সংগ্রাম,অধিকার,জাগরণ,অনুপ্রেরণা ও সাহিত্যের এক প্রধান উৎসমূল

গোলাম কিবরিয়া পিনুগোলাম কিবরিয়া পিনু
Published : 9 Dec 2021, 01:19 PM
Updated : 9 Dec 2021, 01:19 PM

এক : পটভূমি
আমরা জানি, বহু ধরনের সামাজিক অবরোধ, কুসংস্কার আর শিক্ষার অভাবের কারণে যুগ যুগ ধরে বাঙালি নারীর অগ্রসর হওয়া অনেক ক্ষেত্রে সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে সন্তানের জন্ম ও তার লালন-পালন, পতিসেবা ও গৃহকর্মের মধ্যেই জীবনকে বৃত্তাবদ্ধ করে রাখতে তারা বাধ্য হোন। রাষ্ট্রের আইন, সামাজিক বিধিনিষেধ, ধর্মীয় বিবেচনা ও অর্থনৈতিক কারণে নানাভাবে বৈষম্যের শিকার হন তারা। এছাড়া বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, দাসপ্রথা ও সতীত্ব ধারণার কবলে থাকার ফলে নারীদের শৃঙ্খল আরও বেশি করে জোরালো হয়ে থাকে। আঠারো শতক পর্যন্ত এই একরৈখিক ধারা বেশ বজায় থাকে। উনিশ শতকের প্রথমার্ধে সতীদাহপ্রথা, বিধবাবিবাহ, বাল্য বিবাহ ও নারীদের অধিকার বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে, এর ফলে নারী তার আত্মশক্তি খুঁজে পেতে থাকে। নারী শিক্ষার গুরুত্ব ও বিকাশ উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে তাৎপর্যপূর্ণভাবে দেখা যায়। এই সময় থেকে নারীকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করার বিষয়টি গুরুত্ব পেতে থাকে। সামাজিক অত্যাচার, বিধিনিষেধ, প্রথা, পশ্চাৎপদতা যা নারীকে সীমায়িত করে রাখার শৃঙ্খল হিসেবে বিবেচিত হতো, সেই সব শৃঙ্খল থেকে নারীকে মুক্ত করার জন্য সেই সময়ে সমাজে ব্যাপক আলোচনা, উদ্যোগ ও আন্দোলন শুরু হয়। এর ফলে নারীর সামাজিক মর্যাদা ও জীবনের বিকাশ তরান্বিত হয়, অন্যদিকে নারী তার নতুন জীবনবোধ নিয়ে অনেকক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার সাহস ও শক্তি অর্জন করে। বিংশ শতাব্দী নারীর আত্মপ্রতিষ্ঠার যুগ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, এই শতাব্দীতে নারীরা সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেন। আর একবিংশ শতাব্দিতে এসে এই নারীরা অনেক ক্ষেত্রে এগিয়েছে।

বিশেষভাবে আমরা দেখি- আধুনিক চেতনা ও নানা সংস্কার নিয়ে হিন্দু সমাজে নারীদের জন্য সচেতন প্রয়াস উনিশ শতকে জোরালো হয়, তাতে হিন্দু সমাজের নারীদের কল্যাণ সাধিত হওয়ার পথ যেভাবে উন্মুক্ত হতে থাকে, সেই একইভাবে মুসলিম নারীদের পথ বিকশিত হতে দেখা যায়নি। এর কারণ মুসলমানদের ধর্মীয়-দৃষ্টিভঙ্গি এবং নেতৃস্থানীয় মুসলিমদের মধ্যে ব্রিটিশ শাসন ও পাশ্চাৎ-শিক্ষা সম্পর্কে মনোভাব অনেকাংশে দায়ী। দেরি হলেও, পরবর্তীতে রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেনের আর্বিভাব ও মুসলিম নারীর শিক্ষার পথ অনেকটা সুগম হওয়ায় মুসলিম নারীর মধ্যে জাগরণ সৃষ্টি হয়।

