স্বপ্নের সেতু যখন দৃশ্যমান

তৌহীদ রেজা নূর
Published : 24 June 2022, 06:15 PM
Updated : 24 June 2022, 06:15 PM

প্রমত্তা পদ্মা নদীর দুই তীর সংযোগকারী দ্বিতল পদ্মা সেতুর বাস্তবে রূপ লাভ এক যুগান্তকারী ঘটনা নিঃসন্দেহে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ অসাধ্য সাধনের সমতুল্য এক মহা কর্ম সম্পাদন করে মূলত সেই সকল শক্তি ও কুশীলবদের মুখে ঝামা ঘষে দিয়েছে যারা বাংলাদেশকে নানা কৌশল বাতলে 'দাবায়ে রাখতে' চায়। পদ্মা সেতু নির্মাণ আলাপের গভীরে যাবার আগে কিছু বিষয় স্মরণে রাখা দরকার।

এক.

বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে যখন এই বদ্বীপের মানুষ পাকিস্তানি অবাঙালি শাসক ও শোষক এবং তাদের এদেশিয় তাবেদারদের বিরুদ্ধে একাট্টা হয়ে উঠছিল, তখন একটি শ্লোগান ছিল মুক্তিকামী মানুষের মুখে মুখে– "তোমার আমার ঠিকানা – পদ্মা মেঘনা যমুনা"। নদী বিধৌত বাংলাদেশের সীমারেখা এক লাইনে চিহ্নিত করতে এর চাইতে সুন্দর প্রকাশ আর কী হতে পারে?

বাস্তবতই, 'এক সাগর রক্তের বিনিময়ে' বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটি পৃথিবীর কোলে জন্ম লাভ করল ১৯৭১ সালে। এর জন্মলগ্ন থেকেই শিশু বাংলাদেশ রাষ্ট্রটিকে আঁতুড় ঘরেই নিঃশেষ করে দেবার প্রচেষ্টা ছিল– যার অনেকখানি সম্ভব হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা এবং এই নৃশংস হত্যাযজ্ঞের অনধিক তিন মাসের মধ্যে তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ চার জাতীয় নেতাকে কারাগারের অভ্যন্তরে হত্যার মাধ্যমে। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকতেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভয়ানক অবজ্ঞা করে বাংলাদেশকে ভিক্ষার থালা হাতে চলমান একটি দেশ হিসেবে অভিহিত করেছিল। যে আদর্শের ওপরে ভিত্তি করে বাংলাদেশের জন্ম– তা সম্পূর্ণভাবে নস্যাৎ করার দেশী-বিদেশী নানা উদ্যোগ দীর্ঘ সময় ধরে অব্যাহত থাকলেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশকে সম্পূর্ণভাবে নিঃশেষ করতে পারেনি। ১৯৭৫ সালের ভয়াবহ ট্র্যাজেডির সময় দেশের বাইরে থাকার কারণে প্রাণে বেঁচে যাওয়া বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আসার পরে শেখ হাসিনা হাল ধরেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের। নানা প্রতিকুলতা ও নিরবচ্ছিন্ন মৃত্যু ঝুঁকির মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ হাসিনা নিজেকে একজন আস্থাশীল নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। সময়ান্তে দেশের প্রধানমন্ত্রীর পদ অলংকৃত করলে তিনি যে একজন দক্ষ প্রশাসক তা ক্রমশঃ সুস্পষ্ট হয় এবং এরই ধারাবাহিকতায় তার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে দক্ষিণ এশিয়া এবং আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অঙ্গনে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। শেখ হাসিনার দৃঢ়চেতা নেতৃত্ব বিশ্ব আঙিনায় একদিকে যেমন প্রশংসিত হয়, অন্যদিকে বাংলাদেশকে হীনবল করার জন্য যে সকল কুশীলবেরা দেশে-বিদেশে তৎপর রয়েছেন, তাদের চক্ষুপীড়ারও কারণ হয়। নানা হিসেব-নিকেশের বশবর্তী হয়ে ব্যক্তি এবং নেতা শেখ হাসিনাকে এই গোষ্ঠী সহ্য করতে পারে না, অপছন্দ করে। তাই শেখ হাসিনার কৃত যে কোনও কর্মদ্যোগ, রাষ্ট্রের স্বার্থে নেয়া নানা সাহসী পদক্ষেপ, নানা কাজের সফলতা, কোনটাতেই তারা খুশি হন না, স্বস্তি পান না। একেবারে সেই বাংলা প্রবাদ বাক্যের মতো– "যারে দেখতে নারি – তার চলন বাঁকা"! কোনও কাজের গঠনমূলক সমালোচনা সর্বদাই প্রত্যাশিত কিন্তু শেখ হাসিনা কৃত সকল ভালো কাজের ক্ষেত্রেই আমরা দেখি ওই গোষ্ঠী কখনো জোর কন্ঠে, কখনো ইনিয়ে বিনিয়ে নানাভাবে এবং নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রকাশ করতে থাকেন তাদের অন্তর্জ্বালা এবং আক্রমণের মূল লক্ষ্য থাকেন বঙ্গবন্ধুকন্যা ও তার দল আওয়ামী লীগ। ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখব যে প্রায় একই ধরনের গোষ্ঠীর আক্রমণের শিকার হয়েছেন বঙ্গবন্ধু ও তার আওয়ামী লীগ।

