুর সম্ভাবনা বিষয়ে এক সেমিনারে বলেন, পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ ঠিক নয়। প্রধানমন্ত্রী বিশেষজ্ঞদের কাজে কোনো হস্তক্ষেপ করেননি। এক্সপার্ট প্যানেল যা করেছে, তিনি সেটা মেনে নিয়েছেন। দুর্নীতির অভিযোগ আনলে সেটা আমাদের ওপর বর্তায়। কিন্তু আমরা দুর্নীতি করিনি, এর প্রশ্নও আসে না।

শুরুর দিকেই পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে প্রতি দিন গাড়ি চলবে ২৪-২৫ হাজার। ২০৫০ সালে প্রতিদিন গাড়ি চলবে ৬৭ হাজার। হেমন্ত-শীতে কুয়াশা, গ্রীষ্মে ঝড়-বৃষ্টি, শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে উত্তাল নদনদী– এভাবে যুগ যুগ ধরে রাজধানী ঢাকা ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ এলাকার সঙ্গে যোগাযোগে প্রকৃতির কাছে জিম্মি বরিশাল-খুলনা-যশোর-কৃষ্টিয়া অঞ্চল। স্থল-নৌ-আকাশ পথে চলাচলে যখন তখন বিধিনিষেধ জারি হয় '১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত' দিয়ে। এমন পরিস্থিতিতে পদ্মা সেতু যেন প্রচণ্ড দাবদাহে এক পশলা বৃষ্টিতে বয়ে আনা কোমল সুবাতাস। তবে কেবল যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ করা নয়, এ প্রকল্পের আর্থ-সামাজিক প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। বরিশাল অঞ্চল 'ধান, নদী, খাল'-এ সমৃদ্ধ। বালাম চাউলের জন্য বিখ্যাত 'দক্ষিণ বরিশাল' ইলিশেরও অভয়ারণ্য। শিক্ষায় বাংলাদেশের অনেক এলাকা থেকে এগিয়ে। কিন্তু কলকারখানা স্থাপনে অনাগ্রহ উদ্যোক্তাদের। 'অপ্রতুল অবকাঠামো সুবিধা'– এর প্রধান কারণ। বরিশাল না চট্টগ্রাম– কোন এলাকায় যাবেন, এ প্রশ্নে আমি অনেক অনেক মানুষের কাছে শুনেছি– 'বরিশাল তো অনেক দূর, চট্টগ্রাম কাছে– সেখানেই যাব।' এখন নতুন চিত্র পদ্মা সেতুর কারণে। এক দশক আগে ২০১২ সালের ১ জুলাই লিখেছিলাম– 'পদ্মা সেতু: বরিশাল থেকেই প্রতিদিন ঢাকায় অফিস' শিরোনামে। কৃষি-শিল্প উৎপাদন ও বাণিজ্যে যুক্তদের জন্য এ এক অনন্য সুবিধা। তথ্য-প্রযুক্তি-ইন্টারনেট সেবা এখন অনেক সহজ। দূরের চট্টগ্রাম বন্দরে যেতে হবে না, খুব কাছের মংলা ও পায়রা বন্দরেই আমদানি-রফতানির কাজ সম্পন্ন হবে। যশোরের বেনাপোল ও সাতক্ষীরার ভোমরা বন্দরও বৈদেশিক বাণিজ্য পরিচালনায় বাড়তি ভূমিকা নেবে। ধান-সবজি-মাছ-ফল উৎপাদন বাড়িয়ে বাজারজাত নিয়ে তেমন ভাবতে হবে না। দেশে এবং বিদেশে টাটকা পণ্য যেমন সহজে পৌঁছানো যাবে, তেমনি প্রসেসিং সুবিধা সৃষ্টির কথাও ভাবতে হবে। মূল্য সংযোজন বা ভ্যালু এডিশন কেবল স্বপ্ন হয়ে থাকবে না। যশোরে আকিজ গ্রুপ মাত্র কয়েক বছরে গড়ে তুলেছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় পাটকল, যেখান থেকে বিশ্বের জুট ইয়ার্নের চাহিদার চার ভাগের এক ভাগ মেটানো হয়। পদ্মা সেতু এ ধরনের আরও অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পথ খুলে দিয়েছে। কেবল মাছের আড়ত নয়, এ অঞ্চলের উদ্যোক্তারা আধুনিক মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প স্থাপন করতে পারেন। বড় আকারের লঞ্চ নির্মাণের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে জাহাজ নির্মাণ শিল্প স্থাপনেও বিনিয়োগ হতে পারে সমুদ্র উপকূলে। নারকেল বাগান সৃষ্টি এবং নারকেল তেলসহ অনেক ধরনের শিল্পও বিনিয়োগের নতুন ক্ষেত্রে হতে পারে। আমরা শৈশবে শুনেছি দক্ষিণের সমুদ্রে 'বরিশাল ক্যাননের' ডাকের রূপকথা যা এখন বাস্তবেই সৃষ্টি হতে পারে। বরগুনা, পটুয়াখালী, বাগেরহাট, ভোলা– সমুদ্র তীরের বা কিংবা নদী পথে সংযুক্ত সমুদ্রের খুব কাছের এ সব এলাকা পরিণত হবে সমুদ্র অর্থনীতির ভিতে, যাকে আমরা বলতে পারি এ কালের 'বরিশাল ক্যানন গর্জন'।

