পুরুষোত্তমের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন

মো. সেকান্দর চৌধুরী
Published : 9 Jan 2022, 07:22 PM
Updated : 9 Jan 2022, 07:22 PM

১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক স্বাধীন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধুর বীরোচিত দেশে ফেরার ৫০ বছর। এবছরই বাঙালি বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ পালন করলো। উদযাপন করলো স্বাধীনতা ও বিজয়ের সুবর্ণ-বছর। এরকমই মহিমান্বিত বাঙালি জাতির মহান স্মারক জাতির পিতার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। এতেই অর্জিত হয় মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ বিজয়।

কেননা তখন বঙ্গবন্ধু কেবল একটি শরীরী সত্তা নয়, একটা নবোত্থিত জাতির পরিচিতি ও অস্তিত্বের সমার্থক- যার সঙ্গে বাংলা ও বাঙালি একীভূত।

বঙ্গবন্ধুর এই মহান ও ঐতিহাসিক প্রত্যাবর্তন বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ এই অর্থে যে, একটি পরাধীন জাতি যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করলো, অথচ সেই যুদ্ধে তিনি অনুপস্থিতিতেই ছিলেন সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান-সুপ্রিম কমান্ডার অব দ্য আর্মন্ড ফোর্সেস। হাজার মাইল দূল থেকেই ছিল তার দিব্য ও দিব্যি উপস্থিতি। তিনিই ছিলেন রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধের মূর্তিমান প্রতীক। অনুপ্রেরণার উৎস।

পরাধীনতার নাগপাশ, উপনিবেশিকতা বা স্বৈরশাসন থেকে দেশকে মুক্ত করেছেন, শারীরিক অনুপস্থিতি সত্ত্বেও এমন মহানায়কদের মধ্যে যারা দূরে অবস্থান করেছেন, তাদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু বিশেষত্ব হলো- তিনি প্রতিটি মুহূর্তেই মৃত্যুর কাছ থেকে চুল পরিমাণ দূরত্বে ছিলেন। তার বন্দিশালার সামনেই খোঁড়া হয়েছিল কবর। পূর্বেও তিনি পাষাণ করার অন্ধকারে বন্দিত্ব বরণ করেছিলেন ১৪ বছর। পাকিস্তানের প্রত্যন্ত সামরিক ছাউনি মিয়াওয়ালির একটি কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠ থেকে তিনি দৃঢ়ভাবে উচ্চারণ করেছিলেন, "আমি জাতিতে বাঙালি, ধর্মে মুসলমান। আর  মুসলমান একবারই মরে।" তিনি শুধু অনুরোধ করেছিলেন, লাশটি যেন তার দেশ ও জাতিকে ফিরিয়ে দেওয়া হয় এবং তাকে বাংলাদেশে সমাধিস্থ করা হয়। অনমনীয় মানসিক দৃঢ়তায় তিনি সমঝোতার বিনিময়ে মৃত্যু থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার প্রলোভন অগ্রাহ্য করে প্রতিনিয়ত পবিত্র কোরআন পাঠে নিমগ্ন ছিলেন।

ইতিহাসে দেখা যায়-ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন, নেলসন ম্যান্ডেলা, কেনিয়ার জেমো কেনিয়াত্তা, প্রিন্স নরোদম সিহানুক, আয়াতউল্লা খোমেনি দুর প্রান্তে অবস্থান করে স্বদেশ মুক্তির নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু রাশিয়ার বিপ্লবের সময় লেনিনের অবস্থান ছিল জার্মানিতে এবং তার দেশবাসী জানতে লেনিন ফিরবেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় নেলসন ম্যান্ডেলা জীবনহানি নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন না। নির্জন দ্বীপে সম্পূর্ণ নিরাপদ ছিলেন তিনি। সিহানুক চীনে নিশ্চিত ও আয়েশি জীবন-যাপন করছিলেন। আর খোমেনির নিরাপদ অবস্থান ছিল প্যারিসে। তার বাণীবদ্ধ ক্যাসেট ইরানের ঘরে ঘরে পৌঁছে গিয়েছিল।

কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মাথার ওপর খাঁড়া ছিল মৃত্যুর পরোয়ানা। 'জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য' করার এরকম দৃষ্টান্ত আর একটিও নেই।

২৫শে মার্চ কালরাতে 'অপারেশন সার্চলাইট' এবং নিজেকে নিরাপদ অবস্থানে নিয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি ১৯৭২ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি মার্কিন সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে বলেছিলেন, "পাকিস্তানের কমান্ডো বাহিনী সে রাতে আমার বাড়ি ঘিরে রেখেছিল। তারা আমাকে মেরে ফেলত যদি আমি বাড়ির বাইরে আসতাম। মেরে ফেলার পর বলত চরমপন্থিরা আমাকে খুন করেছে। আমাকে মেরে ফেলার অজুহাতে ইহাহিয়া খান আমার দেশের মানুষকে খুন করত। তারা হত্যাযজ্ঞ চালাত।"

বস্তুত কথা যথার্থই। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা, পরিস্থিতি মোকাবেলার অপরিমেয় ক্ষমতা-সর্বোপরি দেশের মানুষের প্রতি অতলান্ত ভালোবাসাই তাকে সুবিশাল উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে। তিনি ছিলেন রাজনীতির দ্রষ্টা, তার অতুলনীয় সাহস, মৃত্যুঝুঁকি নেয়ার দুর্লভ যোগ্যতার কারণে বঙ্গবন্ধু একক এবং অদ্ধিতীয়। অন্যত্র তিনি আর  এক  সাক্ষাৎকার বলেছিলেন, "আমাকে যদি ইয়াহিয়া খান না-পায়, তাহলে তারা সারা ঢাকা শহরে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেবে"। একজন মানুষও অবশিষ্ট রাখবে না।' তাই তিনি সতীর্থদের নিরাপদ অবস্থানে পাঠিয়ে দিয়ে নিজেই মৃত্যুকূপে ঝাঁপিয়ে পড়লেন।

মূলত ৭ই মার্চের রেসকোর্সের জনসভায় তার দীপ্ত কণ্ঠের উচ্চারণ- 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।' এবং 'তোমরা ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল'ই ছিল স্বাধীনতার প্রকৃত ঘোষণা। এক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু অসাধারণ কৌশলী ভূমিকা অবতীর্ণ হয়েছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হিসেবে দুনিয়ার কাছে চিহ্নিত করতে চাননি। আর সাফল্যের সঙ্গে ২৬শে মার্চ স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে স্বয়ং গ্রেপ্তার বরণ করে নেন। এই কারণেই পরিগণিত হয়েছিনে ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে 'আস্থার প্রতীক'।

এ কথা সত্য যে, বঙ্গবন্ধুর ডাকে মার্চ মাসেই পাকিস্তানের মৃত্যু সূচিত হয়েছিলো। তিনি হয়ে ওঠেছিলেন বাংলা ও বাঙালির আলোকবর্তিকা।

পাকিস্তানি ৫ জন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা দ্বারা গঠিত ট্রাইবুন্যালে বঙ্গবন্ধুর বিচার শুরু হলো। রাষ্ট্রদ্রোহিতা, পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বাংলাদেশকে স্বাধীন করাসহ ১২টি অভিযোগ উত্থাপন করা হয় সামরিক আদালতে। এর মধ্যে ৬টির শাস্তি ছিল অবধারিত মৃত্যুদণ্ড।

অনন্য বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান সরকার কর্তৃক প্রদত্ত আইনজীবী নিতেও অস্বীকার করেছিলেন। বিচারপর্ব শেষ হলো ৪ঠা ডিসেম্বর। কারাকক্ষের সামনে খোঁড়া হলো কবর।

