নতুন চ্যানেল নতুন ভাবনা

খ ম হারূন
Published : 12 Sept 2015, 07:11 AM
Updated : 1 Dec 2012, 10:20 AM

বর্তমান সরকারের সময় ১৫ বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল অনুমোদন পেয়েছে। এরমধ্যে ক'টি চ্যানেল সম্প্রচারে এসেছে এবং ক'টি চ্যানেল এখনও আলোর মুখ দেখেনি, এমন জিজ্ঞাসা সর্বত্র। এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে একটু পেছনে যেতে চাই।

বর্তমান সরকার ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতা গ্রহণ করে। তার পরপরই তথ্য মন্ত্রণালয় বেসরকারি টেলিভিশন পরিচালনার জন্য একটি নীতিমালা প্রনয়ণের উদ্যোগ গ্রহণ করে। নীতিমালা-সংক্রান্ত বেশ ক'টি সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার পর হঠাৎ করে সে সময়ের তথ্যমন্ত্রী মনে করেন, আগে কিছু টিভি চ্যানেলের অনুমোদন দেওয়ার পর নীতিমালা প্রনয়ণের কাজে হাত দেবেন। তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী ভেবেছিলেন, প্রথমেই নীতিমালা তৈরি হয়ে গেলে নতুন চ্যানেলের অনুমোদন দেওয়া হয়তো কিছুটা কঠিন হয়ে পড়বে। সম্ভবত এই ভাবনা থেকেই তাড়াহুড়ো করে এক বছরের মধ্যে ১১ টিভি চ্যানেলের অনুমোদন দেওয়া হয়। চ্যানেলগুলো হল- এটিএন নিউজ, বিজয় টিভি, মাই টিভি, মোহনা টিভি, সময়, একাত্তর, চ্যানেল ২৪, চ্যানেল ৯, ইনডিপেনডেন্ট, জিটিভি এবং মাছরাঙা। পরে অনুমোদন পায় আরও ৪ টিভি চ্যানেল- এসএ টিভি, এশিয়ান টিভি, দীপ্ত বাংলা এবং গান বাংলা। এখন পর্যন্ত সর্বমোট ১৫টি।

একটু পর্যালোচনা করলে দেখতে পাব যে, নতুন চ্যানেলগুলোর সবই রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পেয়েছে তা নয়। যেমন, 'মাই টিভি'। যার প্রধান ব্যাক্তি বিএনপি'র একজন প্রাক্তন মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ জন। বিএনপি আমলেই চ্যানেলটি সম্প্রচার শুরু করেছিল। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে চ্যানেলটির সম্প্রচার বন্ধ করে দেওয়া হয়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এলে সে সময়ের তথ্যমন্ত্রীর সুপারিশে 'মাই টিভি' পুনরায় আলোর মুখ দেখতে পায়।

'বিজয় টিভি'ও এক সময়ে সম্প্রচাররত ছিল। চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা প্রাক্তন মেয়র মহিউদ্দিন আহমেদ চট্টগ্রামের সংস্কৃতি ও নগরের উন্নয়নের কথা ভেবে চ্যানেলটি চালু করেছিলেন। 'এক-এগারো' পরবর্তী তত্ত্ববধায়ক সরকার 'বিজয় টিভি'কে কেন্দ্র করে মহিউদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে মামলা করে। যার খেসারত হিসেবে দীর্ঘদিন তিনি কারাবাস করেন। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর চ্যানেলটি ফের সম্প্রচারের অনুমোদন পায়, কিন্তু অর্থাভাবে এটি চালু করতে না পারায় এক সময় 'বিজয় টিভি' চলে যায় এটিএন বাংলার চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমানের হাতে।

মাহফুজুর রহমানের হাতে আসে আরও একটি টিভি চ্যানেল। সেটি হল 'এটিএন নিউজ'। যার উদ্যোক্তা এবং ব্যাবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন যুক্তরাষ্ট্র-প্রবাসী সাংবাদিক মনজুরুল ইসলাম। কিন্তু এক সময় মনজুরুল ইসলামকে 'এটিএন নিউজ' থেকে কৌশলে সরিয়ে দেওয়া হয়। ফলে চ্যানেলটির পুরো কর্তৃত্ব মাহফুজুর রহমানের হাতে চলে আসে। এখন তিন-তিনটি টিভি চ্যানেলের মালিক মাহফুজুর রহমান বাংলাদেশের মিডিয়া-মোঘল হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছেন। তবে 'বিজয় টিভি'র ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রাক্তন মেয়ের মহিউদ্দিন আহমেদ বেশ অস্বস্তিতে রয়েছেন বলে জানা যায়।

