নাম হোক ‘শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু’

মুহাম্মদ শফিকুর রহমান
Published : 15 May 2022, 12:47 PM
Updated : 15 May 2022, 12:47 PM

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও মুজিববর্ষের সবচেয়ে বড় উপহার পদ্মা সেতু। এটি কেবল পদ্মা পারাপারের সেতু নয়, এটি বাঙালি জাতির আত্মবিশ্বাস এমন উচ্চতায় প্রতিষ্ঠা করেছে যে আমরা যেকোনও অসাধ্য সাধন করতে পারি। আর এই আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তুলেছেন আমাদের সৎ সাহসী প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা– জাতির পিতার কন্যা। আর বেশিদিন নয় যেদিন The word 'impossible' কেবল ডিকশনারিতে পাওয়া যাবে, জীবনে নয়।

কে আমাদের এমন আত্মবিশ্বাসী করে তুললেন? তিনি আর কেউ নন আমাদের বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা। পিতা দিলেন দেশ কন্যা দিলেন সমৃদ্ধি, ঘর বারান্দা চলাচলের পথ সাজিয়ে দিলেন। দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া বলেছিলেন জোড়াতালি দিয়ে পদ্মা সেতু বানানো হচ্ছে, কেউ উঠবেন না এতে, এটি ভেঙ্গে পড়বে। পদ্মাসেতুর নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আগামী মধ্য জুনে সেতুর উদ্বোধন করবেন। আর সে কারণেই আমার প্রস্তাব পদ্মা সেতুর নামকরণ করা হোক 'শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু'।

কেন এই নাম? এজন্য যে, বিশ্বমোড়ল আমেরিকার এক সময়ের ফার্স্ট লেডি হিলারি ক্লিনটন তার বন্ধু প্রফেসর ড. মুহম্মদ ইউনুসের প্ররোচনায় যখন বিশ্ব ব্যাংক আইএমএফ-কে দিয়ে পদ্মাসেতুর অর্থায়ন বন্ধ করে দিলেন তখন গোটা জাতি হতাশায় নিমজ্জিত হলো। হবারই কথা, ৩০/৪০ হাজার কোটি টাকার কায়-কারবার। চাট্টিখানি কথা নয়। কিন্তু সমগ্র জাতিকে অবাক করে দিয়ে শেখ হাসিনা তর্জনী উঁচিয়ে উচ্চারণ করলেন– "so what? We will make it on our own money."

এই আমাদের প্রধানমন্ত্রী, এই আমাদের বঙ্গবন্ধুকন্যা, এই আমাদের রাষ্ট্রনেতা, এই আমাদের দেশরত্ন, এই আমাদের star of the east, এই আমাদের mother of humanity, এই আমাদের champion of the earth, এই আমাদের বেগম রোকেয়া, এই আমাদের বেগম সুফিয়া কামাল, এই আমাদের প্রীতিলতা, এই আমাদের জাহানারা ইমাম, এই আমাদের মাদার তেরেসা। আজি হতে শতবর্ষ পরে বাংলার যে কবি কবিতা লিখিবে পদ্মা পারে বসিয়া, দেখিবে ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভেসে উঠবেন বিশাল মানব প্রতিকৃতি বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান, সাহসী সুপুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সাথে সাথে তার পাশাপাশি কাশবন চিরে ভেসে উঠবেন তারই আদরের কন্যা ১৭ কোটি বাঙালির হয়তো তার চেয়েও অনেক বেশি সংখ্যকের আপনজন, ভবিষ্যত প্রজন্মের প্রিয় রাষ্ট্রনেতা, আগামী প্রজন্মের সাহসীকা প্রিয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা। আমি বলব বাঙালি জাতি প্রতিদিন তাকে নব নব রূপে আবিষ্কার করে চলেছে।

আমি জানি আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই নামকরণ করতে নিষেধ করবেন। একবার পার্লামেন্টে তিনি অনীহা প্রকাশ করেছেনও। আমরা এ-ও জানি উত্তর প্রজন্মের স্বার্থে তাকে তুলে ধরা জরুরী। নইলে আমাদের সন্তানরা কাকে দেখে বড় হবে, সাহসী হবে।

