আমরা আসলে কী উৎপাদন করতে চাই?

সুরেশ কুমার দাশসুরেশ কুমার দাশ
Published : 21 May 2022, 01:05 PM
Updated : 21 May 2022, 01:05 PM

খাদ্যপণ্য নিয়ে সারাবিশ্বেই তুলকালাম চলছে, সাথে মূল্যস্ফীতি। আমাদের দেশেও তুলকালাম কম হচ্ছে না। এক 'সয়াবিন যুদ্ধ' আমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছে। এটা 'খাদ্যপণ্যের যুদ্ধের' হিসেবে রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধের চেয়ে কম কিছু ছিল না। এখনও যুদ্ধ শেষ হয়নি। সয়াবিন তেল নিয়ে দেশে যেভাবে লুকোচুরি হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেইনে খাদ্যপণ্য নিয়ে তেমন লুকোচুরির খবর আমরা পাইনি। খাদ্যপণ্য কিনতে লাইনে দাঁড়াতে হয়েছে বটে। আমাদের দেশে একের পর এক অভাবনীয় স্থান থেকে 'সয়াবিন তেলের খনি আবিষ্কার' হয়েছে। একটি জাতির প্রকৃত স্বভাব জানতে এসব 'ব্যবসায়ীরা' যথেষ্ট উদাহরণ তৈরি করেছে।

কিন্তু 'সামান্য সয়াবিন তেল' আর সেসব দুষ্টু ব্যবসায়ীদের নিয়ে পড়ে থাকলে চলবে না। হাওরে বোরো ধান উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে– এটাও দেশের অনেক সচেতন মানুষের আলোচনায় আছে। চালের দাম বাড়ার কথা ছিল না। আবার চালের দাম বাড়ছে এমন খবরও পত্রিকার খবরে জানা যাচ্ছে। চালের দাম না বাড়ানোর জন্য সরকারের নানা উদ্যোগ ছিল। আশা ছিল বোরো ধান নিয়ে। সেখানে যতটা না ফসলহানি হয়েছে তার চেয়ে বেশি খবর রটেছে। এগুলো সয়াবিন তেল ব্যবসায়ীদের মতো চাল ব্যবসায়ীদের জন্য বেশ আরামদায়ক খবর।

'সয়াবিন তেল যুদ্ধে' কোন পক্ষের জয় আর কোন পক্ষের পরাজয় হচ্ছে ব্যবসায়ীরা খুব ভালোভাবে লক্ষ্য করেছেন। সেই হিসাব থেকে ব্যবসায়ীরা শিকারি বাঘের মতো অন্য কোথাও সুযোগ নিতে পারে কিনা ভেবে ওঁৎ পেতে আছে।

এই অবস্থায় ভারতের গম রপ্তানি বন্ধের খবরে ব্যবসায়ীদের কাছে একটা ব্যাপক সুযোগ এসেছে। দেশে চালের চার ভাগের এক ভাগ গম অথবা আটা বা ময়দার চাহিদা আছে। প্রায় ১ কোটি টন। তাহলে গমের দাম বাড়লে চালের ওপর প্রভাব পড়বে। ভাতের বাইরে দেশের একটা বড় অংশের মানুষের নাস্তা হচ্ছে বেকারি পণ্য। যা ময়দা-আটার ওপর নির্ভরশীল। এই প্রসঙ্গে আসছে ডায়াবেটিক রোগীদের কথাও। দেশে ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা প্রায় ৪২৫ মিলিয়ন (২০১৯ সালের হিসাব অনুযায়ী)। তাহলে তারা বড্ড বেকায়দায় পড়বে। অন্য যারা বেকারি নাস্তায় অভ্যস্ত তারা না হয় ভাতে বা অন্য নাস্তায় ফেরত যাবে। সেক্ষেত্রে আবার চালের উপর চাপ পড়বে। কিন্তু ডায়াবেটিক রোগীদের খাবারের সন্ধান কী হবে দাম বাড়লে?

