দুর্গাপূজায় সাম্প্রতিক তাণ্ডব: কারণ, দায় ও করণীয়

শিশির ভট্টাচার্য্যশিশির ভট্টাচার্য্য
Published : 6 Nov 2021, 01:56 PM
Updated : 6 Nov 2021, 01:56 PM

'মা, ওরা বাবাকে মারলো কেন?' ক্রন্দনরত ছেলেকে কী উত্তর দেবে সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক হামলায় নিহত কোনো যুবকের তরুণী, বিধবা স্ত্রী? অন্তর্জালে একটি ছবিতে দেখলাম, চার বছরের অবুঝ ছেলেটিকে কোলে নিয়ে নির্বাক বসে আছেন এরকমই একজন।  দৃষ্টিতে ভয়, শোক কিংবা কোনও প্রকার অনুভূতিই নেই। একেবারে থ হয়ে গেছে বধূটি দুর্ঘটনায় আকস্মিকতায়। কেউ বলছে, লাঠির আঘাতে, কেউ বলছে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছে তার স্বামী। লাঠির আঘাত গুজব হতে পারে, কিন্তু হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া যে তার বন্ধ হয়ে গেছে সেটা তো মিথ্যা নয়।

স্বাধীনতার পঞ্চাশতম বার্ষিকীতে এ তরুণী বিধবা এবং তার দুধের বাচ্চাটির দিকে তাকানোর মতো মুখ আমাদের নেই। এমন এক ভূখণ্ডে আমরা জন্ম নিয়েছি, অনেক চেষ্টাতেও যা একটি কার্যকর 'রাষ্ট্র' হয়ে উঠতে ব্যর্থ হচ্ছে বার বার। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাতো দূর কী বাত। এবারকার দুর্গাপুজার দুর্গতদের বিচারে, তাণ্ডবের মাপকাঠিতে অন্তত, ইয়াহিয়ার পাকিস্তানের সঙ্গে 'উন্নয়নশীল' বাংলাদেশের মৌলিক কোনো তফাৎ নেই। 

দুর্গাপূজাকালীন সাম্প্রতিক তাণ্ডবের কমবেশি যে ২০টি কারণ পাঠ্য-দৃশ্য-শ্রাব্য-সামাজিক-বুনিয়াদি গণমাধ্যমে কিংবা লোকজনের সঙ্গে আলাপে জানলাম-শুনলাম-দেখলাম, সেগুলো নিম্নরূপ: 

১. প্রশাসনের সহায়তা কিংবা মদদে এ হামলা হয়েছে, কারণ ক্ষমতাসীন দল দেখাতে চায় যে তাদের ভোট দেওয়া ছাড়া সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু নির্বিশেষে বাংলাদেশের জনগণের গতি নেই।

২. এই হামলার পিছনে কলকাঠি নেড়েছে বিরোধী দল, কারণ তারা দেখাতে চায় যে ক্ষমতাসীন দল জনগণের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ।

৩. বাংলাদেশের শিক্ষা, সমাজ, রাজনীতি মানুষকে সাম্প্রদায়িক করে তুলেছে আশির দশক থেকে। বাংলাদেশে বিদ্যমান গত কুড়ি বছরের বিশেষ সমাজ-রাজনৈতিক আবহের কারণে সংখ্যাগুরু গোষ্ঠী সংখ্যালঘুদের ঘৃণা করতে শুরু করেছে। 

৪. এই সব হামলার উদ্দেশ্য, স্রেফ হিন্দুর জমি দখল। যত দাঙ্গা হবে, তত বেশি হিন্দু দেশ ত্যাগ করবে। একটি গোষ্ঠী মনেপ্রাণে চায়, বাংলাদেশে হিন্দুর শতকরা সংখ্যা অচিরেই এককের ঘরে চলে আসুক এবং কয়েক দশকের মধ্যে পাকিস্তান-আফগানিস্তানের মতো শূন্যের কোঠায় চলে যাক। হিন্দুদের ফেলে যাওয়া খালি জায়গায় রোহিঙ্গা ভাইয়েরা থাকতে পারবে। 

৫. কুমিল্লার হামলার কারণ স্থানীয় রাজনীতি- কোনো নেতা নিজের প্রভাব প্রদর্শন এবং/অথবা অন্যের প্রভাব ক্ষুণ্ণ করার জন্যে পরিকল্পিতভাবে হনুমানকাণ্ড ঘটিয়েছেন। 

৬. হাজার হাজার পূজামণ্ডপের মধ্যে ৪/৫টি হামলা হতেই তো পারে, এক বস্তা চালেও কি কয়েকটি কাঁকড় থাকে না?

৭. অতিরিক্ত সংখ্যায় পূজা হচ্ছে, সরকারি চাল খয়রাত পাবার জন্যে হিন্দুরা যেখানে-সেখানে পূজামণ্ডপ তুলেছে। সরকার বেডরুমের নিরাপত্তা দিতে পারবে না বলেছে, পূজামণ্ডপের নিরাপত্তা কীভাবে দেবে? 

৮. ভারতেও বর্ণহিন্দুরা হরিজনদের পূজামণ্ডপে হামলা করেছে। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুরা তো এক অর্থে হরিজনই, কারণ হরি তাদেরও দেবতা এবং তাদের সর্বস্ব হরণ করা সংখ্যাগুরুর পক্ষে জায়েজ বটে! সুতরাং উচ্চবর্ণের সংখ্যাগুরু নাগরিকেরা তাদের পূজামণ্ডপে আক্রমণ করতেই পারে! 

