প্রবীণদের জীবনের দায়িত্ব থাকুক তাদেরই হাতেই

উপমা মাহবুবউপমা মাহবুব
Published : 26 May 2022, 12:03 PM
Updated : 26 May 2022, 12:03 PM

উন্নয়ন পেশাজীবী হিসেবে আমি নিয়মিত গ্রাম-গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়াই। দরিদ্র মানুষের জীবনকে খুব কাছ থেকে দেখি। এ রকম অনেক বাড়িতে গিয়ে দেখেছি বৃদ্ধ বাবা-মা বা বিধবা মায়ের ভাঙ্গা কুটিরের সঙ্গেই লাগোয়া ছেলের ঘর। কিন্তু তারা আলাদা পরিবার হিসেবে জীবনযাপন করেন। পুত্ররা তাদের স্ত্রী-সন্তান নিয়ে নিজেদের মতো থাকে। বাবা-মা খেলো কি না তার খোঁজও রাখে না। রান্নাঘর কিন্তু তাদের একটাই! এই পুত্ররা নিজেরাও অত্যন্ত দরিদ্র। তবে বয়সে তরুণ এবং কমর্ক্ষম হওয়ার কারণেই সম্ভবত তাদের বেশিরভাগের ঘর এবং অর্থনৈতিক অবস্থা বাবা-মায়ের চেয়ে তুলনামূলকভাবে একটু ভালো হয়। অন্যদিকে তাদের বৃদ্ধ বাবা-মায়েরা ভিক্ষে করে বা শরীরে যতটুকু কুলায় ততটুকু কামলা খেটে খেয়ে না খেয়ে দিন পার করেন।

জানি, অনেকেই ভাবছেন, 'কত পাজি ছেলে আর ছেলের বউ, বাবা-মায়ের দেখাশোনা করে না'। অথচ এই বাবা-মায়েদের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, অধিকাংশই তাদের স্ত্রী-সন্তান নিয়ে আলাদা থাকা ছেলের ওপর ক্ষুব্ধ নন। তারা বরং বলেন, 'ও তো নিজেই অনেক কষ্ট করে সংসার চালায়, আমাদের কী খেতে দেবে?'। এই বক্তব্য কিন্তু মোটেই যুক্তিহীন নয়। একজন অতিদরিদ্র তরুণ যে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন তার পক্ষে স্ত্রী-সন্তান-বাবা-মা এত মানুষের দায়িত্ব নেওয়া যে সম্ভব নয় তা নিজ জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে তাদের বাবা-মায়েরা খুব ভালোভাবে বোঝেন। তাই তারা ভাবেন বাকি জীবনটা নিজেরা কোনোমতে চালিয়ে নেবেন। পুত্র তার পরিবার নিয়ে একটু ভালো থাকুক।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মধ্যবিত্ত পরিবার কাঠামোর চিত্র আবার ভিন্ন। এখানে পুত্র তার বৃদ্ধ বাবা-মায়ের দায়িত্ব নেবে এটা অনেকটা বাধ্যতামূলক। মধ্যবিত্ত পরিবারের বড় একটা অংশ আবার বাড়ির স্ত্রী-কন্যাদের চাকরি করা পছন্দ করে না। ফলে পুরুষ একাই অর্থ উপার্জনের ঘানি টেনে যান। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই বাবা-মায়েদের জীবনে নিজের বলে কিছু থাকে না। তারা সন্তানের জন্য বাঁচেন। কন্যার একটা ভালো ঘরে বিয়ে হবে আর পুত্র বড় চাকরি পেয়ে তাদেরকে শেষ বয়সে আরাম-আয়েসে রাখবে– এই আশায় তাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়গুলো নিঃশেষ হয়ে যায়। তবে বাস্তবতা খুব নিষ্ঠুর। কর্মজীবনে প্রবেশ করার পর এই পুত্রদের বড় অংশ যে চাকরি পায় তা তাদেরকে তাদের পিতার মতোই একটা জোয়াল বাধা প্রাণীতে পরিণত করে। তারাও রোবটের মতো সংসারের ঘানি টানতে শুরু করেন। স্ত্রী-সন্তানের লালনপালন করে বাবা-মাকে বুড়ো বয়সে দেখেশুনে রাখার, তাদের চিকিৎসার খরচ চালানো– সবই তাদের জন্য কষ্টকর ও ব্যয়বহুল হয়ে যায়।