দুই.

মনে পড়ছে বিপুল জলরাশি বুকে নিয়ে ক্ষিপ্র গতিতে বহমান প্রমত্তা পদ্মা নদী পাড়ি দিয়েই ছেলেবেলায় আম্মা ও বড় ভাইয়ের সাথে প্রতি বছর ডিসেম্বর মাসে আমরা দাদা বাড়ি যশোরে (বর্তমানে মাগুরা জেলা) এবং নানা বাড়ি ফরিদপুরে বেড়াতে যেতাম। পদ্মা পার হলেই বৃহত্তর ফরিদপুরের সীমানা শুরু হয় এবং ফরিদপুর শহরকে পাশ কাটিয়ে আরো এগিয়ে গেলে যশোরের মাগুরা, শালিখা হয়ে চিত্রা নদীর তীরে আমাদের গ্রাম শরুশুনায় হাজির হওয়া যায়। তাই ঢাকা থেকে সফরে বেরিয়ে পড়লে প্রথমে আমরা দাদা বাড়ি যেতাম। ফেরার পথে নানা বাড়ি বেড়িয়ে সব মিলিয়ে টানা এক মাস থাকার পরে ঢাকায় ফিরতাম আমরা। আম্মার সাথে শাহীদ, জাহীদ ও আমি বেড়াতাম– আর বড় ভাই আমাদের পৌঁছে দিয়ে আবার এক মাস পরে ফরিদপুরে হাজির হতেন আমাদের ঢাকায় ফিরিয়ে আনার জন্যে। স্কুলে থাকতে এটি ছিল আমাদের রুটিন সফর। স্কুলের কড়ি কাঠ পেরুবার পর অনিবার্য কারণে প্রতি বছরে এই যাতায়াত অব্যাহত রাখা সম্ভব ছিল না। কিন্তু বেড়াতে না গেলেও কাজের সূত্র ধরে বিভিন্ন সময়ে পদ্মা নদী পার হতে হয়েছে।

