সবার উপরে তিনি

আনিসুর রহমান
Published : 10 Jan 2022, 08:00 AM
Updated : 10 Jan 2022, 08:00 AM

গল্পের মতো করে বলি। সময়টা ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাস। আন্তর্জাতিক ইতিহাসে বিরল ঘটনাগুলোর একটি। মাত্র দিন কয়েক আগেও যিনি ছিলেন কারাবন্দি, ছিলেন জীবন ও মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে- তাকেই মুক্তি দিয়ে বিশেষ বিমানে পাঠিয়ে দেওয়া হলো এশিয়ার একটি দেশ থেকে বিলেতে। সেখানে তিনি পেলেন রাজকীয় রাষ্ট্রাচার আর রাষ্ট্রনায়কের সম্মান। বিলেতে একদিন অতিবাহিত করে সে দেশের রয়াল এয়ারফোর্সের একটি বিমানে করে পৌঁছালেন অন্য একটি দেশে, সেই দেশে তিনি পেলেন বিরল এক সম্মান, অভূতপূর্ব এক অভ্যর্থনা।

তিনি উপনিবেশ উত্তর আন্তর্জাতিক ইতিহাসের 'সুপারম্যান' আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশটি হচ্ছে ভারতবর্ষ। এতক্ষণে আমার গল্পের কিনারা আপনাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে বোধ করি।  তারপরেও খোলাসা করে বলি, পাকিস্তান থেকে ছাড়া পেয়ে বঙ্গবন্ধু বিলেত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি দিল্লিতে পৌঁছান। ওই দিন ভারতবর্ষের রাজধানীতে তাকে  একজন রাষ্ট্রনায়ক এবং একটি নবজন্ম লাভ করা রাষ্ট্রের স্থপতির প্রাপ্য যে সম্মান তার চেয়ে বরং বেশি উষ্ণ সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল।

বঙ্গবন্ধু সংবর্ধনার জবাবে ভারত, সে দেশের সরকার, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, ভারতীয় সৈন্যবাহিনী আর ভারতবর্ষের জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। একই সঙ্গে নবগঠিত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আসন্ন রূপরেখার একটা স্পষ্ট ধারণা দিয়েছিলেন। তিনি যেভাবে বলেছিলেন, "আমি বিশ্বাস করি সেক্যুলারিজমে, আমি বিশ্বাস করি গণতন্ত্রে, আমি বিশ্বাস করি সোশ্যালিজমে। … আমাকে প্রশ্ন করা হয়, শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আপনার আদর্শে এত মিল কেন? আমি বলি, এটা আদর্শের মিল, এটা নীতির মিল, এটা মনুষ্যত্বের মিল, এটা বিশ্বশান্তির মিল। …"

নতুন দেশ পুনর্গঠনে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই কথার প্রতিফলন তিনি রেখেছেন। এখানে বাকশাল (বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ) কর্মসূচির প্রসঙ্গ এসে যায়।  এই কর্মসূচি নিয়ে এত বেশি অপপ্রচার হয়েছে, এ প্রসঙ্গে কথা বলতে আওয়ামী লীগ ঘরানার লোকজনের মধ্যেও একধরনের কাচুমাচু ভাব খেয়াল করা যায়।  বাকশাল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক পণ্ডিতি মহলে উল্লেখ করার মতো কোনও তাৎপর্যপূর্ণ গবেষণা এ পর্যন্ত হয়েছে কি? আমার জানা নাই।

বাকশাল কর্মসূচির ওপর ভর করে বঙ্গবন্ধু আদতে ইউরোপের পুঁজিবাদী আর সমাজবাদী ব্যবস্থার সমন্বয়ে গড়ে ওঠা কল্যাণরাষ্ট্রের ধারণার বিপরীতে নিজস্ব নতুন এক আদর্শ ব্যবস্থার প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন। এই ব্যবস্থা ওই সময়ের জন্যে এক যুগান্তকারী উদ্যোগ ছিল।  বাকশালের  বিপক্ষে যারা কথা বলেন, তাদের কাছে এর চেয়ে উত্তম বিকল্প কোনও ব্যবস্থার দৃষ্টান্ত কী?  তাদের বিকল্প তো আমরা দেখেছি ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সামরিক শাসনের যাতাকল।

