গুণগতমান খুবই জরুরি

সুভাষ সিংহ রায়
Published : 2 Dec 2012, 06:03 PM
Updated : 2 Dec 2012, 06:03 PM

২৮ নভেম্বর, ২০১২ অর্থনীতি বিষয়ক একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার সংবাদ শিরোনাম ছিল 'অকার্যকর কলকারখানা পরিদর্শন পরিদপ্তর'। সেই পাকিস্তান আমলের শেষের দিকে ১৯৭০ সালে তৎকালীন সরকারের সময়ে প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলা হয়েছিল। গুণগতমানসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে কারখানা পরিদর্শন বিষয়টা খুবই জরুরি। প্রতিষ্ঠাকালীন এ পরিদপ্তরের জনবল থাকার কথা ছিল ৩১৪। প্রতিষ্ঠার পর ৪২ বছরে শুধু সাভার এলাকায় দু'হাজারের বেশি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। সে হিসেবে এ প্রতিষ্ঠানের জনবল হওয়ার কথা ৭০০ থেকে ৮০০। কিন্তু এ সময়ে জনবল তো বাড়েইনি বরং এখন এখানে কাজ করছেন মাত্র ১৮৪ জন!

শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীন এ প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব আমরা অনুভব করিনি। তার মানে আমরা একেবারেই সর্তক নই। ১৯৭৯ সালের পর থেকে বাংলাদেশে গার্মেন্টেসে দুর্ঘটনায় এ পর্যন্ত প্রাণহানির সংখ্যা প্রায় হাজারে উন্নীত হয়েছে। স্রেফ অবহেলা ও ক্রুটিপুর্ণ নিরাপত্তা ব্যবস্থার কারণেই এ জাতীয় দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে। এমনকী নাশকতার ঘটনাও ঘটেছে। বড় ধরনের বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনার কথা উল্লেখ করা যায়। যেমন, চৌধুরী নিটওয়ার, স্পেকট্রাম, কেটিএস ফেব্রিকস, তাজরীন ফ্যাশনস্ ইত্যাদি। এসব ক্ষেত্রে কোনোটাতেই পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা ছিল না এবং প্রত্যেকটির মূল ফটক দুর্ঘটনার সময় বন্ধ ছিল।

১৯৬৫ সালে ফ্যাক্টরি আইনে বলা হয়েছে, শ্রমিকদের কর্মকালীন সময়ে মূল ফটক খোলা রাখতে হবে। অথচ সর্বশেষ তাজরীনসহ দুর্ঘটনা-কবলিত প্রায় সব ফ্যাক্টরির মূল ফটক বন্ধ পাওয়া গেছে এবং প্রত্যেকটি ফ্যাক্টরির বৈদ্যুতিক ওয়ারিং ছিল ত্রুটিপূর্ণ এবং নিন্মমানের। কারণ-উদঘাটন করে দেখা গেছে যে, শর্টসার্কিট বা ব্রয়লার বিস্ফোরণের মাধ্যমে কারখানায় আগুন ধরেছে। এমনকী ভবন-ধসের মতো ঘটনা ঘটেছে। এসব ফ্যাক্টরিতে যে ব্রয়লার ব্যবহার করা হয়ে থাকে তা একেবারেই কম-দামি ও নিন্মমানের।

কলকারখানা পরিদর্শন পরিদপ্তর কার্যকরী ভূমিকায় থাকলে এ রকম দুর্ঘটনা আদৌ ঘটত না। যেখানে এত দাহ্যবস্তু নিয়ে কাজ করা হয় সেখানে কোনোভাবেই যখন-তখন মাল্টিপ্লাগ দিয়ে একাধিক সংযোগ দেওয়া যায় না। বাংলাদেশের কলকারখানাগুলোতে যেখানে-সেখানে ক্যাপাসিটির বাইরে মাল্টিপ্লাগ দিয়ে একাধিক সংযোগ দেওয়া হয়ে থাকে। এভাবে বাল্বের ভোল্টেজ বাড়ানো বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। আমরা কেউ জানি না, বাংলাদেশের কতগুলো কারখানার আশেপাশে জলাধার আছে। আগুন লাগলে ফায়ার ব্রিগেডের কর্মীবাহিনী ঘটনাস্থলে প্রবেশ করতে অনেক সময় চলে যায়। কেননা আশেপাশে খালি কোনো জায়গা থাকে না।

