খালেদা জিয়া পরবর্তী বিএনপির ভবিষ্যত

সাঈদ ইফতেখার আহমেদসাঈদ ইফতেখার আহমেদ
Published : 21 Dec 2021, 03:11 PM
Updated : 21 Dec 2021, 03:11 PM

বিএনপি তার ইতিহাসের সবচেয়ে ক্রান্তিলগ্ন পার করছে বর্তমান সময়ে। ১/১১ এর পর থেকে বিএনপির রাজনৈতিক সংকটে নিপতিত হওয়ার সূত্রপাত। দিন যত গেছে সংকটতো কাটেইনি বরং সময়ের সাথে সাথে তা আরো ঘনীভূত হয়েছে। 

সমস্ত সংকট এবং নানাবিধ চাপ সত্ত্বেও যার ওপর মানসিকভাবে নির্ভর করে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত বিএনপির নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ থেকেছেন, তিনি হলেন দলটির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। এক সামরিক অভ্যুত্থানে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি বেগম জিয়া বিএনপিতে যোগ দেন।

জিয়া নিহত হওয়ার পর দলে নেতৃত্বের সংকট তৈরি হয়। একই সাথে শুরু হয় নানাবিধ উপদলীয় কোন্দল। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য ১৯৮৪ সালের ১০ মে খালেদা জিয়াকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দলের চেয়ারপার্সন নির্বাচিত করা হয়। সেই সময় থেকে খালেদা জিয়ার অনেকটা একক নির্দেশনা ও পরিচালনায় দলটি পরিচালিত এবং বিকশিত হয়েছে। 

খালেদা যখন দলের প্রধান হন তখন তিনি বিএনপির মত একটি প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব দিতে পারবেন কিনা- এ প্রশ্ন অনেকের মধ্যেই জেগেছিল। এমনকি বিএনপির কিছু সিনিয়র নেতা সেসময় প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ খালেদা জিয়াকে সামনে রেখে দলের নেতৃত্ব নিজেদের হাতে রাখতে পারবেন বলে মনে করেছিলেন। 

খালেদা জিয়া এমন একটা সময়ে দলের প্রধান হন যখন দেশে সামরিক শাসন চলছে। বিএনপির নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট আব্দুস সাত্তারকে ক্ষমতাচ্যুত করে জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা দখল করেছেন। বিভিন্ন দলছুট রাজনীতিবিদ এবং কিছু সুবিধাবাদী ব্যক্তি নিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতার কেন্দ্রে বসে গড়ে তোলা এ দলটি জিয়ার অনুপস্থিতিতে টিকে থাকবে কিনা, এ প্রশ্ন তখন বিদগ্ধজনদের মনে। 

দলের প্রধান হওয়ার সাথে সাথেই খালেদা জিয়ার সামনে চ্যালেঞ্জ হাজির হয় বিএনপিকে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে নিয়ে যাওয়া। এরশাদ প্রথমে ভেবেছিলেন, গৃহবধু পটভূমি থেকে উঠে আসা খালেদার পক্ষে বিএনপির মত একটি দলকে নিয়ে—যে দলে সুবিধাবাদী নেতাকর্মীদের একটা উল্লেখযোগ্য অবস্থান রয়েছে- তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করা সম্ভব হবে না। 

জিয়ার পথ ধরে এরশাদও বিএনপিসহ অন্যান্য দল থেকে নেতাকর্মী নিয়ে এসে দল গঠনের উদ্যোগ নেন। এ প্রক্রিয়ায় মওদুদ আহমেদসহ বিএনপি এবং তার অঙ্গসংগঠনের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নেতাকর্মী এরশাদের সাথে হাত মেলান। অন্য যেকোন রাজনৈতিক দলের চেয়ে বিএনপি থেকেই বেশি নেতাকর্মী এরশাদের দলে যোগ দেন। 

এ সমস্ত কিছু বিএনপিকে সাংগঠনিকভাবে দুর্বল করে। জিয়াউর রহমান নিহত হওয়া এবং সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানোর ফলে বিএনপির নেতাকর্মীরা এমনিতেই ছিলেন মানসিকভাবে বিধ্বস্ত। এর সবকিছু এরশাদকে একটা মানসিক স্বস্তি এনে দিয়েছিল এই ভেবে যে, অন্তত বিএনপির পক্ষে খালেদার নেতৃত্বে আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব হবে না। 

