মুদ্রারাক্ষস: টাকা, ভাষা ও ধর্মের মধ্যে অমিলটা কোথায়?

শিশির ভট্টাচার্য্যশিশির ভট্টাচার্য্য
Published : 20 May 2022, 01:36 PM
Updated : 20 May 2022, 01:36 PM

এক. স্থানান্তর ও কালান্তরে প্রেরণযোগ্য মূল্য বা সম্পদ

টাকা জিনিসটাকে সম্যক বোঝার প্রয়োজনে মানুষেরই তৈরি আরও দুটি সমজাতীয় সত্তা: 'ধর্ম' এবং 'ভাষা'-র সঙ্গে টাকার তুলনা করা যাক। 'প্রয়োজন আবিষ্কারের জননী' কিংবা 'প্রয়োজন বিনা সত্তা হয় না'– এইসব কথা বিশ্বাসযোগ্য ধরে নিয়ে দেখা যাক, কোন বিশেষ প্রয়োজন বা প্রয়োজনসমূহ মেটাতে ইতিহাস বা প্রাগিতিহাসের কোনো এক বাঁকে ভাষা, ধর্ম এবং টাকার সৃষ্টি হয়েছিল।

ভাষা সৃষ্টির অন্যতম কারণ মানুষে-মানুষে যোগাযোগের ইচ্ছা। চিন্তা ও জ্ঞানকে স্থানান্তরে ও কালান্তরে পাঠানো সম্ভব হয়েছে ভাষার মাধ্যমে। মৃত্যু মানুষের জীবনে যে অন্যতম সত্য– এ ব্যাপারে কোনো দ্বিমত নেই। এই মৃত্যুর পর কী আছে, মানুষ জানে না, কিন্তু প্রত্যেকে জানতে চায়। এই আধ্যাত্মিক প্রয়োজন মেটাতে বিগত হাজার হাজার বছরে উদ্ভাবিত হয়েছে দেবতা, ঈশ্বর, ধর্ম, আত্মা, স্বর্গ-নরক ইত্যাদি সত্তা। মানুষের অনন্ত জীবন লাভের চিরন্তন আকুতি ধর্ম নামক সত্তাটির উদ্ভাবিত হবার অন্যতম কারণ। অন্যভাবে বললে, মানুষের অস্তিত্বকে কালান্তরে ও স্থানান্তরে প্রেরণের প্রয়োজন মেটাতে ধর্মের উদ্ভব।

মাঝে মাঝেই শোনা যায়, বাংলাদেশে অমুক বেলাভূমিতে কিংবা অমুক দ্বীপে কোনো জেলের জালে কয়েক লক্ষ টাকার মাছ ধরা পড়েছে। এত শত মাছ সেই জেলের পক্ষে খেয়ে শেষ করা অসম্ভব, সংরক্ষণও সহজ নয়। জেলে স্বভাবতই চাইবে, এই মাছের মূল্যটা ভবিষ্যতের জন্য জমিয়ে রাখতে, যাতে মাছ যখন প্রয়োজনমতো ধরা পড়বে না, তখন সে যেন নির্বিঘ্ন জীবন যাপন করতে পারে। ধরা যাক, সেই মাছের মূল্য অন্য কোনো জেলায়, এমনকি দেশের বাইরে গিয়ে সে ভোগ করতে চায় কিংবা তার প্রপৌত্রকে দিয়ে যেতে চায়। কীভাবে এটা করা সম্ভব? নিজের আয় বা সঞ্চয়কে একদিকে জঙ্গমতা বা চলিষ্ণুতা এবং অন্যদিকে অনন্ত জীবন দেবার প্রয়োজন মেটাতে উদ্ভাবিত হয়েছে 'টাকা' কিংবা 'অর্থ'।

দুই. আর্বিত্রিকতা ও সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা

ভাষা, ধর্ম, টাকা এই তিনটি সত্তার কয়েকটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য আছে। প্রথমত, এই তিনের কোনোটাই একক মানুষের সচেতন উদ্ভাবন নয়। বহু লক্ষ মানুষ বহু লক্ষ বছর ধরে সম্মিলিত এবং অবচেতনভাবে এই সত্তাগুলো সৃষ্টি করেছে। দ্বিতীয়ত, এগুলো এমন এক সময় উদ্ভাবিত হয়েছে, যখন মানব-মস্তিষ্ক বিমূর্ত, খামখেয়ালি, কাকতালীয়, 'আর্বিত্রিক' (আর্বিট্রারি) চিন্তা করতে সক্ষম হয়েছে। ভাষা, ধর্ম এবং টাকা– তিনটি সত্তাই শতভাগ আর্বিত্রিক, মানুষের সম্মিলিত খামখেয়ালের ফলশ্রুতি।

'ব-অ-ই'– এই তিনটি ধ্বনি বিশেষ একটি ক্রমে বসালে সেটা যে একটা পাঠ্যবস্তু বোঝাবে, অন্য কিছু নয়, এটা একটা বিমূর্ত, আর্বিত্রিক চিন্তা। ঈশ্বরও একটা বিমূর্ত এবং আর্বিত্রিক চিন্তা এই অর্থে যে ঈশ্বরকে কেউ কখনও দেখেনি। ওনাকে দেখেছে বলে দাবি করে যে মহাপুরুষেরা তাদের অভিজ্ঞতার মধ্যেও মিল নেই। সুতরাং ঈশ্বরকে আমরা যে রূপে কল্পনা করি, ঈশ্বরের লেখা পুস্তকগুলোতে তাকে যেভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, সে রকম তিনি নাও হতে পারেন। তার নামে যে পুস্তকগুলো চলে, সেগুলোকে তারই লেখা বলে যারা বিশ্বাস করেন, তাদের সঙ্গে কোনো বাহাস নেই। বিশ্বাস নিয়ে তর্ক পণ্ডশ্রম, বিশ্বাসীদের খুড়ে খুড়ে দণ্ডবৎ প্রণাম বা কদমবুসি, যাই বলুন।

