বাংলাদেশ মডেল বনাম তরুণ প্রজন্মের আইডল

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 21 May 2022, 04:41 PM
Updated : 21 May 2022, 04:41 PM

বাংলাদেশ কি মিরাকল না-কি মডেল? বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলসহ কয়েকটি বিশ্ব সংস্থা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি অতি উন্নত দেশ থেকে বার বার বলা হয়েছে- ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে দেশটি সৃষ্টি করেছেন, তার অর্থনীতির ভিত খুব দুর্বল, বেশিরভাগ নারী অন্তঃপুরবাসিনী, অশিক্ষা-কুসংস্কার সর্বব্যাপী তদুপরি এত দুর্নীতি- এমন দেশটি টিকে গেলে সেটা হবে 'মিরাকল'। তাদের বিবেচনায় বাংলাদেশ ছিল, একটি 'বাস্কেট কেস'। এটি কেবল টিকে থাকতে পারে যুক্তরাষ্ট্র, বিশ্বব্যাংক প্রভৃতি দেশ ও সংস্থার দয়ায়।

কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান এ দেশের সম্ভাবনা যথার্থ উপলব্ধি করেছিলেন। ১৯৭৪ সালের অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে ওয়াশিংটন সফরকালে তিনি বলেছিলেন, "আমাদের কেউ কেউ বাস্কেট কেস বলে উপহাস করে। কিন্তু বাংলাদেশ বাস্কেট কেস নয়। দু'শ বছর ধরে বাংলাদেশের সম্পদ লুট করা হয়েছে। বাংলাদেশের সম্পদেই শ্রীবৃদ্ধি করা হয়েছে লন্ডন, ডান্ডি, ম্যানচেস্টার, করাচি, ইসলামাবাদের। আজো বাংলাদেশের অফুরন্ত সম্পদ রয়েছে। একদিন আমরা দেখাবো বংলাদেশ নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে।" [বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ, ড. এম ওয়াজেদ মিয়া, পৃষ্ঠা ১৯০]

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভবিষ্যদ্বাণী সঠিক প্রমাণিত হয়েছে। বাংলাদেশ এখন আর স্বল্পোন্নত দেশের সারিতে নয়, বরং উন্নয়নশীল বিশ্বের তালিকায়। জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস কোভিড-১৯ সংক্রমণের পরের পরিস্থিতি এবং রাশিয়া-ইউক্রেইন সংঘাতের কারণে সৃষ্ট সংঘাতময় দুর্দশা থেকে উত্তরণের জন্য হাতে গোণা যে কয়েকজন বিশ্বনেতার সঙ্গে পরামর্শ করেছেন, তাদের মধ্যে জ্বলজ্বল করছে করছে একটি নাম- শেখ হাসিনা, বঙ্গবন্ধুকন্যা। না কোনো অসাধ্যসাধন তিনি করেননি, কোনো মিরাকল নয়- যথার্থ নেতৃত্ব দিয়ে তিনি বাংলাদেশকে এমন অবস্থায় নিয়ে গেছেন, যা এখন মডেল তো বটেই, বিশ্বের বিস্ময়ও বটে।

বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক 'বাংলাদেশ কি মিরাকল নামক মডেল'- এ প্রসঙ্গটি সামনে এনেছন হোয়াইট বোর্ড নামের একটি মর্যাদাশীল পত্রিকায় লেখা নিবন্ধে।

না, বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য তিনি লাভ করেননি। তার জন্মের আগেই বঙ্গবন্ধু নিহত হয়েছেন। এরপর দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে তার নাম উচ্চারণ করাও ছিল অপরাধ। লেফটেন্যান্ট জেনারেল এইচ এম এরশাদের দুঃশাসনের সময় ঢাকার একটি স্কুলের ছাত্র ছিলেন রাদওয়ান মুজিব। মা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ রেহানা, পিতা শফিক সিদ্দিক খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ। শিশুটি অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করে স্কুলের বন্ধুদের বাবা-মায়েরা তাকে এড়িয়ে চলেন, সন্তানদের নিষেধ করেন তার সঙ্গে মেলামেশা করতে। একটু বড় হয়ে বুঝেছেন, 'নিষিদ্ধ' বঙ্গবন্ধু পরিবারের সন্তান হওয়ার কারণেই এমন 'নিষেধাজ্ঞা'। ১৯৮০ সালের ২১ মে লন্ডনে জন্ম তার, মা শেখ রেহানা লন্ডনে নির্বাসিত জীবনে। ঠিক ওই সময়ে সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের দুঃশাসন চলছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে যিনি আইন করেছিলেন, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনোভাবেই বঙ্গবন্ধুর কথা বলা বা লেখা যাবে না। এ নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের বিচার করা যাবে না, বিচার চাওয়াও যাবে না।

রাদওয়ান মুজিবের জীবনযাপনে জাতির জনক এবং তার পরিবারের মহত্তম উত্তরাধিকারের ছাপ স্পষ্ট। সবার সঙ্গে মিশতে পারেন, প্রোটোকল সুবিধা নিয়ে মাথা ঘামান না। নিজের মা ও খালাকে মনে করেন- 'সদা হাস্যোজ্জ্বল প্রাণময়ী নারী, পুরুষোত্তম পিতার সংগ্রামী আদর্শ আর সর্বংসহা মাতার অসীম ধৈর্য যাদের এগিয়ে যাওয়ার পুঁজি'।

রাদওয়ান মুজিব বিশ্বখ্যাত লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিস্ক থেকে রাজনীতি ও ইতিহাস বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর কমপারেটিভ পলিটিক্স বিষয়ে এম এ ডিগ্রি অর্জন করেছেন। মেধা-মননের সঙ্গে সাংগঠনিক দক্ষতা অতুলন তার। ২০০৭ সালের ২২ এপ্রিল শেখ হাসিনা লন্ডন থেকে ঢাকা ফেরার সময় বাংলাদেশের তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নির্দেশে তাকে বাধা দেওয়া হয়। কিন্তু শেখ হাসিনা অদম্য। তিনি লন্ডনে সংবাদ সম্মেলন, পার্লামেন্ট সদস্য ও সিভিল সোসাইটির সঙ্গে আলোচনা ও অন্যান্য কর্মসূচির মাধ্যমে এ ঘটনাকে বাংলাদেশের গণতন্ত্র যে কতটা বিপন্ন, তা নজির হিসেবে তুলে ধরেন। খ্যাতিমান সাংবাদিক লন্ডনের স্থায়ী বাসিন্দা আবদুল গাফফার চৌধুরী (সদ্য প্রয়াত) বাংলাদেশের কয়েকজন সাংবাদিককে সে সময়ে বলেছিলেন- রাদওয়ান মুজিবের অনন্য সাংগঠনিক দক্ষতার কারণে লন্ডনে অবস্থানকালে শেখ হাসিনার প্রতিটি কর্মসূচি সফল হতে পেরেছিল। এই তরুণ বয়সেই তিনি একটি প্রতিকূল পরিস্থিতিকে অনুকূলে নিয়ে আসার মতো বুদ্ধিমত্তা দেখাতে পেরেছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র রাদওয়ান মুজিব ২০০৮ সালের ৮ জুলাই বিশ্বখ্যাত সাংবাদিক স্যার ডেভিড ফ্রস্টকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, "বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারেন কেবল শেখ হাসিনাই। তাকে বন্দি রেখে গণতন্ত্র আনা যাবে না।"

গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার সংগ্রামে শেখ হাসিনা ছিলেন সামনের সারিতে। আশির দশকে এইচ এম এরশাদের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন সফল করে তোলায় প্রধান ভূমিকা নিয়েছিল এ দলের নেতা-কর্মীরা। জনগণ শেখ হাসিনার ডাকে সাড়া দিয়েছে। তাকে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছে। তিনি জনগণের ভালবাসা ও আস্থার মূল্য দিয়েছেন। বাংলাদেশ এখন উন্নত বিশ্বের সারিতে বসার কেবল স্বপ্ন দেখে না, এ লক্ষ্যে পৌঁছাবেই- সে বিষয়ে বিশ্ববাসীও নিশ্চিত।

বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বোনের পুত্র- সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দিলে পাবেন নিশ্চিত সাফল্য। কিন্তু নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন এমন কিছু কাজে, যা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গঠনে তরুণ প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ-অনুপ্রাণিত-সংগঠিত করায় সহায়ক হবে। সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন বা সিআরআই নামের প্রতিষ্ঠানটির তিনি অন্যতম প্রাণপুরুষ। যে বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি ভুলিয়ে দিতে চেয়েছিল, তাকে তুলে ধরে ধরার জন্য তিনি বেছে নিয়েছেন এমন একটি ফর্ম, যা শিশু-কিশোর-কিশোরীদের কাছে আকর্ষণীয়। এ পর্যন্ত মুজিব গ্রাফিক নভেল-এর ১০ খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে, শহর-গ্রাম সর্বত্র তার বিপুল চাহিদা।

শেখ হাসিনার জীবন কথা আ ডটার'স টেল নির্মাণের প্রধান উদ্যোক্তাও তিনি।

বঙ্গবন্ধু কিংবা তার কন্যাদের নিষিদ্ধ করে রাখা যায় না। আপন মহিমায় তারা উদ্ভাসিত হয়েছেন। তাদের জীবন নিবেদিত রেখেছেন মুক্তির সংগ্রামে। তাদের কথা নবীন প্রজন্মের কাছে আকর্ষণীয়ভাবে তুলে ধরার কাজ বেছে নিয়েছেন রাদওয়ান মুজিব। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের ত্যাগ-সাহস-স্বপ্ন গাঁথা তুলে ধরার জন্য নির্দিষ্ট ছকে থাকতে চান না তিনি। সর্বদা অনুসন্ধানী নজর তার, নতুন কিছু করার জন্য। বাংলাদেশের গৌরবের ইতিহাস কেবল পরীক্ষায় পাসের জন্য নয়, উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলায় প্রতি মুহূর্তের প্রেরণার আকারে শিশু-কিশোরদের কাছে এ বার্তা ছড়িয়ে দিতে নিরলস সাধনায় নিয়োজিত তিনি। তবে বিস্ময়ের যে এ সব তিনি করে চলেছেন নিজেকে যতটা সম্ভব আড়ালে রেখে এবং একইসঙ্গে পারিবারিক, সামাজিক ও পেশাগত গুরুদায়িত্বের স্বাভাবিক ছন্দ বজায় রেখেই। তার বড় লক্ষ্য- তরুণ প্রজন্মকে জ্ঞানে-গরীমায় এমন সমৃদ্ধ করে গড়ে তোলায় অবদান রাখা, যারা উন্নত বিশ্বের সারিতে নিয়ে যাবে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশকে।

শত ফুল ফুটতে দাও- এটা তিনি কেবল বিশ্বাস করেন না, তাদের জন্য অনুকূল পরিবেশ যেন নিশ্চিত হয়, সে জন্য কাজ করে চলেছেন নিরলস। বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম অসাধ্যসাধন করতে পারে, এটা বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন। ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে তরুণরা লড়েছে অসম সাহসে। তারা দলে দলে রণাঙ্গনে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অংশ নিয়েছে। এখন যে নবীন প্রজন্ম অর্থনীতি-শিল্প-সংস্কৃতি-বিজ্ঞানে সাফল্য লাভ করছে, তাদের ১৯৭১ সালের মতো মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সুযোগ নেই। কিন্তু বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ করার লক্ষ্য অর্জনে যথাযথ অবদান রাখার মধ্য দিয়ে তারাও মহান মুক্তিযোদ্ধাদের যথার্থ উত্তরসূরি হয়ে উঠতে পারেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা এ মহান সংগ্রামে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তারুণ্যেই কিশোর-তরুণদের কাছে আইডল হয়ে ওঠা রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক এ ক্ষেত্রে যে ভূমিকা রাখছেন- সৃজনশীলতা, উদ্যম ও দূরদর্শিতার বিবেচনায় তা অনন্য।