আমাদের ভুলে গেলে চলবে না কি বিরাট ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে আজ পদ্মা সেতু বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে। কোভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাসের কারণে মুজিববর্ষে অনেক কর্মসূচি সীমিত পরিসরে করতে হয়েছে, এর মধ্যেও কিছু প্রকল্প দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে কেননা ওগুলো অধিক জনগুরুত্বসম্পন্ন কর্মসূচি।

লক্ষ্য করার বিষয় হলো একদিকে উত্তাল পদ্মায় পিলার বসিয়ে সেতু নির্মাণ, যার ওপর দিয়ে বিশাল বিশাল ট্রাক-বাস চলবে, কার চলবে। হাজার যাত্রী নিয়ে ট্রেন চলবে। কত বড় কাজ। যত বড় কাজ তত বড় সাহস এবং দক্ষতা। কেউ কেউ তো ঠাট্টা-মশকরা করতেও ছাড়েননি। আমাদের দেশে আরেকজন নেত্রী আছেন যিনি ১১ বছর রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন, ছিলেন বিরোধীদলীয় নেতাও। তার মুখ থেকেও আমরা যেসব হিউমার শুনেছি তা দীর্ঘদিন মনে থাকবে। আজ তিনি কি বলবেন জানি না। অবশ্য আগেই বলেছেন। তিনি আমাদের খালেদা জিয়া, তিনি বলেছেন– "আওয়ামী লীগ পদ্মা সেতু বানাতে পারবে না। আমরা ক্ষমতায় গেলে দুইটি পদ্মা সেতু বানাবো"। যখন দেখলেন সকল বাধা অতিক্রম করে শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজ শুরু করেছেন তখন খালেদা জিয়া বললেন– সেই বিখ্যাত মনিব-ভৃত্যের গল্পের মতো। ভৃত্য তার ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেওয়ার জন্য মনিবকে অনুরোধ করলেন– ভৃত্য: কর্তাবাবু আমার ছেলেটি ভালো ইংরেজি বলে ওকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিন। মনিব: তোর ছেলে ভর্তি হতে পারবে না, ভৃত্য: (কিছুদিন পর) আমার ছেলে ভর্তি হয়ে গেছে কর্তাবাবু, মনিব: ভর্তি হলে কি হবে, পাস করতে পারবে না, ভৃত্য: (কিছুদিন পর) ছেলেটি জলপানি নিয়ে পাস করেছে বাবু, মনিব: তাতে কি চাকরি পাবে না, ভৃত্য: (আরও কিছুদিন পর) ছেলে চাকরি পেয়েছে কর্তাবাবু, মনিব: চাকরি পেলে কি হবে, বেতন পাবে না, ভৃত্য: কর্তাবাবু বেতনও পেয়েছে, মনিব: বেতন পেলে কি হবে ও টাকা চলবে না, সেই ছেলে একদিন চাকরি পেল। বেতন পেয়ে কর্তাবাবুর জন্য মিষ্টি নিয়ে এলো। এবার কর্তাবাবু কী বলবেন?

আমাদের বেগম খালেদা জিয়ার দুই নেতা-নেত্রী মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং সংরক্ষিত আসনের ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা যখন দেখলেন আওয়ামী লীগ পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে পারবে না কথাটি মিথ্যে হয়ে গেল তখন বের করলেন পদ্মা সেতুতে খরচ বেশি হয়েছে। এর চেয়েও অনেক কম টাকায় নির্মাণ করা যেত। বলতে ইচ্ছে করে আপনাদের তো বেশি খরছে একটি বাঁশের সাঁকো বানানোর মুরোদ নেই, অনেকদিন তো ক্ষমতায় ছিলেন কিছুই তো দেখাতে পারেননি!

