সংস্কৃতিহীন সমাজের বর্বর মুখচ্ছবি

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 8 Dec 2021, 08:52 AM
Updated : 8 Dec 2021, 08:52 AM

রাজনৈতিক সংস্কৃতি বলতে কি কিছু আছে দেশে? যখন থেকে রাজনীতি প্রতিযোগিতাহীন এবং ভোটের রাজনীতি শেষ তখন থেকে রাজনীতির সংস্কৃতিও শেষ। সাবেক প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসান খবরের শিরোনাম যখন, তখন এই বিষয়টাও কি বিবেচনায় আসা উচিৎ নয়? বাংলাদেশের সামগ্রিক চেহারা সমাজের কাঠামো আর মনন যে পরিবর্তিত হয়ে গেছে এটা আমরা সবাই বুঝি। কিন্তু এর পচন যে এমন বিকৃত রূপ ধারণ করেছে তা হয়তো অনেকেই টের পান না। মুরাদ হাসান সে বিকৃতির এক চরম দৃষ্টান্ত বা উদাহরণ।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে একজন নারী। মাতৃময়ী নারী। তাকে এ ঘটনা বিচলিত করবে এটাই স্বাভাবিক। মন্ত্রীত্ব থেকে মুরাদকে বাদ দিতে সময় নেননি তিনি। এজন্যে তাকে অভিনন্দন। তিনি পারেন এবং করে দেখিয়েছেন। কিন্তু সার্বিকভাবে রাজনীতির যে কংকাল বেরিয়ে আসলো তার কী হবে? মুরাদের যেসব ঘটনা এখন প্রকাশ পাচ্ছে সেগুলো কিন্তু নতুন কিছু না। যে অডিও ক্লিপের কারণে তাকে বিপদে পড়তে হলো তাও দু বছর আগের।

হঠাৎ করে সে অডিওটি সামনে এসেছে এবং তারপর ধারাবাহিকভাবে তার অশ্লীল কথাবার্তার যেসব অডিও-ভিডিও বের করা হচ্ছে তাতে আমি অবাক হইনি। কারণ এটাই এখন স্বাভাবিক। মামুনুলের ব্যাপারেও আমরা তাই দেখেছিলাম। দীর্ঘসময় ধরে অসাম্প্রদায়িকতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা সরকার বিরোধিতার নামে উগ্র মত আর বাজে কথা বলার পরও তাদের বিরুদ্ধে কিছুই করা হয়নি। যে মুহূর্তে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বলা হয়েছিল তারপরই টনক নড়ল। অথচ মামুনুলের সবগুলো বক্তব্যই ছিল কোনো না কোনোভাবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শবিরোধী। কিন্তু তখন তাকে সতর্কও করা হয়নি। সবগুলো বিষয়ে আমরা দেখছি যৌনতা, নারী আর অশ্লীলতা সামনে চলে এসেছে।

সাবেক প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসানের ব্যাপারে দুটো বিষয় জড়িত বলে মনে করি। প্রথমত সে অনেকদিন ধরে খালেদা জিয়া তথা জিয়াউর রহমানের পরিবারকে নিয়ে বাজে কথা বলে আসছিল। অথচ এ নিয়ে তার দল বা তার আশেপাশের কেউ কোনো উচ্চবাচ্য করেনি কখনো। এই এক সমস্যা। ভূতপূর্ব তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর কাজও ছিল রোজ একবার খালেদা জিয়াকে গালাগাল করা। ইনু সাহেব যতদিন মন্ত্রী ছিলেন এটাই করে এসেছেন। মন্ত্রীত্ব হারানোর পর তার মুখে হয় কুলুপ নয়তো তিনি কি বলেন তা আর মিডিয়া প্রকাশ করে না। আপদটা এখানেই। রাজনীতিতে বিরুদ্ধাচারণ থাকবে। কিন্তু কতটা বলবে বা বলবে না তারও একটা সীমারেখা নিশ্চয়ই থাকবে। আমরা কোনো আমলেই তা দেখিনি। এরশাদ আমলে কাজী জাফর, মওদুদ আহমেদরা যা মনে আসত তাই বলত। এককালের প্রেসিডেন্ট বদরুদ্দোজা চৌধুরী জ্ঞানী ডাক্তার, এখন অবশ্য নিভে যাওয়া বাতি। তিনিও কত বোল-তাবোল কথা বলতেন। শেখ হাসিনাকে নিয়ে কটূক্তি করতেন। তবে সকলকে ছাপিয়ে গিয়েছিল সালাহউদ্দীন কাদের চৌধুরী। ফাঁসিতে ঝোলার আগেও সাকা চৌধুরী বাজে কথা বলতে পিছ পা হতো না। সংসদের মতো জায়গায় দাঁড়িয়ে একজন মন্ত্রী ও এমপি হিসেবে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তার বক্তব্য ছিল রীতিমতো আপত্তিকর ও ভয়ংকর। কিন্তু কোনো সরকারের আমলেই তাদের শীর্ষ নেতারা কাউকে সাবধান করেনি বরং মজা নিয়েছিল।

মুরাদ হাসানের বিরুদ্ধে আকস্মিক এসব ফাঁস হবার একটা কারণ হয়তো বিএনপির লবিং। তাদের টাকার জোর সবাই কমবেশি জানেন। শুধু টাকাই নয়, সরকারের ভেতর-বাইরে তাদের লোকজন যে সক্রিয় তার প্রমাণ মুরাদ নিজে। একদা ছাত্রদল বা যুবদল করা এই নেতা আওয়ামী লীগের তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী হলো কীভাবে? মজার ব্যাপার হলো, অপরাধ করে ধরা খেলে যেখানে মা-বাবাই সন্তানকে স্বীকার করে না সেখানে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আগ বাড়িয়ে বলে দিলেন মুরাদ তাদের দল করত। এর মানে কী?