টাকাও একটা আর্বিত্রিক সত্তা। যে বেগুনের দাম আজ চল্লিশ টাকা কেজি, এক সময় তা পাঁচ পয়সা সের দরে পাওয়া যেত। আবার বাংলাদেশেই বিভিন্ন জেলায় বেগুনের দাম ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। যে কৃষক বা বিক্রেতার সঙ্গে আপনার লেনদেন হচ্ছে, সে ভাবছে কিংবা সমাজ তাকে ভাবাচ্ছে, কিছু বিশেষ ধরনের কাগজ বা ধাতুখণ্ডের বিনিময়ে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উৎপাদন করা এক কেজি জাজ্বল্যমান বেগুন অন্যের হাতে তুলে দেওয়া যায়। ব্যাপারটা আর্বিত্রিক বা খামখেয়ালিভাবেই স্থির হচ্ছে না কি? চাহিদা ও সরবরাহের ভিত্তিতে সাধারণত মূল্য স্থির হয়, আমরা পড়েছি অর্থনীতির পাঠ্যবইয়ে, কিন্তু যা পড়িনি তা হচ্ছে, এই চাহিদা ও সরবরাহ কে, কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করে।

তৃতীয়ত, ধর্ম, ভাষা, টাকা– এই তিনটি সত্তারই অন্যতম ভিত্তি হচ্ছে সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা, সবার মেনে নেওয়া কিংবা সার্বজনীন বিশ্বাস। একজন ব্যক্তি একটি বিশেষ দেবতা বা ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেই পারে, কিন্তু সেটা 'ধর্ম' বলে বিবেচ্য হবে না, যতক্ষণ না একাধিক ব্যক্তি, মানুষের একটি দল সেই বিশেষ ঈশ্বরে বিশ্বাস করতে শুরু করে। একজন ব্যক্তি বিশেষ একটি শব্দ ব্যবহার করতেই পারে, কিন্তু সেটা ভাষার শব্দ হবে তখনই, যখন সবাই সেই শব্দ ব্যবহার করবে কিংবা অন্য কেউ ব্যবহার করলে বুঝতে পারবে।

১০০ ডলার বা ৯০০০ টাকা এক বা একাধিক কাগজের টুকরা মাত্র। যখনই সেই ১০০ ডলার নিয়ে আমেরিকায় ম্যাকডোনাল্ড কর্তৃপক্ষ ১০টি হ্যামবার্গার বিক্রি করতে রাজি হচ্ছে, কিংবা বাংলাদেশে কোনো জেলে ১০টা ইলিশ মাছ বিক্রি করতে আপত্তি করছে না, তখনই সেটা 'ডলার' বা 'টাকা' হিসেবে গ্রহণযোগ্য হচ্ছে। ম্যাকডোনাল্ড ১০০ ডলার নিয়ে ১০টা হ্যামবার্গার খদ্দেরের হাতে তুলে দিচ্ছে এই বিশ্বাসে যে সেই একই ১০০ ডলার দিয়ে বার্গার তৈরির জন্যে গরু বা মুরগির মাংস সে কিনতে পারবে।

এই বিশ্বাস যদি কোনো অশুভক্ষণে কোনো কারণে নষ্ট হয়, যদি ম্যাকডোনাল্ড দেখে যে ডলার নিয়ে মুরগির মাংস তাকে কেউ দিচ্ছে না, তবে পরমুহূর্ত থেকে সেও আর ডলার বা টাকা নিতে রাজি হবে না। যখনই মানুষের বিশ্বাস চলে যাবে, ডলারের বিন্দুমাত্র গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না, ডলার বা টাকা পুনরায় কাগজে পরিণত হবে। হিন্দুরা বলে, 'মানলে শালগ্রাম (দেবতা বিষ্ণুর প্রতীক পাথর) না মানলে শিলা'। একইভাবে বলা যায়: 'মানলে টাকা, না মানলে কাগজ'।

তিন. দেখিব খেলাতে কে হারে কে জেতে!

ভাষা, টাকা, ধর্ম– তিনটি সত্তাই ক্রমাগত প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে যায়। নতুন ভাষা, নতুন শব্দ সৃষ্টি হয়, পুরনো ভাষা, পুরনো শব্দ হারিয়ে যায়। নারকেল, লবণ, পাথর, শুটকি, চা-পাতা, গাছের ছাল, পুঁতি, স্বর্ণ, কাগজ … অনেক রকম টাকা ছিল। অনেক রকম ধর্ম-দেবতা ও ঈশ্বরও ছিল, হাজার হাজার ভাষা এখনও আছে। ভাষা মরে যায়, ধর্ম হারিয়ে যায়, টাকা বাতিল হয়। আজকের ভাষা, টাকা, ধর্ম কিছুই আগামী দিনে থাকবে না, ঠিক যেমন কয়েক শতক আগের ভাষা, টাকা কিংবা কয়েক হাজার বছর আগের ধর্ম আজ নেই। অতীত ইতিহাস যদি সত্য হয়ে থাকে, ভবিষ্যতও মিথ্যা না হবার সম্ভাবনা আছে।