তবে স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিতে হলে জেগে থেকেই স্বপ্ন দেখতে জানতে হয়। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি ও খ্যাতিমান বিজ্ঞানী এপিজে আবদুল কালাম বলেছিলেন, সেটা স্বপ্ন নয়– যা আপনি ঘুমিয়ে দেখেন, বরং সেটাই স্বপ্ন যা আপনাকে ঘুমাতে দেয় না। বরিশাল অঞ্চলের রাজনীতিবিদ, প্রশাসন ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, শিক্ষাবিদ ও পেশাজীবী এবং অর্থনৈতিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রের উদ্যোক্তাদের সামনে এখন এমন অনেক জরুরী করণীয় রয়েছে, যা তাদের ঘুম কেড়ে নিতে পারে। যেমন,

১. ভাঙ্গা থেকে বরিশাল-পটুয়াখালী-বরগুনা-পিরোজপুর-ভোলা ঝালকাঠির সড়ক দ্রুত চার লেনে পরিণত করা। ঢাকা-ভাঙ্গা চার লেনের সড়ক থেকে যখন দুই লেনের সড়কে গাড়ি প্রবেশ করবে, তখন গতি কমবে স্বাভাবিকভাবেই। তখন দুর্মুখেরা দোষ দেওয়া শুরু করবে পদ্মা সেতুকে।

২. মংলা ও পায়রা বন্দরের বিদ্যমান সুবিধা বাড়ানো ও সম্প্রসারণ। খুলনা বা যশোরে কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ, যা হতে হবে আন্তর্জাতিক মানের। এ টার্মিনাল পদ্মা সেতুর রেলপথে সংযুক্ত হবে বাংলাদেশের নানা প্রান্তের সঙ্গে।

৩. ভোলার শাহবাজপুর ও জেলা শহরের কাছে মজুদ প্রাকৃতিক গ্যাস বরিশাল বিভাগ ও আশপাশের এলাকায় সরবরাহ করার জন্য প্রস্তাবিত ১০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ভোলা-বরিশাল সেতু নির্মাণের কাজ সম্পন্ন করা। ইতোমধ্যে দুটি বড় সেতু বেকুটিয়া ও পায়রা সেতু নির্মিত হয়েছে, যা পদ্মা সেতুর সুবিধা কাজে লাগানোয় সহায়ক হবে। ভাঙ্গার কাছে কালনায় সেতু নির্মাণের কাজও শেষ পর্যায়ে। এ ধরনের আরও অনেক উদ্যোগ এখন সময়ের দাবি।

৪. পর্যটন খাতকে ঢেলে সাজানো। কুয়াকাটা সৈকতের আধুনিকায়ন। নদনদী বিধৌত বরিশাল অঞ্চল এবং পার্শ্ববর্তী সুন্দরবনকে দেশ-বিদেশের পর্যটকদের কাছে আরও আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো। স্বরূপকাঠি-বানারীপাড়া অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী নৌকায় ভাসমান বাজারকে সারা বছর সচল রাখা।

৫. পোশাক শিল্প, চামড়া, জাহাজ নির্মাণ, ওষুধসহ বিভিন্ন শিল্প খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে আঞ্চলিক শিল্প নীতি প্রণয়ন। সমুদ্র ও নদনদীর মাছ, ফল, কৃষি পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের শিল্প বিশেষ বিবেচনায় রাখা।