অথচ এই বাকশাল ধরেই বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের ওপর 'কালি লেপন' করার চেষ্টা করেন কেউ কেউ।  তাদের চেষ্টা সফল না হলেও এখন পর্যন্ত থেমে নেই। তাদের অনেকে ছদ্মবেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি বলে নিজেদের পোশাকি চেহারা ধারণ করে প্রশাসনযন্ত্র, ব্যবসা ও রাজনীতির নানা ক্ষেত্রে অযাচিত ফায়দা বাগিয়ে নিয়ে চলেছেন।

সময়ের বিবর্তনে ইতিহাস দূরবর্তী সময়ে পুরাণের মতো মনে হয়।  ইতিহাসের নিরিখে এমন কিছু বিরল মানুষের দেখা পাওয়া যায়, যাদের জীবন, কর্ম আর ঘটনা পৌরাণিক সত্যকেও হার মানায়। আমাদের জাতিরাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু ছিলেন এরকম একজন বিরল মানুষ।  এ  প্রসঙ্গে আধুনিক বাঙালি দার্শনিক ও লেখক আহমদ ছফাকে উদ্ধৃত করতে চাই। তিনি তার 'শেখ মুজিব: ইতিহাসের নিরিখে' শীর্ষক প্রবন্ধে বঙ্গবন্ধুকে এভাবে মূল্যায়ন করেছেন: 

একজন বড় মানুষের মূল্যায়ন একদিন, এক বছর বা একযুগে করা অনেক সময় অসম্ভব। মৃত্যুর অনেকদিন পর্যন্ত ইতিহাসে তাঁদের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা সমালোচনা চলতে থাকে।

আহমদ ছফা এই প্রবন্ধ লিখেছিলেন ১৯৯০ সালের অগাস্টের দিকে।  তখনও সামরিক জামানার অবসান হয়নি। তিনি তার প্রখর দূরদৃষ্টি দিয়ে দেখতে পেরেছিলেন আর তা তার লেখায় উল্লেখ করে গেছেন। তিন দশক পরে এসে আমরা হিসেবে মিলিয়ে নিচ্ছি।  উদযাপন করছি বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ আর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। 

এখন আমাদের আরও অনেক হিসেবে মিলিয়ে নেওয়ার কথা। তার আগে বঙ্গবন্ধুর জীবন নিয়ে কিছু কথা বলে নিতে চাই। তিনি জন্মেছিলেন গ্রামের এক উদার অগ্রসর মুসলিম পরিবারে। গ্রামের প্রেক্ষাপটে পরিবারটি স্বচ্ছল একথা বলা যায়, ছিল বংশগৌরব। বঙ্গবন্ধুর শৈশব-কৈশোর কেটেছে অন্যসব সাধারণ স্বচ্ছল-অস্বচ্ছল ছেলেদের সঙ্গে সুখে-দুঃখে। অন্যের দুঃখে হয়েছেন সমব্যথী, উদ্যোগী হয়েছেন অন্যের সংকট ও অনটন ঘোচাতে। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে এরকম গল্পগুলো এখন অনেকটাই আমাদের জানা।

আমার যখন শৈশব এবং বড়  হয়ে ওঠার কাল বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে অনেক কিছুই আমাদের জানার মধ্যে ছিল না, নাগালের মধ্যেও ছিল না ছফার মতো  প্রাজ্ঞ বুদ্ধিজীবীর লেখাজোকা।

গ্রামের পাঠ চুকিয়ে ১৯৮০-এর দশকের শেষের দিকে টাঙ্গাইলের মধুপুর থানা সদরে অবস্থিত শহীদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হই। ফরহাদ হোসেন পলাশ নামে আমার এক সহপাঠী ছিল। পলাশের বাবা আমির  হোসেন ছিলেন বঙ্গবন্ধুর সময়ের তুখোড় তরুণ সৎ আওয়ামী লীগ নেতা। চারদিকে রাজনীতির পচনশীলতার মধ্যেও দায়বদ্ধ একজন নীতিবান রাজনৈতিক নেতার ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন।