এসব কথা আসবে কারণ খাবারের সঙ্কট তৈরি না হলেও, দামের সঙ্কট তৈরি হচ্ছে। সেখানেই মানুষের খাবারে টান পড়বে। প্রধানমন্ত্রী বলছেন, মানুষকে অপচয় না করতে, কৃচ্ছ্রতা সাধন করতে। মানুষ কৃচ্ছ্রতা সাধন করবে, ঠিক আছে। কিন্তু খাদ্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণের গ্যারান্টি কী! এক সয়াবিনের পেছনে দৌড়াতে গিয়ে ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর ক্লান্ত প্রায়। এরপর বেকারি পণ্য, আবার যারা ঘরে ময়দা-আটার ব্যবহার করে নাস্তা বানিয়ে খান তারাও আছেন। তারপর আছে আবার পেঁয়াজসহ নানা আমদানি পণ্য।

মোট কথা গমের দাম বাড়া আর পেঁয়াজ (কথার কথা), সয়াবিনের দাম বাড়া এক কথা নয়। গমের দাম বাড়লে চালের ওপর চাপ পড়বে। সেক্ষেত্রে চালের ব্যবহার বাড়বে। চালের সাথে ভাত। ভাত খেতে যা যা আছে সবকিছুর ওপরই চাপ পড়বে।

যুদ্ধ চলছে ইউক্রেইনে। করোনাভাইরাস যত ক্ষতি করতে পারেনি ইউক্রেইন-রাশিয়া যুদ্ধ তার চেয়ে বেশি সঙ্কট তৈরি করেছে বিশ্বব্যাপী। যুদ্ধ ওখানে হলেও আমাদের 'খাদ্য যুদ্ধ' মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। সেটা আমরা ইতোমধ্যে বুঝতে পারার কথা। একের পর এক আমদানি বন্ধ হবার খবর আর অন্যদিকে রয়েছে এদেশের মজুতদারি। যখন এ লেখাটি প্রকাশ হতে যাচ্ছে, তখন সিলেটে দেখা দিয়েছে দারুণ বন্যা। এটাও হিসেবে রাখতে হবে।

আগে আমাদের প্রস্তুতি ছিল কেবল ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস নিয়ে। খাদ্য ঘাটতি দেখা দিলেও আমরা দেশের বাইরে থেকে আমদানি করতে পারতাম। কিন্তু বাইরের যেখান থেকে আমদানি করা হতো আজ সেসব জায়গাতেও খাদ্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে। শুনেছি ইউক্রেইন পৃথিবীর খাদ্যভাণ্ডার। সেই খাদ্যভাণ্ডার তছনছ করে দিয়েছেন পুতিন। যদিও অমানবিকভাবে আমরা শুধু আমাদের খাদ্য নিয়েই ভাবছি।

তবে মহামারী চলাকালে অনেক দূর দেশে একটা যুদ্ধ হলেও আজকের বিশ্বে কি ভয়াবহ অবস্থা হতে পারে, এটা ভবিষ্যত দেখার জন্য একটা অভিজ্ঞতাও বটে। প্রকৃতি ও মানুষের খেয়ালের কাছে অভিজ্ঞতার বাইরেও আরও পরীক্ষা কিন্তু মানুষের শেষ হয়নি।

করোনার পর আমরা কি আসলে এ রকম একটা সময়ের জন্য প্রস্তুত ছিলাম? এখানে রাজনীতির কথা আসে। রাজনীতির ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনার সময় এসেছে। সেজন্য দেশের দলাদলির রাজনীতির বাইরে বিশ্ব রাজনীতির মোড় কখন, কোন পরিস্থিতিতে বাঁক বদল করে বা করতে পারে সেটাও চিন্তা ভাবনা করার সময় এসেছে।

রপ্তানিকারক দেশগুলোর খাদ্য রপ্তানি বন্ধের কথা শুনলে আমাদের সরকার বলে, আমরা উৎপাদন করবো। ওই কারণে এবারও কথা এসেছে– আমরা সরিষা উৎপাদন করবো। আমরা গম উৎপাদন করবো। আমরা পেঁয়াজ উৎপাদন করবো। মাছ, মুরগি, ডিম আর যত্রতত্র ইটভাটা করবো, ঘরবাড়ি বানাবো, কারখানা করবো। আবার প্রাণ-প্রকৃতি, জল-জলাভূমি, নদী, খাল, হাওর, বন ও পরিবেশের কথাও বলবো। কিছুদিন পর পর কোনো দেশ তাদের পণ্য রপ্তানি বন্ধের কথা বললেই এই উৎপাদনের কথা শোনা যায়।