দুই : জন্ম ও বিয়ে
রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন জন্মেছিলেন ১৮৮০ সালে, রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে, এক জমিদার পরিবারে। আনুমানিক ১৬ বছর বয়সে বিহারের অধিবাসী বিপত্নীক ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ সাখাওয়াৎ হোসেনের সঙ্গে রোকেয়ার বিয়ে হয়। বিয়ের পর তার নাম হয় রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন। তবে, তিনি বেগম রোকেয়া নামেই সমধিক পরিচিত । ১৯০৯ সালের ৩ মে সৈয়দ সাখাওয়াৎ হোসেন মারা যান। আর রোকেয়া মারা যান ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর, মাত্র ৫৩ বছর বয়সে।

তার বিয়ে হয় সে যুগের তুলনায় বেশ পরিণত বয়সে, ষোলো বছরে। কিন্তু তার পাত্রটি বিলেতফেরত এক অবাঙালি দোজবরে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন, ভাগ্যের কী পরিহাস! পরবর্তীকালে যিনি হন নারীমুক্তি আন্দোলনের একজন অগ্রদূত, তার বিয়ে হয় তার চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি বয়সী এক দোজবরের সঙ্গে। আগের পক্ষের এক কন্যা ছিল সাখাওয়াতের। পরে সে কন্যা এবং তার স্বামী রোকেয়াকে কম লাঞ্ছনা দেননি। বাস্তবে বিয়েটা রোকেয়ার জন্যে তেমন শোচনীয় ছিল না। রোকেয়ার জীবনে স্বামী সাখাওয়াৎ হোসেনের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী এবং গুরুত্বপূর্ণ। তার সাহচর্যে এসেই রোকেয়ার জ্ঞানচর্চার পরিধি বিস্তৃত হয়। উদার ও মুক্তমনের অধিকারী স্বামীর উৎসাহ ও সহযোগিতায় রোকেয়া দেশি-বিদেশি লেখকদের রচনার সঙ্গে নিবিড়ভাবে পরিচিত হন এবং ক্রমশ ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন। তার সাহিত্যচর্চার সূত্রপাতও ঘটে স্বামীর অনুপ্রেরণায়। তবে রোকেয়ার বিবাহিত জীবন বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। রোকেয়ার গর্ভে দুইটি কন্যা জন্ম গ্রহণ করে , তারা অল্পবয়সেই মারা যায়।

লেখক হিসেবে গল্প-কবিতা-উপন্যাসের মধ্যে দিয়ে তিনি আত্মপ্রকাশ করেছেন, সংগঠক হিসাবে রোকেয়া স্কুল প্রতিষ্ঠা, নারীর কল্যাণে সংগঠন প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে এসেছিলেন। বাঙালি, বাঙালি-মুসলমান, নারীশিক্ষা, নারীজাগরণ তার কর্মকাণ্ডের মূলভূমি হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। স্কুল প্রতিষ্ঠা, নারী-কল্যাণ সংস্থা প্রতিষ্ঠা আর লেখক হিসেবে গল্প-কবিতা-উপন্যাসের মধ্যে দিয়ে তিনি নিজেকে আরও আত্মপ্রত্যয়ী হিসেবে প্রকাশ করেছেন।

ব্রাহ্ম অথবা পাশ্চাত্য প্রভাবিত হিন্দু পরিবারে দু-চারটা ব্যতিক্রম দেখা দিলেও, মুসলিম পরিবারের কোনো মেয়ের পক্ষে সেই সময়ে পর্দা ভেঙে বিদ্যালয়ে যাবার প্রশ্নই ছিলো অবাস্তব। এই পর্দা প্রথা কতো কঠোর ছিল, রোকেয়ার নিজের জবানী থেকেই তার পরিচয় পাওয়া যায়। বাড়িতে কোনো স্বল্প পরিচিত নারী বেড়াতে এলেও, পাঁচ বছরের রোকেয়াকে পর্দা করতে হতো। কোনো একবার বাইরের নারীরা বেড়াতে এলে কদিন কী প্রায় অনাহারে কখনো চিলেকোঠায়, কখনো সিঁড়ির নিচে, কখনো দরজার আড়ালে লুকিয়ে থেকেছেন তিনি। প্রায় সমবয়সী ছয় বছরের হালিম কখনো যদি তাকে একটু দুধ এনে দিতেন, তা হলে সেটাই হতো তার একমাত্র পথ্য। মুসলিম মেয়েদের লেখাপড়ায় মস্ত বড় বাধা ছিল এই যে, তখনো তাদের লেখাপড়ার কোনও স্কুল ছিল না। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ না করলেও, রোকেয়া ছিলেন স্বশিক্ষিত মানুষ। এর পিছনে ছিল ব্যাপক আত্ম-প্রচেষ্টা, অধ্যয়ন ও পরিবেশের আনুকূল্য।