শুরু হলো আবিশ্ব তুমুল প্রতিক্রিয়া প্রতিবাদ। পূর্ব জার্মানি, ওয়ার্ল্ড পিস কাউন্সিল, কমনওয়েলথ পার্লামেন্টোরি অ্যাসোসিয়েশন, মার্কিন প্রভাবশালী সিনেটর এইচ পার্সি, আবার লীগ তীব্র নিন্দা জানালো। পাকিস্তান সরকারের প্রতি আহ্বান জানালো এই মহান নেতাকে ফাঁসি না দেওয়ার জন্য। বিশ্ববাসীর কাছে তখন তিনি এক মহান আইডল, আইকন। ইন্দিরা গান্ধী বিচার বা ফাঁসি প্রসঙ্গে বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে প্রতিবাদ বার্তা পাঠালেন।

পাকিস্তানি সামরিক জান্তা শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হলো। বীরের বেশে ১০ জানুয়ারি তিনি ফিরে এলেন বাংলাদেশে। পাকিস্তান সরকারের ইচ্ছা ছিল তিনি ইরান-তুরস্ক হয়ে দেশে ফিরে যান। কিন্তু বঙ্গবন্ধু লন্ডন-দিল্লি হয়ে ব্রিটিশ রয়াল এয়ার ফোর্সের বিমানে দেশে ফিরলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু  যদি কোনো কারণে ফিরে আসতে না পারতেন তাহলে কী হতো?

পাকিস্তানের 'পোড়ামাটি নীতি'র কারণে তখন সমগ্র দেশ ছিল একটি ধ্বংসস্তূপ। বঙ্গবন্ধুর ক্যারিশমাটিক নেতৃত্ব ছাড়া একটি বিধ্বস্ত জনপদ কি আবার মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারতো?

তার অনুপস্থিতিতে সদ্য-স্বাধীন বিশৃঙ্খল এই দেশটিতে কঙ্গো, সোমালিয়া বা আফগানিস্তানের মতো গোষ্ঠীগত না হলেও, দলগত সংঘর্ষ লেগে যেতো হয়তো। আর এই পরিস্থিতি সামাল দেশের সামর্থ্য প্রবাসী সরকারের ছিল না। সরকারেরও ছিল অন্তর্দ্বন্দ্ব। ছিল না দেশ শাসনের জন্যে প্রয়োজনীয় ব্যক্তিত্ব ও মনোবলের অভাব। ছিল চরমপন্থিদের রক্তাক্ত নৈরাজ্য। বঙ্গবন্ধু ফিরে এসে দক্ষ হাতে সব প্রতিকূলতা ছিন্নভিন্ন করে দিলেন। এমনকি অল্প ক'দিনের মধ্যেই ভারতীয় সেনাবাহিনী নিজেদের ভূমিতে ফিরে যায়। ৮ই জানুয়ারি মুক্তি পাওয়ার পর, দিল্লি নেমেই তিনি ইন্দিরা গান্ধীর কাছে প্রথমেই জানতে চেয়েছিলেন, ভারতীয় সেনাবাহিনীকে কবে বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে নেয়া হবে।

প্রসঙ্গ উল্লেখ্য, লন্ডনের হিথ্রো বিমান বন্দরে বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানিয়েছিলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্মিথ আর  নয়াদিল্লিতে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভিপি গিরি এবং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী।

বাংলা ও বাঙালির অহংকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস আজ। এই ঐতিহাসিক দিনে এই প্রদীপ্ত সূর্যের প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা নিবেদন হবে এটাই বঙ্গবন্ধুর প্রার্থিত-স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা। সুখী, সমৃদ্ধ, সচ্ছল ও উন্নত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর যথার্থ ও সুযোগ্য উত্তরসূরী শেখ হাসিনার মিশন ও ভিশন বাস্তবায়নে ব্রতী হওয়া।

৭৫-এর বঙ্গবন্ধু সপরিবারে শাহাদত বরণের পর যে ঘোর অমানিশা নেমে এলো, তা থেকে আমরা পর্যায়ক্রমে বেরিয়ে আসছি এবং সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। এখন দেশ বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গণতন্ত্র ও সুশাসনের ভিত সুদৃঢ় করেছে। শেখ হাসিনার রূপকল্প-৪১ বাস্তবায়নের মাধ্যমেই বঙ্গবন্ধুর প্রার্থিত ও স্বপ্নের সোনার বাংলা নিশ্চয়ই প্রতিষ্ঠিত হবে।