৯. 'উৎসব সবার, ধর্ম যার যার!' এই শ্লোগান দিয়ে মুমিনদের বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। এক ধর্মের উৎসবে অন্য ধর্মের লোক সামিল হতে পারে না, বিশেষ করে মূর্তিপূজা হচ্ছে শিরক এবং দুর্গাপূজা হচ্ছে বাংলাদেশে শিরকের সর্ববৃহৎ আয়োজন।

১০. সংখ্যালঘুর ওপর এ আক্রমণ হয়েছে, যাতে এই অজুহাতে একটি গোষ্ঠী বাংলাদেশের সংবিধান ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে ধর্মনিরপেক্ষ করে তোলার দাবি তুলতে পারে। ধর্মনিরপেক্ষতা মানেই ধর্মহীনতা এবং তৌহিদী জনতা কখনই ধর্মনিরপেক্ষতাকে মেনে নিতে পারে না। সংখ্যালঘুর উপর এই হামলা তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী গোষ্ঠীর একটি চক্রান্ত বৈ নয়।

১১. আওয়ামী লীগ এখন তিনটি পৃথক দলের সমাহার: ক. ধর্মান্ধ আওয়ামী লীগ (যার ভিতরে আছে ক্লিনশেভ করা/হিজাব-খোলা বর্ণচোরা জামাত ও বিএনপি সমর্থক, ক্ষমতাকে যারা ঘিরে ফেলেছে), খ. ধান্দাবাজ আওয়ামী লীগ এবং মাঠে-ঘাটে ত্যাগী আওয়ামি লীগ। ধর্মান্ধ আওয়ামী লীগ সামাজিক গণমাধ্যমে জঙ্গি হুজুরদের সাম্প্রদায়িক প্রচারণা চালাতে দিচ্ছে এবং ধান্দাবাজ আওয়ামী লীগ ফোকটে নিজের স্বার্থ উদ্ধার করছে। ত্যাগী আওয়ামী লীগ ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চার মতো হতাশ তাকিয়ে আছে। 

১২. ক্ষমতাসীন দল, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সব জায়গায় সাম্প্রদায়িক মানসিকতার লোকজন ঢুকে বসে আছে। তারা সময়মতো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে না, কিংবা নিতে গড়িমসি করছ। তারা আদেশ দিচ্ছে না, কিংবা আদেশ মানছে না, কিংবা আদেশ মানার ভান করছে। সর্বাঙ্গে ব্যথা, ঔষধ দিব কোথা? 

১৩. সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা ব্যর্থ হয়েছে, যেমনটা তারা ব্যর্থ হয়েছিল কর্তৃপক্ষকে পিলখানা বিদ্রোহ, মোদির আগমন উপলক্ষে ঘটানো তাণ্ডবের পূর্বাভাস দিতে। 

১৪. দেশে বহুদিন যাবৎ কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন হচ্ছে না। সত্যিকার গণতন্ত্রের দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে এমনতরো অনাচার ঘটারই কথা! 

১৫. সংখ্যালঘুর ওপর হামলার অপরাধীরা যেহেতু সরকারি দলের প্রভাবশালী সদস্য, সেহেতু তাদের শাস্তি দেওয়া যায় না। রামু, নাসিরগর ইত্যাদি ঘটনার না হয়েছে ঠিকমতো তদন্ত, না হয়েছে চিহ্নিত অপরাধীদের শাস্তি! শাস্তির বদলে দলীয় অপরাদীদের দেয়া হয় পুরস্কার, যেমন সম্প্রতি নাসিরনগরের চিহ্নিত দুই সন্ত্রাসী নির্বাচনে মনোনয়নও পেয়েছিল ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে।  বিচার ও শাস্তির অনুপস্থিতিতে দলীয় কুচক্রীদের সাহস দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে। 

১৬. বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এবং বাংলাদেশ ৯০% ভাগ মুসলমানের দেশ। দুর্গাপূজা হচ্ছে শিরক এবং মুসলমানকে শিরকের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতেই হবে। কাবাশরীফের মূর্তিগুলো ভাঙা হয়েছিল, লাত, উজ্জা ইত্যাদি দেবীর মূর্তি ধ্বংস করতে রসুল (স.) নিজে আদেশ দিয়ে পাঠিয়েছিলেন খালেদ বিন ওয়ালিদকে। 

১৭. সংখ্যালঘুদের মধ্যেও সাম্প্রদায়িক মানসিকতা আছে। তারও ধোয়া তুলসীপাতা নয়, কারণ কখনই তারা স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি কিংবা বিএনপি-জামাতকে ভোট দেয় না। সুতরাং হামলার জন্য তারাও কিছুটা দায়ীতো বটেই। 

১৮. বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা সৃষ্টি করা হয়েছে, যাতে ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গসহ সারা ভারতে বিজেপি ও মোদির গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়। এ কারণেই মোদি সরকার এই হামলার ব্যাপারে চুপচাপ। এর প্রমাণ, ইতিমধ্যে ত্রিপুরায় মুসলিম সংখ্যালঘুদের বাসস্থান ও ধর্মস্থানে হামলা হয়েছে। ভুক্তভোগীদের কেউ কেউ বলছে, গত ত্রিশ বছরে বাম ও কংগ্রেস শাসনে তারা এমন হামলা দেখেনি। বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই হামলা শুরু হয়েছে। 

১৯. হিন্দুদের উপর হামলার কারণ, ৭২ এর সংবিধান, যাতে ধর্মনিরপেক্ষতা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা যদি না থাকতো, সংবিধান যদি পাকিস্তানের মতো ইসলামী প্রজাতন্ত্র হতো, তাহলে হিন্দুরা নিরাপদে থাকতো পাকিস্তানে এবং বাংলাদেশে।