এ ধরনের একটি দলকে নিয়েই খালেদা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৫ দলের সাথে যুগপৎ এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সামিল হন। ১৯৮৬ সালে আন্দোলন যখন তুঙ্গে সেই মুহূর্তে হঠাৎ করেই আওয়ামী লীগ, সিপিবি, ন্যাপ (মো) সহ ১৫ দলীয় জোট থেকে আটটি দল এরশাদ ঘোষিত সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। 

জামায়াতও সেসময় তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে নির্বাচনে অংশ নেয়। তখন জামায়াতের রাজনীতির মূল লক্ষ্য ছিল সেক্যুলার এবং বামপন্থি দলগুলোর কাছে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করা। 

সময়টা তখন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে 'শীতল যুদ্ধের' সময়। জামায়াত তখন জাতীয় রাজনীতিতে সিপিবিকে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে। ফলে সিপিবি যেহেতু নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে এ বিবেচনায় এবং সেক্যুলার বামপন্থি দলগুলোর সাথে পাশাপাশি বসার কথা চিন্তা করে জামায়াত নির্বাচনে অংশ নেয়। 

আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য প্রধান রাজনৈতিক দল নির্বাচনে চলে যাওয়ায় তা বিএনপির ওপর প্রচণ্ড চাপ তৈরি করে। বিএনপি নেতৃত্ব কোন সিদ্ধান্ত নেবেন সেটা বুঝে উঠতে পারছিলেন না। খালেদা তখন একক সিদ্ধান্তে নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নেন এবং যারা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে তাদেরকে 'জাতীয় বেইমান' হিসেবে আখ্যায়িত করেন। বিএনপি নেতৃত্ব এজন্য ওসময় তাকে 'আপসহীন নেত্রী' হিসেবে অভিহিত করে। 

 বিএনপি নির্বাচন বর্জন করলেও নির্বাচন প্রতিহত করতে পারেনি। তবে বিএনপির নির্বাচন বর্জন রাজনীতিতে খালেদার একটা ভিন্ন ইমেজ তৈরি করে—যেটা পরবর্তীতে একটা লম্বা সময় তাকে রাজনীতিতে বিশেষ সুবিধা দেয়। 

নির্বাচন পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ, সিপিবিকে বাদ দিয়ে এরশাদবিরোধী আন্দোলন পরিচালনা করতে গিয়ে বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতা স্পষ্ট হয়। বিএনপি নেতৃত্বাধীন সাত দলীয় জোটের বাকি ছয়টি দল ছিল সাইনবোর্ড সর্বস্ব। এছাড়া খালেদা সাথে পেয়েছিলেন রাশেদ খান মেনন, নির্মল সেনের নেতৃত্বে ১৫ দল থেকে নির্বাচন বর্জনের ডাক দিয়ে বের হয়ে আসা পাঁচটি ছোট বাম দলকে। কিন্তু এদেরকে নিয়ে খালেদার পক্ষে এককভাবে এরশাদবিরোধী আন্দোলনকে পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। 

আওয়ামী লীগ, সিপিবিসহ যারা নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল তারা ১৯৮৭ সালে সংসদ থেকে পদত্যাগ করে মাঠের আন্দোলনে যোগ দিলে আন্দোলনে আবার গতি পায়। এরই ধারবাহিকতায় ১৯৯০ সালের ডিসেম্বর মাসে সামরিক শাসক এরশাদের পতন ঘটে। 

এরশাদ সরকারের ভাইস প্রেসিডেন্ট মওদুদ আহমদ তার চলমান ইতিহাস: জীবনের কিছু সময় কিছু কথা, ১৯৮৩-১৯৯০ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন (পৃষ্ঠা ৪৮০-৪৮১), রাষ্ট্রীয় অন্য যেকোন প্রতিষ্ঠানের চেয়ে সেনাবাহিনীর ওপর নির্ভর করে এরশাদ দেশ চালিয়েছেন। আন্দোলন তুঙ্গে উঠলে জেনারেলরা এরশাদের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেন। ফলে পদত্যাগ করা ছাড়া এরশাদের সামনে আর কোন বিকল্প খোলা ছিল না। 

আন্দোলনের শেষ দিনগুলিতেও বিএনপি নেতা ওবায়দুর রহমানসহ ছাত্রদলের কিছু শীর্ষ নেতা এরশাদের দলে ভিড়েন। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নেতাকর্মী জাতীয় পার্টিতে চলে যাওয়ায় সাংঠনিক ভাবে দুর্বল হয়ে পড়া বিএনপির সামনে এরশাদ পতনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের চ্যালেঞ্জ হাজির হয়। 