বুড়ো বয়সে সন্তান আমার সব দায়িত্ব নেবে, আমাকে খাওয়াবে– আমাদের সমাজে প্রচলিত এই ধারণাটাই আসলে সঠিক নয়। বিশেষ করে শিক্ষিত এবং সচেতন মানুষ যা-ই উপার্জন করুন না কেন, তাদের উচিত কর্মক্ষম থাকা অবস্থাতেই অবসর নেওয়ার পর বা বৃদ্ধকালে তার জীবন কীভাবে চলবে তার একটা পরিকল্পনা করা। সব সম্পদ সন্তানের পেছনে বিলিয়ে না দিয়ে স্বামী-স্ত্রী নিজেদের ভবিষ্যতের জন্য কিছু সঞ্চয় করা, ইনস্যুরেন্স সুবিধা গ্রহণ করা। অন্যদিকে রাষ্ট্রের দায়িত্ব প্রতিটি প্রবীণ নাগরিক যেন তাদের বৃদ্ধকাল সুন্দরভাবে পার করতে পারেন তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা। বর্তমানে বাংলাদেশে দুস্থ, স্বল্প আয় করেন বা আয় করতে অক্ষম এ রকম বয়স্ক জনগোষ্ঠীর জন্য বয়স্কভাতা কাযর্ক্রম চালু আছে। ১৯৯৭-৯৮ অর্থবছর থেকে শুরু হওয়া কার্যক্রমটির উপকারভোগীর সংখ্যা সময়ের পরিক্রমায় অনেক বেড়েছে। ভাতার পরিমাণ ১০০ টাকা দিয়ে শুরু হয়ে বর্তমানে ৫০০ টাকা হয়েছে। কিন্তু এগুলো যথেষ্ট নয়। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই সামাজিক সুরক্ষা কাযর্ক্রমটিকে সার্বজনীন করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি ভাতার পরিমাণ বাড়াতে হবে। তবে এটাও ঠিক সরকারকে দরিদ্র ও অবহেলিত জনগোষ্ঠীর জন্য আরও অনেক ধরনের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি পরিচালনা করতে হয়। ফলে বয়স্কভাতার পরিধি ও পরিমাণ বাড়াতে বিশাল বাজেট নির্ধারণ করা সহসা সম্ভব নয়। এই অবস্থায় প্রবীণ জনগোষ্ঠী যেন সুন্দরভাবে খেয়ে-পরে বাকিটা জীবন পার করতে পারেন তা নিশ্চিত করতে হলে আরেকটি প্রচলিত ভুল ধারণাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে হবে। আমরা বাঙালিরা মনে করি, একটা নিদিষ্ট বয়সের পর প্রতিটি মানুষ কোনো কাজ করতে পারে না। তারা বাসায় বসে সন্তানদের সেবা গ্রহণ করবেন। এই ধারণায় বিশ্বাস করার কারণে চাকরি থেক অবসরে যাওয়ার পর বা পুত্র-কন্যার বিয়ে হওয়ার পর, যতটা না শারীরিকভাবে তারচেয়ে মানসিকভাবে বাবা-মায়েরা নিজেদের বয়স্ক এবং পরনির্ভরশীল ভাবতে শুরু করেন। কিন্তু বয়স যাই হোক একজন কর্মক্ষম মানুষের হুট করে সব কাজকর্ম ছেড়ে দেওয়া ঠিক নয়। বরং প্রতিটি মানুষেরই উচিত যতদিন সম্ভব নানা রকম কাজের মধ্যে থাকা। শরীর এবং মস্তিষ্ককে সচল রাখা প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সুস্থতার জন্যও জরুরী।