তবে আজ আর তাদের কথা বলব না। নিজেদের কথা দিয়েই প্রবন্ধের সমাপ্তি টানব। এদিক-সেদিক কিছু ঘটনা, কিছু কথাবার্তা শুনে মনে হয় কোনো কোনো নেতা পদ্মা সেতুর মালিক হয়ে গেছেন। ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান-মেম্বার, পৌর মেয়র-কমিশনার, উপজেলা চেয়ারম্যান (নতুন জমিদার) কিংবা এমপি-মন্ত্রী হতে পারলে একেকজন যেন এলাকার জমিদার। একবার বিশ্ব ব্যাংক মিথ্যা তথ্যের ওপর তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে অপমান করল যা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। এই সৈয়দ আবুল হোসেন ছিলেন একজন যোগ্য মন্ত্রী। একই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। আমার এক বছরের জুনিয়র। হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলে থাকতাম, ছাত্রলীগ করতাম। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর আমি দৈনিক ইত্তেফাকে আর তিনি সরকারি চাকরিতে দীর্ঘদিন। কারো সাথে কারো দেখা নেই। অনেক পরে যখন দেখলাম ততদিনে তিনি এমপি ও পরে মন্ত্রী হয়েছেন এবং অর্থবিত্তে অনেক বড়লোক। নিজ এলাকায় স্কুল-কলেজ বানিয়ে নিজ খরছে পরিচালনা করে চলেছেন বছরের পর বছর। তার কাছে আমার একটা ঋণ আছে। তিনি যখন যোগাযোগমন্ত্রী আমার এলাকা ফরিদগঞ্জ সদরের পাশেই চাঁদপুর-ফরিদগঞ্জ-রায়পুর-লক্ষ্মীপুর আঞ্চলিক মহাসড়কে ফরিদগঞ্জের পাশে ডাকাতিয়া নদীর ওপর একটি বেইলি ব্রিজ ছিল। অনেক পুরনো। একবার তার ওপর দিয়ে যাবার পথে আমার গাড়ি এমনভাবে ঝাঁকুনি খেলো যেন ভেঙ্গে পড়বে। আমি গাড়ি থেকে নেমে তার সাথে যোগাযোগ করলে বললেন তার অফিসে যেতে। এর দুই দিন পরেই ঢাকা ফিরে সচিবালয়ে ঢুকলাম। এলাকার বড় ব্যবসায়ী আব্দুল বশিরের সাথে দেখা, তিনিও আমার সাথে মন্ত্রীর কক্ষে ঢুকলেন। মন্ত্রীমহোদয় যথেষ্ট সম্মানের সাথে আমাকে স্বাগত জানালেন। আমি সাক্ষাতের উদ্দেশ্য জানালে মন্ত্রী বললেন একটা দরখাস্ত লিখতে। তিনি দরখাস্তটি তার অফিসে কম্পোজ করালেন এবং তার রোডস-এর চীফ ইঞ্জিনিয়ার ও একজন অতিরিক্ত সচিবকে ডাকলেন। আপনারা নিশ্চয়ই শফিক ভাইকে চেনেন। তিনি একটি দরখাস্ত নিয়ে এসেছেন এটি একটি ব্রিজের কাজ, বেইলি ব্রিজের রিপ্লেসমেন্ট পাকা ব্রিজ বানাতে হবে। আমি লিখে দিচ্ছি, আপনারা কীভাবে করবেন আপনারাই জানেন বলে তিনি আমার দরখাস্তের ওপর ইংরেজিতে লিখলেন "I want this project be completed within this financial year" সত্যি সত্যি দুই অর্থ বছরের মধ্যে পাকা ব্রিজ হয়ে গেল। তখন আমাদের দলেরই এক অবৈধ বিত্তের মালিক (ঢাকা সিটি করপোরেশনের) স্থানীয় নেতার খুঁজলি শুরু হলো। তিনি উদ্বোধন করবেন। স্থানীয় দুই-একজন সেলফ প্রোকলেম সাংবাদিককে দিয়ে স্থানীয় কাগজে লেখাতে চেষ্টা করলেন তার প্রচেষ্টায় ব্রিজটি হয়েছে অতএব তিনি উদ্বোধন করবেন। অথচ তিনি জানতেনই না ভেতরে ভেতরে ব্রিজের কাজ হচ্ছে। তখন ওবায়দুল কাদের যোগাযোগ ও সেতু মন্ত্রী, তিনিও আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু। আমি তার সাথে দেখা করে কথাটা বললে তিনি হেসে বললেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ডিজিটালি উদ্বোধন করবেন। বিত্তবান লুটেরা ভদ্রলোক হতাশ হলেন। শুনেছি তিনি নাকি নিজের নাম খচিত উদ্বোধনী প্লেটও বানিয়েছিলেন। আর বলতেন "আঁই একখান ডি-ও দিছিলাম"।

