ব্র্যাকের সুবর্ণজয়ন্তী ও আবেদ ভাইয়ের একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণের স্মৃতি

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 20 March 2022, 06:34 PM
Updated : 20 March 2022, 06:34 PM

স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম আর ব্র্যাকের জন্ম ও পথচলা একই সূত্রে গাঁথা। বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তীর গর্বিত উদযাপনের পাশাপাশি ২১শে মার্চ ২০২২ ব্র্যাক তার ৫০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করছে। 

বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় সরকারের পাশাপাশি ব্র্যাকও সহায়ক ভূমিকা পালন করে চলেছে। বিগত ৫০ বছরে ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম, ঘরে ঘরে গিয়ে খাবার স্যালাইন বানানোর প্রক্রিয়া শেখানোর মাধ্যমে ডায়রিয়া নিয়ন্ত্রণ, শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার কমানো, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদান এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে দারিদ্র্য দূর করার ক্ষেত্রে ব্র্যাক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে। ব্র্যাক উদ্ভাবিত উন্নয়নের বিভিন্ন উদ্যোগ ও মডেল আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়েছে।

আজকের দিনে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদকে। তার আন্তরিক প্রচেষ্টা ও দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণেই এমন একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। হ্যাঁ, দেশের জন্য, সমাজের মানুষের অগ্রগতির জন্য কাজ অনেকেই করেন, করেছেন। কিন্তু ঠিক সময়ে ঠিক উদ্যোগটি নিয়ে সাফল্যের শীর্ষে কজন পৌঁছাতে পারেন? স্যার ফজলে হাসান আবেদ পেরেছিলেন। সব রকম বাধা-বিপত্তিকে তুচ্ছ করে তিনি এগিয়ে গেছেন নিজের স্বপ্নপূরণের গন্তব্য। সেই স্বপ্নটাও বেশ খাপছাড়া। শক্তিহীনকে শক্তি জোগানো। যাদের দাবি-দাওয়া-কণ্ঠস্বর কারো কাছে পৌঁছয় না, তাদের কণ্ঠকে উচ্চকিত করা। তাদের অর্থনৈতিক উন্নতিতে ভূমিকা রাখা। তিনি এ জন্য প্রচলিত পথে পা বাড়াননি। তিনি জানতেন- চেনা সংগঠন অভ্যস্ত বুলিতে হারিয়ে যায়। তাই তিনি নতুন সংগঠন গড়েছেন। নতুন স্লোগান রচনা করেছেন। ছোট ছোট উদ্যোগ। ছোট ছোট সাফল্য। সেই সাফল্যের পথ ধরে আবারও নতুন উদ্যোগ। এভাবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্যোগ দিয়ে বিরাট এক জাগরণ। তা শুধু দেশের গণ্ডি নয়, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন। কোটি কোটি পিছিয়ে পড়া মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে রেখেছেন অপরিমেয় অবদান। সদা হাসিখুশি শ্যামলা গড়নের এই ছোটখাট মানুষটি তার কীর্তি দিয়ে নিজেকে বিশাল এক মহীরূহে পরিণত করেছেন। নিজেকে নিয়ে গেছেন বিশাল এক উচ্চতায়।

মনে পড়ছে আবেদ ভাইয়ের সাক্ষাৎকার গ্রহণের একটি স্মৃতি।  

আমি আর আমার সহকর্মী রিফাত ইসলাম এশা ব্র্যাকের একটি প্রকাশনার জন্য আবেদ ভাইয়ের একটা সাক্ষাৎকার গ্রহণের জন্য অনেক দিন ধরেই যোগাযোগ করে আসছিলাম। কিন্তু তার সময় পাচ্ছিলাম না।  ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯, সকাল সাড়ে ১১টা। আবেদভাইয়ের সহযোগী র‌্যাচেল আপা জানালেন, আবেদ ভাই সাক্ষাৎকার দেবেন এবং সেটা এখন-ই। আমরা দ্রুত একটি রেকর্ডার জোগাড় করে আবেদ ভাইয়ের রুমে গিয়ে কাচুমাচু হয়ে দাঁড়ালাম। তিনি আমাদের বসতে বললেন। এই বিশাল ব্যক্তিত্বের সামনে গিয়ে আমরা দুজনেই নার্ভাস হয়ে পড়ি। কীভাবে শুরু করব, বুঝতে পারছিলাম না। 

তিনিই অত্যন্ত সহজ ভঙ্গিতে আমাদের সঙ্গে গল্প শুরু করে দিলেন। আমরা ব্র্যাকে কোন বিভাগে কাজ করি, কতদিন ধরে আছি, কোথায় লেখাপড়া করেছি- এসব সাধারণ প্রশ্ন। এরপর যখন বুঝলেন যে আমাদের জড়তা কাটতে শুরু করেছে, তখন তিনিই বললেন, 'বলো, তোমরা আমার কাছে কী জানতে চাও?' 

