চীন আর নেই সে চীন

চিন্ময় মুৎসুদ্দী
Published : 22 Nov 2012, 03:57 PM
Updated : 22 Nov 2012, 03:57 PM

শচীনদেব বর্মণ'র গাওয়া একটি গানের প্রথম লাইন 'তুমি আর নেই সে তুমি' অনুসরণ করেই বললাম চীন আর নেই সে চীন। সে চিন অর্থাৎ মাও জে দং'র চীন। ১৯৪৯ সালের বিপ্লবের পর থেকে ১৯৭৬ পর্যন্ত ছিল লাল চীন'র যুগ। ঐ বছর বিতাড়িত নেতা দেং আবার ফিরে আসেন 'অনেকটা সামরিক অভূত্থানের' মাধ্যমে। মাও জে দং'র স্ত্রীসহ চার নেতাকে গ্রেফতার করে বলা হয় 'চার কুচক্রী' চীন'র সর্বনাশ করার ষড়যন্ত্র করছে। কয়েক বছরের বিচারের পর তাদের নানান মেয়াদে সাজা দেয়া হয়। চার জনেরই মৃত্যু হয়েছে।

এ সপ্তাহে শেষ হওয়া চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নতুন নির্বাচনে দেখা গেল রক্ষণশীলের আবরণে পুঁজিবাদিরাই সামনে রয়েছেন। গোপন ব্যালটে কেন্দ্রীয় কমিটি নির্বাচন করেছেন ২৩ হাজার দলীয় প্রতিনিধি। 'লাল' ভাবধারার উঠতি জনপ্রিয় নেতা পলিটব্যুরোর সংস্কারবাদি সদস্য বো জিলাই'কে দুর্নীতি আর খুন জখমের মামলায় জড়িয়ে আগেই ট্র্যাশ বক্স-এ ফেলে দিয়েছে পার্টি ও সরকার। অর্থাৎ দেং'র পুঁজিবাদি শিষ্যরা পার্টির মধ্যে এখনও শক্তিশালী এবং কোনোমতেই তারা 'লাল জামানা'র ছায়া খুঁজে পাওয়া যায় এমন কাউকে কোনো ছাড় দেবে না।

চীন'র শাসক দল এখনও কমিউনিস্ট পার্টি হলেও ক্রমশ তারা কমিউনিজম থেকে দূরে সরে এসেছে। কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার প্রথম শর্ত সমাজতন্ত্র বস্তুত বিদায় নিয়েছে বহু আগে। ব্যক্তিগত ধনসম্পদ গড়ার তীব্র প্রতিযোগিতা চলছে গত শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে। এর ফলে বেড়েছে দুর্নীতি, খুন,জখম, রাহাজানি। বিপ্লবের পর মানুষের মধ্যে কল্যাণবোধ জাগ্রত করার প্রচেষ্টা অনেকদূর সফল হয়েছিল। চুরি-ডাকাতি প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। ঘর বাড়িতে তালা লাগানোর প্রয়োজনই পড়ত না।

১৯৫০-১৯৬০ দশকে চীন ভ্রমণকারীদের অনেক রচনাতেই সেই চিত্র পাওয়া যায়। মওলানা ভাসানী'র লেখা মাও সে তুঙ'র দেশে গ্রন্থে চীনের সাধারণ মানুষের সততার অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। পশ্চিমা বিশ্বের অসহযোগিতা ও নানাধরনের ষড়যন্ত্রের কারণে বিপ্লবোত্তর চীন অবশ্য অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে পিছিয়ে পড়ে। তবে তারা তাদের মৌলিক অবস্থান ঠিক রেখে ধীর লয়ে এগোচ্ছিল। সংকটটা শুরু হয় ১৯৬৬ সালে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের বাড়াবাড়ির কারণে। রাজনৈতিক বিপ্লবের পূর্ণ সাফল্যের জন্য সাংস্কৃতিক বিপ্লব অপরিহার্য। কিন্তু লুকিয়ে থাকা প্রতিপক্ষ আর নব্য উগ্রবাদিদের কারণে এই পথটি পার হওয়া খুবই কঠিন। মাও'র চীনও শেষ পর্যন্ত এই ধারার কাছে হার মানে। মাও, চৌ এন লাই এবং মার্শাল চুতে প্রমুখের মৃত্যুর পর পতিত নেতা দেং আবার ক্ষমতা ফিরে পেলে চীন নব উদ্যমে ধনবাদি অর্থনীতির সূত্রপাত করে। তবে সোভিয়েত ইউনিয়ন'র পতনের অভিজ্ঞতার প্রেক্ষাপটে চীনা নেতারা দড়িটা ছেড়েছেন আস্তে আস্তে। প্রথম দিকে সাধারণ মানুষ বুঝতে পারেননি আসলে নতুন পার্টি চেয়ারম্যান দেং জিয়াও পিং কী করছেন। তিনি সজীব হাওয়া প্রবেশের জন্য জানালা খুলে দেয়ার কথা বলেছিলেন। তার মতে খোলা জানালা দিয়ে হয়ত কয়েকটা মাছি ঢুকে পড়তে পারে। তবে এখন বুঝা যাচ্ছে মাছির সঙ্গে মৌমাছিও ঢুকে পড়েছিল এবং সেগুলো হুল ফোটাতে শুরু করেছে। আর দেং'র ভাবশিষ্যরাতো দরোজাই খুলে দিয়েছেন। বেইজিং আর নিউইয়র্কের মধ্যে এখন তেমন পার্থক্য নেই। উভয় নগরীর মানুষই একজন আর একজনকে ঠেলে উপরের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করছেন এবং সদা আতঙ্কের মধ্যে বসবাস করছেন। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায় নিউইয়র্ক কমিউনিস্ট না বেইজিং ক্যাপিটালিস্ট? নিউইয়র্ক দুইশত বছর ধরে আছে একই ধারায়। পরিবর্তন হয়েছে বেইজিং'র। উত্তরটা তাই সহজ, নিউইয়র্ক ও বেইজিং উভয়েই ক্যাপিট্যালিস্ট!