মনে পড়ে, আমাদের বহনকারী বাস ঢাকা থেকে পদ্মা নদী পার হবার জন্য আরিচা ঘাটে আসার আগে নয়ার হাট এবং তরার ঘাট নামক দুই জায়গায় সেতু না থাকার কারণে আরও দুটি নদী অতিক্রম করত। এখানেই শেষ নয়। পদ্মা পাড়ি দেবার পরে আমাদের দাদা বাড়িতে পৌঁছাতে হলে আরো তিন জায়গায় যথাক্রমে কামারখালি, আড় পাড়া এবং আমাদের শরুশুনা গ্রামের সীমান্তে তিনটি শাখা নদী পার হতে হতো। এক কথায় খুব ভোরে রওনা হয়ে নদীর পরে নদী পাড়ি দিয়ে যাত্রাপথ সুপ্রসন্ন হলে ঠিক গোঁধুলিলগ্নে গিয়ে বৈদ্যুতিক বাতিহীন এক অজপাড়াগাঁ শরুশুনায় গিয়ে পৌঁছাতে পারতাম আমরা। সময়ান্তে নয়ার হাট ও তরার ঘাটে সেতু হয়ে যাবার কারণে আরিচা পৌছাবার সময় হ্রাস পায় অনেকখানি। মূল ঝঞ্ঝাট হতো পদ্মার পাড়ে এসে। দুভাবে পার হবার ব্যবস্থা থাকত– লঞ্চ পারাপার এবং ফেরি পারাপার। আরিচা ঘাটে পৌঁছেই ফেরি ধরা যাবে কিনা সেটি ছিল সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়। বেশির ভাগ সময়েই দেখতাম আমরা পৌঁছবার একটু আগেই গাড়ি বোঝাই ফেরি ঘাট ছেড়ে যাচ্ছে। পদ্মার ঢেউ কেটে এগিয়ে চলা ফেরির দিকে তাকিয়ে ছেলেবেলায় হাত নেড়ে বিদায় জানাতাম আর আনন্দে মাতোয়ারা হতাম। কিন্তু অন্যদিকে আমাদের বাস ফেরিতে উঠতে আরও কত সময় লাগবে সেই অজানা আশংকায় তখন আম্মা এবং বড় ভাইয়ের মুখ ভারী হয়ে উঠত। বয়স বাড়ার সাথে সাথে অনুধাবন করেছি পদ্মা পারাপারে কি ভয়ানক ঝঞ্ঝাট ও ঝক্কি। ধীরে ধীরে সেতু তৈরি হলো তরার ঘাটে, নয়ার হাটে, কামার খালিতে এবং আড় পাড়ায়। শুধু প্রমত্তা পদ্মা পাড়ি দেবার জন্য ফেরি এবং লঞ্চই হলো একমাত্র ভরসা। এর মধ্যে মেঘনা নদীর ওপর সেতু নির্মাণ হয়েছে, যমুনা নদীর ওপরেও হয়েছে সেতু কিন্তু পদ্মার দুপার সংযোগকারী কোনও সেতু হবে এই স্বপ্ন বাংলাদেশের মানুষ দেখলেও করার ভাবনাটি বাস্তবায়ন করা ছিল সুদূর পরাহত। কারণ, পানি প্রবাহের ক্ষিপ্রতার দিক থেকে আমাজন নদীর পরেই পদ্মা নদীর স্থান। তাই পদ্মা নদীর ওপরে সেতু করতে হলে অনেক কিছু বিবেচনায় রাখতে হবে।

তিন.

আমরা সকলেই জানি প্রায় সোয়া ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতু নির্মাণে যে অর্থ ব্যয় হওয়ার কথা তা দীর্ঘমেয়াদী ঋণ হিসেবে দেবার জন্য বিশ্ব ব্যাংক আগ্রহ দেখানোয় বাংলাদেশ সরকার নিয়ম মেনে এ ব্যাপারে চুক্তি সম্পাদনের প্রক্রিয়া অনুসরণ করার প্রায় সূচনাপর্বেই আকস্মিকভাবে বিশ্বব্যাংক সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনে। পরবর্তীতে দুর্নীতির অভিযোগ বহাল রেখে ২০১২ সালের ২৯ জুন বিশ্ব ব্যাংক পদ্মা সেতুর জন্য বাংলাদেশ সরকারকে কোনও ঋণ দেবে না ঘোষণা দিয়ে সরে দাঁড়ায়। ঋণ ছাড় করার আগে ঋণচুক্তি বাতিলের নজির নেই। বিশ্বব্যাংক এই উদ্যোগের শুরু থেকে চুক্তি বাতিল ঘোষণা দেয়া পর্যন্ত দেড় বছর সময়ক্ষেপণ করেছে, যার কারণে পদ্মা সেতু নির্মাণের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ১৮ মাস তো পিছিয়েছেই– সাথে সাথে নিজেদের অর্থায়নে সেতু করার সিদ্ধান্ত নিয়ে তা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু করতে করতে আরও সময়ক্ষেপন হয়েছে।