বহু রকম দেবতা ও ঈশ্বরের যেমন সৃষ্টি হয়েছিল, তেমনি বহু বস্তু টাকা হবার প্রতিযোগিতায় কিছুদিন ভূমিকা রেখে তারপর মুদ্রাত্ব হারিয়ে ফেলেছিল চিরতরে। বিনিময়ের এমন একটি মাধ্যমের প্রয়োজন ছিল, যেটির মাধ্যমে বর্তমানের পণ্য, সেবা বা পরিশ্রমের মূল্য স্থানান্তরে এবং কালান্তরে প্রেরণ করা যাবে। শুরু হয়েছিল লবণ, নারকেল, পাথর ইত্যাদি বিভিন্ন বস্তুর মধ্যে টাকা হবার প্রতিযোগিতা।

ব্যাবিলনে টাকার নাম ছিল 'শেকেল'। এই শেকেল নির্দিষ্ট পরিমাণ বার্লি, ১৬০ বার্লিদানায় এক 'শেকেল'। সবার কাছেই বার্লির গ্রহণযোগ্যতা ছিল, কারণ আর কিছু না হোক, বার্লি অন্তত খেয়ে ফেলা যায়। গরু, মাছ, নারকেল, লবণ, কোকো ফলের বীচি ইত্যাদি টাকাও খাবারই ছিল। ক্ষিদে লাগলে টাকা খেয়ে ফেলা সুবিধাজনক বটে, কিন্তু কত আর আপনি খাবেন! বিনিময়ের কোনো মাধ্যম পচনশীল এবং সহজে বহনযোগ্য না হওয়া এর প্রধান দুই নেতিবাচক দিক। স্বর্ণ, রৌপ্য, তাম্র ইত্যাদি ধাতু ভারি হলেও পচনশীল নয়। এই দুটি কারণে সম্ভবত টাকা হবার প্রতিযোগিতায় এই ধাতুগুলো এগিয়ে ছিল।

ঠিক কখন থেকে স্বর্ণ বা রৌপ্য বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হতে শুরু করেছিল, সেটা বলা মুশকিল। ধাতুগুলোর মধ্যে টাকা হবার প্রতিযোগিতায় স্বর্ণ সবচেয়ে এগিয়ে ছিল, কারণ প্রথমত, স্বর্ণে জং ধরে ক্ষয় হয় না এবং দ্বিতীয়ত, স্বর্ণের উৎপাদন মানুষ ইচ্ছা করলেও বাড়াতে পারে না। প্রাচীন ব্যাবিলনে স্বর্ণ ছিল, কিন্তু স্বর্ণ বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হতো না। মিশরে যখন পিরামিড বানানো হচ্ছিল, তখন বার্লির পাশাপাশি নির্দিষ্ট ওজনের স্বর্ণের টুকরা বিনিময়ের মাধ্যম ছিল বটে, কিন্তু তখনও স্বর্ণ বা কোনো ধাতুরই মুদ্রার প্রচলন হয়নি। ৬৪০ খ্রিস্টপূর্বে এশিয়া মাইনরের (আধুনিক তুরস্ক, পশ্চিম আনাতোলিয়া) একটি রাজ্য লিদিয়ার রাজা আলিয়াতেস ইতিহাসে প্রথম মুদ্রার প্রচলন করেন বলে ধারণা করা হয়।

ধাতুখণ্ড দিয়েই যদি কাজ চলে যাচ্ছিল, তবে ধাতুর ওপর ছাপ দিয়ে মুদ্রা তৈরির প্রয়োজন হয়েছিল কেন? এর কারণ ধাতুখণ্ডের কিছু সমস্যা ছিল। ধাতুর পরিমাণের ওপর ধাতুখণ্ডের দাম নির্ভর করত। ক্ষয়ে গিয়ে বা অন্য কোনো কারণে ধাতুখণ্ডে যদি ধাতু কম থাকে বা ধাতুর পরিমাণ কমে যায়, তবে ধাতুখণ্ডের দামও কমে যাবার কথা। বার বার ধাতুখণ্ড ওজন করাও এক ঝামেলা। রাজা বা ঈশ্বরের নামাঙ্কিত মুদ্রার সুবিধা হচ্ছে, বার বার ওজন করার প্রয়োজন নেই। ঈশ্বর কিংবা তার প্রতিনিধি রাজার ওপর বিশ্বাস রাখা যায়: 'ইন গড উই ট্রাস্ট!' টাকা নকলকারীর ভয়ঙ্কর শাস্তি ছিল প্রাচীন ভারতে (দ্রষ্টব্য: চাণক্যের অর্থশাস্ত্র), গ্রীস-রোমে, মধ্যযুগের ইওরোপে, এমনকি ফরাসি বিপ্লবের সময়েও। এর পরেও টাকা 'বাজিয়ে' কিংবা ওজন করে নিতে হতো বোঝার জন্যে ধাতুটা ভেজাল কিনা কিংবা মুদ্রায় ধাতু কম আছে কিনা। স্বর্ণমুদ্রা ছিল সবচেয়ে দামি, তারপর রূপা এবং তারপর কাঁসা বা তামা। প্রাচীন রোমে এই তিন ধরনের মুদ্রা ছিল, স্বর্ণমুদ্রা 'অয়রিউস', রৌপ্যমুদ্রা 'দিনারিউস' এবং কাঁসা/তামার তৈরি 'সেস্টারটিউস'। রোমান সম্রাটেরা নিজেরাই নিজেদের মুদ্রায় ভেজাল মেশাতেন, যা রোমান অর্থনীতি তথা রোমান সাম্রাজ্য ধ্বংসের অন্যতম কারণ।