পলাশের বাবা সম্পর্কে ইতিবাচক গল্পগুলোর একটি ছিল, মধুপুরের নরকোনা গ্রামে অবস্থিত তার বাড়ির কিছুটা দূরেই টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ সড়ক। বঙ্গবন্ধু এই সড়ক দিয়ে যাবার সময় পলাশদের বাড়িতে যেতেন। এই সত্য জানার পর আমার শৈশবে যতবার পলাশদের বাড়ির সামনের ওই রাস্তা দিয়ে গিয়েছি, ততবার থমকে দাঁড়িয়ে বাড়িটির দিকে তাকিয়ে থেকেছি। ভেবেছি বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে আজ নিশ্চয়ই এই বাড়িতে আসতেন। আর কল্পনা করার চেষ্টা করতাম তিনি এই বাড়ির ভেতরে কীভাবে হেঁটে যেতেন, কোথায় বসতেন, কার সঙ্গে কী কথাবার্তা বলতেন, কী খাবার-দাবার খেতেন…। শৈশবের কল্পনা যেমনটা হয় আরকি!

এখন ভাবি বাংলাদেশের এমন কোনও আনাচেকানাচে কী আছে যেখানে পলাশদের বাড়ির মতো বাড়ি নাই আর বঙ্গবন্ধুর পদচারণা পড়ে নাই? তিনি টুঙ্গিপাড়া থেকে গোপালগঞ্জ, গোপালগঞ্জ থেকে কলকাতা, কলকাতা থেকে গোপালগঞ্জ, গোপালগঞ্জ থেকে ঢাকা, ঢাকা থেকে সারাদেশের হাটে, মাঠে-ঘাটে, গ্রামে-গঞ্জে, পাড়া-মহল্লায় সবজায়গায় সবার মাঝে নিজেকে শুধু তুলেই ধরেননি, মেলে ধরেছিলেন হৃদয় ও মন উজাড় করে। যা ছফার প্রবন্ধের ইতি টানা কথার মধ্যে ফুটে উঠেছে: 

. . . আমার মনে হয় বাঙালি জাতীয় রাষ্ট্রের স্থপতি হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান সবচেয়ে বড় আসনটি অধিকার করে থাকবেন। যতই দিন যাবে বাঙালির জনগোষ্ঠীর ইতিহাসে শেখ মুজিবুর  রহমান দীর্ঘতর ছায়া প্রসারিত করতে থাকবেন।

এখানে আমার প্রশ্ন, স্থানীয় পর্যায়ের এসব ঐতিহ্য ধারণ করা পলাশদের বাড়ির মতো এরকম হাজার হাজার বাড়ি বা স্থাপনাগুলোর কি একটা অনলাইন আর্কাইভ করা সঙ্গত ছিল না নিদেন পক্ষে? ঢাকা শহরের কথাই ধরি। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে স্থিত হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবার নানা জায়গায় থেকেছেন সেসব বাড়ি বা নিদর্শন চিহ্নিত করে একটা পর্যটন মানচিত্র করা সম্ভব এবং সঙ্গত ছিল। 

বঙ্গবন্ধু নিজের জীবন দিয়ে দেশটা স্বাধীন করেছেন, মুক্ত করতে চেয়েছেন মানুষকে, বাঙালিকে। তিনি উপনিবেশ উত্তর আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিরল এক রাষ্ট্রনায়ক, জাতিরাষ্ট্রের স্থপতি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বেশিরভাগ দেশের আবির্ভাব হয়েছে ব্রিটিশ শাসনের কোম্পানিওয়ালাদের সঙ্গে বৈঠক করে, মানচিত্রের উপর ছুরি কাঁচি চালিয়ে।

অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর পথপরিক্রমা ছিল ভিন্ন। তিনি তার পথ হেঁটেছেন দেশের মানুষের মুক্তির স্বাদকে বুকে ধারণ করে। তিনি কেবল দেশ স্বাধীন করতে চাননি. চেয়েছিলেন মানুষের মুক্তি। গড়তে চেয়েছিলেন একটি আদর্শ ভাষাভিত্তিক জাতিরাষ্ট্রের। তার সংগ্রামী মাটিঘেঁষা জীবনঘেঁষা মানুষের পক্ষে হিম্মত আর টিকে থাকার প্রত্যয়ের সঙ্গে বাঙালি বাউল দার্শনিক লালন ফকিরের কথা আমার মাথায় আসে। বঙ্গবন্ধু বাঙালির আধুনিক রুচি ও প্রকাশের প্রভাবটা রপ্ত করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ থেকে। উদার গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি রপ্ত করেছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু এবং মহাত্মা গান্ধীর মতো নেতাদের জীবন থেকে।

