চাই আনন্দ-আলোর এক ভুবন

বেবী মওদুদ
Published : 2 Dec 2012, 07:50 PM
Updated : 2 Dec 2012, 07:50 PM

৩ ডিসেম্বর ২১তম আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দিবসটি নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে উদযাপিত হবে। এবারে দিবসটির প্রতিপাদ্য হচ্ছে 'একীভূত সমাজ নির্মাণে সংঘবদ্ধ অঙ্গীকার।'

উন্নত দেশগুলোতে আমরা দেখি, সেখানকার প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী সমাজে যথেষ্ট অবদান রাখার সুযোগ লাভ করেন। তাঁদের দায়িত্ব রাষ্ট্র গ্রহণ করে, এ-সংক্রান্ত সরকারের নানা ব্যবস্থাপনা রয়েছে। সমাজের মূলস্রোতের জনগোষ্ঠী, মানে যাদের আমরা স্বাভাবিক মানুষ বলি- তাঁরাও প্রতিবন্ধীদের ভালোবাসেন, সহযোগিতা করেন, সম্মান দেন; এঁদের আনন্দে রাখার জন্য পাশে-পাশে থাকেন, প্রেরণা জুগিয়ে যান। এঁদের চিকিৎসা, শিক্ষা, খাদ্য ও জীবনযাপনে কোনো গাফিলতি হলে আইন আছে। সে আইনে বিচার ও শাস্তির ব্যবস্থাও রয়েছে। প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর সঙ্গে তাই অসদাচরণ করা বা তাঁদের অবহেলা করার মতো বাস্তবতা ওখানে নেই।

আর আমাদের মতো উন্নয়নশীল বা অনুন্নত দেশের প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী কীভাবে জীবনযাপন করেন? দুর্ভাগ্য নিয়েই এঁদের বেশিরভাগের জন্ম। এঁদের প্রতি সমাজের উপেক্ষা ও পরিবারের অবহেলা তো থাকেই– সে সঙ্গে সরকার ও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে থাকে ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র দায়সারা গোছের কিছু কর্মসূচি। অন্যের করুণা-বিদ্রুপ-উপহাস নিয়ে বেঁচে থাকতে হয় এঁদের। সমাজের এ জনগোষ্ঠী এখানে যেন সৃষ্টিকর্তার অভিশাপ হিসেবে চিহ্নিত হন। সেটাই এঁদের পরিচয় হযে ওঠে। আর তখন পৃথিবীতে মানুষের সবচেয়ে আপনজন যে পিতামাতা- তাদের কাছেও এঁরা বোঝা হয়ে দাঁড়ান। বাধ্য হন অনাদর আর অবহেলায় মানবেতর জীবন কাটাতে।

প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী কারা এবং তাঁদের ধরন কী-কী তা যদি চিহ্নিত করি, তাহলে দেখতে পাব-

১। অটিজম (Autism)
২। চলন-প্রতিবন্ধিতা (Locomotion Disability)
৩। দীর্ঘস্থায়ী মানসিক অসুস্থতাজনিত প্রতিবন্ধিতা (Mental illness leading to disability)
৪। দৃষ্টি-প্রতিবন্ধিতা (Visual Disability)
৫। বাক-প্রতিবন্ধিতা (Speech Disability)
৬। বুদ্ধি-প্রতিবন্ধিতা (Intellectual Disability)
৭। শ্রবণ-প্রতিবন্ধিতা (Hearing Disability)
৮। শ্রবন-দৃষ্টি-প্রতিবন্ধিতা (Hearing Disability)
৯। সেরিব্রাল পালসি (Cerebral Palsy)
১০। বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধিতা (Multiple Disability)
১১। অন্যান্য ধরনের প্রতিবন্ধিতা (Other Disabilities)