সেসময় অনেকের মাঝে এ ধারণা জন্মেছিল যে বিএনপির পক্ষে বোধহয় নির্বাচনে জয় লাভ করা সম্ভব হবে না। বিএনপির নেতাদের অনেকে নার্ভাস ছিলেন। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে খালেদার নেতৃত্বে বিএনপি ১৪০টি আসনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করে। এ বিজয় খালেদা জিয়াকে বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ করে দেয়। 

খালেদার নেতৃত্বে বিএনপি প্রথম ক্ষমতা কেন্দ্রের বাইরে থেকে রাজনীতির চর্চা করে  সামরিক শাসন বিরোধী সফল আন্দোলনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে। তার নেতৃত্বেই প্রথমবারের মত ক্ষমতার বাইরে থেকে নির্বাচন করে বিজয়ী হয়। বস্তুত এ দুটি বিষয় জিয়ার পরিচয় ছাপিয়ে নিজস্ব ইমেজে খালেদা জিয়ার নেত্রী ইমেজ নির্মাণ করে।

খালেদা জিয়া যখন প্রধানমন্ত্রী হন তখন বিশ্বে নারী রাষ্ট্র বা সরকার প্রধান হয়েছেন হাতে গোণা মাত্র কয়েকজন। নারী-পুরুষ সমাধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিদার পাশ্চাত্যের অনেক দেশই তাদের রাষ্ট্র পরিচলানা করার জন্য যোগ্য নারী নেতৃত্ব গড়ে তুলতে পারেনি।    

বাংলাদেশের মত অর্থনৈতিকভাবে পশ্চাৎপদ এবং সামাজিকভাবে অতীব রক্ষণশীল মুসলিম প্রধান দেশে একজন নারীকে সরকার প্রধান হিসেবে মেনে নেওয়ার মানসিকতা তখনো জনগণের একটা উল্লেখযোগ্য অংশের মাঝে গড়ে উঠেনি। এমনকি খালেদা জিয়া রাজনীতিতে আসার আগে বিএনপির মাঠ পর্যায়ের অনেক নেতাকর্মীকে শেখ হাসিনার দলীয় প্রধান হওয়ার বিষয়টা নিয়ে কটাক্ষ করতে দেখা যেত। 'ইসলামপন্থি' দলগুলো নারী নেতৃত্ব 'হারাম' বলে বিএনপির সাথে তখনো জোট বাঁধেনি।  

এমতাবস্থায় খালেদা জিয়া সরকার প্রধান হয়ে প্রমাণ করে দেন যে, দরিদ্র মুসলিম প্রধান দেশ হলেও বাংলাদেশের অধিকাংশ জনগোষ্ঠী নারীকে সরকার প্রধান হিসেবে গ্রহণ করার মানসিকতা অর্জন করেছে—যা তখন পশ্চিমের উদার গণতান্ত্রিক সেক্যুলার রাষ্ট্রের অনেককেই বিস্মিত করে। 

শুধু রাজনৈতিক রক্ষণশীলতা নয়, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি সামাজিক রক্ষণশীলতাতেও ধাক্কা মারেন। সনাতন ধর্ম প্রভাবিত সংস্কৃতির প্রভাবে আবহমান কাল ধরে শ্রেণি-নির্বিশেষে বাংলাদেশের বিধবা নারীরা সাদা শাড়ি পরতেন। খালেদা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর সে ঐতিহ্য ভেঙ্গে ফেলেন। সেসময় সমালোচকদের নানা সমালোচনা উপেক্ষা করে তিনি রঙিন শাড়ি পড়া শুরু করেন। ধীরে ধীরে যার একটা সুদূরপ্রসারী প্রভাব বাংলাদেশের সমাজ কাঠামোতে পড়ে–ক্রমশ বিধবা নারীদের সাদা শাড়ি পড়ার প্রথার বিলুপ্তি ঘটে।   

বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার মধ্য দিয়ে খালেদা জিয়ার সামনে রাজনৈতিক নেত্রী থেকে 'Stateswoman' হয়ে ওঠার সম্ভাবনা হাজির হয়। কিন্তু বিষয়টা তিনি উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হন। শুরুতেই তিনি বিতর্কিত ব্যক্তি আব্দুর রহমান বিশ্বাসকে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করে বিতর্কের জন্ম দেন। 

