একি মন্তব্য করলেন বিচারক কামরুন্নাহার!

শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকশামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক
Published : 15 Nov 2021, 02:17 PM
Updated : 15 Nov 2021, 02:17 PM

একজন বিচারকের অদক্ষতা সমাজ জীবনে যে চরম অমানিশা নামিয়ে আনতে পারে, তার প্রমাণ পাওয়া গেল নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতের বিচারক কামরুন্নাহারের রাজধানী বনানির রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণের মামলায় এখতিয়ারবহির্ভূত পর্যবেক্ষণ এবং রায় দিয়ে । বহু আলোচিত ওই ধর্ষণ মামলার রায় দিতে গিয়ে তিনি যেসব মন্তব্য করেছেন তা একদিকে যেমন আইনের সাথে সাংঘর্ষিক ও অবিশ্বাস্য, অন্যদিকে ভয়ংকরও বটে।

তিনি লিখেছেন, 'ধর্ষণের অভিযোগের ৭২ ঘণ্টা পরে পুলিশ যেন ধর্ষণের অভিযোগে এজাহার গ্রহণ না করে।'  এই উদ্ভট মন্তব্যের পেছনে যে কারণটি তিনি বোঝাতে চেয়েছেন তা হলো- এতো সময় পরে ধর্ষিতার দেহে আর আসামির বীর্য উপস্থিত থাকে না। এ কথা বলে তিনি প্রমাণ করেছেন যে তার মেডিকেল জুরিসপ্রুডেন্সে জানাশোনার সীমাবদ্ধতা রয়েছে। অথচ ফৌজদারি মামলার সাথে জড়িত, বিশেষ করে খুন ধর্ষণের মামলার সাথে জড়িত সকল আইনজ্ঞ এবং বিচারকদের মেডিকেল জুরিসপ্রুডেন্সে জ্ঞান এতোই অপরিহার্য যে এ ছাড়া খুন ধর্ষণের মামলা করা অসম্ভব। বিচারক কামরুন্নাহারের যদি মেডিকেল জুরিসপ্রডেন্সে ন্যূনতম জ্ঞানও থাকতো তাহলে তিনি জানতেন যে বীর্য বিশ্লেষণই ধর্ষণ প্রমাণের একমাত্র সাক্ষ্য নয়। এটি প্রয়োজন হয় ডিএনএ- এর উপস্থিতি পরীক্ষার জন্য। কিন্তু ডিএনএ ছাড়াও ধর্ষণ প্রমাণের বহু পন্থা রয়েছে। 

মেডিকেল জুরিসপ্রুডেন্স- এর অতি পরিচিত লেখক অধ্যাপক জয়সিং মুদি লিখেছেন, ধর্ষণের চিহ্ন ধর্ষিতার সারা দেহেই থাকতে পারে। যেমন- ধর্ষিতার বাহুতে, হাতের কব্জিতে, মুখে, বক্ষদেশে, বিশেষ করে স্তনে, তলপেটের নিম্নাংশে, উরুতে এবং পিঠে। এসব এলাকায় নখের আঘাতের দাগ, ক্ষতচিহ্ন, ফুলে যাওয়া বা জোর প্রয়োগের চিহ্ন থেকে ধর্ষণের প্রমাণ পাওয়া যায়। এছাড়া বক্ষদেশে স্তনবৃন্তে, গালে, ঠোঁটে কামড়ের দাগও ধর্ষণ প্রমাণের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। তবে ধর্ষিতার যৌনাঙ্গের ক্ষতকেই অধ্যাপক মুদি বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ধর্ষণের বহু পরেও যৌনাঙ্গ থেকে মৃদু রক্তপাত হতে পারে। তদুপরি যৌনাঙ্গের অভ্যন্তরে এবং আশেপাশে দাগ, রক্তাক্ত লাল অবস্থা, ছেঁড়া ও ফোলা অবস্থা, ক্ষতও বড় প্রমাণ। মুদির ভাষ্য, ধর্ষণের ৮/১০ দিন পরে এসব চিহ্নগুলো ধীরে ধীরে কমতে থাকলেও বহুদিন পর্যন্ত তা নির্ণয় করা যায়। তিনি লিখেছেন, যৌনাঙ্গের অভ্যন্তরের পোস্টারিয়ার এবং বাইরে ভালবা এলাকায় ছিঁড়ে যাওয়ার চিহ্ন থাকা খুব স্বাভাবিক, যা কয়েকমাসেও সেরে যায় না। ভালবা  অঞ্চলেও ছোট/বড় ক্ষত পাওয়া যায়। এসব এলাকায় ধস্তাধস্তির প্রমাণও বহুদিন থাকে। যৌনাঙ্গের নালিতেও ধর্ষণের চিহ্ন থাকে। মুদি এবং আলেকজান্ডার উভয়েই লিখেছেন- ধর্ষণ এবং স্বাভাবিক যৌন সম্পর্কের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য হলো এই যে, ধর্ষণে বলপ্রয়োগের কিছু না কিছু চিহ্ন থেকেই যায়, যা বহুকাল পরেও নির্ণয় করা যায়। 