২০. হিন্দুরা পাকিস্তান আমল থেকে একের পর এক ভুল করে আসছে। পাকিস্তানের জন্মের পর পরই তারা প্রথমে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছে এবং তারপর যুক্তফ্রন্ট এবং আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেছে। পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ করাতে হিন্দু এবং হিন্দু ভারতের ভূমিকাই প্রধান। পাকিস্তানের মূল চেতনার বিরোধী হওয়াতেই হিন্দুদের ওপর যত হামলা, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ আমলে।

উপরোক্ত কারণগুলোর মধ্যে কোনটি বা কোনগুলো সত্য তা আমরা কখনই জানতে পারবো না, কারণ এসব নিয়ে কোনো গুণগত বা সংখ্যাগত গবেষণা আগেও হয়নি, এবারও হবে না। ১৯৪৭ সাল থেকে পূর্ববঙ্গে শত শত সাম্প্রদায়িক হামলা হয়েছে বটে, কিন্তু সরকার কখনও জানতে দেয়নি, দাঙ্গার জন্যে কে দায়ী। পাকিস্তান আমলে একটি গোষ্ঠীর চেষ্টা ছিল, সব হিন্দু ভারতে চলে যাক। বঙ্গবন্ধু বহু চেষ্টা করেছেন পূর্ববঙ্গের দাঙ্গা থামাতে, সোহরাওয়ার্দী তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ার জলাঞ্জলি দিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের রক্ষা করার দুশ্চিন্তায়। 

এখন একটি গোষ্ঠী চেষ্টা করছে, বাঙালি মুসলমান যেন ১৯৪৭ এর ঘোর থেকে বের হতে না পারে, সে যেন ভুলে যায়, ১৯৭১ সালে একটি মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। এদের সাম্প্রতিক দর্শনটা হচ্ছে এরকম: 

"১৯৭১ এর যুদ্ধ আসলে স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিল না, এটি ছিল মূলত লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়নের চেষ্টা। লাহোর প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, ভারতের দুই প্রান্তে দুটি মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্র থাকবে। দুর্ভাগ্যক্রমে পূর্বপ্রান্তের রাষ্ট্রটির নাম 'বাংলাদেশ', নামটি ইষৎ 'না-পাক', কিন্তু তাতে কী, লাহোর প্রস্তাবে তো দেশ দুটির কোনো নাম ছিল না!" 

সংখ্যালঘুরা যত বেশি সংখ্যায় বাংলাদেশ ছেড়ে যাবে, ততই পূর্বপ্রান্তের দেশটি অধিকতর মুসলিম প্রধান হয়ে উঠবে, ঠিক যেভাবে পাকিস্তানে সংখ্যালঘুর সংখ্যা কয়েক লক্ষ, কিংবা আফগানিস্তানে কয়েক হাজারে নেমে গেছে। উপমহাদেশের দুই প্রান্তে সংখ্যালঘুর সংখ্যার পারদ ক্রমহ্রাসমান। বাংলাদেশে হিন্দুদের সংখ্যা এককের সর্বনিম্ন ঘরে নিয়ে আসার পর যে কয়েক লক্ষ তখনও ভাগশেষ থাকবে, 'এক হাতমে তলোয়ার, আরেক হাতমে গ্রন্থ' নিয়ে তাদের সামনে দাঁড়ালেই আফগানিস্তানের কাফির জনগোষ্ঠীর মতো তারা সদলবলে ধর্মান্তরিত হবে। কাফিরিস্তানের ধর্মান্তরিত নাম আজ 'নূরিস্তান'। 

কোনো সাম্প্রদায়িক হামলাই স্বতঃস্ফূর্ত নয়, ১০০ শতাংশ আরোপিত। সব হামলাই আসলে হোলি আর্টিজান, পার্থক্য শুধু তীব্রতা ও গুরুত্বের। প্রতিটি হামলার একটি গ্রাহকগোষ্ঠী থাকে এবং তারা হামলার বরাৎ দেয়। প্রতিটি এলাকায় একাধিক হামলা সরবরাহকারী গোষ্ঠীও থাকে, কারণ অর্থনীতির নিয়মে চাহিদা থাকলে সরবরাহ থাকবেই। গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা/নিলামের ভিত্তিতে হামলার বরাৎ দেওয়া হয়, অনেকটা পদ্মা বা যমুনা সেতুর মতো। হলি আর্টিজানের হামলা, শ্রীলঙ্কায় বোমা হামলার জন্য আন্তর্জাতিক নিলাম হওয়ার কথা এবং কুমিল্লা বা রংপুরের হামলার জন্যে হয়তো আন্তর্জাতিক/আঞ্চলিক/আভ্যন্তরীণ নিলাম হয়েছে। কোথায় হামলা হবে, কখন হবে, কীভাবে হবে, সব পূর্বনির্ধারিত। একাধিক রেস্টুরেন্ট বেছে নিব্রাসরা অবশেষে হলি আর্টিজানে ঢুকেছিল।

হামলার বরাৎ যারা দেয়, তাদের কত রকম স্বার্থ থাকতে পারে। এই যেমন ধরুন, বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক শান্তি বিঘ্নিত হলে ত্রিপুরার নির্বাচনে বিজেপি ভাল ফল করার কথা। বাংলাদেশে বিরোধীদল দীর্ঘ এক যুগ ক্ষমতায় নেই। অপেক্ষার, সহ্যেরও তো একটা সীমা আছে, নাকি! ওরা হয়তো বলবে, ক্ষমতাসীনেরাই এর বরাৎ দিয়েছে, প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাবর যেমন বলেছিল, 'শেখ হাসিনাই পল্টনে নিজের ওপর গ্রেনেড হামলা করিয়েছে!' ষড়যন্ত্রতত্ত্ব মতে সবই সম্ভব। এ সবই অবশ্য আমার কল্পনা, তবে রবীন্দ্রনাথ যেমন লিখেছেন: 'কবি তব মনোভূমি রামের জনমস্থান অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো!' 

