শৈশব কৈশোরের স্বপ্ন রাঙানো আবদুল গাফফার চৌধুরী

আনিসুর রহমান
Published : 23 May 2022, 11:15 AM
Updated : 23 May 2022, 11:15 AM

‌"আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি- গানটির রচয়িতা কে?" সাধারণ জ্ঞানের বইগুলোতে এই প্রশ্নটি ছিল আমার শৈশব কৈশোরের ১৯৮০ এর দশকে। চারটি প্রশ্নের একটি সঠিক উত্তর অবধারিত- আবদুল গাফফার চৌধুরী। এই ভাবেই আবদুল গাফফার চৌধুরী নামটির সঙ্গে পরিচয়, বেড়ে ওঠা আর উদার প্রগতিশীল অসাম্প্রয়দায়িক লেখাজোকার প্রতি চেতনে-অবচেতনে একটা টান রপ্ত করা।

ওই বয়সে ধরেই নিয়েছিলাম অত আগে ভাষা আন্দোলনের প্রভাতফেরির অবধারিত গানটির যিনি লেখক, তিনি বোধ হয় আর এই দুনিয়ায় নাই। তার গানটি আমরা স্কুলের ছেলেমেয়েরা মুখে মুখে আওড়াই। টাঙ্গাইলের মধুপুর শহীদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরিতে সমবেত সকলে মুখে মুখে বলতে বলতে বংশাই নদীর ধরে শহীদ মিনারের দিকে যেতাম।

ওই সময়েই দৈনিক পত্রিকাগুলোতে উপসম্পাদকীয় বা মতামত বিভাগের বড় কলেবরের লেখাগুলো পড়ার প্রতি একটা ঝোঁক তৈরি হয় আমার মাঝে। এর পেছনে আমার কয়েকজন শিক্ষকের অনুপ্রেরণা কাজ করেছে। এর মধ্যে ছিলেন বিধুভূষণ মজুমদার, আনোয়ার হোসেন আর শেখ মো. আব্দুল জলিল। বিধুভূষণ মজুমদার বাংলা পড়াতেন, আনোয়ার হোসেন ইতিহাস আর শেখ মো. আব্দুল জলিল ইংরেজি পড়াতেন। এরা তিনজনেই নির্ধারিত পাঠ্যসূচির বাইরে বাংলাদেশের ইতিহাস, সাহিত্য, সংস্কৃতি আর রাজনীতি নিয়ে নানা ঘটনা আর গল্প বলতেন। তাদের মুখ থেকেও গাফফার চৌধুরীর প্রসঙ্গে শুনেছি।

এই তিন মহান শিক্ষকের অনুপ্রেরণায় নির্ধারিত পাঠ্যসূচির বাইরে পড়াশোনার প্রতি ব্যাপক আগ্রহ জন্মে বটে। কিন্তু সেই আগ্রহ মেটাবার মতো বইয়ের জোগান, গ্রন্থাগার বা এরকম সুযোগ আমার ধরাছোঁয়ার মধ্যে ছিল না। তাই পত্রিকাগুলোতে শুক্রবারের সাহিত্য সাময়িকী আর সপ্তাহের কলামগুলো পড়া শুরু করি মধুপুর থানাসদরের বিভিন্ন দোকানের বাইরের বেঞ্চে বসে বসে। এরকম বেঞ্চে বসেই গাফফার চৌধুরীর পত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকা লেখাগুলোর সঙ্গে পরিচয়। এরপর তার লেখার সঙ্গেই বড় হয়েছি। কখনো কখনো তার লেখার নিচে তারিখ এবং লন্ডন শব্দটি লেখা থাকতো। এতেই বুঝে গিয়েছিলাম, তিনি বুঝি বিলেতবাসী বিশাল এক মানুষ। ওই সময়ে আমার মাঝে একটা ধারণা কাজ করতো, বিলেতে যারা থাকেন বা পড়াশোনা করতে যান- তারা সবাই জমিদার খান বাহাদুরের সন্তান বা অনেক ধনী। আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরীও এরকম কেউ হবেন। আর নিতান্তই গ্রামের পিছিয়ে পড়া মানুষদের যাদের একটু সামর্থ্য আছে তারা সৌদি-টৌদি যায় নিজেরা আরো একটু ধনী হবার জন্যে।