তাছাড়া আমাদের দেশে সবক্ষেত্রে যাকে দিয়ে যে-কাজ হবে না তাকে দিয়েই সে-কাজ করানো হয়। প্রাচীন শাস্ত্র মনুসংহিতার কথা আমরা জানি। একসময় যখন সমাজ ও সামাজিক রীতিনীতি বৃহদাকার ও জটিল হয়ে যায়, তখন মনুসংহিতার ভূমিকা ছিল পথপ্রদর্শকের। মনুসংহিতায় বলা হয়েছে, "যতজন লোকের দ্বারা কার্যসমূহ নিস্পন্ন হয়, ততজন অনলস, দক্ষ, বিচক্ষণ লোক নিযুক্ত করবেন।" (নির্বর্তেতাস্য যাবদ্ভিরিতিকর্তব্য নৃভি: তাবতোহতন্দ্রিতান্ দক্ষান প্রকুর্বীত বিচক্ষণান্।)। আমাদের পোশাক কারখানাগুলোতে দক্ষ জনবল রাখা হয় না। যাকে-তাকে দিয়ে সব কাজ করানোর জন্যেও অনেক দুর্ঘটনা ঘটে।

এটা আমাদের দেশের সর্বত্র আছে। আমরা প্রতিদিন পাবলিক বাসে চড়ছি কিন্তু এসব বাসের ক'জন ড্রাইভার প্রশিক্ষিত? বেশিরভাগই নন। আমরা সবসময় এ রকম ভয়ঙ্কর সব বিষয় নিয়ে চলছি। এখন ঢাকার রাস্তায় ট্যাক্সিক্যাব হিসেবে রয়েছে ৮০০ সিসি মারুতি গাড়ি; তার সঙ্গে রয়েছে স্বল্পপরিসরে সিএনজি সিলিন্ডার লাগানো। পৃথিবীর আর কোথাও এটা সম্ভব নয়। বিগত সরকারের আমলের আবিস্কার এটি। এর ফলে যেকোনো সময় বড় একটি দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। শুধু ট্যাক্সিক্যাবের চালক এবং আরোহীদের জন্যে এটা বিপদ তা নয়, আশেপাশে যারাই থাকবেন তাদের জন্যও বিপদ ঘটতে পারে।

বিপদ ঘটার আশঙ্কাটা আরও এ জন্যই তীব্র হয় যে, এসব গাড়িতে ঠিকমতো সিএনজি সিলিন্ডার লাগানো হয়েছে কিনা, এগুলো মানসম্পন্ন বা মেয়াদোর্ত্তীণ কিনা এগুলো দেখার যেন কেউ নেই। তাই একমাত্র মহান সৃষ্টিকর্তাই ভরসা। আরও আছে। ঢাকার রাস্তায় এমনসব গাড়ি চলাচল করে যেকোনো সময় যেগুলোর চাকা খুলে দৌড় দিতে পারে। এসব কিছুর দেখভাল করার সংস্থা কোনটি? হয়তো কাগজপত্রে আছে!

যেমন আছে কারখানা পরিদর্শন পরিদপ্তর। প্রতিষ্ঠানটিকে একেবারে অকার্যকর করে রাখা হয়েছে। এখন এ যুগেও একজন পরিদর্শক অফিস থেকে কোনো কারখানা পরিদর্শনে গেলে তাকে গাড়িভাড়া বাবদ দেওয়া হয় প্রতি কিলোমিটারে মাত্র এক টাকা। বোধগম্য কারণেই কোনো পরিদর্শক কারখানা পরিদর্শন করেন না। অতএব, পরিদর্শকদের অবস্থা 'নেই কাজ তো খৈ ভাঁজ'। এদেশের অধিকাংশ কলকারখানায় নির্মাণগত ত্রুটি রয়ে গেছে। দেখভালের দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠঅনটিকে কার্যকর করা যাচ্ছে না বলে নানা দুর্ঘটনা ঘটছে। আর এর ফলে দেশের সম্পদ ও মানুষের যে ক্ষতি হচ্ছে তার দায়ভার কারা নেবে?