প্রায় ৪০ মিনিট আমরা তার সঙ্গে কথা বলেছি। নানা বিষয়ে আমরা তার মতামত জানতে চেয়েছি। তিনি ধীরে-সুস্থে খুবই বোধগম্য করে আমাদের সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। 

আমাদের আলোচনার মূল বিষয় ছিল জেন্ডার। আমরা জেন্ডার বিষয়ে আবেদ ভাইয়ের অভিমত জানতে চেয়েছিলাম। 

তিনি ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলেন। বললেন, পরিবারে, সমাজে নারী-পুরুষের মধ্যে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠাই আসলে জেন্ডার সংক্রান্ত আলোচনার মূল কথা। এ জন্য প্রয়োজন নারী-পুরুষের পারস্পরিক শ্রদ্ধা। একে অন্যের প্রতি সহানুভূতি, সমানুভূতি। পরিবারের সবাই যদি একে অন্যকে শ্রদ্ধা করে, একে অন্যের কাজ ও ভূমিকাকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করে, একে অপরকে সাহায্য-সহযোগিতা করে তবে জেন্ডার সমতা অর্জন সম্ভব হবে। 

জেন্ডারের মূল ভিত্তি হচ্ছে, ন্যায় এবং সাম্য। নারী বা পুরুষ হিসেবে কেউ বেশি সুযোগ বা কম সুযোগ পাবে না। সবাই নিজ নিজ সামর্থ্য বিকাশের সুযোগ পাবে। একে অপরের সহযোগী হবে। সংবেদনশীল হবে। কেউ পিছিয়ে থাকবে না। কেউ এগিয়ে যাবে না। সাম্য ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে সবাই মিলে এক সঙ্গে এগিয়ে চলবে। 

জেন্ডারের আলোচনা কেবল ব্র্যাকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়, এটা সব দেশের, সব মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। জেন্ডার সংবেদনশীল না হলে পরিবাারে সুখ-শান্তি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। 

জেন্ডার সাম্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে গোটা বিশ্বই অনেক দূর এগিয়েছে। নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে পৃথিবীর বহু দেশে বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা ও আইন-কানুনের সংস্কার করা হয়েছে। 

আমাদেরও এখন আইনি কাঠামো পরিবর্তনের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। 

জেন্ডার সমতা প্রতিষ্ঠা করতে হলে অনেক ধরনের উদ্যোগ নিতে হবে। আমাদের মনমানসিকতা বদলাতে হবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক আইন, যেমন পারিবারিক আইন, উত্তরাধিকার আইন ইত্যাদির সংস্কার আনতে হবে। এ জন্য সংসদ সদস্যদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতে হবে। তাদের সঙ্গে অ্যাডভোকেসি করে, তাদের দিয়ে সংসদে বিল আনতে হবে। 

তবে আইন প্রণয়নের আগে আইন তৈরির পক্ষে সামাজিক চাহিদা বা জনমত সৃষ্টির কাজটিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 

এসডিজি ৫-এ জেন্ডার সমতার কথা বলা আছে। এসডিজি অর্জন করতে হলে আমাদের নানামুখী উদ্যোগ নিতে হবে। নারীদের কাজের সুযোগ যেমন বাড়াতে হবে, পাশাপাশি নারীর ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করতে হবে। কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মজুরি বৈষম্য দূর না করতে পারলে আমাদের পক্ষে এসডিজি অর্জন কঠিন পড়বে। এ জন্য নারীর দক্ষতা যেমন বাড়াতে হবে, একই সঙ্গে উপযুক্ত কর্মপরিবেশও নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য গার্মেন্টস মালিক-শ্রমিদের নিয়ে আমাদের কাজ করা দরকার। 

বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নে দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের চেয়ে ভালো অবস্থানে আছে। এই অবস্থাকে আরও উন্নত করতে হবে। এক্ষেত্রে আমাদের জন্য প্রধান বাধা হচ্ছে নারীর প্রতি সহিংসতা। সংহিংসতার বিরুদ্ধে আমাদের আরও ব্যাপক উদ্যোগ নিতে হবে। 

আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রকে বাধ্য করা দরকার। যারা নারী নির্যাতন করে তারা অপরাধী। তাদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি কার্যকর করতে হবে। অপরাধীরা যেন কোনোভাবেই দায়মুক্তি না পায়-তা নিশ্চিত করতে হবে। 

গণপরিবহনে নারীদের হয়রানির ঘটনা রুখতে হবে। এ জন্য ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে। কোন ধরনের আচরণগুলো নারী নির্যাতন, তা সবাইকে বোঝাতে হবে। নারী নির্যাতন যে অত্যন্ত খারাপ, এটা একটা অপরাধ-এই প্রচারণাটা ব্যাপকভাবে চালাতে হবে। 