দেশে দেশে বিশ্ব ব্যাংক বিভিন্ন মেগা প্রকল্পে নানা শর্তের আওতায় অর্থলগ্নী করে যা বাইরে থেকে খুব সহজ মনে হলেও আদতে তা নয়। বরং চুক্তিতে উল্লেখিত নানা শর্তের খপ্পরে পড়ে ঋণগ্রহীতা দেশ সমায়ান্তে আরও বিপদগ্রস্ত হয়। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, বিশ্ব ব্যাংক অথবা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আর্থিক প্রতিষ্ঠান শুধু নয় বরং 'গভীর স্বার্থসংশ্লিষ্ট এক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান' যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ উত্তর গোলার্ধের ধনী দেশসমূহের স্বার্থ রক্ষা করে। অনুন্নত/উন্নয়নশীল দেশে বিশ্ব ব্যাংক বা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল নানা শর্তের আওতায় দীর্ঘমেয়াদী যে ঋণ দেয় তা দিয়ে ঋণ গ্রহীতা রাষ্ট্র স্বনির্ভর হতে পেরেছে এমন নজির খুব একটা নেই।

তাই পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পের ক্ষেত্রে বিশ্ব ব্যাংকের দিক থেকে সহায়তা না করে পিছিয়ে পড়ার ঘোষণা এক অর্থে জাতি হিসেবে আমাদের জন্য শাপে বর হয়েছে। অবশ্য এই 'শাপ'-কে 'বর'-এ রূপান্তরিত করার মুখ্য কৃতিত্ব বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। কেননা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু তৈরির উদ্যোগের বিরুদ্ধে দেশে এবং দেশের বাইরে বিদ্যমান নানা উল্টো স্রোতকে থোড়াই কেয়ার করে শেখ হাসিনা ঋজু ভঙ্গিতে ঘোষণা দেন যে, বাংলাদেশ নিজস্ব সামর্থ্যেই নির্মাণ করবে পদ্মা সেতু। দুর্নীতি করার কুৎসা রটিয়ে, মিথ্যাচার করে, দেশ ও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করে বিশ্ব ব্যাংক সরে গেছে – সরে যাক, আমরা আমাদের টাকা দিয়েই পদ্মা সেতু করব– এই পরিষ্কার বার্তা উচ্চারণ করে বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশপ্রেমিক জনগণকে পাশে থাকার আহবান জানালেন যা ছিল বিশ্ব মোড়ল এবং বিশ্ব ব্যাংকের তাবেদার গোষ্ঠীর জন্য এক চরম চপেটাঘাত। ওই সময়ে বাংলাদেশের সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবী এবং রাজনীতিবিদদের প্রায় সকলের কাছে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ভাবনা ছিল 'কল্প কাহিনী' সদৃশ। তারা বিশ্বাস করতেন এবং প্রচার করতেন বিশ্ব ব্যাংকের মতো অর্থলগ্নীকারী বড় প্রতিষ্ঠানের সহায়তা ও আশীর্বাদ ছাড়া এ ধরনের মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়।

চার.

ওই সময়কার পরিস্থিতি ছিল দারুণ জটিল। একদিকে নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণ করার সম্ভাবনা বিষয়ে ভাবনা চিন্তা শুরু হয়, আর অন্যদিকে বিশ্ব ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানের সহায়তা ছাড়া নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করা কখনোই সম্ভব নয় বরং এ এক অলীক কল্পনা মাত্র– এই বার্তা দিতে থাকে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি এবং অন্য রাজনৈতিক দল। এর সাথে যোগ দেয় অর্থনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজের একটি বড় অংশ যারা দেশ নয়, বিশ্ব ব্যাংকের মর্যাদা ও স্বার্থ রক্ষায় নানা বুলি আউড়াতে থাকে, নানা তত্ত্ব-তথ্য হাজির করতে থাকে।