কিন্তু কথা হলো, আমাদের জমির পরিমাণ কত? আমরা আসলে কী ধরনের কৃষিপণ্য উৎপাদন করতে সক্ষম? আগে আমাদের সেটা নির্ধারণ করতে হবে। অন্তত বৈশ্বিক রাজনীতি নিয়ে জানা-বোঝা কম থাকলেও আমাদের খাদ্যপণ্যগুলো কী হতে পারে সেটা নিয়ে ব্যাপক পর্যালোচনা, পর্যবেক্ষণ, গবেষণা হওয়া দরকার। সেভাবেই প্রস্তুতি নিতে হবে। আমরা গম, আটা, চাল, সয়াবিন, সরিষা, শাক-সবজি সব উৎপাদন করার যোগ্য কিনা, এতো জমি আমাদের আছে কিনা। যদি এতো জমি থাকেও তাহলেও কৃষকরা তাদের অর্থকরী ফসল বাদ দিয়ে অর্থাৎ যেসব ফসল তারা হাটে-বাজারে বিক্রি বেশি লাভ পায়, সেসব ফসল না ফলিয়ে তারা সরকারের কথা মতো ফসল উৎপাদনে যাবে কিনা। যে কৃষক যুগ যুগ ধরে ধান উৎপাদন করে দাম পায় না বলে কথা শোনা যায় তারা হুট করে সরকারের ইচ্ছামতো ফসল ফলাতে যাবে কিনা। ফসল ফলাতে গেলেও তারা সেই লাভের দেখা পাবে কিনা। এসব শুধু কথার কথা নয়, কৃষকের প্রস্তুতির বিষয় আছে। আর সব এলাকার জমি সব ফসলের জন্য উপযুক্ত কিনা সেটাও বিবেচনা করতে হবে। কোনো নতুন ফসলে হাত দিলেই উৎপাদনে সফলতা আসবে তা তো নয়। এগুলো সরকারকে বিবেচনায় নিতে হবে। সুতরাং সঙ্কট দেখা দেওয়ার পর বললেই হবে না যে আমরা উৎপাদনে যাব।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোভিড সংক্রমণের সময়ে বলেছিলেন, কোনো জমি যেন অনাবাদি না থাকে। কিন্তু সেটা হয়নি। সরকারের লোকজনেরও এ ব্যাপারে কোনো প্রত্যয় ছিল না। শুধু প্রধানমন্ত্রী চাইলেই হবে না। বললেই হবে না।

এবার আসি শ্রীলঙ্কার কথায়। এই শ্রীলঙ্কার কথা বলে সরকারকে ব্যতিব্যস্ত রাখার অপচেষ্টা করছে একটি পক্ষ। সে কথা থাক। শ্রীলঙ্কার মানুষ দুই কোটির কিছুটা বেশি। আয়তনের দিক থেকে আমাদের দেশের অর্ধেক প্রায়। সেখানে তাদের মধ্যে নানা সমস্যা দেখা দিয়েছে। সেটা অর্থনৈতিক সঙ্কট থেকে চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু খাদ্য সঙ্কট তাদের মূল সঙ্কট নয়। সেদিক থেকে আমাদের সঙ্কট থেকে তাদের সঙ্কট ভিন্ন। আমাদের উৎপাদন সঙ্কট। দামেরও সঙ্কট।

অথচ বিশ্বে মাছ, শাকসবজিসহ বেশ কিছু খাদ্যপণ্য উৎপাদনে আমরা প্রায় শীর্ষ স্থানে। সেটাই আমরা জানি। কিন্তু এরপরও আমাদের আমদানি করতে হয়। এর একমাত্র কারণ কম আয়তনের দেশে অধিক মানুষের বসবাস। এজন্যই আমাদের মধ্যে বার বার ঘাটতির আশঙ্কা। এটাই পুঁজি করছেন তথাকথিত অসাধু ব্যবসায়ীরা।

এখন আমাদের কিছুটা আঁচ লাগার সময় হয়েছে, ভাবার সময় হয়েছে অধিক জনসংখ্যা আসলে কতটা জনসম্পদ। যদি হাতে টাকা থাকার পরও খাদ্য পাওয়া না যায়। সয়াবিন তেল কিনতে তো সকলের আর্থিক সঙ্কট হয়নি। কিন্তু মজুতদারির কারণে অনেকে দোকানে গিয়েও তেল পায়নি। বিষয়টা এমন– যদি ১৮ কোটি মানুষকে জিম্মি করা যায়। এদেশে একজন দুষ্টু ব্যবসায়ীর কাছে এর চেয়ে আর 'মহৎ ভাবনা' কীভাবে আশা করা যেতে পারে?

