সাবেক অর্থমন্ত্রীর না জানার ভান ও সরকারি হাসপাতালে ‘অনাহারী’

এ বি এম কামরুল হাসানএ বি এম কামরুল হাসান
Published : 27 May 2022, 03:20 PM
Updated : 27 May 2022, 03:20 PM

আঠারো বছর আগে সরকারি চাকরি ছেড়েছি। তখন সরকার আমাকে ঢাকা শহরে থাকার জন্য বাড়ি ভাড়া দিত চার হাজার টাকা। প্রথম শ্রেণির একজন গেজেটেড কর্মকর্তার ঢাকা শহরে সেসময়ে  থাকতে দশ থেকে পনেরো হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া দিতে হতো। বছর শেষে ট্যাক্স রিটার্ন জমা দেয়ার সময় সবাই লিখতো বাড়ি ভাড়া দেই চার হাজার টাকা। প্রয়াত অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান একবার এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, "আমার অফিসাররা বারো হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া দিয়ে ট্যাক্স রিটার্নে লিখে চার হাজার । দেই চার হাজার। সে টাকায় থাকা যায় না বলেই কিছু বলি না। না জানার ভান করি।"

সাইফুর রহমান বাংলাদেশ নামের দেশে বাস করতেন বলে বাস্তবতা মেনে নিয়েছিলেন । অন্য দেশের বাসিন্দা হলে এসব বুঝবার কথা না । যেমনটি ঘটেছিলো যখন আমি চাকরির জন্য ব্রুনাই পিএসসি-র মুখোমুখি হয়েছিলাম দিল্লিতে। পাশ করার পর আমিও এক বছর অনারারি করেছি। 'অনারারি' মেডিকেল অফিসার কী জিনিস তা ব্রুনাই পিএসসি-কে বোঝাতে আমাকে গলদঘর্ম হতে হয়েছিল। তারা 'অনারারি'র এ কনসেপ্টে খুবই বিস্ময় প্রকাশ করেছিলো। সেই থেকে সিভি-তে আমি আর 'অনারারি' শব্দটি লিখি না। 

'অনারারি' মেডিকেল অফিসার নামে বাংলাদেশের হাসপাতালে একটি পদ রয়েছে। যে পদে নামেই কেবল মেডিকেল অফিসার। পদ আছে, বেতন নেই। শুধু শুধু বেগার খাটা। শুধু শুধু বলা ভুল হবে। এটির মাধ্যমে বেকার চিকিৎসক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। আমাদের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা এ প্রশিক্ষণ নিতে ওই বেকার নবীন চিকিৎসককে বাধ্য করে। ওই প্রশিক্ষণ কিছু কিছু উচ্চ শিক্ষাক্ষেত্রে অতি আবশ্যক শর্ত। তাই  উচ্চশিক্ষা গ্রহণে ইচ্ছুক বেকার চিকিৎসকরা মরিয়া হয়ে, না খেয়ে, অমানুষিক কষ্ট করে এ জাতীয় প্রশিক্ষণ নিতে বাধ্য হয়। প্রতিবেশী দেশ ভারতে এ প্রশিক্ষণ চলে উচ্চশিক্ষা চলাকালে বা পরে। পোস্টগ্রাজুয়েশনে ভর্তির আগে আবশ্যিক প্রশিক্ষণ উঠিয়ে দেয়ার ব্যাপারে বিজ্ঞজনদের ভাবা প্রয়োজন। বেতন ছাড়া চাকরি বলেই অনেকে মস্করা করে 'অনারারি'দেরকে বলে 'অনাহারী' মেডিকেল অফিসার। 

আমি বিস্মিত হয়েছি ঢাকার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের 'অনারারি' মেডিকেল অফিসার নিয়োগে শর্তাবলী দেখে। শর্ত মোতাবেক প্রশিক্ষণ চলাকালীন কোনও চিকিৎসক অন্য কোথাও চাকরি করতে পারবে না। অন্যত্র চাকরির তথ্য প্রমাণ হলে সার্টিফিকেট দেওয়া হবে না। প্রশিক্ষণ সার্বক্ষণিক। প্রশিক্ষণার্থীকে সরকারি চিকিৎসকদের মতই দায়িত্ব পালন করতে হবে। প্রশিক্ষণার্থীকে সরকারি বাসস্থান দেওয়া হবে না। নিজ দায়িত্বে বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। 

খুবই যুক্তিসঙ্গত ও বাস্তবসম্মত শর্ত, কোন সন্দেহ নেই। সঠিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্যে এ শর্তাবলী। কিন্তু বাস্তবে কি এটি সম্ভব? দেশে বাস করে এ বাস্তবতা না বোঝার তো কথা নয়। কাজ আছে, টাকা নেই। টাকা ছাড়া সে থাকবে কই ? খাবে কী? হাসপাতালে আসবে কীভাবে? শিক্ষার নিমিত্তে শর্ত দেয়ার আগে অপর চার মৌলিক চাহিদা- অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করাটা জরুরি। যদি সেটা নিশ্চিত না করতে পারেন, তাহলে সাইফুর রহমানের মতো চেপে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।

সাইফুর রহমানের মতো যদি চেপে যেতে না চান, তাহলে এ সরকারের দুই অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বা আ হ ম মুস্তফা কামালের চালু করা বাড়ি ভাড়া ভাতার মতো কিছু একটা সুরাহা করে, কর এড়ানোর দিকে চোখ দিতে হবে। সাইফুর রহমান সাহেব যে কাজটি করতে পারেননি, সেটি করেছেন হালের অর্থমন্ত্রীরা। সরকারি চাকুরীজীবীদের বাড়ি ভাড়া দিচ্ছেন বাজার দরে। বিনিময়ে বাড়ি ভাড়া দাতা ও গ্রহিতাদের ভাড়া লেনদেন ব্যাংকের মাধ্যমে করা আবশ্যিক করেছেন। যাতে ট্যাক্স রিটার্নকালে কোনও পক্ষই ফাঁকি দিতে না পারে। 'অনারারি' মেডিকেল অফিসার নির্বাচনের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ প্রশিক্ষণার্থীদের (নিদেনপক্ষে) অন্ন ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করে, 'যত খুশি তত আদায়' এর প্রকল্প হাতে নিতে পারে। স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগের এ ব্যাপারে এগিয়ে আসা এখন সময়ের দাবি। 

ঢাকা ও অন্যান্য (প্রযোজ্যক্ষেত্রে) শহরে থাকা খাওয়ার মত ন্যূনতম পারিশ্রমিকের বিনিময়ে তারা প্রশিক্ষণার্থী চিকিৎসক চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিতে পারে। তাতে দুই পক্ষই লাভবান হতে পারে। একদিকে হাসপাতালে চিকিৎসক সমস্যার সমাধান। অন্যদিকে প্রশিক্ষণার্থীদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ গ্রহণ। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে এ নিয়োগ হওয়া বাঞ্চনীয়। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের এসব শর্তাবলী ভবিষ্যতের সেই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা যেতে পারে।