পুনর্জাগরণের যুগে মুদ্রাব্যবস্থা ছিল স্বর্ণভিত্তিক। কিন্তু বিভিন্ন কারণে অর্থনীতির আকার যে হারে বাড়ছিল সে যুগে, স্বর্ণের সরবরাহ সে হারে বাড়ছিল না। অনেক স্বর্ণ আবার মসলা, সিল্ক ইত্যাদি পণ্য ক্রয়ের জন্যে ইওরোপের বাইরে, এশিয়ায় চলে গিয়েছিল। ইওরোপীয়রা শুনেছিল, ভারতবর্ষে প্রচুর স্বর্ণ আছে। এই স্বর্ণের খোঁজে সাগরপথে ভারতবর্ষ যেতে গিয়ে আমেরিগো ভেসপিউচি বা কলম্বাস পৌঁছেছিল আজকের আমেরিকায়। হারারি লিখেছেন, ষোড়শ শতকের প্রথম দিকে স্প্যানিশরা মেক্সিকো গিয়ে উপস্থিত হবার কিছু দিনের মধ্যেই সেখানকার স্থানীয় অধিবাসী আজটেকরা খেয়াল করেছিল যে স্বর্ণের প্রতি এই বিদেশিদের বিশেষ দুর্বলতা রয়েছে। স্বর্ণ আজটেকরাও যে অপছন্দ করত তা কিন্তু নয়। স্বর্ণ দিয়ে তারা অলঙ্কার, মূর্তি বানাত, মাঝে মধ্যে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবেও ব্যবহার করত বটে। কিন্তু ওদের কাছে বিনিময়ের অধিকতর গ্রহণযোগ্য মাধ্যম ছিল কোকো ফলের বীচি। স্বর্ণ খাওয়া বা পান করা যায় না, বস্ত্র বয়ন করা যায় না, স্বর্ণ এতই নরম একটা ধাতু যে এটা দিয়ে যন্ত্র বা অস্ত্রও তৈরি করা যায় না। এমন একটি ফালতু ধাতুর জন্যে ইওরোপীয়দের এত আগ্রহ কিছুতেই আজটেকদের বোধগম্য হচ্ছিল না। আজটেকরা স্প্যানিশদের দলপতি কর্টেজকে স্বর্ণের প্রতি তাদের অতি আগ্রহের ব্যাপারে প্রশ্ন করাতে কর্টেজ নাকি জবাব দিয়েছিল: 'আমার বন্ধুরা বিশেষ এক হৃদরোগে ভুগছে, যার একমাত্র ঔষধ হচ্ছে স্বর্ণ।'

সার্বভৌম সরকার টাকা বাতিল করতে পারে, কিন্তু স্বর্ণকে বাতিল করার ক্ষমতা বা ইচ্ছা খোদ ঈশ্বরেরও আছে কিনা সন্দেহ। মুফতে স্বর্ণ দিলে নিতে চাইবে না, হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে পৃথিবীতে এমন কোনো বোকা কি আছে? মাজার-মসজিদ-মন্দিরের দানবাক্সে কী পরিমাণ স্বর্ণ জমা পড়ে দেখেছেন, যার মানে হচ্ছে, ধাতুটা ঈশ্বরেরও মনপছন্দ। স্বর্ণ এখনও শ্রেষ্টতম বিনিময়ের মাধ্যম। কাগজের টাকা স্বর্ণের চেয়ে হাল্কা বলে এর বহনযোগ্যতা বেশি, কিন্তু গ্রহণযোগ্যতা কম, একটি কারণে, কাগজের টাকা সহজেই এবং ইচ্ছেমতো ছাপানো যায়। কোনো জিনিষের দাম বেশি হতে হলে এর চাহিদা বেশি এবং সরবরাহ কম থাকতে হবে। আপনার উঠানে যদি টাকার গাছ থাকে, তবে সে টাকার দাম থাকবে না, এটাই স্বাভাবিক।

মানুষ এখনও কাম্য টাকার সন্ধান পায়নি। কাম্য ধর্ম কিংবা কাম্য ভাষার সন্ধান কি মানুষ পেয়েছে? সব মানব ভাষারই দুর্বল ও সবল দিক আছে। সব ধর্মেরই কমবেশি সমস্যা নিশ্চয়ই আছে, না হলে কিছু মানুষ প্রকাশ্যে এবং বেশিরভাগ মানুষ মনে মনে এগুলোকে মানতে চায় না কেন? আপাতত স্বর্ণসমর্থিত বা গোল্ডরিজার্ভ কাগজের টাকা সর্বশ্রেষ্ঠ বলে দাবি করছেন অষ্ট্রীয় ঘরানার অর্থনীতিবিদেরা। স্ট্যালিনের হাতে খুন হবার কিছু দিন আগে, ট্রটস্কি ত্রিশের দশকে লিখেছিলেন, গোল্ড রিজার্ভ অর্থব্যবস্থা থাকলে প্রথম সোভিয়েত পাঁচশালা পরিকল্পনাও ব্যর্থ হতো না। এর অর্থ, বাকি বিভিন্ন শালা পরিকল্পনাগুলোর একটাও প্রকৃতপক্ষে সফলতার মুখ দেখেনি। শ খানেক বছর পর রাশিয়া তার বিস্মৃত বীরের পরামর্শ মোতাবেক ২০২২ সালের মার্চ মাসে গোল্ডরিজার্ভে ফিরে গিয়েছে।

চার. বিশ্বাসে মিলায় বস্তু!