পুরাণে দুই অসুরের গল্প আছে: বাতাপি ও ইল্বল। কোনো ঋষিকে দেখামাত্র ইল্বল মহা সমাদরে তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যেতো। ইতিমধ্যে বাতাপি ছাগলের রূপ ধারণ করতো এবং ইল্বল ভাইকে কেটে রান্না করে খাওয়াতো ঋষিবরকে। খেয়েদেয়ে ঋষি যখন তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছেন, তখন ইল্বল 'বাতাপি বাতাপি' বলে ডাক দিতো। বাতাপি তখন স্বরূপ ধারণ করে ঋষির পেট ফুঁড়ে বেরিয়ে আসতো, যার ফলে বেঘোরে মৃত্যু হতো সেই ঋষির। ঋষিহত্যা থামাতে অগ্যস্ত মুনি আসলেন একদিন ইল্বলের অতিথি হয়ে। ইল্বল তাকে পাদ্য-অর্ঘ্য দিয়ে স্বগৃহে নিয়ে গিয়ে যথারীতি ছাগলরূপী বাতাপিকে কেটে খাওয়ালো। সবটুকু মাংসই খেলেন তিনি, একেবোরে ঝোলের তলানিটুকুও চেছেপুছে। তারপর 'বাতাপি ভস্ম' মন্ত্র পড়ে পেটে কয়েক বার হাত বুলিয়ে বাতাপিকে হজমই করে ফেললেন। হতবাক ইল্বলকেও ঋষি ভস্ম করলেন ব্রহ্মতেজে।

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা থামাতে আসা গান্ধীর ছাগলকে নাকি কেটে খেয়ে ফেলেছিল নোয়াখালির দাঙ্গাবাজেরা। দুই বার দেশভাগ এবং লক্ষ লক্ষ সংখ্যালঘুকে হত্যা ও দেশছাড়া করার পরও নোয়াখালির ইল্বল ও বাতাপিদের গায়ের ঝাল যে মেটেনি, তার অতি সাম্প্রতিক প্রমাণ পূজায় তাণ্ডব। জানি না, শুভবুদ্ধিরূপী অগস্ত্য মুনি কবে এদেশে আগমন করবেন, নাকি বাংলাদেশের বেহাল ভাবসাব দেখে 'অগস্ত্য যাত্রা'ই করেছেন তিনি, এ জীবনে আর ফিরবেন না বলে!

সংখ্যালঘু সর্বত্রই দেশ ত্যাগ করে, প্রায় কখনই যে রুখে দাঁড়ায় না, দাঁড়াতে পারে না, তার প্রমাণ প্যালেস্টাইনি, রোহিঙ্গা, সিরিয়ান মুসলমান আজ স্বদেশ ত্যাগ করে পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ডে এখনই বেশ কিছু বাংলাদেশি গারো-চাকমা-বড়ুয়া-হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা পাবেন। গত কুড়ি বছরে গড়ে উঠেছে এসব এলাকা ধীরে ধীরে। 

ইউরেনিয়াম আইসোটোপ তেজষ্ক্রিয়তা হারিয়ে সীসায় পরিণত হয় শুনেছি। সব সংখ্যালঘু, সব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বিতাড়িত হলে বাংলাদেশও পাকিস্তান-আফগানিস্তানের মতো সীসা-দেশে পরিণত হবে। তখন সেখানে প্রথমে আক্রান্ত হবে, আহমদিয়া, শিয়া মুসলমান এবং তারপর জেলাভিত্তিক মুসলমানরা 'যুদ্ধং দেহি' বলে পরস্পরের মুখোমুখি হবে, অসম্ভব কী! এমন একটি সীসামার্কা দেশ যদি আমাদের কাম্য হয়, তবে আগামী কয়েক বছর কয়েকটি দুর্গাপূজায় তাণ্ডব চালানোই যথেষ্ট। খুব একটা খরচও নেই, একটি হনুমানের মূর্তি বানাতে আর কী এমন খরচ। আসল একটি হনুমানকেই বসিয়ে দিলেই বা সমস্যা কী! 

যেকোনও হামলার পর ফেইসবুকে সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর কোনও কোনও সদস্য পোস্ট দেয়:

দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে, এবার রুখে দাঁড়াতে হবে। অনেকে এও বলে, হিন্দু যুবক-যুবতীদের জুডো-ক্যারাটে শিখাতে হবে, যাতে তারা আত্মরক্ষা করতে পারে। ভাগ্য ভালো যে এখনও কেউ সংখ্যালঘুদের সশস্ত্র হবার বুদ্ধি দিচ্ছে না। সংখ্যাগুরু সদস্যদের মধ্যে কেউ কেউ অভিযোগ করে, হিন্দুরা ভয় পেয়ে খামাখা কেন ভারতে পালিয়ে যায়? কেন ভারতীয় মুসলমানদের মতো মাটি কামড়ে মাতৃভূমিতে পড়ে থাকে না তারা? হিন্দুরা আসলে দুদেল বান্দা, কলমাচোর। তারা বাংলাদেশেরও খায়, ভারতেরও কুড়ায়। বাংলাদেশের সম্পদ তারা বিদেশে পাচার করছে। সরকারের উঁচু পর্যায় থেকেও বলা হয়, সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু  ও কিছু না। নিজেদের আপনারা সংখ্যালঘু মনে করবেন না, আপনারা সবাই এদেশেরই নাগরিক, আমাদেরই মতো। 