৬. আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে জোর কদমে এগিয়ে যেতে দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টির জন্য বিশেষ পরিকল্পনা প্রণয়ন। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ব্রজমোহন কলেজ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানকে আঞ্চলিক অর্থনীতির বিকাশে দক্ষ মানবসম্পদ জোগানোর উপযোগী করে তোলা। পাঠ্য বিষয় নির্বাচনে আঞ্চলিক চাহিদা বিবেচনায় নেওয়া।

৭. বরিশালে রেললাইন চালু হয়নি ব্রিটিশ স্টিমার কোম্পানির সংকীর্ণ বাণিজ্য স্বার্থের কারণে– এটা হয়ত জনশ্রুতি। পদ্মা সেতুর কারণে বরিশাল বিভাগের ৬টি জেলায় রেল যোগাযোগ স্থাপনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। রেলপথ পরিবেশবান্ধব, ব্যয় ও সময় সাশ্রয়ী। পদ্মা সেতুর রেলপথ ঢাকা ও যশোরের বর্তমান রেলপথের (যমুনায় বঙ্গবন্ধু সেতু হয়ে) ৩৬০ কিলোমিটার দূরত্বকে কমিয়ে এনেছে ১৭২ কিলোমিটারে। ঢাকা-খুলনার দূরত্ব দাঁড়াবে ১৯০ কিলোমিটারে। কিন্তু বরিশাল যে এখনও 'কোন জেলায় রেলপথ নেই' যন্ত্রণায় দগ্ধ! কেবল জেলা নয়, এ কষ্ট বরিশাল বিভাগের ৬ জেলার। ঢাকা থেকে ১৮৫ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত বরিশাল সদর এ কালের দ্রুতগামী রেলগাড়িতে ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই পৌঁছে যাওয়া সম্ভব। পায়রা সমুদ্র বন্দরে যেতে সময় নেবে আরও ঘন্টা খানেক। এ নতুন পথে চলা যেন স্বপ্ন হয়ে না থাকে। ঢাকা-পদ্মা সেতু-খুলনা-যশোর রেলপথ বাংলাদেশকে ট্রান্স এশিয়া রেলপথের সঙ্গে যুক্ত করবে। এ পথের যথাযথ ব্যবহার বাংলাদেশকে আঞ্চলিক বিজনেস হাবে পরিণত করতে পারে। বরিশালের আগৈলঝাড়া ও হিজলায় দুটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা বিবেচনায় রয়েছে। যশোর ও খুলনা অঞ্চলেও এ ধরনের অঞ্চল প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন রয়েছে। কেবল অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানো নয়, রফতানি বাণিজ্য বাড়ানোর জন্যও এ ধরনের উদ্যোগ কাঙ্ক্ষিত।

৮. বরিশাল অঞ্চল শিক্ষায় এগিয়ে। বাংলাদেশের সর্বত্র এবং বিশ্বের নানা দেশে ছড়িয়ে আছেন এ অঞ্চলের কৃতীমানরা। 'বিশ্বের যেখানেই থাকুন, বরিশালের কাছে থাকুন'– এ আহ্বান পৌঁছে যাক সকলের কাছে। মেধা পাচার বা ব্রেন ড্রেন আমরা ঠেকাতে পারিনি। কিন্তু আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তি সুবিধা কাজে লাগিয়ে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশের কল্যাণে আমরা তাদের কাছ থেকে 'রিভার্স ব্রেনড্রেন' সুবিধা গ্রহণ করতে পারি। তারা এ অঞ্চলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থাকবেন, আধুনিক প্রযুক্তি জোগানে সহায়তা করবেন, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে উৎসাহ দেবেন।