১৯৯৩ সালে আমার প্রথম চীন সফরের সময় এক তরুণ চাকরিজীবি ও এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী চীন'র সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন একই কথা,"আগে আমরা সবাই সবার কথা ভাবতাম, এখন ভাবি শুধু নিজের কথা"। তখনই হোটেল কক্ষে মূল্যবান জিনিষপত্র ম্যানেজারের কাছে জমা রাখার নোটিশটিও বলে দেয় চীন-এ অবক্ষয়ের পালা শুরু হয়েছে। মাঝখানে আরো একবার চীন গিয়ে বুঝেছি তারা যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে একসময় যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল সেই সাম্রাজ্যবাদীদের অনুসৃত 'উন্নয়ন কর্মসূচি' গ্রহণে তৎপর। এই পরিবর্তন এখন পাকাপোক্ত হয়েছে।

চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সাম্প্রতিক নেতা নির্বাচনে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আরো সংস্কার আনার পথের অনুসারিদের জয় হবে এটা প্রায় নিশ্চিত ছিল। তবে একটা অন্তর্দ্বন্দ রয়েছে পার্টিতে। এই বিরোধ মৌলিক নয়, স্বার্থের প্রশ্নে। দায়িত্ব পালনের চাইতে ক্ষমতা ভোগ করার দ্বন্দই প্রধান।

নতুন নেতাদের সম্পর্কে আনুষ্ঠানিকভাবে বেশি কিছু জানা যায় না। জি'র গ্রামীণ অভিজ্ঞতা রয়েছে। নতুন নেতা জি জিনপিং বিপ্লব পরবর্তি জেনারেশন, তবে তারুণ্য আর বাল্যকাল কেটেছে বিপ্লবী কর্মকান্ড দেখে। বাবা কমিউনিস্ট থাকলেও তিনি মুক্ত অর্থনীতির প্রবক্তা। নেতা নির্বাচিত হওয়ার পর কমিউনিস্টদের মতো দৃঢ়তার বদলে পশ্চিমা বুর্জোয়া নেতাদের মতো দায়িত্ব এড়ানোর ভঙ্গীতে বলেছেন," আমরা অবশ্যই প্রতিটি সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেব। পুরো দলকে এ ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে।" আগের দুই প্রেসিডেন্ট জিয়াং জেমিন ও বর্তমানে বিদায়ী প্রেসিডেন্ট হু জিনতাও'র মধ্যে রয়েছে সুক্ষ্ম বিরোধ। এই দুজনের অনুসারিরাই এসেছেন পলিটব্যুরোতে। এরা আরো সংস্কারের পক্ষে।

চীন'র মানুষ এখন হতাশ খাদ্যঘাটতি, ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য, অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা, পরিবেশ বিপর্যয় আর শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তার অভাব ইত্যাদি কারণে। পার্টি সম্মেলনের সংস্কার প্রস্তাবে বিজ্ঞানের সঙ্গে মার্ক্সবাদ-লেলিনবাদ, মাও জেদং'র আদর্শ এবং দেং শিয়াও পিং'র তত্বের সংমিশ্রণের কথা বলা হয়েছে। সমাজতন্ত্রের পথ পরিহার করে ১৯৮০ দশকের শুরুতে যে ভোগবাদি অর্থনৈতিক ধারা চালু করা হয় তাতে প্রত্যাশিত ফল লাভ করেনি জনগণ। দিন দিন তাদের জীবন যাপন কঠিন থেকে কঠিনতর হয়েছে। রাষ্ট্রের সম্পদে সাধারণ মানুষের অধিকার প্রায় শূণ্যের কোঠায় নেমে গেছে। কেবল এক শ্রেণীর মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়েছে, যাদের ব্যক্তিগত ধন সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে। চীনা বিপ্লবের মূল উদ্দেশ্যই ছিল ধনী দরিদ্রের বৈষম্য কমিয়ে একটি শ্রেণীহীন সমাজব্যবস্থা কায়েম করা। চীন'র নতুন নেতারা সেই লক্ষে কোনো পদক্ষেপ নেবেন বলে চীন বিশেষজ্ঞরাও আশা করেন না। তারা ভোগবাদি অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই চালু রাখবেন। দুর্নীতিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে মূলত জনগনের দৃষ্টি অন্যত্র ফিরিয়ে প্রত্যাশা জাগানোর জন্য।

চীন এক অদ্ভুত শাসন ব্যবস্থা চালু রেখেছে, একদিকে ভোগবাদি অর্থনৈতিক জীবনধারা অন্যদিকে কেন্দ্রিয় কমিটি গঠন প্রক্রিয়ায় গোপন ব্যালটে মাত্র ২৩ হাজার পার্টি প্রতিনিধির অংশগ্রহণ। আর মূল নেতা নির্বাচন করেন কেন্দ্রিয় কমিটির ৩৭০ জন সদস্য। প্রলেতারিয়েত কেন্দ্রীকতা আর গণতান্ত্রিক অর্থনীতি; এই পরস্পরবিরোধী শাসন ব্যবস্থা চীনকে পৃথিবীর অনন্যসাধারণ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করবে না সাধারণ রাষ্ট্র হিসেবেই ইতিহাসে স্থান নির্ধারণ করবে তা বুঝার জন্য আরো দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হবে।

চিন্ময় মুৎসুদ্দী: লেখক, সাংবাদিক।