সত্য বটে, সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু মূলত একটি কুসংস্কার, জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আগে যার অস্তিত্বই ছিল না। এই কুসংস্কার জাতিরাষ্ট্রে সংখ্যালঘু নিপীড়নে আকছার ব্যবহৃত হচ্ছে। জাতিরাষ্ট্রের প্রশাসন সাধারণত সংখ্যাগুরুর পক্ষে যায়। প্রশাসনের প্রত্যক্ষ সহায়তা ছাড়া সংখ্যাগুরু কখনই সংখ্যালঘুকে দেশছাড়া করতে পারার কথা নয়। বিশ্বাস না হলে রোহিঙ্গাদের জিগ্যেস করে দেখুন। 

শরীরচর্চা করে কিংবা সশস্ত্র হয়ে কোনো জাতিরাষ্ট্রে সংখ্যালঘু নিজেকে রক্ষা করতে পারবে না। ১৯৪৭ এর দেশ ভাগের সময় পুরান ঢাকার ওয়ারী ছিল একটি হিন্দুপ্রধান এলাকা। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই এই জনচিত্র পালটে গিয়েছিল। পুরান ঢাকার মুকুল সিনেমার মালিক মুকুল বাবুর স্বাস্থ্য খুব ভালো ছিল, এলাকার নেতাও ছিলেন তিনি। একদিন সকালে তার গলাকাটা লাশ সিনেমা হলের সামনে দেখার পর তার নিকটাত্মীয়েরা সেই যে ভারতে চলে গেলেন, অদ্যাবধি বাংলাদেশের নামও শুনতে পারেন না। ঢাকায় সব স্বদেশী করা স্বাস্থ্যবান যুবকেরা ছিলেন। কী করতে পেরেছেন তারা? কেন কিছু করতে পারেননি? এমনটা হওয়ার অন্যতম নয়, একমাত্র কারণ, পাকিস্তানের প্রশাসন ছিল সংখ্যাগুরু মুসলমানের পক্ষে।

পক্ষান্তরে পশ্চিমবঙ্গে, কলকাতায় দাঙ্গা হয়েছে, কিন্তু কোনো মুসলিমপ্রধান অঞ্চল, কলকাতার মুসলিম প্রধান এলাকা, যেমন মেটিয়াবুরুজ কিংবা নিউ মার্কেট- কখনই হিন্দুপ্রধান হয়ে ওঠেনি। এর কারণ কী? পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানেরা কি বাংলাদেশের হিন্দুদের তুলনায় বেশি সাহসী, স্বাস্থ্যবান ছিল? না, এর পেছনে অন্যতম কারণ, পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসন বেশিরভাগ সময় দাঙ্গাবাজ হিন্দুদের সহায়তা করেনি। অথচ ভারতেই যেখানে মুসলমানেরা আক্রান্ত হয়েছে, হচ্ছে, সেখানেই প্রশাসন আক্রমণকারীদের পক্ষে ছিল কিংবা আছে। ১৯৮৫ সালে প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদদেই দিল্লিতে হাজার হাজার শিখ খুন হয়েছিল। নোয়াখালিসহ সারাদেশে যেভাবে হিন্দুদের ওপর আক্রমণ হলো, প্রশাসন কিংবা রাজনৈতিক দল সক্রিয় থাকলে কখনই সেটা সম্ভব হতো না।

পুরো সংখ্যালঘু গোষ্ঠী একজোট হলেও নিজেদের রক্ষা করতে পারবেন না কোনো জাতিরাষ্ট্রে, যদি তাদের পিছনে প্রশাসনের কার্যকর সমর্থন না থাকে। বেশি দূরে যাবার দরকার কী, সরকার বদল হলে, লেজুর ছাত্রসংগঠনের নেতারা যে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে যায়, কিংবা নারায়ণগঞ্জের প্রবল শক্তিধর নেতাকেও যে দ্বিতীয় বিএনপি আমলে কানাডায় পালিয়ে প্রাণ বাঁচাতে হয়েছিল, সে তো প্রশাসনের সমর্থনহীনতার কারণেই। 

প্রশাসনের ভেতরের কারও মদদ ছাড়া সংখ্যালঘুর ওপর হামলা হয় না। বড়দের মুখে শুনেছি, আমাদের কুমিরা গ্রামে ১৯৫০ সালের রায়টের রাতে পুলিশ আসেনি, এসেছিল পরদিন সকালে। আগের রাতে যারা নির্বিচারে হিন্দু প্রতিবেশিদের খুন করেছিল, তারা তখন 'আল্লাহু আকবর' ধ্বনি দিয়ে ঢাকা ট্রাঙ্ক রোডেই খোলা তলোয়ার হাতে মিছিল করছিল। তাদের দুই-একজনকে ধরে, পুলিশসুলভ দুই একটি খিস্তি করে, দুই একটা চড়-থাপ্পড় দিয়েই কর্তব্য শেষ করেছিল সীতাকুণ্ড থানার কনস্টেবলেরা। 