আর অর্থনৈতিক পরিকল্পনা, পররাষ্ট্র আর আধুনিক নাগরিকবোধ অর্জন  করেছিলেন তার নিজস্ব পড়াশোনা, জীবনবোধ থেকে। তিনি বিশ্বমানের নাগরিক চেতনা তার জাতিরাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের মাঝে জাগ্রত করতে চেয়েছিলেন সবকিছুকে ধারণ করে।  তার কল্পনাটা ছিল এরকম, 'ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই ছোট সে তরী, আমারই সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।'

তিনি আধুনিক একটি সংবিধান দিয়েছিলেন। তিনি আধুনিক রুচিসম্মত সমৃদ্ধ সংস্কৃতির রাষ্ট্র গড়ে তুলতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিয়েছিলেন সেই অনুযায়ী পরিকাঠামো এবং অবকাঠামো নির্মাণ করেছিলেন। ভিত্তি গড়েছিলেন আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ জাতিরাষ্ট্র, সমাজ আর শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন। চালু করেছিলে কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের, বিশ্বদ্যালয়গুলোকে দিয়েছিলেন স্বায়ত্বশাসন, চালু করেছিলেন লেখক ট্রাস্ট, চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, উৎসাহিত করেছিলেন দেশে প্রথম আন্তর্জাতিক লেখক সম্মেলন আয়োজনের, পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের জাতীয় চারু ও কারুশিল্প জাদুঘর প্রতিষ্ঠায়, প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ইসলামিক ফাউন্ডেশন। উদাহরণ আরো অনেক।  

দেশি-বিদেশি লেখক দার্শনিকের লেখা বইয়ে সমৃদ্ধ ছিল তার ব্যক্তিগত গ্রন্থাগার। রুচিসম্মত গানের ক্যাসেটের সংগ্রহ ছিল অবাক করা। পোশাক আর ব্যবহারে তিনি ছিলেন অতুলনীয় মডেল, একজন বাঙালির মডেল।

তার ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তা কেমন ছিল? যদি কেউ তার ডাক শুনে না আসত, তিনি একলা চলেছেন, সঙ্গে পেয়েছেন সকলকে সময়ের ডাকে। সেই সম্মোহনী ক্ষমতা তার ছিল, এটা তিনি অর্জন করেছিলেন নিজের আরামকে হারাম করে, নিজের জীবনকে পরের তরে, বাঙালির তরে, মানবতার তরে বিলিয়ে দিয়ে।

সেই মানুষটি দেশটাকে স্বাধীন করলেন। বিশ্বদরবারে মানুষের মুক্তিদাতার আধুনিক এক দৃষ্টান্ত হলেন। জীবন রাজনীতির প্রতিটা স্তরে আধুনিক রুচি  ও দৃষ্টিভঙ্গির স্বাক্ষর রেখে গেলেন; পরিবার, সমাজ, রাজনীতি, প্রশাসন, সংস্কৃতি, পররাষ্ট্রনীতি, অর্থনৈতিক রূপরেখা, শিক্ষা, বাণিজ্য সর্বত্র।

মাঝে মাঝে কিছু কিছু দূরদর্শনে বঙ্গবন্ধুর কিছু ভাষণের অংশবিশেষ শোনানো হয়। যেখানে বঙ্গবন্ধু দুর্নীতির বিরুদ্ধে কষ্টঅনুভূত খেদ ঝাড়েন। কখনও আমলাদের সাহেবিয়ানার বিরুদ্ধেও কথা বলেন, সেখানে সকল পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা আর কর্মচারীদের উদ্দেশ্যে বলেন, "আপনাদের বেতন দেয় এদেশের গরিব দুঃখী মেহনতি মানুষের টাকায়। তাদেরকে সম্মান করে কথা বলবেন।"

বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে আমার একটা প্রশ্ন, আমলা, সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারীদের 'স্যার' বলার এই ঔপনিবেশিক চর্চা থেকে আমরা কি বেরিয়ে আসতে পারি না? সচিব, নির্বাহী কর্মকর্তা, জেনারেল, জেলাপ্রশাসক, ডাক্তার, প্রকৌশলী এই পদগুলো ধরে সম্বোধন করলেই তো চলে, চলে না কি?