বেশ। এরপর ১৯৯০ দশকের শেষ দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকার সময়ে সাংবাদিক বেবী মওদুদের স্নেহছায়ায় কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। উনি বসতেন ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের সাপ্তাহিক বিচিত্রা অফিসে। উনি ছিলেন এই পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, শেখ রেহানা ছিলেন সম্পাদক। এই পত্রিকা চালু হবার আগে থেকেই বেবী আপা বিশ্বাস করে অনেক প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য কাজে আমাকে যুক্ত করেছিলেন। বিচিত্রাতে চাকরিজীবনের শুরু হয়েছিল বেবী আপার আশ্রয়ে। বিচিত্রা অফিস থেকে ওই সময়ে লন্ডনে কখনো লোক মারফত কখনো কূটনৈতিক চ্যানেলে বা কখনও ডাকযোগে দুইটি ঠিকানায় নিয়মিত দুটি প্যাকেট যেত। এর একটি ছিল শেখ রেহানার আর অপরটি ছিল আব্দুল গাফফার চৌধুরীর। ওই দুই প্যাকেটে থাকতো বইপুস্তক, পত্রিকা আর সাময়িকী। এই কাজটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে বেবী আপা করতেন আর তাকে এই কাজে বিশ্বস্ততার সঙ্গে সহযোগিতা করতেন বিচিত্রার প্রশাসন বিভাগের প্রধান রাশিদা বেগম আসমা। পরে রাশিদা বেগমের কাছ থেকে গাফফার চৌধুরীর অনেক গল্প শুনেছিলাম। অনেক সময় বিলেতবাসী আরেকজন সাংবাদিক ও বঙ্গবন্ধু পরিবারের ঘনিষ্ঠ আমিনুল হোক বাদশাও আসতেন বিচিত্রায়। তিনি ও রাশিদা গল্পে গল্পে গাফফার চোধুরীর কথা বলতেন। বেশ কয়েকবার এরকম গল্প শোনার সুযোগ আমার হয়েছিল।

পরে নানা ঘটনা ও কালক্রমে পাঠক হিসেবে বুঝে গেলাম আব্দুল গাফফার চৌধুরী বাংলাদেশের পক্ষে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আর বাঙালি জাতীয়তাবাদের পক্ষে একনিষ্ঠ প্রচারক। এর সঙ্গে আরো যোগ করে বলা যায়, আওয়ামী লীগের একনিষ্ট প্রচারক, বিশেষ করে শেখ হাসিনার রাজনীতির পথরেখা বিশ্লেষণ করার এক নির্ভরতার জায়গা।

এ প্রসঙ্গে ডক্টর কামাল হোসেন একবার অভিযোগ করে গাফফার চৌধুরীকে বলেছিলেন- আপনার লেখায় সবসময় শেখ হাসিনার প্রতি পক্ষপাত  থাকে। এই অভিযোগ উড়িয়ে না দিয়ে গাফফার চৌধুরী দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিলেন, ড. কামাল ঠিক বলেছেন, শেখ হাসিনার পক্ষে কলম ধরা তার লেখালেখির একটা সৎ উদ্দেশ্য।

খেয়াল করে দেখেছি নতুন কোনো পত্রিকা প্রকাশের প্রথম দিকে গাফ্ফার  চৌধুরীর লেখাজোকা না থাকলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আর বাঙালি জাতীয়তাবাদের পক্ষে ওই পত্রিকার অবস্থান গ্রহণযোগ্য করে তোলা একপ্রকার কঠিন হয়ে গিয়েছিল। গাফফার চৌধুরীর লেখা কোনো পত্রিকায় ছাপানো মানে ওই পত্রিকার একধরনের স্বীকৃতি বা চরিত্রের সনদের মতো।