ওবায়দুল কাদের দলের দ্বিতীয় ক্ষমতাধর সাধারণ সম্পাদক, আন্দোলন জেল-জুলুম সহ্য করে নেত্রী এবং দলের র‍্যাংক অ্যান্ড ফাইলের আস্থা অর্জন করেই এই পর্যায়ে এসেছেন। শুনেছি বহু কেলেংকারীতে জড়িয়ে পড়া এক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের জায়গা দখলের স্বপ্ন দেখছেন। স্বপ্ন স্বপ্নই। তাই আর বললাম না। চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জে নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে আমারও স্থানীয় রাজনীতি ও প্রশাসন নিয়ে অনেক কথা আছে কিন্তু সেটা তো আমি বাইরে নিতে পারি না। আমার বাইরে নেওয়া মানে প্রতিপক্ষকে আইলে দাঁড়িয়ে আহা বেশ বেশ বলে হাত তালি দেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া। ওবায়দুল কাদেরের অঞ্চলের তার খুব কাছের দুইজন জনপ্রতিনিধি যেভাবে বিষয়গুলো প্রকাশ্যে এনেছেন তা মোটেও কাম্য নয়।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নামে কেন পদ্মা সেতুর নামকরণ করতে হবে তা কিছুটা আগেই বলেছি। আজকের বাংলাদেশ তাই চায় বলে আমি মনে করি। ১৯৭৫-এর পরে আরও তো কত সরকার এলো-গেলো, দুঃখী মানুষের জন্য একসঙ্গে ৬৬ হাজার পাকা ঘর নির্মাণ করে দেওয়া কি চাট্টিখানি কথা। কয়েকদিন আগে ৩২০০০ পাকা ঘর গরীবদের মাঝে বিতরণ করলেন। অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদেরও পাকা বিল্ডিং বানিয়ে দিচ্ছেন। এই নিয়ে সম্ভবত ৭০০০০ ঘর বানিয়ে দিলেন। ঘোষণা দিলেন একজন মানুষও ঘরহারা থাকবে না। সবচে বড় কথা হলো দক্ষিণ বাংলায় কোনো রাস্তাঘাট ছিল না। নদীর পর নদী, ফেরিতে পারাপার করতে হতো। সব নদীর ওপর ব্রিজ করে দিলেন, রাস্তা পাকা করে দিয়ে এখন ঢাকার সাথে যোগাযোগের ব্যবস্থা করলেন পদ্মা সেতুর মাধ্যমে। এতে করে কেবল চলাচল নয়, আমাদের জিডিপি তথা অর্থনৈতিক সূচকও বৃদ্ধি পাবে। এক সময় স্কুলে শিক্ষকরা ছাত্রদের প্রশ্ন করতেন, বল তো কোন জেলায় রেলগাড়ি নেই? ছাত্র-ছাত্রীরা বলত বরিশাল। আগামীতে আর কোনো শিক্ষক এ প্রশ্ন করবেন না। পদ্মা সেতু দিয়ে রেল গাড়িও চলবে।

তাই উত্তর প্রজন্মের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগাবার স্বার্থেই পদ্মা সেতুর নাম 'শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু' রাখা দরকার।