কবি নজরুল কেন ‘পদ্মা সেতুর বিরোধিতা’ করেছিলেন?

মাজহার সরকারমাজহার সরকার
Published : 24 June 2022, 11:49 AM
Updated : 24 June 2022, 11:49 AM

আইরিশ কবি জেমস জয়েস (১৮৮২-১৯৪১) তার নাতি স্টেফিন জয়েসের কাছে একটি চিঠি লিখেছিলেন ১৯৩৬ সালে। চিঠিতে একটি ফরাসি লোকগল্প বলেন জয়েস, যার কাহিনি ফ্রান্সের সবচেয়ে দীর্ঘ নদী লোয়ারের ওপর সেতু নির্মাণ নিয়ে।

লোয়ারের তীরে ছোট্ট শহর বুজেনসি। মানুষ নৌকায় করে নদী পার হতো, কখনও তা-ও পাওয়া যেতো না। একটা নৌকা ঘাট ছেড়ে গেলে আরেকটা নৌকার জন্য পথ চেয়ে বসে থাকতে হতো। নদীর ওপর ছিল না কোন সেতু। মেয়র আলফ্রেড বার্নের সঙ্গে দেখা করে লোয়ার নদীর ওপর সেতু বানিয়ে দিতে চাইলো এক দৈত্য। জানালো, এমন এক সেতু বানাবে সে যা এর আগে কেউ কোনদিন দেখেনি এবং এটা সে বানাবে মাত্র এক রাতে। দৈত্যের কাছে মেয়র জানতে চাইলো এমন সেতু তৈরি করতে তার কতো টাকা চাই। 'কোন টাকা চাই না', দৈত্য বললো- 'আমি শুধু চাই প্রথম যে এ সেতু পার হয়ে আসবে সে আমার হয়ে যাবে।'

বুজেনসির মানুষ সারা রাত জল্পনা-কল্পনা করলো, এক রাতেই সেতু তৈরি হয়ে গেল। কথামতো সেতুর অন্য প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে দৈত্য। যে-ই প্রথম আসবে তাকে-ই সে চিরদিনের জন্য নিয়ে নেবে। কিন্তু দৈত্যের ভয়ে কেউ-ই সেতু পার হচ্ছিল না। বুদ্ধিমান মেয়র সেতুর এক প্রান্ত থেকে একটি বেড়াল ছেড়ে দিলেন, তাকে কোলে নিয়ে রাগে গজগজ করতে চলে গেলো দৈত্য। প্রতীকী লোকগল্পটিতে আছে নেতিবাচকতার বিরুদ্ধে গণমানুষের আকাঙ্ক্ষার জয় আর নেতৃত্বের নিদর্শন।

২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে গেলে 'শিশুর কাটা মাথা লাগবে' এমন একটু 'গুজব' ছড়িয়ে পড়েছিল। কোথাও শিশু হারিয়ে গেলে, অপহরণ হলে বা শিশু-কিশোর কেউ মারা গেলে পদ্মা সেতুর জন্য এমন হয়েছে বলে একটা ভীতি ছড়িয়ে পড়ে। এমনও হয়েছে কোন একটা ঘটনায় স্থানীয় পুলিশকে সংবাদ সম্মেলন করে জানাতে হয়েছে 'শিশুর মাথা কাটার সঙ্গে পদ্মা সেতুর সম্পৃক্ততা নেই'। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসব নিয়ে তখন বাড়াবাড়ি হলেও আসলে এর পেছনে আছে নানা লোকজ পুরাণ। যেমন, গ্রামের বয়স্ক দাদা-নানারা এমন এক স্বপ্নের কথা তাদের নাতিকে বলতে পছন্দ করেন যেখানে আমরা সোনা-রূপা-জহরতভর্তি এক কলসির কথা জানতে পাই। সেই গুপ্তধন আছে গ্রামেরই শতবছর পুরনো পুকুরের তলায় ডোবানো, এটাকে পাওয়া যাবে কেবল কাল ভোরে নাতিকে পুকুরতলে বিসর্জন দিলে! এমন গল্পে ছোট্ট নাতির ঘুম চলে আসতো। ঘুমের ঘোরে তার জন্য সেতুর ওপারে অপেক্ষায় থাকতো জয়েসের দৈত্য। মানুষের সমৃদ্ধির পথে চিরকালই এমন ভয়ের গালগল্প গ্রাস করেছে, বেড়ে ওঠার বদলে মানুষে হয়েছে লোভী।