বর্তমান সরকারের আমলে বেশ ক'টি ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠান টিভি চ্যানেলের অনুমোদন পায়। যেমন, স্কয়ার গ্রুপের 'মাছরাঙা', বেক্সিমকো গ্রুপের 'ইনডিপেনডেন্ট' এবং হামিম গ্রুপের 'চ্যানেল ২৪'। এই তিনটি চ্যানেলই এখন বেশ প্রতিষ্ঠিত, ঝকঝকে স্ক্রিন। নতুন মাত্রার অনুষ্ঠান এবং তরতাজা সংবাদ পরিবেশনের প্রচেষ্টা রয়েছে, যা চ্যানেল তিনটিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। দর্শকের আগ্রহ আছে এ তিন চ্যানেলের ব্যাপারে।

এদিকে শুধুমাত্র সংবাদভিত্তিক চ্যানেল হিসেবে অনুমোদনপ্রাপ্ত চ্যানেলগুলো হল- 'এটিএন নিউজ', 'ইনডিপেনডেন্ট', 'সময় টিভি' ও 'একাত্তর টিভি'। 'একাত্তর টিভি' এর সব অনুষ্ঠানের মধ্যেই নতুন মাত্রা আনার চেষ্টা করছে। 'সময় টিভি' নিউজ চ্যানেল হিসেবে যথেষ্ট এগিয়ে গেছে। 'ইনডিপেনডেন্ট' ও 'এটিএন নিউজ'-এর কথা আগেই বলেছি। 'চ্যানেল ২৪' প্রথমে শুধুমাত্র নিউজ চ্যানেল হিসেবে অনুমোদনপ্রাপ্ত হলেও পরবর্তীতে এরা মিশ্র চ্যানেল হিসেবে নিজেদের উপস্থাপিত করে।

অন্যদিকে দুজন সংসদ সদস্য দু'টি টিভি চ্যানেলের মালিক হওয়া সৌভাগ্য লাভ করেছেন এ সরকারের আমলে। এরমধ্যে রয়েছে, কামাল আহমেদ মজুমদারের 'মোহনা টিভি' ও গাজী গোলাম দস্তগীরের 'জিটিভি'। এ দু'টি টিভি চ্যানেল আলোচনায় তেমন গুরুত্ব লাভ করতে এখনো পারছে না। পূর্ণাঙ্গ সম্প্রচারে এসেও দর্শকদের আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হচ্ছে। তবে 'জিটিভি' তুলনামূলকভাবে 'মোহনা'-র চেয় এগিয়ে আছে।

এদিকে, আরেক নতুন টিভি 'চ্যানেল ৯' বিপিএল ক্রিকেট দেখিয়ে রাতারাতি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে। মূলত চ্যানেলটি একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেলের, যিনি জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলামের পুত্র। কিন্তু চ্যানেলটির মালিকানার একটি বড় অংশ এখন এনায়েতুর রহমান বাপ্পীর হাতে। এনটিভির প্রাক্তন ব্যবস্থাপনা পরিচালক এনায়েতুর রহমান বাপ্পী বর্তমানে এ চ্যানেলটির ব্যবস্থাপনা পরিচালেকর দায়িত্ব পালন করছেন।

একটু সচেতনভাবে তাকালেই আমরা দেখতে পাই, যে দুজন ব্যক্তিকে সহানুভূতির নিদর্শন হিসেবে দুটি চ্যানেল প্রদান করা হয়েছিল। এর একটি 'বিজয় টিভি' অন্যটি 'চ্যানেল নাইন', দু'টিই এখন পরিচালিত হচ্ছে অন্যপক্ষ কর্তৃক।

পরবর্তীতে প্রাক্তন তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদের আশীর্বাদে যে চারটি চ্যানেল অনুমোদন পায় এবং যেগুলো এখনও সম্প্রচারের অপেক্ষায় আছে সেগুলো হল, এসএ পরিবহনের সালাহ উদ্দিন আহমেদের 'এসএ টিভি'; এশিয়ান টেক্সটাইলের হারুন অর রশিদের 'এশিয়ান টিভি'; কাজী ফার্মের কাজী জাহিদুল হাসানের 'দীপ্ত বাংলা' এবং বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী চঞ্চল খানের 'গান বাংলা'। এখন এই চ্যানেল ক'টি কবে কখন সম্প্রচার শুরু করবে, সেজন্য অপেক্ষার প্রহর গোনা চলছে।