বঙ্গবন্ধু গাফ্ফার চৌধুরী থেকে চৌদ্দ বছরের বয়োজ্যেষ্ঠ ছিলেন। জাতির পিতার সঙ্গে তার পরের প্রজম্মের তিন তরুণ সাংবাদিকের সঙ্গে অনেকটা নিত্যদিনের সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। এদের তিনজনকে বঙ্গবন্ধু রসিকতা করে স্নেহের তাৎপর্য প্রকাশ করতে বলতেন,  'এরা তিনজন হচ্ছে আমার আপদ বিপদ আর মসিব্বত: আব্দুল গাফফার চৌধুরী, ফয়েজ আহমদ আর এবিএম মূসা।' আসলে আপদে বিপদে আর মসিবতে বঙ্গবন্ধু এদেরকে বিশ্বাস করতেন আর নির্ভরযোগ্য খবরাখবর পেতেন।

সেই গাফফার চৌধুরী আজীবন তার অবস্থানের নড়চড় করেন নি। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তার বাংলাদেশ, বাঙালি জাতি আর কন্যা শেখ হাসিনার রাজনীতির পক্ষে অবিরাম লিখে গেছেন। তিনি তার লেখালেখিতে পরিষ্কার করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে বাংলাদেশ এবং আওয়ামী লীগ এর অপ্রতিরোধ্য অপ্রতিদ্বন্দ্বী কাণ্ডারি হবেন শেখ হাসিনা, অন্য কেউ নন।  তার মানে এই নয় যে তার দৃষ্টিতে, শেখ হাসিনার কোনো ভুল সিদ্ধান্ত লেখার মাধ্যমে সমর্থন করেছেন। তিন বরং তার লেখায় অনেক সময় শেখ হাসিনাকে সতর্ক করেছেন।

১৯৩৪ থেকে ২০২২ সাল- এই ৮৮ বছরের জীবনে কর্মজীবন ছিল সত্তর বছরের উপরে। এই সত্তর বছরে তার লেখার গতিবিধি ও রাজনৈতিক দিকনির্দেশনার পরিধি ঈর্ষণীয়। তিনি যা বলেছেন বা অগ্রিম লিখেছেন তা অনেকটাই ফলেছে। তিনি ছিলেন খবরের কাগজের পাতায় বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির এক ট্রাফিক সিগনাল।

ইতিহাস, রাজনীতি, দর্শন আর সাহিত্য নিয়ে তার জানাশোনা ছিল সমুদ্রসমান। প্রকাশের ভাষা ছিল সরল, সুন্দর আর বোধগম্য। তিনি যে কেবল রাজনৈতিক বিষয় তার কলমে তুলে ধরতেন তা নয়, তার লেখা ছিল বহু বৈচিত্র্যময় প্রসঙ্গে টইটুম্বুর। তিনি যেমন তার থেকে বয়সে বড়দের  নিয়ে কলম ধরতেন, তেমনি তার থেকে বয়সে অনুজদের নিয়েও লিখতেন, কথা বলতেন, মানুষের প্রয়োজনে সুপারিশ করতেন। তিনি হুমায়ূন আহমেদ এর মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে চমৎকার এক লেখা লিখেছিলেন। তাতে বুঝেছিলাম, তিনি ছিলেন হুমায়ূনের লেখার একনিষ্ঠ পাঠক। ওই লেখাটিতে, আফসোস করে বলেছিলেন, "অবচেতন মনে কল্পনা করেছিলেন, তার  মৃত্যুর পর হুমায়ূন আহমেদ তাকে নিয়ে লিখবেন। কিন্তু সেই ভাগ্য আর হলো না, এখন অগ্রজ হয়ে অনুজ এর পক্ষে লিখতে হলো।"