কবি কাজী নজরুল ইসলামের (১৮৯৯-১৯৭৬) লেখা একটি একাঙ্ক নাটক 'সেতুবন্ধ'। এর প্রথম দুটি দৃশ্য 'নওরোজ' পত্রিকায় ছাপা হয় 'সারাব্রীজ' শিরোনামে। তবে এটি যখন নজরুলের প্রথম নাটকের বই 'ঝিলিমিলি'-তে  প্রকাশিত হয় তখন নাম দেওয়া হয় 'সেতুবন্ধ', যোগ করা হয় নাটকের তৃতীয় ও শেষ দৃশ্য । 'ঝিলিমিলি' প্রকাশিত হয় ১৯৩০ সালের নভেম্বরে । এতে 'ঝিলিমিলি', 'সেতুবন্ধ' ও 'শিল্পী' নামে তিনটি ছোট নাটক রয়েছে। 'সেতুবন্ধ' নাটকে প্রকৃতির বিরুদ্ধে মানুষের প্রযুক্তির সংঘাতে শেষ পর্যন্ত প্রযুক্তির পরাজয় দেখানো হয়েছে। এর মূল বিষয়বস্তু পদ্মার ওপর সেতু নির্মাণ নিয়ে, নাটকটি রূপক বা সাঙ্কেতিক।

সূচনা দৃশ্যে আছে মেঘলোক। গন্ধর্বলোকের পদ্মাদেবী মেঘকে জরুরিভাবে ডেকে পাঠিয়েছেন। কারণ, পদ্মার ওপর বাঁধ তৈরি করতে যন্ত্ররাজ্যের ষড়যন্ত্র চলছে। মেঘ হচ্ছে রাজা, যন্ত্ররাজ পদ্মার উপর দিয়ে সেতু বানিয়ে স্বর্গলক্ষ্মী বন্দি করতে চায়। আকাশ থেকে গান ভেসে আসছে। সে তালে নাচছে মেঘমালা। তারপর গান করতে করতে মঞ্চে প্রবেশ করে বৃষ্টিধারা। বৃষ্টিধারার সঙ্গে এগারোজন মেয়ে, তারা হলো- নীপা, কৃষ্ণা, চম্পা, রেবা, চিত্রা, কঙ্কা, চূর্ণী, মঞ্জুনীরা, বিন্দু, অশ্রু আর মন্দা। মেঘ তাদের সবাইকে অভিযানে বের হতে আহ্বান জানিয়েছে। বৃষ্টিধারার মেয়েরা সবাই পদ্মাকে রক্ষা করতে সংকল্প করছে।

দ্বিতীয় দৃশ্যে দেখা যায় যন্ত্রপতির রাজসভা। লোহার তৈরি বিকট সিংহাসনে বসে আছে যন্ত্ররাজ, মাথায় লোহার মুকুট, ইলেকট্রিক টর্চ। যন্ত্রপতির কঠিন মুখে রক্ত-আলো পড়ে তাকে আরও ভীষণ ভয়ংকর করে তুলেছে। সারা শরীর ঘিরে আছে লোহার জালির সাজসজ্জা। যন্ত্রপতির সঙ্গে রয়েছে -যন্ত্রপাতি, ইট, কাঠ, লোহা আর পাথর। রঙ্গমঞ্চের পট জুড়ে শুধু দালান-কোঠা, আট্টালিকা আর কংক্রিটের উঁচু উঁচু ভবন। যন্ত্রপতি যন্ত্রকে উদ্দেশ্য করে বলছে, বাঁধ নির্মাণ করলেও যেন পদ্মার ক্ষতি কম হয়। যন্ত্র জবাব দিচ্ছে, পদ্মা তো সব নদীরই সম্রাজ্ঞী। পদ্মার তেজে পৃথিবী কাঁপে। কিন্তু যন্ত্রপতি কম যায় কিসে! যন্ত্রপতি যন্ত্রকে বলছে, সে পদ্মার হাঙর-কুমির দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছে কিনা। পদ্মার ঢেউয়ের তোড়ের কাছে সবকিছু নস্যি। খড়কুটার মতো সব তলিয়ে ভাসিয়ে নিয়ে যায় সে, তার পেটে অনেক ক্ষুধা। তখন যন্ত্র আহ্বান জানায়, সবার যৌথ শক্তি দিয়ে পদ্মাকে জব্দ করতে হবে। যন্ত্রপতি বলেছে, 'সেনাপতি! আজই যাত্রা করো পদ্মাতীরে তোমার সৈন্যসামন্ত নিয়ে। সৈন্য পরিচালনের ভার আমিই গ্রহণ করব। (ইট, কাঠ, পাথর, লোহার প্রতি) প্রিয় সৈনিকগণ! তোমাদেরই আত্মদানে আমার এই বিশাল সাম্রাজ্য। এর যা কিছু গৌরব, যা কিছু প্রতিষ্ঠা সব তোমাদেরই। আমাদের এ যুদ্ধ স্বর্গ-মর্ত্যের চিরন্তন যুদ্ধ। এ যুদ্ধ জড় ও জীবের, বস্তু ও প্রাণের, মৃত্যু ও মৃত্যুঞ্জয়ের।'

