ধর্মান্ধরা নিঃশেষ হলেই গাফফার ভাইয়ের আত্মা শান্তি পাবে

শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকশামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক
Published : 21 May 2022, 11:51 AM
Updated : 21 May 2022, 11:51 AM

প্রকৃতির অমোঘ বিধান অনুযায়ীই গাফফার ভাই চলে গেলেন না ফেরার জগতে। কবিগুরুর ভাষায় 'তোমার হলো শুরু, আমার হলো সারা, তোমায় আমায় মিলে এমনি বহে ধারা'। একজন যায়, আর একজন আসে তার শূন্যতা পূরণের জন্য, এটাই প্রকৃতির ধারা। কিন্তু এ নিয়ম সবার বেলায় প্রযোজ্য নয়। এমন কিছু ক্ষণজন্মা মহাপুরুষের জন্ম হয়, বিভিন্ন সময়ে, যাদের প্রস্থানে সৃষ্ট শূন্যতা কখনো পূরণ হয় না। গাফফার ভাই ছিলেন তেমনি একজন। আজ তার আত্মার শান্তি কামনাই আমাদের একমাত্র করণীয়। প্রশ্ন হলো, কিভাবে তার আত্মার শান্তি কামনা করা যায়? কোন ব্যক্তি এই ভূবন থেকে চলে গেলে তার স্মৃতি রক্ষা এবং আত্মার শান্তি কামনার সর্বোত্তম পন্থা হচ্ছে তিনি যে আদর্শ নিয়ে জীবনভর কাজ করেছেন, তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করা।

১৮ বছর বয়স থেকে, যে বয়সে তিনি তার অমর কবিতা 'আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি' লিখেছিলেন, তার গোটা জীবনের কর্মকাণ্ড এবং লেখনি সব সময় একই ধারায় প্রবাহিত হয়েছে, আর তা ছিল সাম্প্রদায়িকতা, তথা ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে, বাঙালি সংস্কৃতি এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে অবিশ্রান্ত  সংগ্রাম। একদিনের জন্যও তিনি তার সেই আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। তার সাথে এপ্রিল মাসের ২২ তারিখে যখন হাসপাতালে দেখা হলো, তখন তিনি জানতেন তার আয়ু আর কয়েকদিন মাত্র। ছয় মাস আগেই ডাক্তার বলে দিয়েছিলেন তিনি ৬ মাসের বেশি বাঁচবেন না। যেহেতু তার দুটি কিডনিই ১০০ ভাগ অকেজো হয়ে গেছে, তাই ডায়ালাইসিস কাজ করবে না। শুধু ইনজেকশন দিয়েই তাকে সর্বোচ্চ ছয় মাস বাঁচিয়ে রাখা যেতে পারে, এর বেশি নয়। তার সাথে হাসপাতালে আমার দুই ঘণ্টা কথা হয়েছে। আর এর প্রায় ৮০ ভাগ সময় তিনি দেশে ধর্মান্ধ মৌলবাদিদের উত্থান নিয়ে কথা বলেছেন। তার স্বাস্থ্য নিয়ে খুব একটা কথা বলেননি। তবে মাঝে মাঝে তার তৃতীয় কন্যা বিনুর মৃত্যুর কথায় ভেঙে পড়ে অঝোরে কান্নাকাটি করেছেন। বার বার প্রশ্ন করেছেন, "হেফাজতিদের সাথে কেন আপস প্রচেষ্টা?" বলেছেন, "এরাতো কখনো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারকে ভোট দেয়াতো দূরের কথা, সমর্থনও করবে না, কারণ তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য বাঙালি সংস্কৃতি ধ্বংস করে এ দেশে তালেবানি সংস্কৃতি এবং মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা করা, দেশকে ইসলামিক প্রজাতন্ত্রে রূপান্তরিত করা, আবার পাকিস্তানের অংশ হিসেবে ফিরিয়ে নেয়া।" মাদ্রাসায় প্রথম জীবনে পড়াশোনা করা সকল বাঙালির বাতিঘর হিসেবে স্বীকৃত এই মহামানব বলেছেন, ধর্ম ভীরুতা আর ধর্ম ব্যবসা এক নয়, ধর্ম ব্যবসায়ী তারা যারা ধর্মকে পুঁজি করে ব্যবসা করে পুঁজি বাড়ায়। যারা বিনা পয়সায় ওয়াজ করে মঙ্গলের বাণী, সম্প্রীতির বাণী প্রচার করে, তারা ধর্ম ভীরু, কিন্তু যারা নিজেদের ফি নির্ধারণ করে ওয়াজে যায় তারাই ধর্ম ব্যবসায়ী। ইসলাম ধর্মে এটি বেআইনি। ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী ধর্মের কথা প্রচার করার জন্য ফি আদায় করা হারাম। কেউ খুশি হয়ে দিলে, তা নেয়া যায়, কিন্তু চেয়ে বা দরাদরি করে নেয়া অবৈধ, যা বেশির ভাগ ওয়াজ ব্যবসায়ীরা করছে। তথাকথিত ওয়াজের মাধ্যমে তারা অন্য ধর্মের মানুষের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াচ্ছে, যা ইসলাম অনুমোদন করে না, যার বাণী মদিনা সনদ এবং বিদায় হজে পরিস্কার। তারা নারীর ক্ষমতায়নের বিরুদ্ধে কথা বলছে, যেটিও ইসলামিক চিন্তা-চেতনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। নবীজীর (সা.) সময়ে নারীরা যুদ্ধ ক্ষেত্রে যুদ্ধ করেছে, যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে। আমাদের দেশে যে সব তুর্কি সুলতান লক্ষ লক্ষ হিন্দু-বৌদ্ধকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেছিলেন তার অন্যতম ছিলেন সুলতান ইলতুতমিশ, আর তিনিই তার পুত্রদের রাজসিংহাসনের উত্তরাধিকারি না করে, তার কন্যা সুলতানা রাজিয়াকে মনোনয়ন দিয়েছিলেন। আর এই নারী ১২ শতকে শুধু রাজ্য শাসনই করেননি, রণক্ষেত্রে যুদ্ধেও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ইংল্যান্ডে টিউডর বংশীয় প্রথম এলিজাবেথ রাণী হওয়ার কয়েকশ বছর আগেই সুলতানা রাজিয়া ভারত সম্রাজ্ঞী হয়েছিলেন। প্রতিটি দেশের জনসংখ্যার অর্ধেক নারী বিধায়, তাদের বাদ দিয়ে কোন দেশ উন্নত হতে পারে না। গাফফার ভাই কবি নজরুলের একটি কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছিলেন "বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে, আমরা তখনো বসে, বিবি তালাকের ফতোয়া খুঁজেছি ফিকাহ ও হাদিস চষে।" তিনি বলেন, এদের অবস্থান ধর্মের বিপরীতে। কাজী নজরুল ইসলাম রাধা-কৃষ্ণের উপর বহু গান লিখেছেন, যেমন- "প্রাণ সখিরে ঐ শোন কদম্ব তলে বংশী বাজায় কে"। অনেকে এখন ধর্মান্ধদের ভয়ে এসব নজরুল গীতি গাওয়ার সাহস পাচ্ছেন না, যে কথাটি প্রখ্যাত নজরুল গীতির গায়িকা, আব্বাস উদ্দিনের নাতনী নাশিদ কামাল একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানে পরিস্কার করে বলেছিলেন। গাফফার ভাই মুন্সিগঞ্জের শিক্ষক হৃদয় মন্ডল, ঢাকার অধ্যাপিকা লতা সমাদ্দার, আমোদিনি পাল প্রমুখের উপর ধর্মান্ধদের আক্রমণের নিন্দা করে আমরা মুন্সিগঞ্জে গমনসহ যে সব পদক্ষেপ নিয়েছি, তার জন্য সাধুবাদ জানিয়েছিলেন। প্রশ্ন করেন ঝুমন দাস নামে এক হিন্দু মামুনুল হকের মতো স্ব-স্বীকৃত মিথ্যাবাদি এবং ধর্ষণ মামলার আসামির বিরুদ্ধে যৌক্তিক কথা বলায় কিভাবে তার বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার মামলা হলো, আর সুনামগঞ্জের জেলা-দায়রা জজইবা কিভাবে সে মামলা আমলে নিয়ে ঝুমনকে এক বছর হাজত খাটালো, জামিন নামঞ্জুর করে। প্রশাসন, পুলিশ এমনকি নিম্ন আদালতে যে প্রচুর ধর্মান্ধ ঢুকে পড়েছে, তা পরিস্কার। গাফফার ভাইয়ের প্রশ্ন এসব আবর্জনা কে, কিভাবে পরিস্কার করবে?