এমন এক সময়ে বিশ্ব ব্যাংক পদ্মা সেতু নির্মাণে সহায়তা দেবার চুক্তি বাতিল করে যখন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ সরকার দেশে ও দেশের বাইরে নানা বিরুদ্ধ শক্তিকে মোকাবেলা করে যুদ্ধাপরাধী এবং একাত্তর সালে মানবতার বিরুদ্ধে যারা অপরাধ করেছে তাদের বিচার প্রক্রিয়া এগিয়ে নেবার কাজে নিয়োজিত ছিল। এই সময়ে একাদিক্রমে দুটি নেতিবাচক উদ্যোগ সক্রিয় ছিল: ১) পদ্মা সেতুতে সহায়তা দেবার প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে বিশ্বব্যাংক সারা বিশ্বের সামনে বাংলাদেশের তথা ক্ষমতাসীন হাসিনা সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করার অপচেষ্টা করছিল; ২) পরোক্ষভাবে জাতিসংঘ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমে বাংলাদেশে চলমান বিচার প্রক্রিয়া আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন নয় এমন অভিযোগ তুলে এই ট্রাইবুন্যালের রায় মানা হবে না বলে বাংলাদেশ সরকারের ওপরে কঠিন চাপ প্রয়োগ করছিল যাতে এই ঐতিহাসিক বিচার প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হয় ও মাঝপথে বন্ধ করে দিতে সরকার বাধ্য হয়। এই সকল অপচেষ্টা বেগবান করতে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের পক্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যে বিশাল অংকের টাকা বিনিয়োগ করে লবিস্ট নিয়োগ করেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি ও তাদের সমর্থনকারী গোষ্ঠী।

এই সংকটাপন্ন আবহে ২০১২ সালের ১৯ জুলাই এক সেমিনারে প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাত সেতু নির্মাণের বহুমাত্রিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে তার গবেষণালব্ধ পেপার উপস্থাপনের মাধ্যমে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মানের নৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, প্রায়োগিক দিক বিশ্লেষণ করে জোরের সাথে বলেন যে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব। বিশ্লেষণমূলক এই আলোচনা নিজেদের শক্তিতে পদ্মা সেতু তৈরির বিষয়ে সমাজে সৃষ্ট নানা নেতিবাচক গুমোট ধুম্রজাল ছিন্ন করতে ভূমিকা রাখে। তবে আগেই উল্লেখ করেছি এর চেয়েও মুখ্য ভূমিকা রাখে নিজ শক্তিতে পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে বঙ্গবন্ধুকন্যার সুস্পষ্ট ঘোষণা যার ফলে এই সেতু নির্মাণের আকাঙ্ক্ষা জনদাবিতে রূপান্তরিত হয়। আরও পরিষ্কার করে যদি বলি, বিশ্ব ব্যাংকের এই সিদ্ধান্তের বিপরীতে বঙ্গবন্ধুকন্যা নিজেদের অর্থে পদ্মা সেতু তৈরির ঘোষণা করার ফলে দেশে এবং দেশের বাইরে বাংলাদেশি জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই স্বপ্নকে ঘিরে (স্বার্থান্বেষী, সুযোগসন্ধানী মহল এবং নাগরিক/ব্যক্তিবর্গ বাদে) অভূতপূর্ব সাড়া মেলে যার ফলে জাতীয় ঐক্য তৈরি হয়। দেশে এবং বিদেশে পদ্মা সেতুর অর্থ সংস্থানের জন্য যে যার সাধ্যমত স্বতঃস্ফূর্তভাবে অনেকেই এগিয়ে আসতে থাকে। জনগণের সংশ্লিষ্টতা এবং এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যার অদম্য মনোভাবের কারণে আত্মশক্তিতে বলীয়ান এই মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার সূচনা হয়।

অদম্য সাহসী পিতার রক্ত বইছে কন্যা শেখ হাসিনার ধমনীতে। মুক্তিযুদ্ধে বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে বিশ্ব ব্যাংকের নেতৃত্বে দাতা দেশগুলো বৈদেশিক সাহায্য দিতে এগিয়ে এলে শর্ত জুড়ে দিয়েছিল যে পূর্ব পাকিস্তানের বকেয়া ঋণ শোধ করার দায়িত্বও নিতে হবে নবজাত বাংলাদেশকে। বঙ্গবন্ধু স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছিলেন তাদের যে, এ ধরনের শর্তে বাংলাদেশ কোনও সাহায্য নেবে না এবং তারা এই শর্ত থেকে সরে না দাঁড়ালে ফিরে যেতে পারেন। বাবার মতন কন্যাকেও আমরা দেখি পদ্মা সেতুকে ঘিরে বিশ্ব ব্যাংকের নানা কূটকৌশল ও অপচেষ্টার বিরুদ্ধে শির খাড়া করে দাঁড়াতে।

পাঁচ.

