আয়কর আইন ২০২২ (খসড়া) এবং কিছু প্রস্তাব

জসীম উদ্দিন রাসেল
Published : 4 Dec 2021, 07:28 AM
Updated : 4 Dec 2021, 07:28 AM

আইন যদি সমৃদ্ধ হয় এবং পাশাপাশি তার প্রয়োগটা যদি সঠিকভাবে করা যায় তাহলে সবাই তার সুফল ভোগ করতে পারেন। আয়কর আইন ২০২২ (খসড়া)-তে যে ভালো বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে সেগুলো যদি আরেকটু স্পষ্ট করা যায় তাহলে এর সঠিক ব্যবহারের ফলে করদাতা যেমন একদিকে আইন পালনে উৎসাহী হবেন আবার তেমনি আয়কর কর্মকর্তারাও কম পরিশ্রমে সরকারের জন্য বেশি রাজস্ব আহরণ করতে পারবেন।

আমরা প্রায়ই ডিজিটাল ব্যবস্থার কথা বলে থাকি। এর মূল কারণ হলো, ডিজিটাল বা অনলাইন ব্যবস্থা আমাদের জীবনযাত্রাকে অনেক সহজ করে তুলেছে। এর প্রতিফলন আয়কর আইনেও গত কয়েক বছর দেখা যাচ্ছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কাজ করে যাচ্ছে আয়কর ব্যবস্থাকে ডিজিটালাইজড করার জন্য যার একটি অন্যতম উদ্যোগ হলো ই-টিডিএস/ই-পেমেন্ট ব্যবস্থা।

ই-টিডিএস/ই-পেমেন্ট ব্যবস্থা থেকে আয়কর পরিশোধের তথ্য সংগ্রহ

বছরে দুবার উৎসে করের রিটার্ন দাখিল করার সময় রিটার্নের সঙ্গে প্রমাণ হিসেবে চালানের কপি সংযুক্ত করতে হয়। যদিও বর্তমানে শুধু চালান নম্বর থাকলেই যাচাই করা যায় সরকারি কোষাগারে কর্তনকৃত কর প্রকৃতপক্ষে জমা হয়েছে কিনা। আবার বাৎসরিক রিটার্ন দাখিল করার সময় আয়কর জমা দেওয়ার প্রমাণ হিসেবে চালানের কপি পুনরায় সংযুক্ত করতে হয় যদিও ইতোমধ্যেই সারা বছরের চালানের কপি ট্যাক্স সার্কেলে দুবার জমা দেওয়া হয়েছে।

একটি কোম্পানিতে প্রতিদিন অসংখ্য লেনদেন হয় যার ফলে মাস শেষে চালানের কপির পরিমাণও অনেক বেশি থাকে। বার বার একই চালানের কপি ফটোকপি করায় একদিকে যেমন প্রতিষ্ঠানের খরচ বেড়ে যায় আবার তেমনি সময়ের অপচয় হয়।

এই পুনরাবৃত্তি দুভাবে রোধ করা যায়।

এক. সারা বছর ধরে যে চালানের মাধ্যমে সরকারি কোষাগারে আয়কর জমা দেওয়া হয়েছে সেই চালানগুলোর নম্বর উল্লেখ করে একটি সারসংক্ষেপ জমা দেওয়ার স্পষ্ট বিধান আইনে রাখা।

দুই. ই-টিডিএস/ই-পেমেন্ট সিস্টেমে যারা আয়কর জমা দেবেন তারা ওই সিস্টেম থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ধারা অনুযায়ী কোন খাতে কত টাকার বিপরীতে কত টাকা আয়কর জমা দিয়েছেন তার চালান নম্বরসহ বিবরণী বের হওয়ার ব্যবস্থা রাখা। এই বিবরণী রিটার্নের সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে।

খসড়া আইনে বোর্ড সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা ইলেকট্রনিক, যন্ত্রে পাঠযোগ্য বা কম্পিউটারে পাঠযোগ্য মাধ্যমে রিটার্ন দাখিলের ক্ষেত্র, ফরম ও পদ্ধতি নির্ধারণ করার সুযোগ রাখা হয়েছে। এই উপ-ধারায় যদি উল্লেখ থাকে ম্যানুয়াল পদ্ধতি অথবা ইলেক্ট্রনিক পদ্ধতি ব্যবহার করে রিটার্ন দাখিল করা যাবে তাহলে করদাতারা ই-টিডিএস/ই-পেমেন্ট সিস্টেম ব্যবহারে উৎসাহী হবেন।