মানুষের কাছাকাছি কোনো প্রাণীর সম্ভবত বিশ্বাস করার ক্ষমতা নেই, কারণ তার মস্তিষ্ক সেভাবে বিবর্তিত হয়নি। ডলফিন বা ময়নাপাখি মুখ দিয়ে অর্থবোধক শব্দ করতে পারে, কিন্তু বিমূর্ত বস্তুতে বিশ্বাস করা ডলফিন বা পাখির মস্তিষ্কের পক্ষে অসম্ভব। আমি মনে করি, মানব মনের দুটি প্রবণতা আছে: বিশ্বাস এবং সন্দেহ। ব্যক্তিভেদে এই প্রবণতার কমবেশি হয়। কিছু লোক আছে তারা যতটা সন্দেহ করে, ততটা বিশ্বাস করে না। কিছু লোক, আসলে বেশিরভাগ লোক, বিনাপ্রশ্নে অন্ধের মতো বিশ্বাস করে থাকেন।

বিশ্বাস এবং সন্দেহ থেকে কোনো জীবিত মানুষই মুক্ত নয়। টাকা, ধর্ম, ভাষার মতো সত্তাকে প্রতিমূহূর্তে মানুষের সন্দেহকে জয় করে বিশ্বাস অর্জন করে নিতে হয়। টাকাটা চলবে তো? ধর্মের এই নিয়মটা অন্যরা মেনে নেবে তো? যা বলছি, শ্রোতার তা বোধগম্য হবে তো? ব্যক্তির চেতনে-অবচেতনে এই সব সন্দেহ স্বতঃজাগরুক থাকে। একবার বিশ্বাস অর্জিত হয়ে গেলে টাকা, ভাষা, ধর্ম পায়ের তলায় যেন মাটি খুঁজে পায়। কোনো বিশ্বাসই ভুঁইফোঁড় নয়– হঠাৎ করে কোনো বিশ্বাস সৃষ্টি হয় না। বহু শত-হাজার-লক্ষ বৎসর ধরে চলে একেকটি বিশ্বাসের নির্মাণকর্ম। গাছ-পাথর-দেবদেবী-নিরাকার একক ঈশ্বর … মানুষের বিশ্বাস বিবর্তিত হয়ে চলে এক রূপ বা ফর্ম থেকে ভিন্নতর একেকটি রূপ বা ফর্মে।

পাঁচ. হিমশৈলের দৃশ্যমান চূড়া

নোয়াম চমস্কি দাবি করেন, মানুষের মস্তিষ্কে থাকে 'ভাষাবোধ' বা কম্পিটেন্স। এর অতি ক্ষুদ্র একটি অংশ 'ভাষাপ্রয়োগ' বা 'পারফরমেন্স' অর্থাৎ বাচনে ও লিখনে ভাষার ব্যবহার। চমস্কির কমপক্ষে অর্ধশতক আগে ফার্দিনঁ দ্য সস্যুর দাবি করেছিলেন, সব মানুষের মনে সম্মিলিতভাবে যোগাযোগের যে বিশেষ প্রক্রিয়াটি রয়েছে, সেটা হচ্ছে 'ভাষা' বা 'লংগ' বা 'ল্যাঙ্গুয়েজ' আর একক ব্যক্তি এই ভাষার যে ক্ষুদ্র অংশটুকুর অধিকারী, সেটা হচ্ছে 'বুলি' বা 'পারোল' বা 'স্পিচ'। এর মানে হচ্ছে, ভাষার যে অংশটুকু কথাবার্তা-আলাপ-আলোচনায় দৃশ্যমান হয়, সেটি ভাষার অতি ক্ষুদ্র একটি অংশ মাত্র। একইভাবে সব বিশ্বাসীর মনে, ধর্মপুস্তকে রয়েছে বিশালকায় যে ধর্ম তার সবটা মানুষের ধর্মাচরণে প্রকাশিত হয় না। যেটুকু প্রকাশিত হয়, নামাজ-পূজা, উপবাস, শবেবরাত… সেটুকু হিমশৈলের দৃশ্যমান চূড়া মাত্র নয় কি?

মাঝে মাঝেই মাটি খুঁড়ে প্রাচীন যুগের মুদ্রা পাওয়া যায়। এই মুদ্রা সে যুগের অর্থব্যবস্থার সম্পূর্ণ প্রতিনিধিত্ব করে ভাবলে ভুল ভাবা হবে। মুদ্রা অর্থব্যবস্থার অতি ক্ষুদ্র একটি অংশমাত্র এবং সেটা যে কোনো যুগেই। পাথর, পুঁতি, রৌপ্য, স্বর্ণ, কাগজ ইত্যাদি যখন বিনিময়ের মাধ্যম ছিল, তখন সেগুলোও হিমশৈলের দৃশ্যমান অংশ মাত্র ছিল। মানুষ যে পরিমাণ লেনদেন করে, তার একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ বিনিময়ের মাধ্যম টাকা বা মুদ্রায় প্রকাশিত হয়। ইতিহাসে এর প্রমাণ আছে। মধ্যযুগে লন্ডনে ওয়েস্ট মিনিস্টার ভবনের আশেপাশে টেমস নদীর তীরে উইলো গাছ প্রচুর জন্মাত। এই গাছের কাটা ডালকে বলা হতো 'ট্যালি'। এই সব 'ট্যালি' ব্যবহার করা হতো হিসাব লেখার জন্যে। কোনো আমলাকে দেওয়া ঘুসের হিসাবও লেখা থাকতো ট্যালিতে, ধরা যাক: 'রাজার সুনাম খাতে ২০ পাউন্ড'। হিসাবের ট্যালিগুলো ছিল যেন হিসাব খাতার একেকটি পাতা। বাংলাদেশের পাটশিল্পে কিছুদিন আগেও 'ট্যালিক্লার্ক' নামে একটি পদ ছিল।