বহু আলোচিত ইয়াসমিন ধর্ষণ-হত্যা মামলা হাইকোর্টে পরিচালনার ভার পড়েছিল আমার ওপর। আমি তখন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল। ইয়াসমিন মামলা দায়েরেও বেশ বিলম্ব হয়েছিল। তার মৃতদেহে বীর্যের কোনও চিহ্নই ছিল না। সে সময়ে ডিএনএ পদ্ধতিও আবিষ্কৃত হয়নি। তারপরও যৌনাঙ্গের এবং দেহের অন্যান্য স্থানের ক্ষত, আঘাতের চিহ্ন, ফোলা অবস্থা, দাগ, নখের প্রয়োগের চিহ্ন এবং বলপ্রয়োগের বিভিন্ন প্রমাণ থেকেই হাইকোর্ট নিশ্চিত হয়েছিল যে ইয়াসমিনকে ধর্ষণ করে পরে পুলিশের গাড়ি থেকে ফেলে দেওয়ায় তার মৃত্যু হয়েছিল। সেই মামলায় তিনজন পুলিশ সদস্যের ফাঁসি হয়েছিল। তাছাড়া বহু আলোচিত বরিশালের স্মৃতি কণা ধর্ষণ মামলায় হাইকোর্ট পরিষ্কারভাবে বলেছিল, 'আদালত যদি ধর্ষিতার একক সাক্ষ্যকে বিশ্বাসযোগ্য মনে করে, তাহলে ধর্ষিতার একক সাক্ষ্যের ভিত্তিতেই আসামির সাজা হতে পারে।' ওই মামলায় স্মৃতি কণার একক সাক্ষীর ভিত্তিতেই হাইকোর্ট আসামিকে সাজা দিয়েছিল। আপিল বিভাগও সেই রায় অনুমোদন করেছিল বিধায় এটি এখন দেশের আইন। বিচারক কামরুন্নাহার নিশ্চয়ই সেই রায়টি পড়ে দেখেননি। অথচ এই যুগান্তকারী রায়টি ধর্ষণ মামলার সাথে সম্পৃক্ত সকলের জানা উচিত।

বিচারক কামরুন্নাহার আর একটি অমার্জনীয় অন্যায় করেছেন এই বলে যে, 'ধর্ষণের অভিযোগ আনা দুই নারী  আগে থেকেই যৌন কার্যকলাপে অভ্যস্ত'। ধর্ষণের মামলায় এ ধরনের তথ্য বিবেচনায় নেওয়া শুধু আইনবিরোধী নয়, মারাত্মক ধরনের বিকৃতিও বটে। পৃথিবীর অনেক দেশের সাক্ষ্য আইনেই ধর্ষিতদের যৌনজীবনের ওপর কোনও প্রশ্ন করতে দেওয়া হয় না, যা সম্ভবত আমাদের দেশেও হতে যাচ্ছে। আইন অনুযায়ী এমনকি একজন যৌনকর্মীও উপযুুক্ত ক্ষেত্রে ধর্ষণের মামলা করতে পারেন। 

বিচারক কামরুন্নাহার বিচার জগতে নবাগত নন। তিনি জেলা জজ মর্যাদার বিচারক, অর্থাৎ বেশ জ্যেষ্ঠ। অথচ তার মন্তব্যগুলো থেকে ধরে নেওয়া যায় আইনের ব্যাপারে তার শিক্ষা বা জ্ঞান একজন সাধারণ মানুষের মতো। তার মন্তব্য নতুন করে প্রমাণ করছে নিম্নআদালতের বিচারকদের ব্যাপক প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন।

মাননীয় প্রধান বিচারপতি কামরুন্নাহারের বিচারিক ক্ষমতা রুদ্ধ করে খুবই প্রশংসনীয় কাজ করেছেন। কেননা তার মতো শিক্ষা এবং জ্ঞান বিবর্জিত বিচারকের রায় সর্বদাই ভ্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকবে। আমি হাইকোর্টের বিচারপতি থাকাকালে একজন অতি জৈষ্ঠ জেলা ও দায়রা জজের বিচারিক ক্ষমতা রুদ্ধ করে দিয়েছিলাম, কারণ সেই জেলা জজ একটি খুনের মামলায় আপস মেনে নিয়ে রায় দিয়েছিলেন।

বিচারক কামরুন্নাহারের ধ্বংসাত্মক মন্তব্যগুলোকে মুছে না ফেললে তার মারাত্মক ফলাফল রয়ে যাবে। এর ফলে পুলিশ ধর্ষণ মামলা গ্রহণ করতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলবে। তাই এগুলো অবশ্যই মুছে ফেলার উদ্যোগ নেওয়ার জন্য রায়টি হাইকোর্টে নিয়ে যেতে হবে।

বহু দেশে ধর্ষণের কয়েক বছর পরও মামলা শুধু নেওয়া হয়নি, বিচারে সাজাও দেওয়া হয়েছে। বিচারক কামরুন্নাহারের তো এগুলো জানার কথা। এটাও মনে রাখা প্রয়োজন যে, ডিএনএ শুধু বীর্য, রক্ত বা লালা থেকেই পাওয়া যায় না, নখ, চুল, খসে যাওয়া চামড়া, দাঁত প্রভৃতি থেকেও পাওয়া যায়।  পরিধেয় বস্ত্রেও বীর্য, রক্ত, চুল মাসের পর মাস থেকে যেতে পারে। যেগুলো থেকেও ডিএনএ নেওয়া যায়। প্রতিটি বিচারককেই এগুলো শেখানো প্রয়োজন। এছাড়া স্মৃতি কণা মামলার রায়সহ ভারত, যুক্তরাজ্য প্রভৃতি দেশের সেই সমস্ত রায়সমূহ পড়াতে হবে যেগুলোয় বলা হয়েছে, আদালত বিশ্বাসযোগ্য মনে করলে ধর্ষিতা বা নির্যাতিতার একক সাক্ষ্যেই আসামির সাজা হতে পারে।