এসময় খালেদা জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ৭১ এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে উঠা প্রবল আন্দোলনের সম্মুখীন হন এবং এ বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হন। কিন্তু সবচেয়ে বড় ভুলটা তিনি করে বসেন- মেয়াদ শেষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের অসম্মতি জানানোর মধ্যে দিয়ে। 

১৯৯১ সালে অনেকেই যখন মনে করছিলেন সাংগঠনিকভাবে দুর্বল বিএনপি ক্ষমতায় আসতে পারবে না, তখন জনগণের একটা বড় অংশ বিএনপিকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় নিয়ে এসে খালেদাকে বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্মান এনে দেয়। কিন্তু ক্ষমতায় এসে তিনি সে জনগণের ওপর আস্থা রাখতে পারেননি। 

প্রশাসনের ওপর নির্ভর করে ক্ষমতায় টিকে থাকাকে খালেদা 'Stateswoman' হওয়ার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করলেন। ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগ, বামপন্থি এবং জামায়াত যুগপৎভাবে ভিন্ন ভিন্ন প্লাটফর্ম থেকে আন্দোলন গড়ে তোলে। আন্দোলনের এক পর্যায়ে যে প্রশাসনের উপর নির্ভর করে তিনি ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছিলেন, সে প্রশাসন তার প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করে নিলে, এরশাদের মত তার সরকারের পতন ঘটে। এর মধ্যে দিয়ে তিনি অনেকটা পতিত এরশাদের কাতারে নেমে আসেন। 

ক্ষমতা হারানোর পর খালেদা যে সামরিক শাসক এরশাদের অধীনে নির্বাচন না করার জন্য 'আপসহীন' খেতাব পান, সেই এরশাদের সাথেই ৪ দলীয় জোট গড়ে তোলেন। এতে যে তার 'আপসহীন' ইমেজ প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে সেটা তিনি বিবেচনায় নেননি। যে জামায়াত তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য আন্দোলন করেছিল তাদের সাথেও তিনি জোটবদ্ধ হন। পরবর্তীতে অন্যান্য 'ইসলামপন্থি' দলগুলোর সাথেও বিএনপির নৈকট্য বাড়ান। 

এর মধ্য দিয়ে 'ইসলামপন্থি' দলগুলোর নৈতিক দেউলিয়াত্ব জনগণের সামনে স্পষ্ট হয়। কেননা যারা এতদিন নারী নেতৃত্ব 'হারাম' বলে আসছিলেন, সে-ই তারাই নারী নেত্রীর অধীনে রাজনীতি করতে সম্মত হন। কিন্তু খালেদার ৯/১১ পরবর্তী আন্তর্জাতিক রাজনীতির বাস্তবতা বুঝতে পারার ব্যর্থতা থেকে 'ইসলামপন্থি' দলগুলো সাথে জোটবদ্ধ হওয়ার সিদ্ধান্ত বিএনপির সাথে পশ্চিমা দুনিয়ার দূরত্ব তৈরি করে। তাইওয়ানের সাথে ব্যবসায়িক সূত্র ধরে দূরত্ব তৈরি হয় বিএনপির দীর্ঘদিনের মিত্র চীনের সাথেও।

খালেদা জিয়ার ক্ষমতার দ্বিতীয় মেয়াদে প্রথম মেয়াদের তুলনায় দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার ঘটে। পুত্র তারেক রহমানকে রাজনীতিতে আনার ফলে দলের মধ্যে সমান্তরাল নেতৃত্ব তৈরি হয়, যা খালেদার নেতৃত্বকে দুর্বল করে। এ সময়কালে 'ইসলামপন্থি' সন্ত্রাসবাদের ব্যাপক উত্থান, ২১ অগাস্ট গ্রেনেড হামলা খালেদা এবং বিএনপির রাজনীতিকে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তদুপরি দ্বিতীয় মেয়াদেও তিনি প্রথম মেয়াদের মত অনেকটা একই ধরনের ভুল করে বসেন। 

একটু ভিন্নভাবে দলীয় ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা রেখে নির্বাচন করার উদ্যোগ নেন খালেদা। ফলে তার আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত জেনারেল মঈনের নেতৃত্বে ১/১১ এর ঘটনা ঘটে, যার খেসারত বিএনপিকে এখনো বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। যে দলকে খালেদা এরশাদ শাসনামলের দুঃসময় থেকে টেনে তুলে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেন, জাতীয়, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির গতিপ্রকৃতি উপলব্ধি করতে পারার ব্যর্থতার ফলে সে দল বিএনপিকেই তিনি তার ইতিহাসের সবচেয়ে সংকটময় অবস্থায় নিপতিত করেন। 