ভণ্ড, ধান্দাবাজ, বুদ্ধিজীবীদের নিয়েও বঙ্গবন্ধু কথা বলেছেন, আমাদের ঘুম ভাঙাতে চেয়েছেন।

আজকে উন্নয়নের রমরমা সময়ে আমার মনেও প্রশ্ন, বঙ্গবন্ধু কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলেন? যে উন্নয়ন হয়েছে বা হচ্ছে তা দেখে তিনি খুশি হতেন, কল্পনা করতে পারি।

তিনি যে সমাজতন্ত্রের কথা বলেছিলেন, তার কী হলো? এক্ষেত্রে আমার উপলদ্ধি হলো তিনি বেঁচে থাকলেও হয়তো অর্থনৈতিক ব্যবস্থার একটা পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়েই যেতেন। যেখানে পুঁজিবাদ আর সমাজতন্ত্রের মিশেলে জনকল্যাণমুখী একটা নমুনা তিনি বাতলে নিতেন।

তিনি যে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলেছিলেন তার নমুনা কোথায়? তা টিকিয়ে রাখার জন্যে যে সাংস্কৃতিক অবকাঠামো, শিক্ষা ও প্রশাসনের যে চরিত্র হবার কথা সেটা কি আমরা পেরেছি?

আজকে আমাদের চারদিকে বিরাজমান ধনী ও গরীবের মাঝে মানুষের জীবনমানের কুৎসিত বৈষম্য দেখে বঙ্গবন্ধু কী ভাবতেন? ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার যে আকুতি তা কি আমরা ধারণ করতে পেরেছি? ঘুষ ছাড়া কোন কোন জায়গায় কাজ হয় তার একটা তালিকা কি কেউ দিতে পারবেন? দুর্নীতিমুক্ত দপ্তরগুলোর পরিসংখ্যান আর ঠিকানা কি কারো কাছে আছে? বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে সেইসব ঘুষ, দুর্নীতিমুক্ত দপ্তরের দণ্ডমুণ্ডের কর্তাদের আমি পা ছুঁয়ে সালাম করতে চাই।

বঙ্গবন্ধু গণতন্ত্রের কথা বলেছিলেন। নির্বাচনী গণতন্ত্রই শেষ কথা নয়। সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন পর্যায়ে তা কতটা জনসম্পৃক্ত, জনকল্যাণমুখী ও স্বচ্ছ তাই হচ্ছে গণতন্ত্রের নির্যাস। নির্বাচন তো কেবল চেয়ার ভাগাভাগি। বাকি গণতন্ত্র প্রতিদিনের বিশ্বাস, সম্মান, আস্থা আর চর্চার বিষয়। যেটা বঙ্গবন্ধু দেখিয়েছিলেন। বিশেষ করে ৭ই মার্চের ভাষণে তিনি বলেছিলেন, "যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, তিনি যদি সংখ্যায় একজনও হন, আমরা তার ন্যায্য কথা মেনে নেবো।" আমরা কি এর প্রতিফলন দেখতে পাই?

তিনি মানুষের মুক্তি আর বাঙালির নাগরিক মর্যাদার স্বপ্ন দেখতেন, স্বপ্ন দেখাতেন। তিনি মানুষকে সর্বোচ্চ আসনে দেখতে চেয়েছেন মানুষকে কোনও পোশাকের খোলসে বা পদের আড়ালে রেখে নয় বা কোনো ধর্মের লেবাসে নয়। এই বিষয়গুলো তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীসহ অন্যান্য লেখায় খেয়াল করা যায়। 

বাঙালি হচ্ছে পৃথিবীর মেধাবী জাতিগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে অন্যতম। অথচ ১৯৭১-এর আগে বাঙালি কখনোই সার্বভৌম ছিল না, আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ছিল না, তাদের স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল না। একটি নিজস্ব জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেয়ে মহৎ আর কোনও অর্জন এই পৃথিবীতে নাই। এই অর্জনের রূপকার বঙ্গবন্ধু। এটা যে কতটা আবশ্যক আমরা অতটা বুঝি আর না বুঝি জিজ্ঞেস করে দেখুন কুর্দিদের, তাইওয়ানিদের, কাশ্মীরিদের, বেলুচদের, ফিলিস্তিনিদের, বার্মার নানা জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের, আফগানিস্তানের মানুষদের।