৯. পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরুর পর নদী তীরের একদল কৃষকের কথা এখনও কানে বাজে– 'সেতু হইতেছে, খুব ভাল কাজ। শেখের বেটি আমাদের মান রাখছে। তবে যাই করেন– নদীটা রাইখেন।' পদ্মা সেতু যেন নদনদী স্রোতস্বিনী রাখার নিয়মিত কাজ মন্থর করে না দেয়। নদী প্রকৃতির দান, নদীপথ সৃষ্টিতে সরকারের অর্থ ব্যয় হয় না। এ পথে নৌযান চলে কম ব্যয়ে। সেচের জন্য পানি মেলে। মাছের অভয়ারণ্য নদনদী পরিবেশ রক্ষা করে। বন্যার হাত থেকে বাঁচায়। বরিশাল অঞ্চলের এ মহামূল্যবান এ সম্পদ আমাদের বাঁচিয়ে রাখতেই হবে। বরিশাল শহর প্রাচ্যের ভেনিস নামে অভিহিত হতো। শহরের বুক চিরে এক সময় চলাচল করত বড় বড় মালবাহী নৌকা। বরিশালের একদল ছাত্রছাত্রী এক আলোচনায় তাদের স্বপ্নের কথা বলেছিল এভাবে– 'আমরা দেখতে চাই, বরিশালের বুক চিরে চলুক জাহাজ।' শহরের বিভিন্ন খালে বর্ণিল নৌযানে ঘুরে বেড়াতে পদ্মা সেতু পথে আসবে দেশের নানা প্রান্তের, এমনকি ভিন দেশের পর্যটক। নৌপথেই তারা চলে যাবেন ধানসিঁড়ি নদীতে, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের চাখারের বাড়িতে, গুঠিয়ার মসজিদে, গৈলায় বিজয় গুপ্তের মনসা মন্দিরে, কুড়িয়ানা-ভীমরুলির পেয়ারা-আমড়া বিক্রির 'জলের হাট-বাজারে', উজিরপুরের শাপলার বিলে।

১০. খুলনা-বরিশাল অঞ্চলে দারিদ্র্যর হার জাতীয় গড়ের তুলনায় অন্তত ১০ শতাংশ বেশি। পদ্মা সেতুর কারণে আঞ্চলিক পর্যায়ে দারিদ্র্যের হার ১.০১ শতাংশ এবং জাতীয় পর্যায়ে ০.৮৪ শতাংশ কমবে। জিডিপি বাড়বে ১.২ শতাংশ। ২০২২ সালে জিডিপির পরিমাণ ছিল প্রায় ৪০০ বিলিয়ন ডলার। পদ্মা সেতুর কারণে এটা বাড়বে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার। এর সঙ্গে তুলনা টানা যায় এভাবে– ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে বাংলাদেশ ৭.১ বিলিয়ন ডলার বিদেশি ঋণ-অনুদান পেয়েছে এবং পরিশোধ করেছে ১.৯১ বিলিয়ন ডলার। নীট বৈদেশিক সাহায্য এসেছে ৫.২ বিলিয়ন ডলার। পদ্মা সেতুর সম্ভাবনা পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগাতে পারলে জিডিপিতে আরও বেশি অবদান জোগানো সম্ভব হবে, এমনই অভিমত উদ্যোক্তা ও অর্থনীতি সংশ্লিষ্টদের।

১১. সমৃদ্ধির পথে চলতে হলে জমিতে হাত পড়বেই। সড়ক, রেলপথ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কারখানা, হাসপাতাল, হোটেল, অবকাশ কেন্দ্র যা কিছুই করা হোক না কেন টান পড়বে কৃষি জমিতে। কিন্তু নদনদী যেমন বরিশালের জীবন, তেমনি জমিও। এ জমির পরিমিত ও যৌক্তিক ব্যবহার করা চাই। আমরা এক ইঞ্চি জমি যেমন খালি রাখব না, তেমনি জমির সামান্য অপচয়-অপব্যবহারও করব না।

১২. বরগুনা-পটুয়াখালীকে কেন্দ্র করে সমুদ্র অর্থনীতিতে গতি আনায় পরিকল্পনা প্রণয়ন।

১৩. অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি পরিবেশ রক্ষার প্রতিও মনোযোগী হতে হবে। কীর্তনখোলা, পায়রা, সুগন্ধা বা আগুনমুখা-তুষখালী নদী যেন বুড়িগঙ্গা-শীতলক্ষ্যা-তুরাগের মতো দূষিত হয়ে না পড়ে, সেটা নিশ্চিত করতেই হবে। এটা ভুললেও চলবে না যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে বরিশাল-খুলনা অঞ্চল।

১৪. শিল্প স্থাপন, শিক্ষা-স্বাস্থ্যসেবার প্রসার, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার পরিবেশ উন্নত করা, পর্যটন আকর্ষণীয় করা– সবকিছুর অপরিহার্য শর্ত আইন শৃঙ্খলা ভাল রাখা। এ দায়িত্ব প্রশাসন ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর, স্থানীয় সরকারের, রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের এবং সর্বোপরি সমাজের। সড়ক ও নৌ পথের শৃঙ্খলা রক্ষার মতোই গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে অপরাধের প্রতি জিরো টলারেন্স। আইন শৃঙ্খলা পরিবেশ ভাল থাকলে মানুষ শান্তিতে ঘুমাতে পারবে এবং যতক্ষণ জেগে থাকবে– নির্বিঘ্নে কাজ করে যাবে স্বপ্ন পূরণের জন্য।