করদাতা যে আয় করেন তা থেকেই টিডিএস বা উৎসে কর কর্তন করা হয়। এই আয় যা বিক্রয় হিসেবে কোম্পানি তার আর্থিক প্রতিবেদনে দেখিয়ে থাকেন তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এর ওপরই নির্ভর করে কোম্পানির লাভ-ক্ষতি। সাধারণত বিক্রয় যত বেশি হবে লাভও তত বেশি হবে। এর সঙ্গে সরকারও আয়কর বেশি পাবেন। তাই উপ-কর-কমিশনার কর্তৃক কর নির্ধারণের সময় বিক্রয়ের প্রতি আলাদা দৃষ্টি থাকে।

উপ কর কমিশনার কর্তৃক বিক্রয় প্রাক্কলন

উপ-কর-কমিশনার কর্তৃক কর নির্ধারণের সময় প্রায়ই বিক্রয় প্রাক্কলন করতে দেখা যায়। কোম্পানি আইন ১৯৯৪ অনুযায়ী কোম্পানি অডিটর নিয়োগ করেন এবং আইন অনুযায়ী তারা অডিট সম্পন্ন করে রিপোর্ট ইস্যু করেন। খসড়া আইনের ধারা ৬৫ ও ৬৬ অনুযায়ী কোম্পানিকে হিসাবরক্ষণ এবং আর্থিক প্রতিবেদন নিরীক্ষার কথা বলা আছে। কিন্তু তারপরও এই প্রাক্কলন কর নির্ধারণী আদেশে দেখা যায়।

কোম্পানির বিরুদ্ধে যদি যথাযথ প্রমাণ থাকে যে উক্ত কোম্পানি তার বিক্রয়ের তথ্য গোপন করেছে বা যে ব্যাংক বিবরণী দিয়েছে তার বাইরে অন্য কোনো ব্যাংকে বিক্রয়ের টাকা জমা হয়েছে যা নিরীক্ষিত হিসাব বিবরণীতে উল্লেখ করা হয়নি বা নগদে বিক্রয় ছিল যা প্রদর্শিত হয়নি তাহলে উপযুক্ত প্রমাণ উল্লেখ করে উপ কর কমিশনার বিক্রয় প্রাক্কলন করতে পারবেন। তবে শর্ত হিসেবে, প্রদর্শিত অতিরিক্ত কর কমিশনারের পূর্বানুমোদন নিতে হবে।

এখানে আরও উল্লেখ্য, যদি প্রাক্কলনের পরিমাণ প্রদর্শিত বিক্রয় থেকে ১০% বেশি হয় তাহলে কর কমিশনারের পূর্বানুমোদন নিয়ে তৃতীয় কোনো অডিট ফার্ম দিয়ে নিরীক্ষা করাতে হবে। এবং নিযুক্ত অডিট ফার্মের রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে উপ কর কমিশনার বিক্রয় প্রাক্কলন করতে পারবেন।

খসড়া আইনের ধারা ৫১-তে উল্লেখ রয়েছে, করদাতার পরিসম্পদের ন্যায্য বাজার মূল্য ঘোষিত মূল্য অপেক্ষা ১৫% অধিক হলে উপ কর কমিশনার পরিদর্শী অতিরিক্ত কর কমিশনারের পূর্বানুমোদন নিতে হয়। এই একই নীতি যদি বিক্রয় প্রাক্কলনের ক্ষেত্রে অনুসরণ করা যায় তাহলে করদাতা এবং কর কর্তৃপক্ষের মধ্যে সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব তৈরি হবে। এর অন্যথা হলেই দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হতে পারে যার কারণে আপিল এবং পরে ট্রাইব্যুনালে যাতে হয়।

আপিলাত ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা

বর্তমানে প্রতিনিয়তই প্রযুক্তির দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। এর সঙ্গে লেনদেনের প্রকৃতিও পরিবর্তিত হচ্ছে। ট্রান্সফার প্রাইসিং, ডিজিটাল সার্ভিসেস ট্যাক্স ইত্যাদি আয়কর ব্যবস্থাকে আরও জটিল করে তুলছে। এমনিতেই কোম্পানির আর্থিক বিবরণী বেশ জটিল। এমন অবস্থায় আয়কর নির্ধারণ এবং বিরোধ নিষ্পত্তিতে হিসাববিদদের অন্তর্ভুক্ত করা হলে একদিকে যেমন আয়কর নির্ধারণ করা যাবে আবার তেমনি দ্রুত সময়ের মধ্যে করদাতা এবং কর কর্তৃপক্ষের মধ্যে বিরোধ নিষ্পত্তিও করা যাবে।