এটা ঠিক যে একটা নির্দিষ্ট বয়সের পর সবাইকেই অর্থ আয়ের দায়িত্ব থেক অবসর নিতে হয়। মায়েদের সংসারের চাবি পুত্রবধূর হাতে তুলে দিতে হয়। কিন্তু একজন প্রবীণ মানুষের সারা জীবন সঞ্চিত যে জ্ঞান, দক্ষতা এবং প্রজ্ঞা তা অত্যন্ত মূল্যবান। এগুলো আমাদের জাতীয় সম্পদ। প্রবীণ হলেও সুযোগ ও সহায়তা পেলে তারা নানাভাবে সেগুলাকে ব্যবহার করে সমাজ ও জাতীর উন্নয়নে অবদান রাখতে পারেন। শুধু শিক্ষিত মানুষ নয় গ্রামের একজন প্রবীণ কৃষকের কৃষি কাজ করার অভিজ্ঞতারও অনেক মূল্য আছে। একজন গৃহবধূ মা অনেক টোটকা ওষুধের খবর রাখেন। এই জ্ঞানগুলো থেকে আমরা নিজেদের বিশেষ করে পরবর্তী প্রজন্মকে বঞ্চিত করে রাখছি। তাই সরকারসহ সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের প্রবীণ জনগোষ্ঠীর জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞাকে কীভাবে কাজে লাগানো যায় যা উভয় পক্ষের জন্যই লাভজনক হবে তা খুঁজে বের করতে হবে। প্রবীণদের চাহিদা খুব সীমিত। তারা সন্তানদের ওপর নির্ভরশীল থাকেন বটে কিন্তু অনেকেই আছেন যারা তাদের বয়স, অভিজ্ঞতা এবং সক্ষমতা অনুযায়ী কাজের সুযোগ পেলে নিজেরাই নিজেদের জীবনের দায়িত্ব নিতে আগ্রহী। অল্প বিনিয়োগেই তাদের এই চাহিদা পূরণ সম্ভব। কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা গেলে বয়স্কভাতার ওপর তাদের নিভর্রশীলতাও অনেক কমে আসবে।

বাংলাদেশে পুত্র-কন্যারা বিদেশে গিয়ে স্থায়ী হয়েছে আর বাবা-মা দেশেই থাকেন এ রকম প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বর্তমানে অনেক। এটাই বাস্তবতা যে এই হার বাড়তে থাকবে। তাই সন্তানদের দোষারোপ করে নয় বরং এই বাবা-মায়েদের দেখাশোনা করার জন্য নানাবিধ উদ্যোগ গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি। এই বিষয়টিকে পলিসি লেভেলের আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সম্প্রতি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় একটি চমৎকার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। মন্ত্রণালয়ের অধীনে অভিভাবকহীন শিশু এবং বৃদ্ধাশ্রমে বসবাসকারী প্রবীণদের একই কমপাউেন্ড থাকার ব্যবস্থা করা হবে। এর ফলে শিশুরা বয়স্ক নাগরিকদের আদর-স্নেহ পাবে। তাদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখবে। পাশাপাশি প্রবীণদেরেও সময়টা ভালো কাটবে। তারা ওই শিশুদের মানিসক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবেন।

আমাদের এরকম আরও অনেক উদ্ভাবনী উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। প্রবীণদের সমাজের বোঝা মনে করার মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশে তরুণ জনগাষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠ। আজকে তারা দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে নিরলস পরিশ্রম করে চলেছেন। আগামীতে তারা যখন বৃদ্ধ হবেন তখন দেশে প্রবীণ জনগোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠ হবে। এই মানুষগুলো যেন নিরাপদ ও সুন্দর জীবনযাপন করতে পারেন তা নিশ্চিত করা আমাদের সবার দায়িত্ব। আজকের তরুণ আগামীতে যেন বোঝা হিসেবে গণ্য না হয় এটা আমাদের সবারই কাম্য।