এরশাদের হাতে ক্ষমতাচ্যুতি ঘটার পর দলকে টেনে তুলতে পারলেও ১/১১ পরবর্তী সংকট থেকে খালেদা দলকে আর বের করে আনতে পারেননি। ২০১৪ সালের বিরোধী দলবিহীন নির্বাচনের পরে তিনি শেখ হাসিনার মত আন্দোলন করে সরকারের পতন ঘটাতে পারেননি।  

জীবনের একটা পরিণত সময়ে এসে এসময়ে যেন তিনি ক্লান্তি বোধ করছিলেন। এরশাদ আমলের মত দীর্ঘ আন্দোলন, সংগ্রাম গড়ে তোলার মত ধৈর্য অথবা শারীরিক বা মানসিক কোন অবস্থাই যেন তার ছিল না। তাই অনেকটা যেন শর্টকাট পথ হিসেবে জামায়াতের সাথে মিলে দুই দুইবার পেট্রোল বোমা নির্ভর সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনে দলকে নিয়ে যান-যার লক্ষ্যবস্তু করা হয় সাধারণ আমজনতাকে।

অধিকাংশ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়ে যাওয়ার পর জামায়াত জোটে নিস্ক্রিয় হয়ে যায়। খালেদা বুঝতে পারেন গণতন্ত্রের জন্য নয়, সুবিধাবাদী জামায়াত বিএনপির জনসমর্থনের শক্তিকে ব্যবহার করেছে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে শনাক্ত তাদের দলীয় ব্যক্তিদের রক্ষা করার জন্য। জামায়াতের কৌশল বোঝার ব্যর্থতার চরম মাশুল দিতে হয় বিএনপিকে। 

সরকারের প্রবল চাপের মুখে পড়ে দল অনেকটা নিস্ক্রিয় হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় খালেদা চিকিৎসার জন্য লন্ডন যান। অনেকে ভেবেছিলেন তিনি হয়ত আর ফিরে আসবেন না। কিন্তু খালেদা দেশে ফিরে এসে তার বিরুদ্ধে আনীত দুর্নীতির মামলার রায় মোকাবেলার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি হয়ত ভেবেছিলেন, যে দলের পেছনে তিনি তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় ব্যয় করেছেন, যাকে অবলম্বন করে জিয়া নিহত হওয়ার পর দলটি এত দীর্ঘ পথ চলেছে—সে দলের নেতাকর্মীরা তিনি গ্রেপ্তার হলে আর যাই হোক সর্বস্ব দিয়ে মাঠে নামবেন, তাকে মুক্ত করার জন্য। 

এ আত্মবিশ্বাস থেকেই খালেদা দেশে ফিরে আসেন। তিনি হয়ত ধরে নিয়েছিলেন একমাত্র তার গ্রেপ্তারের মধ্যে দিয়েই সরকার বিরোধী আন্দোলন দাঁড়াবে—বিএনপির নেতৃত্বে জনগণ হয়ত তার মুক্তির দাবিতে রাস্তায় নামবে। কিন্তু তিনি অবাক হয়ে দেখলেন, জামায়াত নেতাদের মুক্তির দাবিতে যে দল এত রক্ত ঝরালো, তার নিজের অতি প্রিয় সেই দল তার মুক্তির জন্য কিছু লোক দেখানো ছাড়া- এক অর্থে কোন আন্দোলনই করল না।

শুধু তাই নয়, তিনি যে সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবেন না বলেছিলেন, তিনি জেলে যেতে না যেতেই বিএনপির নেতারা দলকে সেই সরকারের অধীনেই নির্বাচনে নিয়ে যায়। এ সমস্ত কিছুই জীবন সায়াহ্নে এসে খালেদার ওপর প্রচণ্ড মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। 

গত ৩৭ বছর ধরে বিএনপির সমস্ত কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে খালেদা জিয়াকে কেন্দ্র করে। তাকে আঁকড়ে ধরেই বিএনপি রাজনীতির নানা উত্থান পতনের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে।  সেই তিনি এখন গুরুতর অসুস্থ। 

বেশ অনেকদিন ধরে খালেদা জিয়া এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তার জন্য গঠিত মেডিকেল বোর্ড কিছুদিন আগে সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছে তিনি লিভার সিরোসিসসহ নানাবিধ জটিল রোগে আক্রান্ত। খালেদা জিয়াকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়ার মত প্রযুক্তি বাংলাদেশে না থাকার ফলে তারা তাকে দ্রুত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য অথবা জার্মানিতে পাঠানোর সুপারিশ করেছে।

