৫০ বছরে ব্র্যাক: পুরস্কারপ্রাপ্তি নয় আরও গভীরে প্রোথিত যে অর্জন

উপমা মাহবুবউপমা মাহবুব
Published : 23 March 2022, 11:03 AM
Updated : 23 March 2022, 11:03 AM

'জেন্ডার আপা', 'স্বাস্থ্য আপা'– আমরা যারা উন্নয়ন পেশাজীবী তাদেরকে মানুষ এরকম নানা নামে ডাকে। যাদের কাছে আমরা সেবা নিয়ে যাই, যাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে সহায়তা করার চেষ্টা করি– এরকম সহজ-সরল গ্রামীণ মানুষেরা ভালোবেসে এই নামগুলো দিয়ে থাকেন। অবশ্য অনেকে বিদ্রুপ করেও এ রকম নামে ডাকেন। যে উন্নয়ন পেশাজীবীরা জেন্ডার নিয়ে কাজ করেন তারা বন্ধু-বান্ধবের আড্ডাতে নায়িকা থেকে শুরু করে অনুপস্থিত বন্ধুর স্ত্রীকে লক্ষ্য করে অশালীন, ইঙ্গিতময় আলোচনা বা নারীকে হেয় করা মন্তব্য শুনে চুপ করে থাকতে পারেন না– এগুলো যে জেন্ডার অসংবেদনশীল এবং অসম্মানজনক সে কথাটি সবাইকে মনে করিয়ে দেন। ফলে তাদেরকে দেখলেই বন্ধুরা হো হো করে হেসে উঠে বলে 'জেন্ডার আপা চলে এসেছে, এখন এসব চটুল আলাপ করা যাবে না। সিরিয়াস কথা বলতে হবে'।

এসবে অবশ্য উন্নয়ন পেশাজীবীদের কিছু যায় আসে না। প্রত্যন্ত গ্রামের নিজেরাই ভালোভাবে দুমুঠো খেতে না পারা বয়োবৃদ্ধ চাচা-চাচীরা আমাদেরকে গাছের পেয়ারা, ডাব পেড়ে খাওয়াতে চান। স্কুল থেকে ঝরে পড়া শিশুর বাবা-মাকে কাউন্সিলিং করে শিশুটিকে স্কুলে পাঠাতে সক্ষম হয়েছেন যে উন্নয়ন পেশাজীবী তার কাছে দশ বছর পর খবর আসে সেই শিশুটি বড় হয়ে গেছে, ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে। স্বাস্থ্যসেবিকা হিসেবে কাজ করা যে নারী গর্ভবতী মাকে নিরাপদে সন্তান প্রসবের জন্য হাসপাতালে নিয়ে যান, রাত জেগে তার পাশে বসে থাকেন, অনেক কৃতজ্ঞ বাবা-মা সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুটিকে সেই উন্নয়ন পেশাজীবী আপার কোলে তুলে দিয়ে তার একটি সুন্দর নাম রাখতে অনুরোধ করেন। মানুষের দোয়া এবং ভালোবাসা– এগুলোই তাই আমাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন। উন্নয়ন সংস্থায় যারা কাজ করেন তাদের বেতন অত্যন্ত কম। তাদেরকে গ্রাম-গ্রামান্তরে বিরামহীন ছুটে বেড়াতে হয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পোস্টিং হওয়ায় পরিবারের সঙ্গে অনেকেই থাকতে পারেন না। তারপরও বাংলাদেশ জুড়ে হাজার হাজার নর-নারী উন্নয়ন পেশাজীবী হিসেবে মানুষের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছেন। কারণ এই কাজের যে মানসিক প্রশান্তি তাকে অর্থ দিয়ে মূল্যায়ন করা যায় না।