আর ব্যবসায়ীদের বাইরে আমরা আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের কথা বলি। কারো রাজনীতির হাতিয়ার যদি মানুষ পুড়িয়ে-পিটিয়ে হত্যা করা হয়, সেক্ষেত্রে খাদ্য ঘাটতি তৈরি করাও তাদের কাছে বড় অনৈতিক বিষয় হবার কথা নয়। বিরোধী পক্ষ যারাই হোক না কেন।

অন্যদিকে বৈশ্বিক রাজনৈতিক মেরুকরণ বা বলয় থেকে ছুটে গেলে শাস্তিস্বরূপআমাদের কাছে রপ্তানি না করে যদি কোনো দেশ খাদ্য সঙ্কট তৈরির চেষ্টা করে সেক্ষেত্রে কী হবে? যেমন, চুয়াত্তর সালে আমাদের খাদ্য বোঝাই জাহাজ যুক্তরাষ্ট্র আটকে দিয়েছিল বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়।

সুতরাং সরকার দেশকে কোন ধরনের খাদ্য উৎপাদনে স্বনির্ভর করতে চায় সেটা আগে নির্ধারণ করতে হবে। সবকিছু উৎপাদনের কথা বলে অপরিকল্পিত কিছু দেশের ভবিষ্যত নিরুদ্বেগ করবে না।

আর আমরা যা রপ্তানি করছি– এমন কোনো খাদ্যপণ্য এর মধ্যে রপ্তানি বন্ধ করা দরকার আছে কিনা সেটাও ভেবে দেখার সময় এখন। যাতে ভাত ও আটা-ময়দার ওপর চাপ পড়লে সেসব খাবার মানুষের খাদ্য ঘাটতি বা ক্যালরির বিকল্প হতে পারে। সেটা সবজিও হতে পারে। ফলমূল কিংবা আলুও হতে পারে।

এতদিন আমরা নানা সূচকে ভারতকে পেছনে ফেলার কথা বলে এসেছি। এখন দেখা যাচ্ছে ভারতের মৌলিক খাদ্যপণ্যের কোনো সঙ্কটের কথা আমরা সেভাবে শুনিনি। বরং তাদের গম রপ্তানি বন্ধের খবর আমাদের উদ্বেগ বাড়িয়ে দিয়েছে। যা এখন জি টু জি পর্যায়ে আমদানির সুযোগ আছে বলে শোনা যাচ্ছে। সুতরাং একটি দেশের শক্তিমত্তা বোঝার এটাই সময়। সেভাবেই প্রস্তুতি নিতে হবে আমাদের।

যুদ্ধবিগ্রহে, মহামারীতে নিজেদের খাদ্যপণ্য যে দেশের মানুষের জন্য প্রকৃত নিরাপত্তাবেষ্টনী সেটা আজ ভাববার সময় এসেছে। শুধু ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস বা ঢলের পানিতে ফসল হারানোই একমাত্র বিপদ নয়।

আর এ রকম একটা সময়ে আমাদের ভাবতে হবে এদেশের ব্যবসায়ী যারা এই সুযোগে মাফিয়ার মতো আচরণ করছে তাদের কাছে ভবিষ্যত আদৌ কোনো সহযোগিতা আমরা আশা করতে পারি কিনা। অথচ করোনাকালে সরকার দরিদ্র ও হতদরিদ্র মানুষের বাইরে সরাসরি যাদের সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেছে তারা সম্ভবত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী। অন্য অনেক দেশের ব্যবসায়ীরা সরকারকে সহযোগিতা করেছে করোনাকালে, আমাদের দেশে উল্টো সরকারের কাছ থেকে সুবিধাই নিয়েছে ব্যবসায়ীরা।

তাই উৎপাদন ও আমদানির পাশাপাশি এই কতিপয় মাফিয়াদের ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় যথেষ্ট প্রস্তুতিও থাকতে হবে। এখনও তারা অপেক্ষায় আছে সরকারের কোমরের জোর কতটা তা দেখার জন্য। সুযোগ পেলেই জনগণের গলা টিপে ধরবে। সেই অন্ধকারে ভালো-মন্দের চেহারা পৃথক করা যাবে না। সময়ও পাওয়া যাবে না।