রাজনীতিতে প্রতিপক্ষের সমালোচনা করাটা একটা স্বীকৃত রীতি। সব দেশেই রাজনৈতিক দলের নেতারা প্রতিপক্ষের ত্রুটি-দুর্বলতা খুঁজে বের করেন। নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরতে গিয়ে প্রতিপক্ষের নীতি-কর্মসূচির সীমাবদ্ধতা খুঁজে বের করে সমালোচনা করেন। এটা হয় সীমা ও শালীনতা মেনে, যুক্তিবুদ্ধির আলোকে। সেই কারণেই পৃথিবীর সব দেশে মন্ত্রী-এমপি ও রাজনীতিবিদরা সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত হন। সাধারণ মানুষ তাদের সম্মান করেন। মর্যাদা দেন। তাদের কথা গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচারিত হয়। কিন্তু আমাদের দেশে সামগ্রিক অধঃপতনের ঢেউ রাজনীতিতেও প্রবলভাবে আছড়ে পড়েছে। এখানে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অশালীন ও বিদ্বেষমূলক ভাষায় একে-অপরকে আক্রমণ করেন। রাজনৈতিক নেতাদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কুৎসা রচনা করেন। এমনকি নারী ও শিশুদের নামেও নোংরা মন্তব্য করতেও পিছ পা হন না। এতে নীতি-আদর্শের পাশাপাশি রুচি, শালীনতা বা সৌজন্যবোধকেও ধুলায় মিশিয়ে দেওয়া হয়।
রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের কথাবার্তায় শোভনতার একটা ন্যূনতম মাত্রা থাকা বাঞ্ছনীয়৷ তারা স্থূল, উৎকট ও ক্ষতিকর কোনো মন্তব্য থেকে সচেতনভাবে দূরে থাকবেন– এটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু আমাদের দেশের কিছু রাজনীতিবিদ যেন উল্টোপথে চলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অনুচিত, অশোভন, ক্ষতিকর সব কথার ডালি নিয়ে মাঠে নেমেছেন। রাজনৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধকে ধ্বংস করার সাধনায় মশগুল হয়ে উঠেছেন। তা না হলে তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রীর মতো দায়িত্বশীল ব্যক্তির মুখ থেকে কেন এমন আপত্তিকর বক্তব্য উচ্চারিত হবে?
সম্প্রতি এক ফেইসবুক লাইভ সাক্ষাৎকারে তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, দলটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি তারেক রহমান এবং তার কন্যা জাইমা রহমানকে নিয়ে বেশ কিছু আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন। তার এই বক্তব্য শুভবোধসম্পন্ন মানুষকে ক্ষুব্ধ করেছে। বিভিন্ন নারী ও মানবাধিকার সংগঠনের নেতৃবৃন্দ এই মন্তব্যকে 'অশ্রাব্য ও অশালীন' হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
নারী শিশুদের নিয়ে যৌনতাসূচক মন্তব্য করা, তাদের তথাকথিত 'চারিত্রিক শিথিলতা' তুলে ধরা আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের একটা স্বাভাবিক প্রবণতায় পরিণত হয়েছে। এর অবশ্য একটি ভিন্ন মাত্রাও আছে। কারণ চরিত্রের ওপর কলঙ্ক লেপন বা নিন্দা-অপবাদের রয়েছে অপার শক্তি। চিরকালই নিন্দা-অপবাদ অপরের আচরণ নিয়ন্ত্রণের সেরা অস্ত্র। সেই অস্ত্রটি অহরহই প্রয়োগ করা হয়। নারীর কুৎসা রটিয়ে যে সুখ, সে সুখ আর কিছুতে আছে বলে মনে হয় না।