আরেকটি বিষয়টি হতে পারে মুরাদের রাষ্ট্রধর্ম বিলের বিরোধিতা। সঙ্গত কারণেই জামায়াত-হেফাজত বা ধর্মীয় দলগুলো এ কথা পছন্দ করবে না। মন থেকে বলুক বা স্টান্টবাজি হোক যেভাবেই বলুক না কেন মুরাদ রাষ্ট্রধর্মের বিরুদ্ধে বলার পর থেকে তার দুশমন বাড়ছিল। এসব কারণেই হয়তো কেঁচোর গর্ত থেকে বেরিয়ে এলো লকলকে সাপ। তবে যাই হোক না কেন এমন অশ্লীল আর রগরগে কথা বলার জন্য তার শাস্তি হওয়াই উচিৎ। এমনকি খালেদা জিয়ার পরিবার নিয়ে বলা কথাগুলোর জন্যও তার দৃষ্টান্তমূলক সাজা হবার দরকার আছে।

মূলকথা হলো আমাদের দেশের রাজনীতিতে এখন আর ভদ্র-সভ্য মানুষের জায়গা নেই। সেটাই প্রমাণ করল মুরাদ হাসান। তার অডিও ক্লিপের ভাষা উল্লেখ করার মতো নোংরা মনের অধিকারী মানুষের সংখ্যা হাতেগোণা। মুরাদ হাসান একজন ডাক্তার, ময়মনসিংহ মেডিকেল থেকে পাশ করা ডাক্তার। ভিডিওগুলোতে দেখছি মঞ্চে গান গাইছে। পোশাকে মর্ডান। কথাও বলতেন বেশ কনফিডেন্স নিয়ে। কিন্তু কথার ভেতর কোনো শালীনতা কিংবা ভদ্রতা ছিল না। আমার প্রশ্ন হচ্ছে এটা কি আসলেই বিচ্ছিন্ন কিছু? আজকে আমাদের সমাজের প্রতিটা স্তরেই এই এক দৃশ্য। উন্নয়নের নামে কিছু টাকাপয়সা, পুল-ব্রিজ বা সড়কের চোখ ধাঁধানো বাস্তবতার আড়ালে বেড়ে উঠছে কুৎসিত মন। আচরণ কথা বা সৌজন্যে এখন আর ভদ্রলোক নয় কেউ। মুরাদের ভাষা শুনলেই বুঝবেন যৌন বিকৃতি কোথায় গিয়ে ঠেকেছে! কিন্তু আমার একটা খটকা থেকে যাচ্ছে সবসময়। এবারের অডিও ক্লিপ শুনে মনে হয়েছে ওপাশের নারীটি অসহায়। আমি তার কথা বলছি না, বলছি সাধারণত এমন কথা যারা বলে তারা একটা সম্পর্কের ভেতর দিয়ে যায়।

দু বছর আগে দেশে গিয়ে মনে হয়েছিল তিনটা বিষয়ে ব্যাপক চর্চা চলছে। এক. টাকা, দুই. নেশা, তিন. নারী। সমাজে সংস্কৃতি নেই, আনন্দ নেই, বিনোদন নেই। আছে শুধু বিকৃতি আর জান্তব উল্লাস। যে যত বড় আর ছোট হোক না কেন এই তিন বিষয়ের বাইরে থাকতে পারছে না। মুরাদ হাসান আরও একটা বিষয় প্রমাণ করল অমানুষ মন্ত্রী হলেও অমানুষই থেকে যায়।

সরকারের জন্য যেমন তেমনি দেশের জন্যও এ এক অশণি সংকেত। ঘটনার পেছনের ঘটনা যাই হোক মুরাদ কাণ্ডে এটা স্পষ্ট আমাদের লাজ-লজ্জা, মান-অপমান, ভয় সব এখন উধাও। যে যত বড় বা মর্যাদার নামে যত বড় পদে মনে হচ্ছে তার বেলায় এই বিষয়গুলো হয়তো আরও ভয়ংকর। যেভাবে শাসিয়ে ধরে এনে ধর্ষণের হুমকি দেয়া হয়েছে তাতে এটা নিশ্চিত চোখের তো বটেই কানের পর্দাও ফেটে গেছে সমাজের।

সময় থাকতে এর বিহিত করার বিকল্প নেই জেনেও আমরা কি ঘুমিয়ে থাকব? সবুর করব আরও এমন একটি কুৎসিত অডিও-ভিডিওর জন্য?