তিন : স্কুল প্রতিষ্ঠা ও শিক্ষার জন্য সংগ্রাম
মৃত্যুর সময় সাখাওয়াতের সঞ্চিত অর্থের পরিমাণ ছিল সত্তর হাজার টাকা। স্বামীর মৃত্যুর পাঁচ মাস পরে মাত্র পাঁচটি ছাত্রী নিয়ে রোকেয়া ভাগলপুরে একটি বালিকা বিদ্যালয়ের সূচনা করেন। কিন্তু সাখাওয়াতের পূর্বপক্ষীয় কন্যা এবং সেই কন্যার স্বামীর পীড়নে অল্পকালের মধ্যে তিনি ভাগলপুর ছাড়তে বাধ্য হন। ফলে বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনের প্রথম উদ্যোগ অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়। তবে বাধা পেলেও নিরুৎসাহ হননি তিনি। কলকাতায় গিয়ে এক বছর পাঁচ মাস পরে, ১৯১১ সালের ১৬ মার্চ তিনি আর একটি বিদ্যালয়ের গোড়াপত্তন করেন। স্কুলটির নাম ছিল 'সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল'। রোকেয়ার অক্লান্ত প্রচেষ্টায় ১৯১৭ সালে এই স্কুল মধ্য গার্লস স্কুলে রূপান্তরিত হয়, পরবর্তীতে ১৯৩১ সালে উচ্চ ইংরেজি গার্লস স্কুলে পরিণত হয়। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কারণে এবং ছাত্রী সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার ফলে স্কুলটি কলকাতার বিভিন্ন স্থানে স্থানান্তরিত করতে হয়।

সেই সময়ে কলকাতায় মেয়েদের জন্যে বেথুন কলেজিয়েট স্কুল, ব্রাহ্ম গালর্স স্কুল এবং ক্রাইস্ট চার্চ স্কুলসহ সাতটি উচ্চ বিদ্যালয়, ছয়টি এমই স্কুল, পাঁচটি ভার্নাকুলার স্কুল, ৪১টি উচ্চ প্রাথমিক এবং ৪১টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল। মুসলিম মেয়েদের জন্য নিম্ন-মাধ্যমিক উর্দু স্কুল ছিল ১৪টি আর ২৫টি কোরান স্কুল অর্থাৎ মক্তব ছিল। কিন্তু একটি উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়ও ছিল না। অথবা বাংলাভাষী মুসলিম বালিকাদের জন্যেও একটি স্কুলও ছিল না। প্রথম দিকে কেবল অবাঙালি ছাত্রীরাই পড়ত সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল স্কুলে। রোকেয়ার অনুপ্রেরণায় ক্রমশ বাঙালি মেয়েরাও এগিয়ে আসে পড়াশোনার জন্য। ছাত্রীদের পর্দার ভেতর দিয়েই ঘোড়ার গাড়িতে করে স্কুলে আনা-নেওয়া হতো। বিরূপ সমালোচনা ও নানাবিধ সামাজিক প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করে তিনি এই প্রতিষ্ঠানটিকে সে যুগের মুসলিম মেয়েদের শিক্ষালাভের অন্যতম পীঠস্থানে পরিণত করেন। এটি ছিল তাঁর স্বপ্ন ও আদর্শের বাস্তবায়ন। শৈশব থেকে মুসলিম নারীদের যে দুর্দশা তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন- তার প্রতিকারের ব্যবস্থা করাই ছিল এই স্কুল প্রতিষ্ঠার অন্যতম লক্ষ্য।