শেখ হাসিনার সময়ে বাংলাদেশ বহুমুখী ও দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নের ধারা চালু রয়েছে এবং সময়ান্তে একের পর এক সেই সকল প্রকল্পের ফল আমর দেখব দেশব্যাপী।

শেখ হাসিনা এখন একজন জননন্দিত বিশ্বনেত্রী যিনি অত্যন্ত সাহসী, অদম্য এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। বিস্মিত হতে হয় এ কথা ভাবলে– যে মানুষটির বিশ্বনন্দিত, জননন্দিত পিতা, স্নেহময়ী মা, প্রাণপ্রিয় তিন ভাই, দুই ভাইয়ের সদ্য বিবাহিত স্ত্রীরা এবং বৃহত্তর পরিবারের আরও অনেক সদস্য নৃশংস হত্যার শিকার হয়েছেন, তিনি সেই সকল দুর্বহ যন্ত্রণা মনের মধ্যে লালন করে, সর্বক্ষণ মস্তিষ্কে বহন করে, সমস্ত ধরনের হত্যার ঝুঁকি মোকাবিলা করে সারা জাতির জন্য নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে চলেছেন।

কত ধরনের উল্টোস্রোত মোকাবেলা করে এবং চাপ অগ্রাহ্য করে তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার সম্পন্ন করতে পেরেছেন, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের একটি বড় অংশকে বিচারের আওতায় এনেছেন যে বিচার প্রক্রিয়া এখনো চলমান রয়েছে। জেনোসাইডের শিকার মায়ানমার প্রত্যাগত রোহিঙ্গাদেরকে বাংলাদেশে আশ্রয় দেওয়ার সিদ্ধান্ত এবং নিরবচ্ছিন্নভাবে তাদের সহায়তা প্রদান করে যাওয়া একটি মাইলফলক ঘটনা। বীরাঙ্গনাদেরকে মুক্তিযোদ্ধার পরিচয়ে পরিচিত করিয়েছেন এবং তাদের জন্য ভাতা-ব্যবস্থা চালু করেছেন। তাদের কেউ মৃত্যুবরণ করলে মরদেহ জাতীয় পতাকায় মুড়ে বিউগলের করুণ সুর বাজিয়ে যথাযথ অভিবাদন জানিয়ে দাফন করানো হয় এখন।

এখন শিক্ষা, চাকুরি, ব্যবসার জন্য নিজের পরিচয় দিতে গেলে বাবার সঙ্গে মায়ের নাম উল্লেখ করতে হয়– পৃথিবীর অনেক দেশেই এখনো যে নিয়ম চালু করা সম্ভব হয়নি। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য অনেক সুপরিকল্পিত কাজ/উদ্যোগ চলমান রয়েছে, যা আমাদের কোনও সরকার কখনোই করেনি। এই সরকারের আমলে আশ্রয়ন প্রকল্প দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য একটি বড় উদ্যোগ।

এমন একটি সময় ছিল বাংলাদেশে যখন ঢাকা শহরসহ মফস্বল শহরে দিনে এবং রাতে প্রচণ্ড গরমের মধ্যে বিদ্যুতের সরবরাহ না থাকায় বৈদ্যুতিক বাতিহীন কাটাতে হতো ঘন্টার পর ঘন্টা। 'লোডশেডিং' ছিল সবচেয়ে পরিচিত শব্দ– যেন আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ। এখন আলো ঝলমল করে ঢাকা এবং দেশের বিভিন্ন প্রান্ত, লোডশেডিং বলে কিছু নেই। এত শপিংমল, বহুতল ভবন, রাস্তায় সুন্দর বাতি, নিয়ন বাতি, বড় বড় অফিসে বাতি, ঘরে ঘরে ফ্রিজ, টেলিভিশন, কম্পিউটার, সেল ফোন, এয়ারকন্ডিশন, চলন্ত সিঁড়ি, লিফট– কত কিছু যোগ হয়েছে জনজীবনে যা বিদ্যুতে চলে। এক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু কন্যা আমাদেরকে একটি জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছেন। মেট্রোরেল চালু হবে অদূর ভবিষ্যতে– সে ব্যাপারে চলছে ব্যাপক আয়োজন।

ছয়.