এই খুনিদের একজন কুমিরা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা (স্কুলের জমিটা তার দান) নিবারণ চন্দ্র দাশকে খুন করে মৃতদেহকে টুকরা টুকরা করেছিলেন। তিনি নিবারণ দাশের প্রিয় ছাত্রও ছিলেন, নিবারণ দাশের অর্থানুকূল্যেই তার জীবন চলতো। মরণোন্মুখ নিবারণ দাশ নাকি বলেছিলেন: 'রফিক (নাম বদলানো হয়েছে, বদলাতে হলো, কারণ তাঁর উত্তরপুরুষেরা আমার এলাকার ছোট ভাই, আমি তাদের প্রিয় দাদা!), তোকে যে এতদিন ধরে মানুষ করলাম, তুই তার এই প্রতিদান দিলি!' এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন দানবীর শিক্ষাব্রতী নিবারণ দাশের পরিবারের মেয়েরা, যারা তখন পাশের ঘরে লুকিয়ে মৃত্যুভয়ে থরহরি কম্পমান।

রফিকের সঙ্গে আমার দাদুর দুটি সংলাপ এলাকায় বিখ্যাত ছিল। এক. ১৯৫০ সালে রায়টে আগের রাতে পুড়ে যাওয়া মাটির ঘর সাফ করছিলেন আমার দাদু। রফিক এসে বললো: 'আহা ঠাকুরদা, আপনার মতো লোকের ঘরেও কেউ আগুন দেয়!' দাদুর সপ্রতিভ উত্তর ছিল: 'রাতে আগুন যখন দিয়েছিলে, কথাটা তখন মনে ছিল না!' দুই. এই একই রফিক সাহেব আইউব খানের মৌলিক গণতন্ত্রের নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন বিডি (বেসিক ডেমোক্রেসি) মেম্বর পদে। দাদুর কাছে ভোট চাইতে এলে নিবারণ দাশকে নৃশংসভাবে হত্যা করার কথা রফিককে তিনি স্মরণ করিয়ে দেন। রফিক কাঁচুমাচু হয়ে উত্তর দিয়েছিলেন: 'তখন বয়স কম ছিল, রক্তও গরম ছিল, ভুল হয়ে গেছে, মাফ করে দেওয়া যায় না?' মাফ না করে সংখ্যালঘুর আর উপায়ইবা কী! রফিক পরে ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন, স্কুল কমিটির সভাপতিও ছিলেন। 

আমরা লক্ষ্য করতে পারি, পুরো পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলজুড়ে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলাকারীদের কারোরই কোনো শাস্তি হয়নি। তারা প্রত্যেকে সুখে-শান্তিতে দীর্ঘ জীবন যাপন করে স্বশয্যায়, সসম্মানে মৃত্যুবরণ করেছেন। ইহজগতে কোনো শাস্তিই তারা পায়নি, পরলোক যদি থাকে, সেখানে হয়তো তাদের বিচার হলেও হতে পারে। বিশ্ববেহায়ার মতো ব্যক্তি আজীবন নিজের ও পরের ভার্যাদের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে অতি বৃদ্ধ বয়সে সসম্মানে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। পরকালের ভরসায় থেকে পৃথিবীতে শাস্তি না হলে অপরাধী একই অপরাধ বার বার করবে প্রয়োজনে বা সুযোগ বুঝে এবং সম্ভাব্য অপরাধীরাও একই অপরাধ করতে উৎসাহিত হবে। বিচারহীনতার ফলে বাংলাদেশের গ্রামগুলো হিন্দুশূন্য হচ্ছে গত সত্তর বছর ধরে।

বাংলাদেশে দুর্গাপূজায় সাম্প্রতিক তাণ্ডবের বেশ কিছু সমাধান উদারবাদীরা দিয়েছেন: ১. মানুষের মনে শুভবুদ্ধি জাগ্রত করতে হবে। এই লক্ষ্যে ফেইসবুকে পোস্ট দিতে হবে, প্রতিবাদ মিছিল-সভা-সমাবেশ করে বক্তব্য দিতে হবে; ২. সংবিধানকে ধর্মনিরপেক্ষ করতে হবে। ৩. দোষী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে অতি সত্বর শাস্তিবিধান করতে হবে; ৪. দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে হবে। ৫. প্রশাসনে যাদের বিরুদ্ধে আদেশ পালন না করা বা আদেশ পালনে দীর্ঘসূত্রিতার অভিযোগ পাওয়া যাবে, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ৬. অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্যে শিক্ষাকে অসাম্প্রদায়িক করে তুলতে হবে, অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি যেমন কবিগান, বাউলগান, যাত্রাপালা, পালাগান ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হবার মতো পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। এগুলো উদারবাদীদের প্রদত্ত সমাধান এবং সরকারের কাছে উত্থাপিত দাবি। 

রাজনীতিবিদেরা একে অপরের দোষ দিচ্ছেন। বলা হচ্ছে, কিছু সাম্প্রদায়িক দল এই অপকর্ম করছে। কিন্তু পাগলেও বিশ্বাস করবে না, মার্কামারা সাম্প্রদায়িক দলগুলো এই অপকর্ম করতে সক্ষম, যখন কিনা সরকারি প্রশাসন এবং সরকারি দলের অনিচ্ছায় গাছের পাতাটিও নড়ে না। কিছু সম্ভাব্য অপরাধীকে চিহ্নিত করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। পুলিশ কর্মকর্তারা ইতিমধ্যে বদলি হয়েছেন, যা ইঙ্গিত করে যে 'ডালমে কুছ না কুছ কালা' ছিল। ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেবার আদেশ হয়েছে। বুদ্ধিজীবীরা প্রথমে (সম্ভবত হতবুদ্ধি হয়ে) বাতাস কোনদিকে যায়, বোঝার চেষ্টা করেছে, সামান্য প্রতিবাদটুকুও করেনি। কয়েক দিন পর বাতাস বুঝে তারা সভা-সমাবেশ-মিছিল-পথনাটক শুরু করেছেন। অসাম্প্রদায়িক সংবিধানের দাবিও উঠতে শুরু করেছে। নিন্দুকেরা বলছে, বুদ্ধিজীবী-সংস্কৃতিকর্মীরা সরকারের কোনো অপকর্মের প্রতিবাদ কখনও করে না, এখন সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রতিবাদ করলেই লোকে তাদের কথা গুরুত্ব দিয়ে শুনবে কেন?