বিদেশি ক্রেতারা আজ চাপ দিচ্ছে ত্রুটিপূর্ণ কারখানা থাকলে তারা আর রপ্তানি আদেশ দিবে না। এরা এখন অন্যকোনো দেশের দিকে যাওয়া শুরু করলে সমূহ বিপদ। লি অ্যন্ড ফাং, এইচ অ্যন্ড এম, ওয়ালমার্ট, ফিলিপস্ ভ্যান হুইসেন (পিভিএইচ), ইন্ডিটেক্স, এমএস মোড, টেসকো, নিলেন – এসব কোম্পানি বলছে, ভবিষ্যতে শতভাগ কমপ্লায়েন্স ব্যবস্থাপনাসম্পন্ন কারখানা ছাড়া তারা আর ক্রয়-আদেশ দেবে না। ক্রেতারা পোশাককারখানাতে অগ্নিনিরাপত্তার দ্রুত মানোন্নয়নের তাগিদ দিয়েছে। এমনকি তারা সরকারের কাছে শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার অঙ্গীকারও চেয়েছে।

এদেশের মানুষেরই ঐকান্তিক আর প্রাণপণ প্রচেষ্টায় গার্মেন্টেস শিল্প মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েচিল। ১৯৭৯ থেকে মূলত এর যাত্রা শুরু। তখন মাত্র ১২,০০০ ডলার মূল্যের রপ্তানি করা হত। আজ এ অংকটা ২০০ কোটি ডলার। এ শিল্পের কোনোরকম ক্ষতি হলে বাংলাদেশের অর্থনীতি দারুণভাবে বির্পযস্ত হবে। এটা আমরা যেমন বুঝি, এ বাজারে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষরাও তা জানে। প্রতিদন্দ্বিতার এ বাজারে অনেকেই হয়তো বাংলাদেশকে টার্গেট করেছে। সক্ষমতা দিয়ে বাংলাদেশ তা অর্জন করেছে। পোশাক রপ্তানিতে আমরা দ্বিতীয় অবস্থানে; এটা আমাদের প্রতিযোগীদের একটা মাথাব্যথার কারণ হতে পারে। তাদের স্থানীয় এজেন্টরাই কি সুমি বেগমের হাতে ২০,০০০ টাকা গুঁজে দিয়েছিল? দেশের বিবদমান রাজনীতির কোনো অংশ কি এর সঙ্গে জড়িত? ঠান্ডা মাথায় এসব ভেবে দেখতে হবে।

বঙ্গবন্ধুর সময়ে দেশে একের পর এক পাটকলে আগুন দেওয়া হয়েছিল। তখন পাট ছিল আমাদের প্রধান অর্থকরী ফসল; এখন যেমন পোশাক-শিল্প। গার্মেন্টস শিল্পের ইতিহাসে গোটা দুনিয়ার মধ্যে এ যাবতকালের সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটেছিল নিউইয়র্কের ম্যানহাটনে। ১৯১১ সালের ২৫ মার্চ। যে কারণে পোশাকশিল্পের ইতিহাসে অভিসপ্ত দিন হিসেবে এটিকে ম্মরণ করা হয়। সে দুর্ঘটনায় ১৪৬ জনের প্রাণহানি ঘটেছিল। এ দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র পোশাক-শিল্পের পরিবেশ কর্মবান্ধব করেছে। আর আমরা কী করছি? আমাদের দেশে ২০০৫ সালের পর দুঘর্টনা ঘটার প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে। আশ্চর্যজনকভাবে, গার্মেন্টেস্ শিল্পকারখানা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে। যে কারনে শিল্প মন্ত্রণালয়ের মধ্যে এ শিল্প নিয়ে একটা গা-ছাড়া ভাব দেখা যায়।

সুখের কথা, অনেক আগেই যা হওয়ার দরকার ছিল এখন সেটা হতে যাচ্ছে। অতিসম্প্রতি গামের্ন্টস খাত তদারকির জন্য একটি ত্রিপক্ষীয় টাস্কফোর্স গঠন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এখানে সরকার, মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধিরা থাকবেন। সেক্ষেত্রে ক্রেতারা কঠিন শর্তে বলছেন, এ টাস্কফোর্সে বিদেশি অডিট প্রতিষ্ঠান, আইনজ্ঞ, স্থপতি ও প্রকৌশলীদের সম্পৃক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছেন। বিদেশিদের এ সুযোগ আমরাই করে দিয়েছি।