প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর সহায়তার জন্য আমাদের দেশে সরকারি প্রতিষ্ঠান জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের অধীনে ৬৪ জেলায় রয়েছে ৬৪ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী স্কুল, পাঁচটি শ্রবণ-প্রতিবন্ধী স্কুল এবং দুটি বুদ্ধি-প্রতিবন্ধী স্কুল। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১৫০। এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে প্রথমত ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও আর্থিক সহায়তার ওপর নির্ভর করে। পরবর্তীতে বিদেশি সাহায্য নিয়ে পরিচালিত হয় কোনো-কোনো প্রতিষ্ঠান। তবে একটা সময় আমাদের সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য ক্লিনিক এবং বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে এ জনগোষ্ঠীর জন্য চিকিৎসারও কোনো ব্যবস্থা ছিল না। বিশেষ করে যারা অটিজিমে আক্রান্ত তাদের চিহ্নিত করে চিকিৎসার ব্যবস্থা দেখা যায়নি। শিশু বিশেষজ্ঞরাই সাধারণত এ রোগীদের চিকিৎসা করতেন।

একুশ শতকে এসে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকাররক্ষায় বিশেষ গুরুত্ব প্রদান শুরু হয়েছে। জাতিসংঘ এ-সংক্রান্ত বিশেষ একটি সনদ প্রণয়ন করেছে। বিশ্ব সংস্থাটি প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর অধিকাররক্ষায় সদস্য দেশগুলোকে কর্মসূচি বা প্রকল্প গ্রহণ করতেও বাধ্য করছে।

আমাদের দেশে ১৯৯৬ সাল থেকেই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য সরকারি উদ্যোগ নিতে দেখা যায় সমাজ কল্যাণ বিভাগের মাধ্যমে। কিন্তু পরবর্তী সরকারের সময় উদ্যোগগুলো বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতাগ্রহণের পর থেকে আবার এ বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে অর্থ বরাদ্দ করেছেন। নানা কর্মসূচিও নিয়েছেন। বিশেষ করে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করে সারাদেশে এর শাখা গঠন করা হয়েছে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য চিকিৎসাসেবার নিশ্চয়তা দেওয়া হচ্ছে সরকারের তরফ থেকে। এঁদের নিবন্ধীকরণ, ভাতা-প্রদান, প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় প্রতিবন্ধী জরিপ এবং এঁদের অধিকাররক্ষায় নীতিমালা ও আইন প্রণয়নের পদক্ষেপও নিয়েছে। প্রতিবন্ধী দিবসসহ নানা কর্মসূচি পালনের মধ্য দিয়ে জনগণকে সচেতন করে তোলার উদ্যোগও গৃহীত হচ্ছে।

আমরা দেখেছি প্রতিবন্ধী সন্তানকে নিয়ে মা-বাবা এবং অভিভাবকরা দুশ্চিন্তা করেন। এঁরা সমাজে ও পরিবারে উপেক্ষার শিকার হন। সরকারের পক্ষ থেকে উদ্দীপনামূলক কিছু নীতি গ্রহণ করায় ও সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোতে, এখন অভিভাবকরাও নিজেদের প্রতিবন্ধী সন্তানদের উন্নত জীবনের অধিকারী করার স্বপ্ন দেখছেন। বিশেষ করে এ জনগোষ্ঠীর কিছু অংশকে চিকিৎসা নিয়ে অনেকটা সুস্থ ও স্বাভাবিক করে তোলা যায়। চিকিৎসা-সুযোগ বাড়ার ফলে এ বিষয়ে সচেতনতাও বাড়ছে। প্রতিবন্ধী শিশুরা শিক্ষা ও সৃজনশীল চর্চার জন্য প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুযোগ পাচ্ছে। ওরা সংস্কৃতিচর্চায় যুক্ত হচ্ছে, নাচ-গান করে সবার কাছে প্রশংসিত হচ্ছে। বিশেষ করে বিশ্ব অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করে দেশের জন্য স্বর্ণ অর্জন করেছে কিছু সোনার ছেলেমেয়ে। নতুন এ প্রণোদনামূলক পরিবেশের কল্যাণে আমাদের দৃষ্টি-প্রতিবন্ধী তরুণরা বিশেষ টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলায় অংশ নিচ্ছে। এ জন্য সারা দেশ থেকে প্রতিভা খুঁজে বের করে তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।