সাখাওয়াৎ মোমোরিয়াল স্কুলে তফসিরসহ কুরআন পাঠ থেকে আরম্ভ করে বাংলা, ইংরেজি, উর্দু, ফারসি, হোম নার্সিং, ফাস্ট এইড, রান্না, সেলাই, শরীরচর্চা, সংগীত প্রভৃতি বিষয় শিক্ষা দেওয়া হতো। স্কুল পরিচালনা এবং পাঠদান অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য রোকেয়া বিভিন্ন বালিকা স্কুল পরিদর্শন করতেন। পর্যবেক্ষণ করতেন সেসব স্কুলের পাঠদান পদ্ধতিও। কলকাতায় উপযুক্ত শিক্ষয়িত্রী নিয়ে আসেন তার স্কুলে। শিক্ষার ক্ষেত্রে রোকেয়ার নিবেদিত হওয়ার আরও ভূমিকা লক্ষ করা যায়, তার মধ্যে এমনি সচেতনতা ছিল- শিক্ষা ব্যতিত নারী বিশেষ করে মুসলিম নারীর বিভিন্ন পর্যায়ে মুক্তি সম্ভব নয়। শিক্ষা বিস্তারে রোকেয়ার ভূমিকা সেইকালের নিরিখে শুধু তাৎপর্যই ছিল না, ছিল এক কঠিন চ্যালেঞ্জ, সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সাহসী আর উদ্যমী এক নারীর জীবন সংগ্রামের গৌরবময় ভূমিকা আমরা লক্ষ করি, তার জীবনের পরতে পরতে।
চার : সংগঠক ও সাংগঠনিক সম্পর্ক
রোকেয়ার আর একটি বড় পরিচয়, তিনি একজন নারী আন্দোলনের অগ্রসর কর্মী। তিনি নারীর সার্বিক অবস্থা, বন্ধন, অসম্মান প্রত্যক্ষভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। তার মতে, ''উড়তে শেখার আগেই পিঞ্জরাবদ্ধ এই নারীদের ডানা কেটে দেওয়া হয়। এবং তারপর সামাজিক রীতিনীতির জালে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখা হয় তাঁদের।'' রোকেয়া আরও বলেছেন, ''নারীর দাসত্বের প্রধান কারণ, পুরুষশাসিত সমাজ ধর্মের নাম করে নারীর দাসত্বকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ এবং অলৌকিক মহিমা দিয়েছে।'' জীবনকে অর্থবান করার জন্য শৃঙ্খল থেকে মুক্তির বিষয়ে রোকেয়া ছিলেন দৃঢ় ও দ্বিধাহীন।

রোকেয়া বাংলা ও নিখিল ভারত পর্যায়ে এক সংগ্রামী সাংগঠনিক ভূমিকা পালন করেন। নারী সমাজের মধ্য দায়িত্বশীলতা, কর্তব্যপরায়ণতা, দক্ষ নেতৃত্বের গুণাবলি সৃষ্টি এবং সমাজ ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯১৬ সালে তিনি 'আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম' (মুসলিম মহিলা সমিতি) প্রতিষ্ঠা করেন। এটিই মুসলিম নারীদের কল্যাণ ও অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রথম সংগঠন। এর কার্যক্রম ছিল দরিদ্র বালিকাদের শিক্ষা প্রদান, আশ্রয়হীন নারীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি, কুটিরশিল্প স্থাপন, মেয়েদের বিয়ের ব্যবস্থা করা, অজ্ঞ ও অশিক্ষিতদের শিশুপালন ও স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে জ্ঞানদান এবং সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার আদায়। নারীজাতিকে সংগঠিত করার মানসে তিনি বিভিন্ন সংগঠন ও মুসলিম সমিতি, বেঙ্গল উইমেন্স এডুকেশনাল কনফারেন্স প্রভৃতি সংস্থার জীবন সদস্য ছিলেন। এসব সংগঠনের মধ্যে দিয়ে রোকেয়ার সংগঠক জীবনের পরিচয় আমরা পাই। নারীর বিভিন্নমুখী সমস্যা সমাধানে সংগঠিত প্রয়াস প্রয়োজন বলেই তিনি তার প্রজ্ঞা সাংগঠনিভাবে কাজে লাগিয়েছেন। সমাজসংস্কারের জন্য নারীদের সংগঠন ও সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড বিশেষভাবে ভূমিকা রাখতে পারে, এ অর্ন্তদৃষ্টি তিনি অর্জন করেছিলেন সেই পশ্চাৎপদ মুসলিম সমাজে অবস্থান করেও, পরবর্তীতে মুসলিম-নারী আন্দোলনে তার ভূমিকা বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