পদ্মা সেতু হচ্ছে ইচ্ছা পূরণের উপাখ্যান। এ সেতু স্বর্ণালী সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। বরিশাল অঞ্চল এ সেতুর সুবিধা কাজে লাগিয়ে নতুন যুগে প্রবেশ করবে, সন্দেহ নেই। বাংলাদেশের গৌরবের মুক্তিযুদ্ধে বরিশাল অঞ্চলের ছিল অনন্য অবদান। ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকায় গণহত্যা অভিযান শুরু করে। কিন্তু এরপরও এক মাস বরিশাল ছিল মুক্ত এলাকা। এ জেলার আগৈলঝাড়া-গৌরনদী এলাকায় গড়ে উঠেছিল অজেয় মুক্তিবাহিনী। পঞ্চাশের দশকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল বরিশাল। তার প্রতিটি মুহূর্ত ছিল গোয়েন্দা নজরদারিতে। সম্প্রতি প্রকাশিত গোয়েন্দা রিপোর্টগুলোতে দেখা যায়– তিনি ঢাকা বা নারায়ণগঞ্জ থেকে স্টিমারে যতবার গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, খুলনা ও যশোরে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে গিয়েছেন এবং এ পথে ঢাকা ফিরেছেন, যতবার টুঙ্গিপাড়ায় নিজ বাড়িতে যাতায়াত করেছেন– যাত্রাবিরতি হয়েছে বরিশালে। স্টিমার বরিশাল শহরে ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করত। এ সময়ে তিনি বরিশালের রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করতেন। রিকশায় বা হেঁটে চলে যেতেন ছোট বোন আমেনা বেগম ও ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাতের কালীবাড়ি রোডের বাসায়। প্রায় আড়াই বছর দুঃসহ কারাজীবন ভোগ করে ঐতিহাসিক একুশের আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে অনশন ধর্মঘট পালনের পর ১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি মুক্তিলাভ করে গোপালগঞ্জ থেকে ঢাকা যাওয়ার পথে তিনি প্রথম সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন বরিশাল শহরে। দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছিলেন– বাংলা রাষ্ট্রভাষা হবেই। জেল থেকে মুক্তির পরপরই সারা দেশে পুলিশের কাছে বার্তা ছিল– 'শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর সর্বক্ষণ নজর রাখতে হবে। ফের বেআইনি কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হলে তাকে গ্রেফতার করতে হবে।' [গোয়েন্দা প্রতিবেদন, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৪৬] বরিশাল থেকে ঢাকা যাওয়ার পরেই তার ওপর অর্পিত হয় আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব। এই গুরুদায়িত্বের সূত্র ধরেই তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন। নেতৃত্ব প্রদান করেন মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে।

বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিধন্য বরিশাল শহর এবং আশপাশের অঞ্চল এখন নতুন সম্ভবনার সামনে দাঁড়িয়ে। কৃষি-শিল্প-শিক্ষা-সংস্কৃতিতে অনন্য উচ্চতায় উঠে যাবে কীর্তনখোলা-ধানসিঁড়ির বরিশাল, প্রাচ্যের ভেনিস হয়ে উঠবে এ যুগের জলে ভাসা পদ্ম পাতার মতো প্রিয় শহরটি। আমরা আনন্দে গেয়ে উঠব– 'আমার সকল কাঁটা ধন্য করে ফুটবে ফুল ফুটবে। আমার সকল ব্যথা রঙিন হয়ে গোলাপ হয়ে ফুটবে।' ধানসিঁড়ি নদীর এলাকাকে উন্নত-সমৃদ্ধ-গৌরবের জনপদে পরিণত করার জন্য আসুন প্রত্যেকে উজাড় করে দিই, যার যা আছে তা কাজে লাগিয়ে। পদ্মা সেতু নির্মাণ যে কোনো মানদণ্ডেই মহৎ কর্মযজ্ঞ। তবে এটা হচ্ছে আরও অনেক বড় লক্ষ্য– দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিস্তীর্ণ জনপদের উন্নয়নের পথে চলার গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। নিশ্চিতভাবেই আমরা এ ধারায় দেখতে থাকব একের পর এক দূরদর্শী, সৃষ্টিশীল ও সংকল্পবদ্ধ পদক্ষেপ।

জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।