ডালের যে দিকটা গাছের সঙ্গে লাগানো থাকে, যে দিকটা একটু মোটামতো হয়, তাকে বলা হতো 'স্টক'। এ থেকে আমরা পেয়েছি যৌথমূলধন কোম্পানির 'স্টক' শব্দটা। অপেক্ষাকৃত চিকন দিকটা, যেদিকে পাতা জন্মায়, তার নাম ছিল 'ফয়েল'। 'ফয়েল' কথাটার অর্থ 'পাতা'। ডাবল এন্ট্রি বুক কিপিং ব্যবস্থা অনুসারে পাওনাদারের (ক্রেডিটর) বিবরণ লেখা হতো স্টকের দিকে এবং দেনাদারের (ডেবিটর) বিবরণ লেখা হতো ফয়েলের দিকে।

মধ্যযুগের ইংল্যান্ডে বিভিন্ন মুদ্রা অবশ্যই ব্যবহৃত হতো। কিন্তু যে পরিমাণ অর্থের লেনদেন হয়েছিল, মুদ্রাগুলো তার অতি সামান্য একটি অংশ মাত্র। এর বাইরে যে হাজার হাজার লেনদেন, সেগুলো লেখা ছিল ট্যালিগুলোতে। পুনর্জাগরণের যুগেও যে পরিমাণ স্বর্ণমুদ্রা বাজারে চালু ছিল, তার শতগুণ, হাজার গুণ লেনদেন হতো সমাজে। বর্তমানেও যত টাকা বাজারে আছে, তা মোট অর্থের অতি সামান্য একটি অংশ মাত্র। ২০২১ সালে সারা পৃথিবীতে ইউরো-ডলার-রুবল-টাকা মিলিয়ে ৪০ ট্রিলিয়ল নগদ টাকা ছিল, কিন্তু আসল টাকার পরিমাণ ছিল এর বহুগুণ বেশি, কয়েক শ কোয়াড্রিলিয়ন হবে।

অর্থের অতি ক্ষুদ্র একটি অংশ দৃশ্যমান, সাকার রূপ ধারণ করে। অর্থের সিংহভাগ থাকে নিরাকার। ঈশ্বরও নিরাকার, কিন্তু সব ধর্মই ওনার একটি মূর্তি নির্মাণ করে, কেউ ধাতু-পাথর-মাটির মূর্তি, কেউ বা কথা বা ভাবমূর্তি। মূর্তি থেকে মুক্তি নেই কিংবা মূর্তি বিনা মুক্তি নেই। ঈশ্বরকে 'নিরাকার' বলার অর্থ অবশ্যই এটা স্বীকার করে নেওয়া যে তিনি যে কোনো জায়গায় থাকতে পারেন। কিন্তু মানুষ যদি ঈশ্বরের সাকার রূপে বিশ্বাসই না করবে, তবে সে প্রার্থনাগৃহ নির্মাণ করবে কেন, তীর্থযাত্রায়ই বা সে যাবে কেন, তার সঙ্গে দেখা করার জন্যে দূর আকাশে যাবারই বা প্রয়োজন কেন হবে? সব ধর্মই দাবি করে, ঈশ্বর সর্বব্যাপী এবং নিরাকার, কিন্তু প্রার্থনা কিংবা আধ্যাত্মিক আনন্দ/শান্তি পাবার প্রয়োজনে মানুষকে ঈশ্বরের সাকার উপস্থিতি কল্পনা করতেই হয়, ঠিক যেমন লেনদেনের জন্যে মানুষের প্রয়োজন হয় নগদ টাকার।

ছয়. মানুষের তৈরি কিছুই অপরিহার্য নয়!

ভাষাহীন, ধর্মহীন এবং অর্থহীন জীবন যাপন কি সম্ভব? ইলিয়াড-ওডিসির যুগের গ্রীসে মুদ্রা ছিল না। রামায়ণ-মহাভারতের যুগে মুদ্রা ছিল, যার মানে হচ্ছে ইলিয়াড-ওডিসি সম্ভবত প্রাচীনতর। যাই হোক, মুদ্রাহীন, ব্যাংকহীন জীবনও যে সম্ভব তারও প্রমাণ আছে। ১৯৭০ সালের মে থেকে নভেম্বর– সাত মাস আয়ারল্যান্ডে সব ব্যাংক বন্ধ ছিল কর্মচারী-ধর্মঘটের কারণে। খুব যে সমস্যা হয়েছিল তা কিন্তু নয়। বন্ধের আগে আগে মানুষ একাউন্ট থেকে সব টাকা তুলে নিয়েছিল, যার যার চেকবইও ছিল। সেই টাকা এবং চেকবইয়ের পাতা যখন ফুরিয়ে গেছে, মানুষ নিজেই তখন টাকা সৃষ্টি করেছে। এর নাম 'আই-ও-ইউ' যার মানে 'আই ওও ইউ' বা 'আমি তোমার কাছে ধারি'। 'আমি তোমার কাছে ২০০ পাউন্ড ধারি' বা 'তুমি আমার কাছে ২০০ পাউন্ড পাও' লিখে তার নিচে ঠিকানা, ফোন নম্বর এবং স্বাক্ষর দেওয়া কাগজ পরিচিত জনের মধ্যে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে গৃহীত হয়েছিল। নভেম্বর মাসে ব্যাংক খোলার পর ধীরে ধীরে সব হিসাব চুকানোর পর দেখা গিয়েছিল যে সেই ছয় মাসে আয়ারল্যান্ডের অর্থনীতির ভালো রকম প্রবৃদ্ধি হয়েছিল।