আর কে না জানে, বাংলাদেশের উন্নয়ন সেক্টরকে সারা পৃথিবীর কাছে সুপরিচিত এবং প্রশংসিত করেছে যে সংস্থাটি, তার নাম ব্র্যাক। গত ২১ মার্চ ব্র্যাক ৫০ বছরে পদার্পণ করল। সংস্থাটি এক নাগাড়ে গত পাঁচ বছর ধরে বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করে চলেছে। ব্র্যাকের ৫০ বছর পূর্তিকে কেন্দ্র করে মাননীয় রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীসহ দেশ-বিদেশের নীতিনির্ধারক এবং বিশিষ্টজনেরা বাণী দিয়েছেন। তারা ব্র্যাককে প্রশংসায় ভাসিয়েছেন। তবে একজন ব্র্যাককর্মী হিসেবে আমি আমার সংস্থাকে খানিকটা ভিন্ন চোখে দেখি। আমার মনে হয় বিশ্বের সবচেয়ে বড় এনজিও হিসেবে ব্র্যাক উন্নয়ন সংস্থাসহ এই সেক্টরে কর্মরত সকল স্টেকহোল্ডারদের জন্য রোল মডেল হবে এটাই স্বাভাবিক। সংস্থাটির অনন্যতা তাই তার অর্জন বা অবদানে নয়। কারণ এই অবদানগুলো রাখতে পারাটা তার দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। বরং আমার মনে হয় ব্র্যাকের অনন্যতা তার প্রতিটি কাজ ও অ্যাকশনের মধ্যে 'মানবিকতা' ও 'সমতা'কে কার্যকরভাবে প্রোথিত করতে পারার সক্ষমতার মধ্যে নিহিত আছে।

ব্র্যাক সেই সংস্থা যেখানে প্রতিটি প্রোগ্রাম নিরলসভাবে তাদের কর্মী সংখ্যার মধ্যে জেন্ডারসমতা আনার জন্য কাজ করে চলেছে। এই সংস্থার কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে চমৎকার একটি ডে কেয়ার সেন্টার আছে। সারাদেশ জুড়ে অবস্থিত অধিকাংশ অফিসে ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার আছে। সংস্থাটিতে পুরুষ কর্মীরা এক মাসের পিতৃত্বকালীন ছুটি উপভোগ করেন। কেউ যদি এই ছুটি না নিয়ে অফিস করতে চান সেটিকে ভালো চোখে দেখা হয় না, কেননা এ রকম সময়ে স্ত্রী ও সন্তানের পাশে থাকতে না চাওয়াটা দায়িত্ব অবহেলা করে সন্তান পালনের সব দায় স্ত্রীর ওপর চাপিয়ে দেওয়ার মনোভাবকেও নির্দেশ করে। ব্র্যাক সেই সংস্থা যেখানে প্রতিবন্ধী কর্মী নিয়োগ দেয়ার একটি লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে এবং সেটি নিশ্চিত করতে নানাবিধ উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। ব্র্যাক প্রতিটি প্রোগ্রাম ডিজাইন এবং বাস্তবায়নের সময়ও 'মানবিকতা' এবং 'সমতা'র ধারণাকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। ২০২০ সালে দেশব্যাপী কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে গ্রামাঞ্চলে অনেক মানুষ কাজ হারিয়ে অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ওই সময় ব্র্যাক তার ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচির কিস্তি সংগ্রহ করার কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। কর্মীরা কোভিড-১৯ বিষয়ক সামাজিক এবং স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক কার্যক্রমে অংশ নেন। অন্যদিকে তারা ক্ষুদ্রঋণ গ্রহণকারী সদস্যদের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগও রাখেন। কিস্তি সংগ্রহ বন্ধ থাকলেও তাদের জন্য সঞ্চয় তোলার সুযোগ খোলা রাখা হয়। ফলে অসংখ্য ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতা ব্র্যাক থেকে তাদের জমানো টাকা বিকাশের মাধ্যমে তুলে নিয়ে দুর্যোগের সময়ে পরিবারের জন্য খাবার যোগাড় করতে এবং এই অর্থ সে সময় সচল আছে এ রকম ছোটখাট ব্যবসায় লাগাতে সক্ষম হন। ব্র্যাকের শিক্ষা কার্যক্রমেও 'মানবিক মানুষ' হওয়াকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। ব্র্যাক স্কুলে শিশুরা আনন্দের সঙ্গে পড়ালেখা শেখে। সেখানে তারা গান-নাচ-ছবি আঁকার চর্চা করে। ব্র্যাক বোট স্কুল এক চর থেকে আরেক চরে ঘুরে ঘুরে শিক্ষার্থীদের বড় নৌকায় তুলে নেয়। সেই নৌকাতেই তাদের শিক্ষা কার্যক্রম চলে। স্কুল শেষে আবার শিশুদের তাদের নিজ নিজ চরে নামিয়ে দেয়া হয়। দুর্গম ও পিছিয়ে পড়া অঞ্চলের শিশুদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে নেওয়া অসাধারণ এই উদ্যোগ সারা পৃথিবী জুড়ে প্রশংসিত হয়েছে।