পাঁচ : বাংলা সাহিত্য : রোকেয়ার সাহিত্য জীবন
স্বামীর অকালমৃত্যু, স্কুল প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার ফলে রোকেয়ার সাহিত্যজীবন একটু বিঘ্নিত হয়েছে; কিন্তু তাকে সাহিত্য থেকে দূরে রাখতে পারেনি প্রতিকূল পরিস্থিতি। স্কুলের কাজে শত ব্যস্ততা সত্ত্বেও সাহিত্যচর্চা ছাড়েননি তিনি, তার সাহিত্যচর্চা ও স্কুল পরিচালনার পেছনে অনন্য উদ্দেশ্য কাজ করে গিয়েছিল বলেই এ দুই ব্রতই তিনি উদযাপন করেছেন। তার মৃত্যুর আগের দিনেও তাকে দেখা গেছে সাহিত্যচর্চায় নিমগ্ন থাকতে। ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর ভোরে  মারা যাওয়ার আগের রাতেও তিনি ১১টা পর্যন্ত তার টেবিলে বসে তিনি কাজ করেছিলেন। যে টেবিলে শেষ লেখাপড়ার কাজ করেছিলেন, সেখানে পরদিন অসমাপ্ত লেখা 'নারীর অধিকার' পেপার ওয়েটের নিচে দেখা গিয়েছিল। তা থেকে বোঝা যায়, রোকেয়া একজন আত্মনিবেদিত সাহিত্যসাধক ছিলেন।

বাংলা সাহিত্যে আধুনিক যুগের শুরু ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ধরা হয়ে থাকে। এই সময় থেকে বাংলা সাহিত্যের বিকাশ ও সমৃদ্ধি বিশেষভাবে চিহ্নিত হয়েছে। উনিশ শতকে এসে বাংলা সাহিত্যের সব শাখা ব্যাপকতা নিয়ে বিকশিত হয়। উনিশ শতকের আগে বাংলা সাহিত্য যতটুকু বিকাশ হয়নি, তার অনেক গুণ ব্যাপকতা নিয়ে, সৃজনশীলতা নিয়ে বাংলা সাহিত্য এই শতাব্দীতে বিকশিত হয়েছে। এর ফলে বাংলা সাহিত্যের বৈচিত্র্য ও উৎকর্ষ এর আগের ৯০০ বছরের তুলনায় গত একশ বছরে অনেক বেশি সমৃদ্ধ। উনিশ শতকে বাঙালি নারীরা আধুনিক শিক্ষা গ্রহণে এগিয়ে আসেন, শিক্ষা গ্রহণের ফলে নারীদের মধ্যে সৃজনশীলতা উন্মুখ হতে থাকে। এই কার্যকারণে- কবিতা, গান, নাটক, ছোটগল্প, উপন্যাস, আত্মজীবনী, প্রবন্ধ লেখক হিসেবে বেশ ক'জন নারী লেখকের আর্বিভাব ঘটে, এদের মধ্যে অনেকেই লেখক হিসেবে খ্যাতিও অর্জন করেন।