মৌলবাদীরা বলেছেন, ধর্মীয় ব্যাপারে বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদদের নাক গলানো বন্ধ করতে হবে, কারণ এই বিষয়ে বলার মতো জ্ঞান ও অধিকার আছে কেবল ধর্মগুরুদের, বিশেষ করে 'ধর্ম যার যার, উৎসব সবার'- এর মতো অন্তঃসারশূন্য কথাবার্তা বলা বন্ধ করতে হবে। ইসলাম ধর্মীয় বক্তাদের মধ্যে কেউ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উপর জোর দিয়েছেন মদিনায় এবং অন্যত্র হজরত মুহম্মদের (স.) সংখ্যালঘুদের প্রতি আচরণের রেফারেন্স দিয়ে। কেউ বা আবার বলেছেন, কোরানের অবমাননা বরদাস্ত করা হবে না। হিন্দু ধর্মীয় নেতারা নিন্দা ও হতাশা জানিয়ে সংখ্যালঘুদের দেশত্যাগের অনিবার্যতার দিকে ইঙ্গিত করেছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ৭২ এর সংবিধানে ফিরে যাবার দাবিও জানিয়েছেন। 

উপরের সমাধানগুলো প্রত্যেকটিই হয়তো কমবেশি কাজের। সচেতন নাগরিক একজোট হয়ে মিটিং-মিছিল-সমাবেশ-পথনাটক করতেই পারে, কিন্তু এসব কখনই সংখ্যলঘু নিপীড়নের কার্যকর ও স্থায়ী সমাধান হবে না। মূল কাজটা যে করতে হবে রাষ্ট্র তথা প্রশাসনকে' এ ব্যাপারে সবাই কমবেশি একমত। সব দেশে, সব কালে সংখ্যালঘু নিপীড়নের জন্যে প্রশাসন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দায়ী থাকে। সুতরাং এক বাক্যে প্রশাসনকে দোষ দিচ্ছে সকলেই, দেওয়ারই কথা, কারণ দায়িত্ব প্রশাসনের। দায়িত্ব পালন করতে না পারলে প্রশাসন অন্তত স্বীকার করুক, ব্যর্থতার জন্যে ক্ষমা চাক। 

বিচার, শাসন, আইন প্রণয়ন, শিক্ষা ইত্যাদি মিলিয়ে রাষ্ট্রের চতুরঙ্গকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, বাংলাদেশ রাষ্ট্র আসলে কী চায়। সংখ্যালঘু বিতাড়ণে যদি রাষ্ট্রের মঙ্গল হয়, তবে সেই পথেই হাঁটা উচিত। ঢাক ঢাক গুড় গুড় করে লাভ নেই। ঝেড়ে-কাশাটাই সবার জন্যে মঙ্গল। যদি সংখ্যালঘুদের পরিষ্কার বলে দেওয়া হয়, মায়ানমারের বর্মী বৌদ্ধরা যেমনটা বলেছে রোহিঙ্গাদের: 'বাপু তোমাদের আর এ দেশে থেকে কাজ নেই, তোমার নিজের নিজের পথ দেখো!', তবে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরাও তাদের আশু করণীয় ঠিকই করে নিতে জানবে। 

এতে সংখ্যালঘুরা হয়তো সাময়িক কষ্ট পাবে, কিন্তু দুই-এক প্রজন্ম পরেই সবাই সব কিছু ভুলে যাবে। ভাসানচর কি ইতিমধ্যেই অনেক রোহিঙ্গার নতুন আবাসভূমি হয়ে উঠেনি? আমারই কতো নিকটাত্মীয় নিজের প্রাণ আর পরিবারের মা-মেয়ের ইজ্জতটুকু বাঁচাতে পাকিস্তানের পৈত্রিক ভদ্রাসন ছেড়ে গিয়ে উড়িষ্যার দণ্ডকারণ্যের গহীন জঙ্গলে জীবনপাত করেছেন। যারা যাননি তারা যে কম বেশি যতন সাহার মতো মৃত্যুঝুঁকিতে আছেন- তাতে কি সন্দেহের কোনো অবকাশ আছে?

ইতিহাস বলে, পাকিস্তান-আফগানিস্তানের বর্তমান দুরবস্থা ও ব্যর্থতা থেকেও অনুমান করা যায়, সংখ্যাগুরুর এই সিদ্ধান্ত তার নিজের জন্যই বুমেরাং হবে, নিজের কবর নিজেই খুঁড়বে সে। কেন? উপনিষদে বলা হয়েছে: 'স বৈ নৈব রেমে, স দ্বিতীয়ম অইচ্ছত' অর্থাৎ 'সে একা আনন্দ পেলো না, সে দ্বিতীয়কে ইচ্ছা করলো!' কোরানের ৪৯নং সুরা আল হুজুরাতের ১৩নং আয়াতে বলা হয়েছে: 'হে মানবকূল, তোমাদের আমি একাধিক কওমে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পরকে জানতে পারো'। এর অর্থ বৈচিত্র্যই জীবনের ধর্ম, সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু মিলেমিশে থাকাটাই রাষ্ট্রের জন্য মঙ্গল। 

জনবৈচিত্র্য যে একটি দেশের প্রকৃত সম্পদ, কোনোমতেই আপদ নয়- এই স্বতঃসিদ্ধ এখন প্রতিষ্ঠিত সত্য। আমরা যদি জোর করে বিদ্যমান বৈচিত্র্য ধ্বংস করি, তবে অচিরেই নতুন বৈচিত্র্য সৃষ্টি হবে। আফগানিস্তানে হিন্দু নেই, কিন্তু আন্তমুসলিম/আন্তর্জাতিক সাম্প্রদায়িকতা সেখানে প্রায় প্রতিদিন রক্ত ঝরিয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তান কিংবা আফগানিস্তানে ধর্ম কি মানুষকে একসূত্রে গাঁথতে সক্ষম হয়েছে? 