তার লেখা থেকেই জানতে পারি, ইতালির শহর বোলোনিয়ার গুরুত্ব। তার লেখা থেকেই জেনেছিলাম পার্ল এস বার্ক  'গুড আর্থ' উপন্যাস লিখে সাহিত্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। উপন্যাসটি লেখা হয়েছে চীনের গ্রামীণ কৃষক সমাজের জীবনের উপর ভিত্তি করে। এরকম হাজার হাজার বিরল সূত্র আর বিশ্লেষণে ভরা তার লেখালেখি।

তার মাঝে কিছু খেদ যে ছিল না, তা কিন্তু নয়।  তিনি চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর জীবনভিত্তিক বড় বাজেটের একটা ছায়াছবি নির্মাণ করতে। সেই আফসোস ছিল তার। আক্ষেপ রয়ে গেলো অক্ষম আমাদের। তিনি আক্ষেপ করেছিলেন এতো এতো রাজনৈতিক লেখা না লিখলে তিনি সৃজনশীল সাহিত্যে বিশেষ করে কবিতা, উপন্যাস আর কথাশিল্পে  আরো সময় দিতে পারলে লেখক হিসেবে তার সম্ভাবনার প্রতি সুবিচার করা হতো।

জীবনটাকে যখন যেখানে যেমন, সেই সহনশীল আর দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী গাফফার চৌধুরী জমিদার পরিবারের সন্তান হয়ে জীবনের প্রথম দিক থেকে প্রায় গোটাজীবনে আর্থিক টানাপড়েন থেকে কি মুক্তি পেয়েছিলেন?

গাফফার চৌধুরীর সততা আর ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তা ছিল অবাক করার মতো। ঢাকার বহুল পঠিত দুটি মূলধারার পত্রিকা আর একটি ট্যাবলয়েড পত্রিকার তিন সম্পাদককে নিশানা করে অনেকবার তাদের দুইনম্বরি দুরভিসন্ধি তুলে ধরে লেখালেখি করেছেন, এমনকি অবিরাম এই ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন মৃত্যুর আগে পর্যন্ত। কিন্তু গণমাধ্যমের 'মুঘল' হবার পরেও এই সম্পাদকত্রয় তার বিরুদ্ধে কোনো একটি শব্দ উচ্চারণ করার অসৌজন্যতা বা দুঃসাহস দেখাননি।

একবার আওয়ামী লীগ এর তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে সমালোচনা করে দিকনির্দেশনামূলক একটি লেখা লিখেছেন গাফ্ফার চৌধুরী। এর কিছুদিন পরে একবার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম আর আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী একই বিমানের যাত্রী। যাত্রাপথে দূর থেকে দেখে মন্ত্রী তার আসন ছেড়ে গাফফার চৌধুরীর কাছে এসে কুশলবিনিময় করেছেন, খোঁজখবর নিয়েছেন। পরের একটি লেখায় সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের প্রশংসা করতে ভোলেননি গাফফার চৌধুরী।

বছর কয়েক আগে গাফফার চৌধুরী সংক্ষিপ্ত সফরে ঢাকায়। আমিও বেশ কয়েকদিনের জন্যে ঢাকায়।  জাতীয় প্রেসক্লাবে সাবেক এক সচিবের সঙ্গে চা-পর্বের আলাপচারিতায় আগ্রহ প্রকাশ করলাম, "আবদুল গাফফার চৌধুরী ঢাকায়, আপনি যেহেতু উনার সবকিছু সমন্বয় করছেন, যদি দয়া করে আমাকে 'সালাম' দেবার একটা সুযোগ করে দিতেন।" সদাচারী সাবেক সেই সচিব আমার অনুরোধটা গুরুত্বের সঙ্গে নেননি। ফলে আমার আর দেখা করা হয়ে ওঠেনি।

সেই ইচ্ছা অপূর্ণ থাকতেই চলে গেলেন শৈশব কৈশোরের স্বপ্ন রাঙানো আবদুল গাফফার চৌধুরী।