নারী স্বমহিমায় জীবনীকার, প্রবন্ধকার, উপন্যাসিক, কবি হিসেবে পুরুষের পাশাপাশি নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে সচেষ্ট হয়। হিন্দু নারী লেখকদের পাশাপাশি মুসলিম নারীরাও লেখালেখিতে পিছিয়ে থাকেনি।

প্রথম বাঙালি নারী কবি কৃষ্ণকামিনী দাসী, ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে কৃষ্ণকামিনীর কথা উল্লেখ করেছেন কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত তার সংবাদ প্রভাকর-এ। প্রথম নারী আত্মজীবনীকার শ্রী মতি রাসসুন্দরী দেবী-র (১৮০৯-১৯০০) আমার জীবন প্রকাশিত হয় ১৮৭৬ সালে। বাংলা ভাষায় রচিত এ গ্রন্থে মেয়েদের সে সময়কার জীবনধারার একটি দলিল উপস্থাপিত হয়েছে। রাসসুন্দরীর মতো গ্রন্থ প্রকাশ করতে পারেননি সে সময় হয়ত আর কেউ, কিন্তু উনিশ শতকের ষাট-সত্তরের দশকে মেয়েদের গদ্যের বেশ কিছু নমুনা পাওয়া যায় সাময়িকপত্রে, বিশেষত বামাবোধিনী পত্রিকায়। এ ছাড়া নারীদের লেখার সুযোগ করে দেয় অবলাবান্ধব (১৮৬৯), বঙ্গমহিলা (১৮৭৫), ভারতী (১৮৭৭), অন্তপুর ইত্যাদি পত্রিকা।

প্রথম নারী নাট্যকার কামিনী সুন্দরী দেবী, উর্বশী নাটক লেখেন ১৮৫৬ সালে (মতান্তরে ১৮৬৬)। অনেকের মতে প্রথম নারী ঔপন্যাসিক শিবসুন্দরী দেবী, তার 'তারাবতী' প্রকাশিত হয় ১৮৬৩ সালে (মতান্তরে ১৮৭৩)। এরপর বহু নারী লেখক সৃজনশীলতায় নিজেদের যুক্ত করেছেন। মহর্ষি দেবেন্দ্র নাথ ঠাকুরের দশম সন্তান ও চতুর্থ কন্যা স্বর্ণকুমারীর জন্ম ১৮৫৫ সালে। তার ৭৭ বছরের জীবনে তিনি লিখেছেন বহু উপন্যাস, গল্প, গীতিনাট্য, প্রবন্ধ, বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ ইত্যাদি।

বঙ্গদেশে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশ সর্বত্র সমান অথবা একই সময়ে হয়নি। উচ্চবর্ণের হিন্দুদের মধ্যেই সেটা প্রথম দিকে সীমিত ছিল। মুসলিম ও নিম্নবর্ণের হিন্দুরা ছিলেন অনেকটা পিছিয়ে। উনিশ শতকে মুসলিম নারী লেখকদের অস্তিত্বের বিষয়টি জোরালো হয়। রূপজালালের লেখিকা ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী (১৮৩৪-১৯০৪) একটি পূর্ণাঙ্গ পুস্তক রচনার কৃতিত্ব দেখান। উনিশ শতকের শেষপর্বে বেশ কিছু মুসলিম নারী কবি ও লেখিকার সন্ধান পাওয়া যায়। রোকেয়ার বেশ কিছু আগে উনিশ শতকের শেষভাগে খুলনার আজিজুন্নেসা খাতুন (১৮৬৪-১৯৪০) লেখালেখি শুরু করেন। তিনি পার্নেল ও গোল্ডস্মিথের হারমিট বাংলাভাষায় উদাসীন নামে অনুবাদ করেন।

রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন ১৯০৪ সাল থেকে সাহিত্যিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯৩২ সাল পর্যন্ত তার লেখকজীবন বিস্তৃত। তার রচনার মধ্যে রয়েছে মতিচুর ১ম ও ২য় খণ্ড (১৯০৬, ১৯২১); পদ্মরাগ ও অবরোধবাসিনী (১৯২৮) উপন্যাস; কয়েকটি ছোটগল্প ও রসরচনা। নবনূর, মহিলা, নবপ্রভা, ভারত-মহিলা, আল-এসলাস, সওগাত ও বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত সতেরটি প্রবন্ধ মতিচুর- এ সঙ্কলিত হয়। এছাড়া সেসময় পুস্তকাকারে অপ্রকাশিত (পরে রচনাবলিতে যুক্ত) তার প্রবন্ধাবলির মধ্যে রয়েছে : রসনা পূজা, ঈদ সম্মিলন, সিসেম ফাঁক, চাষার দুক্ষু, এন্ডি শিল্প, রাঙ ও সোনা, বঙ্গীয় নারী শিক্ষা সমিতি, লুুকানো রতন, বানী ভিখারিণী, উন্নতির পথে, বেগম তরজির সহিত সাক্ষাৎ, সুবেহ সাদেক, ধ্বংসের পথে বঙ্গীয় মুসলিম, হজের ময়দানে, বায়ুযানে পঞ্চাশ মাইল ও নারীর অধিকার। তার ছোটগল্প ও রসরচনার নাম : ভ্রাতা-ভগ্নী, তিন কুঁড়ে পরী বিবি, বলিগর্ত, পঁয়ত্রিশ মন খানা ও বিয়ে পাগলা বুড়ো। তিনি কয়েকটি কবিতাও রচনা করেছেন।

উনিশ ও বিশ শতাব্দীর প্রথমে যে-সব লেখিকা খ্যাতি অর্জন করেছেন তাঁরা প্রায়-সবাই কথাশিল্পী (স্বর্ণকুমারী দেবী, অনুরূপা দেবী, নিরুপমা দেবী, শান্তা দেবী, সীতা দেবী প্রমুখ) বা কবি (গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী ১৮৫৮-১৯২৪, কামিনী রায় ১৮৬৪-১৯৩৩, মানকুমারী বসু ১৮৬৩-১৯৪৩, প্রিয়ন্বদা দেবী ১৮৭১-১৯৩৪, লজ্জাবতী বসু ১৮৭৩-১৯৪২ প্রমুখ)। কিন্তু বেগম রোকেয়ার মতো চিন্তাশীল গদ্যলেখিকা, যিনি সমকালীন সমাজচিন্তায় সর্বতোভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন, যিনি সমাজ সাহিত্য নারী ইত্যাদি নানা বিষয়ে জাগৃতির জন্যে সচেষ্ট ছিলেন, স্কুল ও নারীকল্যাণ সংস্থাও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, চাষি-সমাজের কথাও ভাবেন ('চাষার দুক্ষ'), এন্ডি শিল্পের প্রসারের জন্যে বিজ্ঞান সম্মত প্রবন্ধ রচনা করেন (এন্ডি শিল্প), তার রচনার দ্বারা সমকালীন পুরুষ ও নারী-সমাজকে সচকিত করে তোলেন, এরকম দ্বিতীয় কোনো নারী লেখক বাংলায়- সেই সময়ে দেখা যায়নি।

রেকেয়ার বক্তব্যের দু'টি উদাহরণ দিয়েই শেষ করছি

''যখনই কোন ভগ্নী মস্তক উত্তোলনের চেষ্টা করিয়াছেন, তখনই ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচন-রূপ অস্ত্রাঘাতে মস্তক চূর্ণ করিয়াছে। … আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগণ ঐ ধর্মগ্রন্থগুলিকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রকাশ করিয়াছেন।"

আমাদের অবনতি, 'নবনূর' ভাদ্র সংখ্যা ১৩১১।

''ভারতবর্ষে সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট জীব কাহারা জানেন? সে জীব ভারত-নারী। এই জীবগুলির জন্য কখনও কাহার প্রাণ কাঁদে নাই।''

ঙ্গীয় নারী শিক্ষা সমিতির সভাপতির ভাষণ, ১৯২৭।