তিনি ধারণ করতেন একটি সত্য, সবার উপরে মানুষ। তিনি নিজে ছিলেন এরকম একজন বিরলপ্রজ মানুষ। আজ থেকে ছয় শ বছরের বেশ কাল আগে চতুর্দশ শতকে বাঙালি কবি বড়ু চণ্ডীদাস কি এরকম একজন মানুষের অবয়ব কল্পনা করেছিলেন- 'সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই'। বঙ্গবন্ধু ছিলেন এরকম একটি সত্য। 

বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতা বইমেলা

মুজিববর্ষের অংশ হিসেবে দেশব্যাপী বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতা বইমেলা নিয়ে কয়েকটি কথা বলে এই লেখার সমাপ্তি টানতে চাই। 

মুজিববর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের অংশ হিসেবে রাজধানীসহ দেশের সবকটি জেলায় ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে চারদিনব্যাপী গ্রন্থমেলার আয়োজন করা হয়। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকার বিভাগের সহযোগিতায় বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি এই গ্রন্থমেলা আয়োজন করে। যা কার্যত একটা অসফল উদ্যোগ হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে। এই মেলাগুলোতে শতাধিক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান অংশ নিলেও মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেনি, তেমন একটা জনসমাগমও হয়নি। 

এত গুরুত্বপূর্ণ একটা আয়োজন এতটা দায়সারা গোছের কেন হলো? এবার আমি এই মেলা আয়োজনকে কেন্দ্র করে তিনটি খবরে দৃষ্টি দিতে চাই। প্রথমটি ২৮ ডিসেম্বরের। এটি বইমেলা আয়োজনকে সামনে রেখে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির প্রধান সমন্বয়ক, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ কতিপয় আমলার সংবাদ সম্মেলন।

অপর দুটি খবরের একটি হচ্ছে ভোলার। খবরে বলা হচ্ছে বইমেলার উদ্বোধন করেন জেলা প্রশাসক। উপস্থিত ছিলেন জেলা পরিষদ সভাপতি, পুলিশ সুপারসহ কতিপয় আমলা।

শেষোক্ত খবরটি নেত্রকোনার। এখানেও দেখা যায় মেলা উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করছেন একজন আমলা, আলোচনায় অংশ নিচ্ছেন জেলা প্রশাসকসহ অন্যরা।

প্রসঙ্গ যেহেতু বইমেলার। এখানে আমার কয়েকটি প্রশ্ন। এখানে লেখক, প্রকাশক, সম্পাদক আর অনুবাদকদের দৃশ্যমান অংশগ্রহণ কোথায়? এদের কার্যকর কোনও প্রতিনিধিত্ব না রাখলে গ্রন্থমেলার মতো একটি আয়োজন ব্যর্থ হবারই কথা। হয়েছেও তাই। সংশ্লিষ্টদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, আমলাদের কাজ মঞ্চ তৈরি করে সেখানে আসন দখল করে নিজেকে উপস্থাপন করা নয়। তারা এর নেপথ্যে আসল কাজটি করে যাবেন, বিনিময়ে জনগণের করের টাকা থেকে মাইনে পাবেন।

দেশে কোনও কোম্পানি আমলের শাসন চলছে না। এত বড় একটা আয়োজনে লেখক-প্রকাশক তো দূরের কথা, উল্লেখ করার মতো জনপ্রতিনিধিদের অংশগ্রহণও চোখে পড়েনি ৬৪ জেলার কোথাও। বঙ্গবন্ধু কি এই আমলাতন্ত্র চেয়েছিলেন? আমলাদের কারো যদি বুদ্ধিজীবী হবার খায়েশ থাকে তাদের অনুরোধ করব বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীসহ পাবলো নেরুদা, আবু ইসহাক, শহীদুল জহিরের মতো প্রতিথযশা লেখক এবং আমলাদের জীবনী থেকে আত্মমর্যাদাবোধের শিক্ষা রপ্ত করতে।