আমাদের সমাজ পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে মেয়ের জন্ম মানেই পরিবারের ভয়, নিরাপত্তার অনিশ্চয়তা, মেয়ে মানেই দুর্বল যা তাকে পরনির্ভরশীল করে তোলে। সমাজ নিজের প্রয়োজনে ছোটখাটো পরিবর্তন এনে মেয়েদের কিছু সুযোগ সুবিধা দিলেও মূল কাঠামোতে কোনও পরিবর্তন আনতে পারেনি। বদলায়নি সমাজের মানসিকতাও। সমাজ মেয়েদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রাচীন ভারতের মনুর নিষেধাজ্ঞা বা উনিশ শতকের ইংল্যান্ডের ভিক্টোরিয় সামাজিক আদর্শ সযত্নে লালন করে চলছে নতুন নতুন রাংতায় মুড়ে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষের প্রাধান্য অক্ষুণ্ণ রাখার চেষ্টায় নারীকে নিরাপত্তা দেওয়ার অঙ্গীকার থাকলেও তাকে সমানাধিকার দেওয়ার ভয় অবিরাম তাড়া করে চলছে।
আমাদের মধ্যে অনেকেই মনে করেন, আমি ঠিক এমন নই, ছেলে মেয়েকে সমান দেখি। যারা এমনটা মনে করেন, তাদের মধ্যে নিশ্চয় উদারতা আছে, কিন্তু সমাজ তাকে উদারতা দেখানোর যতটা ছাড় দিয়েছে তারা সেইটুকুর মধ্যেই আসা যাওয়া করেন, বেশি উদার হতে গেলে যে আবার সমাজ বহির্ভুত হবেন। যুগ যুগ ধরে বড় বড় রথী-মহারথী, শাস্ত্রকার, পণ্ডিত সমাজের নিয়ম বা কাঠামোতে মাটি লাগিয়ে তাকে মজবুত ও অনমনীয় করেছেন। স্থান, কাল, পাত্র নির্বিশেষে মেয়েদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টাটা প্রায় একই রকম। মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ছাড়া অন্যত্র রাজা বা শাসকের পুত্রসন্তান না থাকলে বা অযোগ্য প্রমাণিত হলে তবেই কন্যাসন্তানকে সিংহাসনে বসানোর কথা ভাবা হয়েছে। নারীর স্থান পুরুষের পরেই রয়ে গিয়েছে প্রাচীন কাল থেকে।
নানা দিক থেকে আমাদের সমাজ অনেক এগিয়েছে। কিন্তু সমাজের মানসিকতা বদলায়নি কোনও অংশেই। নারীর যৌনতা নিয়ে নানা ধরনের কটূ মন্তব্য করে আমরা এখনও শান্তি লাভ করার চেষ্টা করি। এ নিয়ে আমাদের মধ্যে অনুশোচনা পর্যন্ত হয় না। সামাজিক প্রতিবাদ-প্রতিরোধ তো দূরের কথা। আসলে সমাজে একটি বড় কাঠামোর ভেতরে আরও একাধিক ছোট ছোট কাঠামো থাকে। প্রচলিত ঐতিহ্য, আচার-আচরণ, সামাজিক রীতি-নীতি, ধর্ম, শিক্ষা, সংস্কার, আইন, বিবাহব্যবস্থা ও অন্য সব কিছু নিয়ে একাধিক কাঠামো, আর সেই সব কাঠামো নিয়ে বৃহৎ কাঠামো গড়ে উঠেছে। মানুষ জন্মের পর থেকে ধীরে ধীরে সমাজবদ্ধ জীবে পরিণত হয়, সমাজ তাকে কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত শুধু করে না, বরং সে চেতনে বা অবচেতনে ওই কাঠামোর ধারকে পরিণত হয়।