দীর্ঘ সময় ধরে জাতীয় রাজনীতিতে প্রবল চাপের মুখে থাকা বিএনপি তাদের দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে বিদেশ পাঠানোর ইস্যুকে কেন্দ্র করে আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু এটিও আরো অনেক উদ্যোগের মতই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। জনগণের বড় অংশকে সম্পৃক্ত করতে পারা তো দূরের কথা, দলটি তার মাঠ পর্যায়ের সব নেতাকর্মীদেরই এ ইস্যুকে কেন্দ্র করে রাস্তায় নামাতে পারেনি।   

জনগণের পালস বুঝতে না পারা বা জনগণের মনোজগতকে ঠিক মত পড়তে না পারার বিএনপির বর্তমান নেতৃত্বের যে প্রবল সীমাবদ্ধতা, সেটি আন্দোলন গড়ে তুলতে পারার ব্যর্থতার মধ্যে দিয়ে আরেকবার তারা স্পষ্ট করে।

খালেদা জিয়া যে হাসপাতালের চিকিৎসা নিচ্ছেন, অর্থাৎ এভারকেয়ার, বাংলাদেশের উন্নয়নের নানা জয়গান গাওয়া সত্ত্বেও চরম বাস্তবতা হচ্ছে, এ ধরনের হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার সামর্থ্য দেশের ৯০ শতাংশ জনগোষ্ঠীরই নাই। ভিআইপি কেবিনতো দূরের কথা, এ হাসপাতালটির সাধারণ কেবিনে থেকে চিকিৎসা নেওয়ার সামর্থ্য দেশের ৯৮ শতাংশ জনগোষ্ঠীর নেই। 

বিএনপির মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের ক্ষেত্রেও পরিসংখ্যান দুটি কম-বেশি একই রকম। অপরদিকে, দেশের শীর্ষ রাজনীতিবিদ, আমলা এবং ব্যবসায়ী-পুঁজিপতিদের এভারকেয়ারের মত হাসপাতালে ভরসা রাখতে না পারাটা দেশের আমজনতার স্বাস্থ্য সেবার মানের চিত্র আসলে কতটা করুণ, সে দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করে। 

এখন প্রশ্ন হলো, খালেদা জিয়া পরবর্তী সময়ে বিএনপির রাজনীতি কি টিকে থাকবে? বিএনপি আওয়ামী লীগ, জামায়াত বা সিপিবির মত রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে গড়ে উঠা দল নয়। বিএনপি গঠন করা হয়েছে ক্ষমতার কেন্দ্রে বসে, কিছু সামরিক/বেসামরিক আমলার সহায়তা নিয়ে। এ কারণে বিএনপি বিরোধী রাজনীতি যারা করেন তারা বিএনপিকে নিয়ে একটি মিথ তৈরি করেন। 

মিথটি হল বিএনপি গঠিত হয়েছে- "উত্তরপাড়া বা প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেনাবাহিনীর সমর্থন নিয়ে'। বিএনপির পিছনে সেনা আমলাতন্ত্রের আশির্বাদ রয়েছে।" বিএনপির রাজনীতির বিরোধিরা এ মিথের জন্ম দিলেও এর সবচেয়ে বেশি ভোক্তা কিছুদিন আগ পর্যন্ত ছিল বিএনপির নেতাকর্মীরা। অবশ্য সম্প্রতি, বিশেষত ১/১১ এর পর থেকে আস্তে আস্তে তাদের অনেকে বুঝতে পারছেন বিষয়টা সঠিক নয়। এটা তাদের এতদিন যাবত গড়ে উঠা মনোজাগতিক নির্ভরতাকে ধাক্কা দিলেও সেটি তাদের রাজনীতির মূল স্পিরিটকে নষ্ট করেনি।