ভাষা কিংবা ঈশ্বরের মতোই টাকা মানুষের অবচেতনভাবে উদ্ভাবিত একটি প্রযুক্তি। মনুষ্যসৃষ্ট কোনো সত্তা, কোনো প্রযুক্তিই অপরিহার্য নয়, কারণ এসব প্রাক-প্রযুক্তি যুগেও মানুষ বেঁচে ছিল। মনুষ্যতর প্রাণীরা ভাষা-ধর্ম-টাকা ছাড়াই চমৎকার চালিয়ে নিচ্ছে। চীনে ঈশ্বর বা ধর্ম কোনোটাই নেই। কিন্তু চীনের মানুষ তথাকথিক ধার্মিক দেশগুলোর চেয়ে অ-সুখে আছে, এমন দাবি করা যাবে না। (যেমন ধরুন, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বচসা হয়ে কথা বন্ধ হয়ে গেলে) 'নির্ভাষ' জীবন মানুষের জন্যে অসহনীয় মনে হতে পারে, কিন্তু একেবারে 'অযাপনীয়' নিশ্চয়ই নয়।

সাত. মহামিলনের চাবিকাঠি

ভাষা, ধর্ম, টাকা– এই তিনটি মানুষের উদ্ভাবিত সমজাতীয় তিনটি প্রযুক্তি। আমরা জানি না, ঠিক কখন টাকা, ধর্ম, ভাষার সৃষ্টি হয়েছিল। ভাষা সম্ভবত সবচেয়ে পুরনো, ধর্ম ও টাকার মধ্যে কোনটি প্রাচীনতর, আমরা জানি না। তবে ভাষা ও ধর্মের তুলনায় টাকার একটি শ্রেষ্ঠত্ব আছে। মানুষ সাধারণত নিজের ধর্মকেই শ্রেষ্ঠ মনে করে। দুই ধর্মের লোক যদিও নিরুপায় হয়ে একই ভাষা বলতে বাধ্য হয়, সেই ভাষার শব্দের ব্যাপারে তাদের ছুঁৎমার্গ থাকে। 'বিসমিল্লায় গলদ' বা 'মহাভারত অশুদ্ধ হবে না' হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে হয়তো ব্যবহার করে থাকেন, কিন্তু বাংলা শব্দ 'মঙ্গল' বা 'শ্মশান' জিবের ডগায় আনতেও আপত্তি করে থাকে অনেক বাঙালি মুসলমান। হিন্দুর মুখে 'পানি' বা 'জি' শুনে অনেক হিন্দু বিরক্ত হয়। অনেক মুসলমান হিন্দি-উর্দু লেখার সময় দেবনাগরী লিপিতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন না, আরবি লিপি দেখলে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচেন।

খ্রিস্টানেরা আন্দালুশিয়া পুনর্দখল করে নেবার পর নতুন স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রা চালু করেছিল। সেই মুদ্রার ওপর ছিল ক্রুশচিহ্ন এবং অবিশ্বাসীদের পরাজিত করার জন্যে ঈশ্বরকে ধন্যবাদজ্ঞাপন। নিজেদের পরাজয়ের এই স্মারক মুদ্রা মুসলমানেরা সানন্দে ব্যবহার করত। অন্যান্য ইওরোপীয় মুদ্রা যেমন, ফ্লোরিন বা ডুকাট নিতেও মুসলমানদের কোনো আপত্তি ছিল না। একইসাথে 'মিলারেস' বা 'দিনারেস' নামে একটি চতুষ্কোণ মুদ্রা চালু হয়েছিল যার উপর মুদ্রিত ছিল কলেমা শাহাদাত: 'আল্লাহ ছাড়া উপাস্য নাই এবং মুহাম্মদ (স.) তার নবী।' মুসলমানকে আজন্ম ঘৃণা করে এমন ক্যাথলিকেরাও সানন্দে, বিনা প্রশ্নে (খ্রিস্টান বিচারে) 'বেদাতি' মিলারেস ব্যবহার করত।

ইতিহাসে খ্রিস্টান-মুসলমান, হিন্দু-মুসলমানে কাজিয়া-ঝগড়া কম হয়নি। একে অপরের ধর্মকে তো মানেই না, ঈশ্বরকেও আদৌ মানতে চায় কিনা, সে ব্যাপারেও সন্দেহের অবকাশ আছে। মঙ্গল শোভাযাত্রা হিন্দুয়ানি কিনা, ভাত কিংবা ইলিশ মাছ আদৌ মুসলমানদের ভক্ষ্য কিনা– এ নিয়ে বাহাস চলমান। কিন্তু টাকা জিনিসটা হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টান-ইহুদি সবার কাছে সমান গ্রহণযোগ্য। কোনো মুসলমানকে হিন্দুর বা হিন্দুকে মুসলমানের টাকা নিতে আপত্তি করতে দেখা যায়নি ইতিহাসে। 'মানি ইজ সুইটার দ্যান হানি' কিংবা 'গড ইজ মানি'– এসব প্রবাদবাক্য সৃষ্টি হবার নিশ্চয়ই কারণ আছে। টাকা এমন এক ভাষা যা সব জাতির কাছে বোধগম্য। টাকা যদি কোনো দেবতা হতো, আমি নিশ্চিত, এর ভক্তের অভাব হতো না।

আট: টাকা তুমি দীর্ঘজীবী হও!