এই সমাজে নারীকে মানুষ হিসেবে দেখার বা সমানাধিকারের কথা বললেই নারীবাদী বলে তির্যক মন্তব্য করা হয়। সমাজের রক্ষণশীল মানুষই শুধু নন বরং অধিকাংশ মানুষ মনে করেন নারীবাদীরা সমাজের পক্ষে বিপজ্জনক, তাদের প্রভাব নেতিবাচক এবং নারীবাদ মেয়েদের উশৃঙ্খলতার পথ দেখায়। নারীবাদ আসলে বহুমাত্রিক; একই সঙ্গে বৌদ্ধিক চর্চা ও রাজনৈতিক আন্দোলন যা লিঙ্গ বৈষম্যের অবসান ও সমানাধিকারের কথা বলে; যাদের আন্দোলনের ফলেই মেয়েরা ভোটদানের অধিকার, সম কাজে সমান বেতন লাভের অধিকার, আরও অন্য অধিকার উপভোগ করছে। তবে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ দেওয়া হলেও যুগ যুগ ধরে নারীকে পিতৃতান্ত্রিক ক্ষমতার জালে আবদ্ধ রাখা হয়েছে। মেয়েদের চালচলন, পোশাক, চরিত্র নিয়ে সমাজের কৌতূহল ও সমালোচনার শেষ নেই। শিক্ষার যথেষ্ট প্রসার হওয়া সত্ত্বেও আজও ধর্ষণের জন্য নারীর পোশাক বা আচরণকে দায়ী করা হয়, ধর্ষকের উদ্দেশ্য বা মানসিকতাকে নয়! কিছু মানুষ অবশ্যই আছেন যারা প্রচলিত ধারণাগুলিকে প্রশ্ন করেন, কিছু পুরাতন ধারণা ভাঙার চেষ্টা করেন, মানসিকতা বদলের কথা বলেন। আবার সমাজ বিশেষ প্রয়োজনে কখনও কিছুটা উদার হয়, মেয়েদের সুরক্ষায় আইন তৈরি হয়, এর ফলে আমরা কিছু পরিবর্তনের আশা দেখি, কিন্তু মূল কাঠামো এক থেকে যায়। পিতৃতন্ত্র এমনই এক কাঠামো, যা যুগ যুগ ধরে অটল। নারীকে সম্মান দেওয়ার যে শিক্ষা সমাজ দেয় সেটি আরোপিত, অনেকাংশে বাহ্যিক যা নারীকে অবদমনের পথ খুলে দেয়।
আমাদের সমাজে কেউ বিতর্কিত কিছু একটা বলে ফেললে সেটা 'তার নিজস্ব মত' বা 'নিজের দৃষ্টিভঙ্গি' বলে উপেক্ষা করা হয়। কিন্তু সেটা আসলে কতখানি নিজস্ব? তাকে গড়ে তোলায় তো অনেকের, অনেক কিছুর অনেক অবদান থাকে। আমাদের পারিপার্শ্বিকই আমাদের শেখায়, কোন পরিস্থিতিতে কেমন ভাবে চলা উচিত, কোন পথে চিন্তা করা উচিত, কী ভাবে প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিত। সেটা যে কেবল অন্যকে গ্রহণ করার মাধ্যমে গড়ে ওঠে তা নয়, বর্জন করার মধ্যে দিয়েও তৈরি হতে পারে। যিনি নিজেকে প্রচলিত সমস্ত মত এবং রীতিনীতির বিপরীতে প্রতিষ্ঠা করতে চান, তাকেও কিন্তু সেই প্রচলিত মত ও রীতিনীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকতে হয়, নয়তো তিনি নিজেকে কীসের বিপরীতে প্রতিষ্ঠা করতে চান, সেটাই স্পষ্ট হবে না।
নারীর সম্মান বা নারীর মর্যদার কথা আমরা বড় মুখ করে বলি। কিন্তু নারীর মর্যাদা আসলে কী, সে উপলব্ধি অধিকাংশেরই নেই। জগতের সব নারীর মধ্যে মা আর বোনকে খুঁজে পাওয়াই হলো নারীকে সম্মান করা— অধিকাংশের কাছেই ধারণাটা এই রকম সম্ভবত। কিন্তু নারী-পুরুষের সম্পর্কটা যে শুধু মা বা বোনের সঙ্গে সন্তান বা ভাইয়ের সম্পর্ক নয়, নারী-পুরুষ যে আরও অনেক রকমভাবে পরস্পরের পরিপূরক, যে নারীকে মা-বোনের চোখে দেখা সম্ভব নয়, তারও যে সুনির্দিষ্ট সম্মান প্রাপ্য, সে কথা বুঝতেই শেখেননি অনেকে। সভ্যতা এগোচ্ছে। কিন্তু সেই অগ্রগতির উপলব্ধিটাকে ধারণ করার মতো শক্তিশালী এখনও হয়ে ওঠেনি সমাজের অনেকটা অংশই।