যৌন হয়রানির কারণে অনেক মেয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে। এটা খুবই দুঃখজনক। এ ব্যাপারে আমাদের কাজ করতে হবে। ঘরে ঘরে গিয়ে মেয়েদের কাউন্সেলিং বা বোঝাতে হবে। তাদের সাহস যোগাতে হবে। আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হবে। আগামী দিনে ব্র্যাক মেয়েদের মানসিক স্বাস্থ্য বিকাশের জন্য কাউন্সেলিং কর্মসূচিকে গুরুত্ব দিচ্ছে। 

প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে কীভাবে নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলোর প্রতিকার করা যায়, সেটাও বিবেচনা করে দেখতে হবে। ৯৯৯-এর মতো হটলাইন কার্যকর করতে হবে। যৌন হয়রানি বা নারী নির্যাতনের ঘটনা প্রতিকারে একটা ভ্রাম্যমান টিম গঠন করা যায় কিনা সেটাও ভেবে দেখা যেতে পারে। কোনো ফোন নম্বর বা মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে নারী নির্যাতনের ঘটনা জানালে সেই ভ্রাম্যমাণ টিম সরাসরি ঘটনাস্থলে গিয়ে অপরাধীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। 

মেয়েদের দক্ষতা বাড়িয়ে বৈদেশিক শ্রমবাজারে পাঠানোর ব্যাপারে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। তবে মধ্যপ্রাচ্যে নারীকর্মীদের পাঠানোর ব্যাপারে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। প্রয়োজন হলে মধ্যপ্রাচ্যে নারীকর্মী পাঠানো বন্ধ করতে হবে। এখানকার ব্যাপারে আমাদের অভিজ্ঞতা মোটেও ভালো নয়। ব্র্যাক আগামী দিনে নারীদের নার্সের প্রশিক্ষণ দিয়ে জাপানে পাঠানোর উদ্যোগ গ্রহণ করবে। জাপানে নার্সের চাহিদা রয়েছে। 

জেন্ডার সমতা অর্জনের জন্য ব্যাপক জনমত গঠন করা দরকার। সরকারকে এ ব্যাপারে প্রাতিষ্ঠানিক ব্য উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সরকারের সঙ্গে এ নিয়ে আলাপআলোচনা করতে হবে। 

বর্তমান সরকার মৌলবাদের বিরুদ্ধে বেশ সোচ্চার। এটা খুবই ইতিবাচক একটি দিক। যেকোনো ধরনের মৌলবাদ ও গোঁড়ামির বিরুদ্ধে আমাদের সতর্ক ও সচেতন হতে হবে। এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। নারীর এগিয়ে চলার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়-এমন সব কিছু আমাদের ভেঙ্গে ফেলতে হবে। 

জেন্ডার সমতা অর্জন দেখে যাওয়া আমার জীবনের একটি প্রধান স্বপ্ন। হয়তো আমার জীবদ্দশায় তা দেখা হবে না। তবে আমি আশাবাদী, মানুষ নিজের প্রয়োজনেই জেন্ডার সমতা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেবে। ইতিমধ্যে এ ব্যাপারে পৃথিবীর অনেক দেশে অনেক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। আমাদের দেশেও অনেক ইতিবাচক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। তবে আমাদের আরও বহুদূর যেতে হবে। জেন্ডার সমতা ছাড়া যেহেতেু সুখী সমাজ গঠন করা সম্ভব নয়, কাজেই মানুষ নিজের প্রয়োজনেই একদিন সমতার সমাজ গড়ে তুলবে। 

আমরা যদি একে অপরের প্রতি সমব্যথী হই, মানবিক হই, কোনো ধরনের বৈষম্য না করি, সংবেদনশীল হই, আমাদের মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গি বদলাই- তাহলেই আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত সমাজ নির্মাণ করতে পারব। 

আমরা যখন আবেদভাইয়ের আমাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম, তখন ছিলেন পুরোপুরি অসুস্থ। কিন্তু তিনি আমাদের তা বুঝতে দেননি। আমরাও বুঝতে পারিনি। তবে তাকে সেদিন কিছুটা ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। 

সাক্ষাৎকার-পর্ব শেষে আমরা তার সঙ্গে একটি ছবি তুলতে চাই। তিনি হেসে বলেন, "ঠিক আছে, তাহলে সেল্ফি তোল।" এরপর আমরা আবেদভাইয়ের সঙ্গে সেল্ফি তুলে তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বের হয়ে আসি।

সেই সাক্ষাৎকার এবং সেল্ফি-ই যে এই মহীরূহের সঙ্গে আমাদের 'শেষ স্মৃতি'তে পরিণত হবে তা কখনও ভাবিনি!

তার প্রতি জানাই শ্রদ্ধা।