অনৈতিহাসিক: চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় শত শত কোটি টাকার বাণিজ্য

মুহাম্মদ শফিকুর রহমান
Published : 25 Jan 2022, 01:49 PM
Updated : 25 Jan 2022, 01:49 PM

অনেকদিন থেকেই প্রস্তাবিত চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চাবিপ্রবি) প্রতিষ্ঠা নিয়ে নানান গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যে ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে পাঁচ-ছয় শ কোটি টাকার বাণিজ্য হচ্ছিল অবাধে। এর পেছনে যেহেতু খোদ শিক্ষামন্ত্রীর ক্ষমতা ও তার ভাই-বেরাদর জড়িত তাই কেউ মুখ খুলছিল না। চাঁদপুরের সচেতন নাগরিকরা অতি সঙ্গোপনে গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে সরকারের দৃষ্টিতে বিষয়টি আনলে একটি জরিপ করা হয়। জরিপে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসতে শুরু করে। দেখা যায় অধিগ্রহণের জন্যে চিহ্নিত জমির দাম স্থানীয়ভাবে প্রতি শতাংশ এর মূল্য ১৪ থেকে ১৫ হাজার টাকা, ভিটি বাড়ি হলে শতাংশ ৩২ থেকে ৩৩ হাজার টাকা। প্রভাবশালী মহল এই জমি প্রকার ভেদে ২,৫০০০০ (দুই লাখ পঞ্চাশ হাজার) থেকে ৩,০০০০০ (তিন লাখ) টাকা দলিলে লিখিয়ে কিনে নেয়। লক্ষ্য হলো মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ইতিহাসের বীরকন্যা শেখ হাসিনার একটি ঘোষণা- "ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে বাজার মূল্যের তিনগুণ দাম মূল মালিককে দিতে হবে ক্ষতিপূরণ হিসেবে"। তারই অন্যায় সুযোগ নিয়ে ১৪/১৫ হাজার টাকা শতাংশ জমি আড়াই থেকে তিন লাখ টাকার দলিল করে সরকারের কাছ থেকে ২০ গুণ বেশি দাম পকেটস্থ করার ফন্দি আটা হয়েছিল।

দ্বিতীয়ত, সাইট সিলেকশনই আত্নঘাতী। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে খরস্রোতা মেঘনা পাড়ে। ভাঙন প্রবণ মেঘনা পাড় থেকে ৫০০-৬০০ মিটার ভেতরে চাঁদপুর থানার লক্ষীপুর ইউনিয়ন পরিষদ এলাকায়। এটিকে আবার নাম দেওয়া হয়েছে 'মডেল ইউনিয়ন পরিষদ'। এই ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. সেলিম খান। তিনি শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি এবং তার ভাই ডা. টিপুর অত্যন্ত কাছের লোক এবং তাদের ছত্রছায়ায় মেঘনায় শতশত ড্রেজার দিয়ে বালি তুলে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে, এখনও চলছে বালি বাণিজ্য, এতে করে তাদের শতশত কোটি টাকার বাণিজ্যের ছোবলে মেঘনার তলদেশের ভাঙন চাঁদপুর শহরকেও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। চাঁদপুরবাসীর ধারণা ওখানে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হলে মেঘনা গর্ভে বিলীন হতে বেশি সময় লাগবে না।