কিছু সামরিক আমলার সহায়তায় জিয়ার রাজনৈতিক দল গঠন অন্য সেনা সদস্যদের ক্ষুদ্ধ করে। যারা জিয়ার এ প্রক্রিয়ার প্রতি ক্ষুদ্ধ হয়েছিলেন তারা কেবল কোনও একটি বিশেষ মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন না। ক্ষুদ্ধ হওয়া অফিসারদের মধ্যে একদিকে যেমন ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীরা, তেমনি ছিলেন পাকিস্তান ফেরতরা। একই সাথে ছিলেন মুসলিম জাতীয়াবাদ বা 'ইসলামপন্থা'য় বিশ্বাসীরা এবং জাসদ ধারার বামপন্থিরা। এমনকি পেশাগত ঈর্ষা থেকেও অনেকে জিয়ার প্রতি ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠেন। তারা সকলেই চাচ্ছিলেন জিয়াকে ক্ষমতাচ্যুত করতে। ফলে জিয়ার বিরুদ্ধে ১৯টির ক্যু সংগঠিত হয়—যার ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ায় সহস্রাধিক সেনা সদস্য নিহত হন। ২০ তম সেনা অভ্যুত্থানে জিয়া নিহত হন। 

জিয়ার স্ত্রী খালেদা দুই দুইবার ক্ষমতাসীন হলেও রহস্যজনক কারণে জিয়া হত্যার বিচার বা এর তদন্তের কোন উদ্যোগ নেননি। বিএনপির নেতাকর্মী, বুদ্ধিজীবীদের মাঝে এ নিয়ে কোন আগ্রহ দেখা যায়নি। ১৫ অগাস্টের বিয়োগান্তক ঘটনা যেমন দেশি-বিদেশি নানা গবেষক নানা আঙ্গিক থেকে বোঝার চেষ্টা করেছেন, জিয়া হত্যাকাণ্ড নিয়ে সেটা কারো মাঝে পরিলক্ষিত হয়নি। এর মধ্যে দিয়ে বিএনপি সংশ্লিষ্ট বুধিজীবীদের বুদ্ধিবৃত্তিক এবং নৈতিক দুর্বলতা ফুটে উঠে। 

চলমান ইতিহাসে  মওদুদ আহমদ লিখেছেন (পৃঃ ২১৪), "জিয়া হত্যার বিচার বা সেই হত্যার পেছনে আর কোন ষড়যন্ত্র ছিল কিনা সেটার আর কোন সুরাহা হয়নি।" ফলে এর সাথে এরশাদ সংশ্লিষ্ট ছিলেন কিনা সেটা আর প্রমাণ করা যায়নি। সেটা করার মতো উদ্যোগ নেওয়ার সাহস এবং মেধা দুটোই বিএনপির মাঝে প্রবল ভাবে অনুপস্থিত। আর এ সাহসিকতার অভাবের ফলেই বিএনপিকে এরশাদ মনোনীত বিচারপতি সাত্তারকে তাদের রাষ্ট্রপতি প্রার্থী হিসেবে মেনে নিতে হয় (মওদুদ আহমদ, পৃঃ ২১৩)। 

সাত্তার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরে এরশাদ তাকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। আবার খালেদা জিয়ার প্রথম শাসনামলের শেষ দিকে জেনারেল নাসিমের অসন্তোষের বহির্প্রকাশ জাতি প্রত্যক্ষ করে। আবার তার দ্বিতীয় ক্ষমতার মেয়াদকালের শেষে জেনারেল মঈন কর্তৃক ১/১১ এর ঘটনা ঘটে। এর থেকে যে বিষয়টা স্পষ্ট হয় সেটা হলো, সামরিক/বেসামরিক আমলাতন্ত্রের সমর্থন ছাড়াও বিএনপি নিজের পায়ে মূলধারার দল হিসেবে টিকে থাকতে সক্ষম।       

আগামী দিনেও বিএনপি মূলধারার দল হিসেবে টিকে থাকবে কিনা- এটি নির্ভর করছে দলটি যে রাজনৈতিক মতাদর্শ অনুসরণ করছে সমাজ কাঠামোয় এর প্রভাব কতটুকু তার উপর। বিএনপির রাজনৈতিক মতাদর্শের উৎস মুসলিম জাতীয়তাবাদ। ভারতীয় উপমহাদেশে জিন্নাহর হাত ধরে মুসলিম জাতীয়তাবাদের জন্ম। পরবর্তীতে মাওলানা ভাসানী এবং জুলফিকার আলী ভুট্টো মুসলিম জাতীয়তাবাদের সাথে তৎকালীন প্রভাবশালী ধারণা সমাজতন্ত্রের মিশ্রণ ঘটিয়ে ইসলামী সমাজতন্ত্রের কথা বলেন। 