এপ্রিলের ৩০ তারিখে যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের হাইকমিশনার গাফফার ভাইয়ের তৃতীয় মেয়ে, ক্যান্সার রোগের কাছে পরাজিত হয়ে যেই মেয়েটি গাফফার ভাইয়ের মৃত্যুর মাত্র দুই সপ্তাহ আগে প্রয়াত হয়েছেন, যা গাফফার ভাইয়ের জীবনের শেষ কটি দিনকে আরো অধিক বিভীষিকাময় করে তুলেছিল, তার স্মৃতির প্রতি সম্মান জানাতে হাইকমিশনার তার বাসভবনে এক অনুষ্ঠান করেছিলেন। ওই অনুষ্ঠানে গাফফার ভাইয়ের যাওয়ার জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ একটি বিশেষ অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করেছিলেন। সেখানেই গাফফার ভাইয়ের সাথে আমার শেষ সাক্ষাত। রাষ্ট্রদূতসহ বিভিন্ন বক্তা সবাই স্মরণ করিয়ে বলেছিলেন- যতদিন পৃথিবী টিকে থাকবে, ততোদিন গাফফার ভাইয়ের 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি' গান গোটা বিশ্বের সকল বাঙালির হৃদয়ে জাগ্রত থাকবে, বাঙালির স্মৃতির জগত থেকে তিনি কোন দিন খসে পড়বেন না। আমার বলার সুযোগ হয়েছিল গাফফার ভাই আজীবন যে আদর্শের জন্য সংগ্রাম করেছেন, তা জিইয়ে রাখার মাধ্যমে তার স্মৃতিকে সমুন্নত রাখতে হবে। সভা শেষে গাফফার ভাই বলেছিলেন, "আমি তো চলে যাচ্ছি, এসব ধর্মান্ধদের শেষ করে দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রসারিত করার, দেশে তালেবানি আদর্শের যাত্রা পথ রুদ্ধ করার দায়িত্ব এখন পড়বে তোমাদের উপর"। আমি জবাবে বলেছিলাম, প্রয়াণের পর আপনার আত্মা শান্তি পাবে যদি এসব ধর্মান্ধকে সমূলে নিশ্চিহ্ন করা যায়, আর সে চেষ্টাতেই আমরা লিপ্ত থাকবো। গাফফার ভাই বললেন এরা গোটা জনসংখ্যার ১৫ শতাংশের বেশি নয়। এরা ৪ শতাংশের বেশি ভোট পায় না। সুতরাং এদেরকে ভয় পাবার কিছু নেই। একাত্তরেও  এদের সংখ্যা ১৫ শতাংশই ছিল। সে সময় মুক্তিযুদ্ধে এরা পরাজিত হয়ে পালিয়েছিল, এখন আবার মাথাচাড়া দিয়েছে। কিন্তু এরা কখনো জয়ী হবে না। বিদায়ের মুহূর্তে গাফফার ভাই কবিগুরুর দুটি লাইন আবৃতি করলেন যা ছিল "যাবার দিনে এই কথাটি বলে যেন যাই, যা দেখেছি, যা পেয়েছি তুলনা তার নাই"। এটি শুনে সবাই কেঁদেছিলেন এটি আন্দাজ করে যে মৃত্যুর ঘণ্টাধ্বনি গাফফার ভাই শুনতে পাচ্ছিলেন। সবাই তখন বলতে শুরু করলেন যে এটা কমবেশি নিশ্চিত গাফফার ভাই খুব শিগগিরই এ পৃথিবী থেকে বিদায় নেবেন। তখন প্রশ্ন আসবে তার আত্মার শান্তি কামনার এবং তার স্মৃতিকে অম্লান রাখার। সবাই তখন একথাও বলতে লাগলেন তার স্মৃতিকে সম্মান দেখানোর জন্য এবং তার আত্মার শান্তি কামনার জন্য আমাদের সবাইকে প্রতিজ্ঞা করতে হবে গাফফার ভাই সারা জীবন যে আদর্শ, অর্থাৎ মৌলবাদকে প্রতিহত করার চেষ্টা করেছিলেন, আমরাও যেন সেটি চালিয়ে যেতে পারি। সে প্রতিজ্ঞায় আমরা অটল থাকলেই সেটিই হবে গাফফার ভাইয়ের স্মৃতির প্রতি প্রকৃত সম্মাননা।