তৃতীয় ও শেষ দৃশ্যে দেখা যায়- মকরবাহিনী পদ্মা সিংহাসনে বসে আছে। গায়ে কাঁচা রোদ, পরনে জলতরঙ্গ শাড়ি, হাওয়ায় ঝিলিমিলি করছে। পদ্মাকে ঘিরে আছে ছয় জলদেবী, তারা হলেন- অনিলা, তটিনী, তরঙ্গিণী, সলিলা, নির্ঝরিণী ও বালুকা। তারা বন্দনাগীত গাইছে। পদ্মা জলদেবীদের ডেকে বলছে, তোমরা গান বন্ধ কর। তরঙ্গিণী বলছে, 'জানি মা তোমার বেদনা কত বিপুল। কিন্তু যন্ত্রপতির এ স্পর্ধার দণ্ড কি আমরা দিতে অসমর্থ, মা?' পদ্মা তখন বলছে, 'আপাতত তো তাই মনে হচ্ছে তরঙ্গিণী। কত বাধাই না দিলাম। যন্ত্রপতির অগণিত সেনা-সামন্ত আজও আমার বালুচরের তলে তো তাদের সমাধি রচনা করে পড়ে রয়েছে, তবু তো তাকে আটকে রাখতে পারলাম না। সে আমার বুকের ওপর দিয়ে তাঁর উদ্ধত যাত্রাপথ রচনা করে গেল। (অদূরে সেতুবন্ধ দেখা যাইতেছিল সেই দিকে অঙ্গুলী নির্দেশ করিয়া) ওই দেখেছিস তার সেতুবন্ধ? ও যেন কেবলই আমার মাথার উপর চড়ে বিদ্রুপ করছে।'

'সেতুবন্ধ' নাটকে এভাবেই প্রাকৃতিক শক্তির বিরুদ্ধে মানবশক্তির দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আনা হয়েছে । মানুষ বিজ্ঞান-প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রকৃতির শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, তাকে ধ্বংস করতে চায়। কিন্তু কবি নজরুল দেখিয়েছেন, মানুষ আসলে প্রকৃতিকে ধ্বংস করতে পারে না, বারবার নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়। যন্ত্ৰকুশলী উদ্ভাবনী মানুষ প্রাকৃতিক শক্তি পদ্মার ওপর সেতু নির্মাণ কাজে ব্যস্ত। নাটকটিতে দেখা যাচ্ছে যন্ত্রশক্তি ব্যবহার করছে মানুষের দল আর প্রাকৃতিক শক্তিকে সঞ্চালন করছে দেবতা। মানুষ দাবি করছে, 'প্রকৃতিকে আমরা বশীভূত করেছি, এবার স্বর্গ জয়ের পালা। আমাদের পথের প্রধান প্রতিবন্ধক ওই মুক্ত স্রোতস্বতী, আনন্দলোকের গোপন প্রাণধারা। ওকে বাঁধব না, ওর বুকের ওপর দিয়ে চলে যাবো আমাদের চলার চিহ্ন এঁকে। স্বর্গের আনন্দলক্ষ্মী করবে এই জড় জগতের পরিচর্যা।'

নাটকের শেষের দিকে দেবশক্তির হাতে যন্ত্রশক্তি হেরে যায়। যন্ত্রশক্তির তৈরি সেতু পদ্মার পানিতে ডুবে যায়। মানবশক্তি যন্ত্র পদ্মার উদ্দেশ্যে বলে, '(মৃত্যুকাতর কণ্ঠে) আমার মৃত্যু নাই! আজ তোমারই জয় হল।' দানব কড়া জবাব দেয়, 'আমি আবার নতুন দেহ নিয়ে আসব। আবার তোমার বুকের ওপর দিয়ে আমার স্বর্গজয়ের সেতু নির্মিত হবে।' পদ্মা বিনীতস্বরে বলে, 'জানি যন্ত্ররাজ! তুমি বারেবারে আসবে, কিন্তু প্রতিবারেই তোমায় এমনই লাঞ্ছনার মৃত্যুদণ্ড নিয়ে ফিরে যেতে হবে!'

কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'মুক্তধারা' নাটকের সঙ্গে কাজী নজরুলের 'সেতুবন্ধ'- এর একটা মিল আছে, তবে সেটা সংবেদনশীলতায়, চরিত্রে নয়। 'মুক্তধারা' প্রকাশিত হয় ১৯২২ সালে, এর মূল দ্বন্দ্বটিও যন্ত্রশক্তির সঙ্গে প্রাণের। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর একদিকে পশ্চিমা দেশগুলোর সাম্রাজ্যবাদী দেশনীতি, শীর্ণ জাতীয়তাবোধ এবং মানবিকতা বিবর্জিত যান্ত্রিক সভ্যতা; আরেকদিকে নিজ দেশে সত্যাগ্রহ, অহিংস ও অসহযোগ আন্দোলনের প্রভাব 'মুক্তধারা' নাটকে আছে। সেই সময়ের ভেতর-বাহিরের ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো দুই কবির মানসে যে প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছিল নাটকে তারই হয়তো ছায়া পড়েছে। নজরুলের 'সেতুবন্ধ' প্রকাশের প্রায় বিরানব্বই বছর পর আমরা পদ্মার ওপর সেতু উদ্বোধনের অপেক্ষায় আছি। আমরা যেমন দেশজ উন্নয়ন দর্শন বা 'হোম গ্রোন ডেভেলপমেন্ট' চাই তাতেই এ সেতু তৈরি বলা হচ্ছে। কবি নজরুল বেঁচে থাকলে কী লিখতেন জানা সম্ভব নয়, জানা যাবে না রবীন্দ্রনাথের প্রতিক্রিয়াও। সম্ভবত তারা দেশের জনগণকে অভিনন্দন জানাতেন। হয়তো পত্রিকায় দুই কলম লিখতেনও।

ইলিনর অসট্রম নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন নেপালে কাজ করে। একটা কাজে নেপালে কৃষকরা বাঁধ বাঁধতো। একসময় বাঁধটা আবার ভেঙে পড়তো। যে গ্রামটা বাঁধটা বাঁধতো দূরবর্তী গ্রামের লোকেরাও এই বাঁধের সুবিধা পেতো। ওই বাঁধটা যে গ্রামের লোকেরা বাঁধতো তারা-ই বাঁধটা পরিষ্কার করতো। এটার জন্য তারা মজুরি পেতো। বিশ্বব্যাংক থেকে লোকজন এসে বললো যে, এতো বহু কষ্টের কাজ, একটা পাকা বাঁধ নির্মাণ করো। সব পাকা করলো, বিলিয়ন ডলার খরচ করে। তারপর বাঁধ বন্ধ হয়ে গেল, কারণ পরিষ্কার করার লোক নেই। সারা বছরই আমরা পত্রিকায় দেশের এমনসব সেতু, সড়ক বা কালভার্টের ছবি দেখি যেগুলো কোটি টাকা খরচ করে বানানো হয়েছে, অথচ ব্যবহার নেই। কোনটার দুই পাশে সংযোগ সড়ক নেই, কোনটা বিরান বিলের মাঝে বছরের পর বছর পড়ে আছে, কোনটা আবার উদ্বোধনের আগেই ভেঙ্গে পড়ছে, কোনটাতে এমন নির্মাণত্রুটি রয়ে গেছে যে সেতুতে উঠতে মই ব্যবহার করতে হয়! স্থানীয়রাও ত্যাগ করেছে সেইসব সেতু।

উন্নয়নের একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হলো রিজিলিয়েন্স বা স্থিতিস্থাপকতা। নানা দুর্নীতির মধ্যেও চতুর্থ বিপ্লবের যুগে  মানুষের কিছুটা দক্ষতা হয়তো বেড়েছে, এবং সময় যতো বাড়বে ওই দক্ষতা বাড়বে। কিন্তু জনগণের করের টাকায় করা উন্নয়ন যদি ন্যায্যতা সৃষ্টি না করতে পারে, যদি দীর্ঘ মেয়াদে পিছিয়ে পড়া, দরিদ্র ও বঞ্চিত মানুষেরই কষ্ট লাঘব না হয় তাহলে সমাজিক বৈষম্য আরও বাড়বে। কবি নজরুলই লিখেছিলেন, 'পদ্মার ঢেউ রে, মোর শূন্য হৃদয় পদ্ম নিয়ে যা যারে…'।