খসড়া আইনের ৩২৭ ধারায় বোর্ডের সদস্য, কর কমিশনার, চার্টার্ড একাউন্টেন্ট, কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউনটেন্ট, আইনজীবী হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী ব্যক্তি আপিলাত ট্রাইব্যুনালের সদস্য হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার আইন রয়েছে। প্রতিটি বেঞ্চ দুই সদস্যবিশিষ্ট হয়ে থাকে। একজন সদস্য বোর্ডের বা কর কমিশন থেকে এবং অন্যজন চার্টার্ড অ্যাকাউনটেন্ট বা কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউনটেন্ট বা আইনজীবীর সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয় তাহলে প্রসাশনিক এবং প্রফেশনাল অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তি করা সহজ হবে।

তবে আপিলাত ট্রাইব্যুনালে বিরোধ নিষ্পত্তি করার আগে বিক্ষুব্ধ ব্যক্তি কর কমিশনার (আপিল)-এ যান। তাই কর কমিশনার (আপিল) নিয়োগেও সমান গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ, যত দ্রুত বিরোধ নিষ্পত্তি করা যাবে তত দ্রুত সরকার রাজস্ব আহরণ করতে পারবে।

কর কমিশনার (আপিল) নিয়োগ

কর কমিশনার (আপিল) নিয়োগে সমান সংখ্যক কর কর্মকর্তা এবং চার্টার্ড অ্যাকাউনটেন্ট বা কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউনটেন্ট বা আইনজীবীর সমন্বয়ে হতে হবে। উপ কর কমিশনার কোম্পানির কর নির্ধারণের পর করদাতা কর আদেশ পাওয়ার পর যেকোনো আদেশের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ হতে পারেন। বর্তমানে জটিল ব্যবসা প্রকৃতির কারণে এই সংক্ষুব্ধের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে করে আপিল এবং ট্রাইব্যুনালে মামলার পরিমাণ বাড়ছে। একদিকে সৃষ্টি হচ্ছে মামলাজট অন্যদিকে দীর্ঘদিন ধরে মামলা অনিষ্পন্ন থেকে যাওয়ার ফলে সরকারের রাজস্ব আহরণে বিলম্ব হচ্ছে।

এমতাবস্থায়, কর কমিশনার (আপিল) পদে যদি চলমান কর কর্মকর্তার পাশাপাশি সমান সংখ্যক চার্টার্ড অ্যাকাউনটেন্ট বা কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউনটেন্ট বা আইনজীবী নিয়োগ করা হয় তাহলে তারা কোম্পানির লেনদেনের জটিল বিষয় এবং আইনি বিষয়ে আপিল পর্যায়েই নিষ্পত্তি করতে পারবেন। আপিলাত ট্রাইব্যুনালে যাওয়ার আগেই মামলা নিষ্পত্তি হয়ে যাবে। সরকার অল্প সময়ের মধ্যেই যেমন রাজস্ব আহরণ করতে পারবে আবার তেমনি করদাতা কোম্পানির কন্সালটেন্সি ফিও কমবে।

মূলত করদাতা আপিল এবং ট্রাইব্যুনালের শরণাপন্ন হন যদি তিনি মনে করেন উপ কর কমিশনার কোম্পানির নিরীক্ষিত আর্থিক বিবরণীকে যথাযথভাবে বিবেচনা না করে আয়কর নির্ধারণ করেছেন। যেহেতু আয়কর নির্ধারণ শুরু হয় উপ কর কমিশার থেকে তাই শুরুটাতে যদি গুরুত্ব দেয়া যায় তাহলে নিম্ন পর্যায়েই অনেক বিষয় নিষ্পত্তি হয়ে যাবে। কিন্তু যারা উপ কর কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তারা এক সময় সহকারী কর কমিশনার হিসেবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে যোগদান করেন।

সহকারী কর কমিশনার (বিসিএস) নিয়োগ

কর নির্ধারণ শুরু হয় উপ কর কমিশনার পর্যায়ে যা সরকারের রাজস্ব আহরণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কোম্পানির আর্থিক বিবরণীর মতো জটিল বিবরণী বিশ্লেষণ করে কর নির্ধারণ করতে হয়। কিন্তু এই আর্থিক বিবরণী প্রস্তুত সম্পর্কে যথেষ্ট পড়ালেখা না থাকলে তা বিশ্লেষণ করা দুরূহ। তাই ব্যবসা শিক্ষা শাখায় যারা জ্ঞান অর্জন করেছেন তাদের যদি কর নির্ধারণের সঙ্গে যুক্ত করা যায় তাহলে কর নির্ধারণ বাস্তবসম্মত হবে।

সহকারী কর কমিশনার পদে যারা নিয়োগপ্রাপ্ত হন তারা বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে পরে পদোন্নতি পেয়ে উপ কর কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাই যখন সহকারী কর কমিশনার পদে নিয়োগ দেয়া হবে তখন ব্যবসা শিক্ষা শাখা থেকে যারা ডিগ্রি অর্জন করেছেন কেবলমাত্র তারাই যেন কর কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পান সেই বিধান রাখতে হবে।