জিন্নাহ ছাড়াও ভাসানী এবং ভুট্টোর তাত্ত্বিক প্রেরণার উৎস আরব জাতীয়তাবাদী সিরিয়ার দার্শনিক মিশেল আফলাক, যিনি বাথ সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্ম দেন। এ মতাদর্শের মূল বিষয় হলো ইসলামী পরিচয় এবং রেটোরিক আরব জাতীয়তাবাদী (এবং সমাজতান্ত্রিক) আন্দোলনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আফলাকের মতে, ইসলাম হচ্ছে মুসলমানদের জন্য ধর্ম, কিন্তু এটি একই সাথে ধর্ম নির্বিশেষে সমস্ত আরববাসীর পরিচয় এবং সংস্কৃতির অংশ।  

এ ধারণার বিশ্বাসীরা রাষ্ট্র এবং সমাজে শরীয়া আইন চান না, শুধু কিছু ইসলামিক রেটোরিক, প্রত্যয় এবং শ্লোগান ব্যবহার করতে চান। ক্ষেত্র বিশেষে ইসলামকে জাতিগত পরিচয়ের অন্তর্ভুক্ত করতে চান। একই সাথে তারা জনমানস এবং জীবনযাপন প্রক্রিয়ার অনেকটা পশ্চিমা ধারার মত আধুনিকায়নও চান।     

জিন্নাহ এবং ভাসানীর হাত ধরে মুসলিম জাতীয়তাবাদের যে বিবর্তন সেটির আরেকটু আধুনিক সংস্করণ দাঁড় করান জিয়াউর রহমান তার 'বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে'র ধারণায়—যেখানে ভূ-কেন্দ্রিক জাতীয়াতাবাদের কথা বলা হলেও কিছু ধর্মভিত্তিক রেটোরিক, প্রত্যয় এবং শ্লোগান এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। 

এটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে সমাজ কাঠামোয় এ ধরনের চিন্তার একটা শক্তিশালী উপস্থিতি রয়েছে। বাংলাদেশের সেক্যুলার আন্দোলন এ ধরণের চিন্তাধারাকে সমাজ কাঠামো থেকে দূর করতে তো পারেইনি, বরং তাদের অনেকেই এ চিন্তাধারা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন, বা এ চিন্তাধারার সাথে আপস করেছেন। এ সূত্র ধরে আওয়ামী লীগের মাঝেও ধর্মভিত্তিক শ্লোগান এবং প্রত্যয় ব্যবহারের ঝোঁক আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। আবার "ইসলামপন্থিরা" মনে করেন এ ধারার প্ল্যাটফর্মের উপস্থিতি তাদের রাজনীতির বিকাশের সহায়ক।

তাহলে দেখা যাচ্ছে সমাজ কাঠামোতে বিএনপির রাজনৈতিক মতাদর্শের একটা প্রভাবশালী অবস্থান রয়েছে। এ মতাদর্শের অনুসারীরা বিএনপিকেই এখন পর্যন্ত এ রাজনীতির সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্লাটফর্ম মনে করে আসছে।

নির্ভরযোগ্য রাজনৈতিক প্লাটফর্ম গড়ে উঠে দুই প্রক্রিয়ায়। এর একটি হলো- ক্যারিশমেটিক  নেতার নেতৃত্বে জাতীয় পর্যায়ে আন্দোলন গড়ে তোলার সক্ষমতার ওপর। উপমহাদেশে এভাবে গড়ে উঠেছে গান্ধীর হাত ধরে কংগ্রেস, জিন্নাহ নেতৃত্বে মুসলিম লীগ এবং বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে আওয়ামী লীগ। 

আর অপরটি হলো- রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। উদাহারণস্বরুপ বলা যায় ইরাকের সাদ্দাম হোসেন, লিবিয়ার গাদ্দাফি এবং সিরিয়ার হাফেজ আল আসাদের কথা। জনপ্রিয়তা অর্জন না করার ফলে এরশাদের জাতীয় পার্টিকে বিএনপির হুবহু নকল করে গড়ে তোলা হলেও নির্ভরযোগ্য প্লাটফর্ম হিসেবে গড়ে উঠতে পারেনি।     

ভবিষ্যতে খালেদার অনুপস্থিতিতে উপরে উল্লিখিত দুটি প্রক্রিয়ার যেকোন একটি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত বিএনপি যে মতাদর্শে বিশ্বাস করে সে ধারার বিকল্প প্লাটফর্ম গড়ে উঠবে না। ফলে বিএনপিই মূলধারার দল হিসেবে থেকে যাবে। যদিও দলে ছোটখাট ভাঙ্গন থেকে শুরু করে নানা মহল থেকে বিকল্প গড়ার প্রক্রিয়া পরিলক্ষিত হতে পারে।