এসএ টিভি সম্প্রচারে আসার কথা ছিল ২০১১ সালে। চার দফা তারিখ পরিবর্তন করার পর সেটির সম্প্রচার তারিখ এখন নির্ধারণ করা হয়েছে ২৫ জানুয়ারি ২০১৩। নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে নিজস্ব ভবনে কাজ শুরু করেছে চ্যানেলটি। বিশিষ্ট চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব এবং বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রাক্তন মহাপরিচালক সৈয়দ সালাহউদ্দিন জাকী এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী। চ্যানেলটিতে শুরু হচ্ছে একটি আন্তর্জাতিক রিয়েলিটি শো 'বাংলাদেশী আইডল'। এই শোকে কেন্দ্র করে এখন বিশাল কর্মষজ্ঞ চলছে। আর এটা চ্যানেলের আকর্ষণ বাড়িয়ে দিয়েছে।

দীপ্ত বাংলা চ্যানেলটিরও নিজস্ব ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। শিল্পপতি ও স্থপতি কাজী জাহিদুল হাসান রুচিবান ব্যক্তি। শোনা যাচ্ছে মিডিয়া-ব্যক্তিত্ব আসাদুজ্জামান নূর 'দেশ টিভি' ছেড়ে 'দীপ্ত বাংলা'তে যোগ দেবেন। সেই সঙ্গে কানাডা থেকে আসবেন আরেকজন মিডিয়া-বিশেষজ্ঞ ফুয়াদ চৌধুরী। সুতরাং 'দীপ্ত বাংলা'কে কেন্দ্র করে দর্শকের প্রত্যাশা বেড়েই চলেছে।

গান বাংলা একটি সঙ্গীতভিত্তিক চ্যানেল। চঞ্চল খানের দীর্ঘদিনের ইচ্ছ বাংলাদেশে একটি পূর্ণাঙ্গ মিউজিক চ্যানেল চালু করা, সেটি অবশেষে পূরণ হতে চলেছে।

এশিয়ান টিভি নিয়ে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। এর অধিকাংশ অনুষ্ঠান তৈরি হচ্ছে ভারতে। তাই যদি হয়, তবে বাংলাদেশের জন্য চ্যানেলটির প্রয়োজনীয়তা জিজ্ঞাসার মুখে পড়বে। বাংলাদেশের সম্প্রচার-নীতিমালা ভঙ্গের দায়ে অভিযুক্ত হবে এই চ্যানেলটি এমন অভিমত ব্যক্ত করেছেন অনেক মিডিয়া-ব্যক্তিত্ব।

নতুন চ্যনেলগুলো পর্যলোচনা করলে কয়েকটি বিষয় চোখে পড়ে:

ক.
শুধুমাত্র রাজনৈতিক বিবেচনায় চ্যানেলগুলোর অনুমোদন দেওয়া হয়নি। এরমধ্যে বেশকিছু চ্যনেল আছে যারা বর্তমান সরকারের সমর্থক নন।

খ. অধিকাংশ চ্যানেল পরিচালিত হচ্ছে অদক্ষ এবং অনভিজ্ঞ ব্যাক্তির দ্বারা। তাই চ্যনেলগুলো সম্পচারে আসার আগেই নানা ধরনের ঝামেলার মুখোমুখি হচ্ছে।

গ. অধিকাংশ চ্যানেল যাদের নামে প্রদান করা হয়েছিল তারা শুধুমাত্র টাকার জন্য সুবিধাভোগী পক্ষের কাছে চ্যানেল বিক্রি করে দিয়েছেন।

ঘ. রাজনৈতিকভাবে সরকারের একটি বিরোধী-চক্র সুকৌশলে এসব চ্যানেলের মাঝে অনুপ্রবেশ করেছে।

ঙ. বেশকিছু চ্যানেল এক বছরের ভেতর সম্প্রচার শুরু করলেও অনেক চ্যানেল দু'বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও সম্প্রচারে আসতে পারেনি।

কোন মাপকাঠিতে চ্যানেলগুলোর অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল তা বোধহয় প্রাক্তন তথ্যমন্ত্রী জানেন। মোজাম্মেল বাবু (একাত্তর টিভি) ছাড়া আর কোনো মিডিয়া-ব্যক্তিত্বকে চ্যানেলের অনুমোদন দেওয়া হয়নি। কেন হয়নি সেটাও প্রাক্তন তথ্যমন্ত্রী বলতে পারবেন। কিন্তু ফলাফল যে ভালো হয়নি সেটা সরকারের উর্ধতন মহল এখন সম্ভবত বুঝতে পারছেন।

খ ম হারূন : টিভি ব্যক্তিত্ব। শিক্ষক, টেলিভিশন ও ফিল্ম ষ্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।