মহা ঝঞ্ঝাট সামাল দিয়ে, সংগ্রাম করে পদ্মা পাড়ি দিয়ে ওপারের জেলাগুলোতে যাবার অভিজ্ঞতা হয়েছে আমাদের সেই ছেলেবেলা থেকে। কিন্তু বাঁধা অতিক্রম করে স্বপ্নের পদ্মা সেতু দৃশ্যমান এখন– মাত্র ছয় থেকে সাত মিনিটে আমরা পার হয়ে যাবো প্রমত্তা পদ্মা নদী। ভাবা যায়! পদ্মা সেতু তৈরির সূচনালগ্ন থেকে এই সেতুকে ঘিরে বাংলাদেশে যে অপরাজনীতি ও অপসংস্কৃতির চর্চা আরম্ভ হয়েছিল– আবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করছি এই স্বপ্নের সেতুর নির্মাণ কাজ হয়ে যাবার পরেও সেই অপচর্চা সোৎসাহে অব্যাহত রেখেছেন সেই একই গোষ্ঠী। বাংলা ভাষায় একটি প্রবাদ আছে, 'দুর্জনের ছলের অভাব হয় না'। সে কাজটাই করে চলেছে বিএনপি এবং এই দলের সাথে সুর মেলাতে বাম-ডান ঘরানার অন্যান্য দলের নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের এক বিরাট অংশ। সাথে আছেন বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজের মানুষজনও। সত্যি খুব দুঃখজনক যে, আমাদের দেশে যে কাজে রাষ্ট্রের সম্মান বাড়ে অথবা রাষ্ট্রীয় স্বার্থ সংরক্ষিত হয়– সে কাজের প্রশংসা করতে ঘোর আপত্তি ওনাদের। এতই যদি আপত্তি তাহলে প্রশ্ন জাগে, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে যাতায়াতের সময় এই অসন্তুষ্ট ব্যক্তিবর্গ কি পদ্মা সেতু ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকবেন? কখনোই বিরত থাকবেন না, বিরত থাকা সম্ভব নয়– তাদের এই সকল অপ্রত্যাশিত, অসংস্কৃত আচরণের দিকে ইঙ্গিত করে বলা দরকার, 'সেই তো নথ খসালি – তবে কেন লোক হাসালি!'

সাত.

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আত্নমর্যাদার প্রতীক এই পদ্মা সেতুর নাম 'শেখ হাসিনা সেতু' রাখার প্রস্তাব করেছিলেন অনেকেই। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকন্যা তার নিজের নামে এই সেতুর নামকরণ করেননি বরং 'পদ্মা সেতু' বহাল রেখেছেন। আমরা সকলেই জানি কী সংকটময় পরিস্থিতিতে বিশ্ব মোড়ল প্রতিষ্ঠানের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে শেখ হাসিনা এই সেতু নির্মাণে বদ্ধপরিকর থেকেছেন। সেতুর নাম বঙ্গবন্ধুকন্যার নামে না হলেও সকল প্রতিবন্ধকতা ও অপচেষ্টার জাল ছিন্ন করে পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের সাহসী ইতিবৃত্ত পদ্মা সেতুর দুই প্রান্তে সুলিখিত বাক্যে বর্ণিত থাকা দরকার যাতে অনাগত ভবিষ্যতের ছেলেমেয়েরা এখানে এসে জানতে পারে কত প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে শির উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এই পদ্মা সেতু। যেন তারাও অনাগত ভবিষ্যতে এই গর্বের অংশীদার হতে পারে। যেন তারা এই ঐতিহাসিক স্থাপনার দিকে তাকিয়ে দ্বিধাহীন চিত্তে বলে উঠতে পারে, 'জয়তু শেখ হাসিনা'।