ভাষা, ধর্ম এবং টাকা– মানুষের উদ্ভাবিত এই তিনটি প্রযুক্তি সভ্যতার অগ্রগতিতে অপরিহার্য ভূমিকা রেখেছে। এই প্রযুক্তিগুলোর সাধারণ বৈশিষ্ট্য আমরা উজানে সবিস্তারে বর্ণনা করেছি। ভাষা মানুষে মানুষে যোগাযোগ সম্ভব করেছে, ধর্ম মানুষকে 'যুথবদ্ধ' করেছে, লেনদেন ও বিনিয়োগের বাহন হয়ে টাকা অর্থনীতির সৃষ্টি ও বিকাশের প্রধান নিয়ামক হয়েছে। মূল্য ও সম্পদ, চিন্তা ও বক্তব্য এবং মানুষের অস্তিত্বকে কালান্তরে এবং স্থানান্তরে প্রেরণের প্রয়োজনে সৃষ্টি হয়েছে যথাক্রমে অর্থ, ভাষা এবং ধর্মের। তিনটি প্রযুক্তিই বহু হাজার বছর ধরে, বহু হাজার মানুষের সম্মিলিত ও অবচেতন প্রয়াসে উদ্ভাবিত হয়েছে। সার্বজনীন বিশ্বাস এবং গ্রহণযোগ্যতা এই প্রত্যেকটি প্রযুক্তির ভিত্তি। ভাষা, ধর্ম ও অর্থ– তিনটি সত্তাই আর্বিত্রিক, অর্থাৎ মানুষের খামখেয়ালের ওপর ভিত্তি করে এগুলো গড়ে উঠেছে।

এই তিনটি প্রযুক্তি এবং এর আন্ত উপকরণগুলো ক্রমাগত প্রতিযোগিতার ভেতর দিয়ে যায়। প্রতিটি প্রযুক্তির ক্ষুদ্র একটি অংশ সাকার অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হয় এবং বেশির ভাগ অংশ নিরাকার, অদৃশ্য থাকে। ধর্মের দৃশ্যমান অংশ এর আচার-সংস্কার, ভাষার দৃশ্যমান অংশ বাচন-লিখন, অর্থের দৃশ্যমান অংশ মুদ্রা ও কাগজের টাকা। মানুষের তৈরি অন্য যে কোনো কিছুর মতো ভাষা, ধর্ম বা টাকাও জীবনধারণের জন্যে অপরিহার্য নয়। প্রযুক্তি থাকলে ভালো, না থাকলেও জীবন একেবারে থেমে যায় না।

উপরোক্ত তিনটি সদৃশ প্রযুক্তির মধ্যে টাকা শ্রেষ্ঠ এ কারণে যে টাকার মতো আর কিছুই ধর্ম-বর্ণ-ভাষা-সংস্কৃতি-বয়স-লিঙ্গ-সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে মানুষে-মানুষে মহামিলন ঘটাতে পারেনি। ভাষা এবং ধর্ম উভয়েই সমভাষী, সমধর্মী মানুষের মধ্যে কমবেশি মিলন ঘটালেও ভিন্ন ভাষী, ভিন্ন ধর্মী মানুষের সঙ্গে প্রায় অলঙ্ঘ্যনীয় ব্যবধান সৃষ্টি করে। অন্য ধর্মের ঈশ্বরে মানুষের বিন্দুমাত্র বিশ্বাস না থাকতে পারে, বিধর্মীর ভাষা বা শব্দকেও সে ঘৃণা করতে পারে, কিন্তু বিধর্মীর টাকায় মানুষের আস্থা আছে আঠারো আনা। এর মানে, ভাষা যা করতে ব্যর্থ হয়েছে, ঈশ্বর কিংবা ধর্ম যা করে দেখাতে পারেনি, 'হাতের ময়লা' তুচ্ছ টাকা তা করে দেখিয়েছে।

এক অশিক্ষিতা বৃদ্ধা মহিলা নাকি হাইকোর্টের এক জজের বিচারে সন্তুষ্ট হয়ে এই বলে তাকে আশীর্বাদ করেছিলেন: 'বাবা, প্রমোশন পেয়ে তুমি দারোগা হয়ো!' টাকাকে আমি আর দারোগা হতে বললাম না, কারণ দারোগাদের এমনিতেই শুনেছি অনেক টাকা। তার চেয়ে বরং 'টাকা তুমি যুগ যুগ জিও!'– এই কামনা করে প্রবন্ধের ইতি টানলাম। এই কামনা অর্থহীন নয় মোটেই, কারণ ঈশ্বরের 'নিজের হাতে তৈরি' মানুষ যেহেতু মরণশীল, মানুষের 'নিজের হাতে তৈরি' টাকা (এবং ভাষা ও ধর্ম) চিরজীবি না হবার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।