এরই প্রেক্ষিতে চাঁদপুর জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে জরিপের ব্যবস্থা করা হয়। জরিপকারীদের মধ্যে রয়েছেন- চাঁদপুর সদর, কচুয়া, মতলব দক্ষিন, ফরিদগঞ্জ, হাজীগঞ্জ প্রভৃতি উপজেলা ভূমি অফিসের সার্ভেয়ার এবং চাঁদপুর, হাজিগঞ্জ, কচুয়া ও ফরিদগঞ্জের ভূমি অফিসের কানুঙ্গোদের সমন্বয়ে ১৩ সদস্যের জরিপ কমিটি। এই কমিটির জরিপে যে বিষয়টি সামনে চলে আসে তা হলো রেজিস্ট্রি অফিস থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী- কতিপয় ব্যক্তি ১৮/৫/২০২০ ইং তারিখ থেকে ১৭/৫/২০২১ তারিখের মধ্যে মাত্র এক বছরে মূল মালিক থেকে নামে বেনামে জমি রেজিস্ট্রি করে নিয়েছে। প্রচলিত বাজার মূল্যের ২০ গুণ বেশি টাকা দলিলে লেখায়। ক্রেতাদের একটি নামের তালিকাও কমিটি তৈরি করে। যেমন কয়েকটি উল্লেখযোগ্য নামের মধ্যে সর্বোচ্চ ক্রয়কারী ব্যক্তি হলেন ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. সেলিম খান। তিনি নিজের নামে ও বেনামে অনেক জমি কিনেছেন। উদাহরণ দিচ্ছি-

১. পিংকি আক্তার, পিতা মো. সেলিম খান

   সাং লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর সদর।

২. মো. সেলিম খান পিতা মৃত মো. আব্দুল হাই খান

   সাং লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর সদর।

৩. শাহিন খান পিতা মো. সেলিম খান

   সাং লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর সদর।

৪. জাওয়াদুর রহিম ওয়াদুদ পিতা-মৃত ওয়াদুদ

   সাং উত্তর ধানমন্ডি

৫. মো. জাহিদুল ইসলাম পিতা মৃত সিরাজুল ইসলাম

   সাং আদালত পাড়া, চাঁদপুর সদর।

অর্থাৎ প্রমুখ ব্যক্তিবর্গের নামে ১৩৬টি দলিল হয়। এবং আগেই বলেছি তা সম্পাদন হয় মাত্র এক বছরের ১৮/৫/২০২০ থেকে ১৭/৫/২০২১ তারিখের মধ্যে। এবং উল্লেখিত ব্যক্তিরা শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির ঘনিষ্ঠ আত্মীয় অথবা ঘনিষ্ঠজন।

চাঁদপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ শাখা এর বিস্তারিত প্রতিবেদন নির্মাণ করে ভূমি মন্ত্রণালয় বরাবর পাঠিয়ে দেয়। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় প্রস্তাবিত অধিগ্রহণ ভূমির মূল্য:

ক. অবকাঠামো ও বালির মূল্য মোট ১১,৬৪,৪৫,৩৭৪ (এগার কোটি চৌষট্রি লাখ পয়তাল্লিশ হাজার তিনশ চুয়াত্তর) টাকা।

খ. গাছপালার মূল্য ২,৭৬,১০০ (দুই লাখ ছিয়াত্তর হাজার একশ) টাকা।

গ. নাল শ্রেণি শতাংশ প্রতি মূল্য ২,৮১,৭১৭.৮৪ (দুই লাখ একাশি হাজার সাতশ সতের টাকা চুরাশি পয়সা) টাকা।

ঘ. বাড়ি বাগান শতাংশ প্রতি মূল্য ১,৮৬,৫৮১.০৫ (এক লাখ ছিয়াশি হাজার পাঁচশ একাশি টাকা পাঁচ পয়সা) টাকা।

ঙ. ভিটি ভূমি শতাংশ প্রতি মূল্য ২,৩৯,৬৯৫.৩৬ (দুই লাখ উনচল্লিশ হাজার ছয়শ পঁচানব্বই টাকা ছত্রিশ পয়সা) টাকা।

কিন্তু প্রতিবেদনের ফাইন্ডিং থেকে দেখা যায় ১১৫ নং লক্ষীপুর মৌজার সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের ভূমির নির্ধারিত বাজার মূল্য:

ক. নাল ভূমি শতাংশ প্রতি ১৩,৮০২ (তেরো হাজার আটশ দুই) টাকা।

খ. বাড়ি বাগান শতাংশ প্রতি ২৩,৯৬৬ (তেইশ হাজার নয়শ ছেষট্টি) টাকা।

অর্থাৎ প্রতিবেদনে প্রাপ্ত তথ্যাদি থেকে দেখা যায় নাল শ্রেণির ভূমির হস্তান্তরের গড় মূল্য ১৮/৫/২০২০ থেকে ১৭/৫/২০২১ এই এক বছরে ২০ পয়েন্ট ৪ (বিশ পয়েন্ট চার) গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যান্য শ্রেণি ডোবা, বাগান, ভিটি বাড়ির ক্ষেত্রেও চরম অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

প্রতিবেদনে দেখা যায় বিগত ১৫/৯/২০২০ তারিখে চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় বিল সংসদে পাস হবার এবং গেজেট প্রকাশিত হবার এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হবার পর থেকে ১১৫ নং লক্ষ্মীপুর মৌজার ভূমি হস্তান্তর মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বাড়ানো হয় যা উদ্দেশ্য প্রণোদিত বলে পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয়। অর্থাৎ গোটা বিষয়টাই চরম দুর্নীতির কর্মকাণ্ড।

চাঁদপুর জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অধিগ্রহণকৃত ২০ গুণ দাম দিয়ে যেসব দলিল করা হয়েছে তা বিবেচনায় নিলে সরকারের ৩৫৯,১৬,৪১,৭৮২.৯৮ (তিনশ উনষাট কোটি ষোল লাখ একচল্লিশ হাজার সাতশ বিরাশি টাকা আটানব্বই পয়সা) টাকা লোকসান হবে। সাধারণ জনগণও ভূমি হস্তান্তরের (ক্রয়-বিক্রয়) ক্ষেত্রে নানাবিধ অসুবিধার সম্মুখীন হবেন।

প্রতিবেদনে এও দেখানো হয়েছে উল্লেখিত পরিমাণ অর্থাৎ ৬২.৫৪৯০ (বাষট্টি দশমিক পাঁচ হাজার চারশ নব্বই) একর ভূমির মোট মূল্য হতে পারে ১৯৩,৯০,৬৫,৫০৭.১৭ (একশ তিরান্নব্বই কোটি নব্বই লাখ পয়ষট্রি হাজার পাঁচশ সাত টাকা সতের পয়সা) টাকা। অথচ আলোচিত দলিলের মূল্য যোগ করলে দাঁড়ায় প্রায় ৬০০ কোটি টাকা।

জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ প্রতিবেদনটি ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব মহোদয়ের বরাবরে পেশ করেছেন। অনুলিপি দিয়েছেন-

১. মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে

২. প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবকে

৩. শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা সচিবকে

৪. বিভাগীয় কমিশনার চট্টগ্রামকে

দ্বিতীয়ত, আরও যে বিষয়টি চাঁদপুরের সচেতন নাগরিকদের মধ্যে বিশেষভাবে আলোচিত হচ্ছে চাবিপ্রবি সাইড নিয়ে। অর্থাৎ চাঁদপুর একটি নদী ভাঙন প্রবণ এলাকা। মেঘনার ভাঙনে প্রতিবছর শত শত মানুষ গৃহহীন, সম্পদহীন, জমিহীন ও নিঃস্ব হচ্ছেন। ভাঙন প্রবণ মেঘনা পাড় থেকে মাত্র ৫/৬ শ মিটার ভিতরে প্রস্তাবিত চাবিপ্রবির স্থাপনের স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। এখানে স্থাপিত হলে খুব বেশি সময় নেবে না একদিন মেঘনা গর্ভে বিলীন হবে। চাবিপ্রবি ইতিহাস হয়ে যাবে।

এ ব্যাপারে চাবিপ্রবির উপাচার্য প্রফেসর ড. নাসিম আখতারের সাথে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোন মন্তব্য না করলেও সন্তুষ্ট যে নন তা বোঝা গেছে।

 ঢাকা, ২৫.০১.২০২২