এ শিশুদের যারা প্রশিক্ষণ দেন তাদের যথেষ্ট ধৈর্য এবং আন্তরিকতার পরিচয় দিতে হয়। আর যারা সংগঠক হিসেবে কাজ করছেন তাদেরও যথেষ্ট সাহস রাখতে হয়, ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। প্রতিবন্ধী শিশুদের নিয়ে কাজ করা বা তাদের অভিভাবকদের সচেতন করে তোলা একটা বিরাট শ্রমসাধ্য বিষয়। এ কাজের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের অবিরত অভিযোগ শুনতে হয়, নানা সমস্যা ও অভাবের মধ্য দিয়ে কাজ করতে হয়। বিশেষ করে অর্থ ও জনবল সমস্যা সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে আছেই। কেননা সরকারি বাজেট বরাদ্দ প্রয়োজনের তুলনায় কম। আর বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যে ছিটেফোঁটা বরাদ্দ পায় তাতেও চলে না। আমাদের দেশে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর জরিপ এবং সমস্যা চিহ্নিতকরণ সঠিকভাবে কখনও-ই হয়নি। ফলে না-বুঝেই অনেকক্ষেত্রে চিকিৎসা এবং কাজ হয়েছে, যেটা উচিত নয়।

১৯ নভেম্বর, ২০১২ বিকালে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে ইকোসক চেম্বারে এক বিশেষ সভায় সভাপতিত্ব করেন জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ড. এ. কে. আবদুল মোমেন। সেখানে জাতিসংঘের উচ্চ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দসহ বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। সভায় গ্লোবাল অটিজম পাবলিক হেলথ ইনিশিয়েটিভ ইন বাংলাদেশের জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারপার্সন সায়মা হোসেন একটি উল্লেখযোগ্য মানবিক প্রস্তাব রেখেছেন। প্রস্তাবটি হল, 'অটিজিম-আক্রান্ত শিশু ও তার পরিবারের জন্য আর্থ-সামাজিক সহায়তা।' তিনি অটিজম-আক্রান্ত শিশুদের সমস্যাগুলো তুলে ধরে বলেন, 'বিশ্বে মোট সাত কোটি মানুষ অটিজিমে ভুগছে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ৮৮ জনের মধ্যে ১ জনের অটিজম রয়েছে। তিনি অটিজম-আক্রান্তদের জন্য বহুমুখী সহায়তার প্রস্তাব রাখেন। সায়মা হোসেনের প্রস্তাবটি যুগোপযোগী হিসেবে বিবেচনা করে আগামী সাধারণ অধিবেশনের আগে একটি উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকের সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাতিসংঘ।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মধ্যে যারা অটিজম আক্রান্ত তাদের অবস্থা আরও ভয়াবহ। কেউ-কেউ চিকিৎসা ও পারিবারিক পরিচর্যায় অনেকখানি সুস্থ হলেও সম্পূর্ণ সুস্থ কখনও-ই হয় না। আমাদের দেশে এখন এ ব্যাপারে সচেতনতা বাড়ছে। এঁদের সারাজীবন পরিচর্যা ও খাওয়া-পরার দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে। পরিবারগুলোও এটুকু দাবি করে। কেননা অটিস্টিক শিশুদের চিকিৎসা ও ওষুধ কেনায় বেশ বড় একটা অর্থ খরচ হয়, দরিদ্র মা-বাবার পক্ষে তা বহন করা অনেক ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না।

আজ বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস উদযাপনকালে সমাজের সবাইকে মনে রাখতে হবে, প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীরও সব ধরনের অধিকার রয়েছে। তাঁরা জন্মেছেন কোনো অভিশাপ নিয়ে নয়, সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ নিয়ে। তাঁদের ভালোবাসা ও আনন্দ দেওয়া আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। দয়া-মায়া-করুণা এবং ছিটেফোঁটা সাহায্য নয়– তাঁদের জন্য আমরা যেন একটি আনন্দময় ভুবন প্রতিষ্ঠা করতে পারি, এ প্রতিশ্রুতিই হোক এ দিনে আমাদের তরফ থেকে শ্রেষ্ঠ উপহার।

বেবী মওদুদ: লেখক ও সাংবাদিক।