উন্নয়ন সেক্টরে আমরা নয়টা-পাঁচটা সময় ধরে ধরাবাঁধা কাজ করি না। দরিদ্র, সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সমস্যা এবং চাহিদা বহুমুখী। প্রতিটি মানুষকে তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী সেবা ও সহায়তা দেওয়া লাগে। এই সেক্টরে কাজ করতে গেলে তাই মানুষের কল্যাণে কাজ করার ইচ্ছে থাকাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষের কাছে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, জীবিকায়নসহ বহুবিধ সেবা ও সহযোগিতা পৌঁছে দিতে আমরা নিজের কাছেই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকি। সেই স্পৃহাকে কর্মীদের মনে আরও পোক্তভাবে প্রোথিত করে দেওয়ার এক আশ্চর্য ক্ষমতা আছে ব্র্যাক নামের এই সংস্থাটির। একটা সত্যি ঘটনা বলে শেষ করি। ব্র্যাকের আল্ট্রা-পুওর গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রাম অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য পরিচালিত একটি জীবিকায়ন কর্মসূচি। এই কর্মসূচির এক মাঠকর্মী আপা তার নারী সদস্যর বাড়িতে গিয়ে দেখলেন সদস্য এবং তার পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ুয়া কন্যা দুজনেরই মন খারাপ। তাদের চোখ ছলছল করছে। তিনি কথা বলে জানতে পারলেন সদস্যের কন্যাটিকে তার বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আজকে পরীক্ষায় অংশ নিতে দেয়নি। কারণ তার স্কুল ড্রেস নেই। এই কথা শোনার পরে ওই মাঠকর্মী আপা সঙ্গে সঙ্গে স্কুলের হেডমাস্টারের সঙ্গে দেখা করলেন। তাকে কথা দিলেন আগামীকাল শিশুটি স্কুল ড্রেস পরে যাবে তাকে যেন পরীক্ষায় বসার সুযোগ দেওয়া হয়। স্যার রাজি হলেন। এরপর ওই আপা গ্রামের কিছু ধনী মানুষকে সঙ্গে নিয়ে টাকা তুলে, দর্জি খুঁজে বের করে সেই রাতেই সদস্যের কন্যার হাতে নতুন স্কুল ড্রেস তুলে দিলেন। ব্র্যাককর্মী এই আপার মূল কাজ হলো সদস্যকে তার জীবিকায়নের সহায়তা করা। সদস্যর সন্তানের জন্য এতটা না করলেও তার চলত। তারপরও তিনি শিশুটি যেন পরীক্ষা দিতে পারে তার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন। একটি দরিদ্র পরিবারের প্রতি এই যে অপরিসীম মায়ার বন্ধন তা ব্র্যাকই তার কর্মীদের শিখিয়েছে।

তাই পরপর পাঁচবার পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বেসরকারি সংস্থা হিসেবে পুরস্কৃত হওয়া নয় বরং একটি মানবিক সংস্থা হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে পারা, মানবিকবোধকে কর্মীদের মধ্যে সঞ্চারিত করতে পারাই ব্র্যাকের সবচেয়ে বড় অর্জন। ব্র্যাক তাই আমাদের শুধু কর্মক্ষেত্র নয়। ব্র্যাক এবং এর রূপকার স্যার ফজলে হাসান আবেদ, আমাদের আবেদ ভাইকে আমরা নিজের মধ্যে ধারণ করি। ৫০ বছর উদযাপনের এই সুন্দর লগ্নে ব্র্যাকের জন্য তাই এক সমুদ্র ভালোবাসা।