সাধারণ মানুষের অভিযোগ, পোশাক-শিল্পের মালিকরা মুনাফা ছাড়া আর কিছু বুঝতে চান না। ওষুধ-কারখানায় বাংলাদেশে অনেক এগিয়ে গেছে। কারেন্ট গুড ম্যানুফ্যাকচারিং (সিজিএমপি) এর বাধ্যবাধ্যকতার কারণে বাংলাদেশে অনেক উন্নতমানের ফ্যাক্টরি তৈরি হয়েছে। হাতেগোনা দুয়েকটি ফ্যাক্টরি ছাড়া ইটিপি (ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট) নেই; কোথাও কোথাও যদিও থাকে তা অত্যন্ত নিম্নমানের। আবার কোনো ফ্যাক্টরিতে ইটিপি আছে; কিন্ত ব্যবহার নেই।

আমাদের বড় দুভার্গ্য যে, আমাদের আমলাতন্ত্র প্রথাসিদ্ধ পথ থেকে এদিক-ওদিক যাওয়া পছন্দ করে না। এ জন্য বিশেষজ্ঞদের খুবই দরকার। একমাত্র তারাই যে পারেন কোনও সরকারি নীতিকে পূর্ণাঙ্গ রুপ দিতে, কোনো বিষয়ে সুপরামর্শ দিতে। অথচ প্রচলিত ব্যবস্থাতে বিশেষজ্ঞদের খুব বেশি প্রয়োজন নেই!

দেশেথ এখন সবক্ষেত্রে দলীয় রাজনীতির কালোথাবা। আমরা এখন সবকিছু নিয়ে রাজনীতি করি। রুশ লেখক লিও তলস্তয় বলেছিলেন, 'সবাই দুনিয়া পরিবর্তনের কথা বলেন, কিন্তু নিজের পরিবর্তনের ব্যাপারে কারও কোনো আগ্রহ দেখি না।'

আমি মনে করি, শ্রমজীবীদের প্রতি আচরণ যেন হয় সম্পূর্ণ পক্ষপাতহীন। এমন কিছু বিষয় আছে যা নিয়ে আপোস করা চলে না। আমরা যেন শুধু জগৎ-সংসার পরিবর্তনের সস্তা ও উপাদেয় শ্লোগান না দিয়ে নিজেরা পরিবর্তিত হই।

পোশাক-শিল্পের সহায়তায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। শিল্পপ্রতিষ্ঠানের আশেপাশে অবস্থানকারীদেরও এক্ষেত্রে অনেক ভূমিকা রয়েছে। আশেপাশের শিল্প প্রতিষ্ঠান সঠিকভাবে নির্মিত হচ্ছে কি না এটা তাদেরও দেখতে হবে। কেননা মনে রাখতে হবে, নগরীতে আগুন লাগলে দেবালয়ও বাদ যায় না।

তাজরীন গামের্ন্টেসের দুর্ঘটনা প্রমাণ করে দেশের পোশাক-শিল্প কতটা অনিরাপদ ও ঝুঁকিপূর্ণ। কারখানার ত্রুটিপূর্ণ ডিজাইন, যথাযথ অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র না থাকা, যে-ক'টি ছিল তার ব্যবহারে দক্ষ সার্বক্ষণিক কর্মচারি না-থাকা, আগুন লাগার পরপরই কারখানার গেট খুলে দেওয়া– এ সবই একটি নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিযার মধ্যে আনতে হবে।

এটাও মনে রাখতে হবে যে, পোশাক-শিল্পের মালিকদের বিরুদ্ধে সবকিছু চাপিয়ে না দিয়ে সমন্বিত ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে। তারা উৎসাহ হারিয়ে ফেললে শিল্পের ব্যাপক ক্ষতি হবে। গুণগতমান উন্নয়নে সবাইকে সচেষ্ট থাকতে হবে।

সুভাষ সিংহ রায়: ইউনিহেলথ ফার্মার মার্কেটিং ম্যানেজার ।