দেশের উন্নতি কিংবা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বার্থে যদি সংখ্যালঘুর সংরক্ষণ অপরিহার্য হয়, সংখ্যার লঘু-গুরু যদি আসলেই একটি কুসংস্কার হয়, তবে সংখ্যালঘুকে সর্বতোভাবে রক্ষার চেষ্টা করতে হবে সংখ্যাগুরুকে এবং রাষ্ট্রের প্রশাসনকে। সংখ্যালঘু প্রকৃতিগতভাবে দুর্বল বলে তাকে রক্ষায় সম্ভাব্য সব রকম যত্নেরও প্রয়োজন হবে। সংখ্যালঘুর মনে স্বস্তি ও রাষ্ট্রের প্রতি বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা সহজ কাজ নয়। পৃথিবীর বড় বড় জাতিরাষ্ট্রগুলোও অনেক ক্ষেত্রে এ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। মনে রাখতে হবে, সংখ্যার লঘুগুরু একটি আপেক্ষিক ব্যাপার। বাঙালি মুসলমান তার ডানে-বাঁয়ে শ পাঁচেক মাইল অতিক্রম করেই ভারত বা মায়ানমারে গিয়ে সংখ্যালঘু হবার স্বাদ নিয়ে আসতে পারে। 

দুর্গাপূজায় তাণ্ডবের সমস্যাটা আগাপাশতলা রাজনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবেই এর সমাধান করতে হবে। রাজনৈতিক সমাধানের প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে, সব রাজনীতির যা ভিত্তি, রাষ্ট্রের সেই সংবিধানটিকে ধর্মনিরপেক্ষ হতে হবে। ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার এবং সে কারণেই রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম থাকতেই পারে না। সংবিধানে সংখ্যাগুরুর ধর্ম রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে রাখা হলে রাষ্ট্রই চরিত্রহীন হয়ে যায়, কারণ আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের সূত্রপাত যে ফরাসি বিপ্লবে, সেই ফরাসি বিপ্লবের দৃষ্টিকোণ থেকে ধর্মের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক একটি নিষিদ্ধ রাজনৈতিক আচরণ। সংখ্যালঘুর মনে নাগরিকত্বের বোধ পুনস্থাপনের জন্যও ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান অপরিহার্য।

কাজীর গরু কাগজে থাকলেও যে গোয়ালে থাকবে না সেটা জানি, কিন্তু গোয়াল নয়, প্রথমে কাগজটাই ঠিক করতে হবে। বিচার করা নয়, সভ্যতার প্রথম সোপানই হচ্ছে আইন প্রণয়ন করা এবং তার পর সেই আইনের ভিত্তিতে বিচার হবে, আইন কেউ না মানলে শাস্তিবিধান হবে। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বজায় রেখে ধর্মনিরপেক্ষ কিংবা ধর্মীয় সন্ত্রাসমুক্ত বাংলাদেশ গঠনের স্বপ্ন সোনার পাথরবাটি। 

কাগজ ঠিক করার পর গোয়ালের দিকে নজর দিতে হবে কাজীকে। শিক্ষা, বিচারব্যবস্থা, প্রশাসনসহ রাষ্ট্রের চতুরঙ্গকে অসাম্প্রদায়িক করে তুলতে হবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই এটা করা সম্ভব। একই সঙ্গে চেষ্টা করতে হবে, রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ মিডিয়া যাতে এতটাই স্বাধীন ও দায়িত্বপরায়ন ওঠে যে বাকি তিনটি স্তম্ভের কর্তব্যে যে কোনো প্রকার বিচ্যুতি তারা জনসমক্ষে নিয়ে আসতে পারে। সরকারকে বুদ্ধিজীবীদের কথা আমলে নিতে হবে এবং বুদ্ধিজীবীদেরও লোভের মুখে লাগাম দিয়ে সরকারের লেজুরবৃত্তি বন্ধ করতে হবে।

অসাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে কোনো ছাড় দেওয়া যাবে না। 'দুদেল বান্দা কলমা চোর, না পায় শ্মশান না পায় গোর'। রাষ্ট্র ও জনগণকে প্রথমে লক্ষ্য বা নিয়ত ঠিক করতে হবে এবং ঠিক রাখতে হবে। হিন্দু লেখকের রচনা সিলেবাসে বেশি রাখা যাবে না, নজরুলের রচনায় 'মহাশ্মশান' লেখা থাকলে সেটাকে কেটে 'গোরস্থান' করে দিতে হবে, মুসলমানের বাংলা নাম রাখা যাবে না, কারণ বাংলা হচ্ছে হিন্দুয়ানি ভাষা, বাসে-ট্রেনে ওঠামাত্র সাঈদীর ওয়াজের রেকর্ড শুরু হবে যাতে সংখ্যালঘুদের হেয় এবং ধর্মান্তরিত করার খবর সগৌরবে বয়ান করা হচ্ছে … এইসব 'ছোট বালুকার কণা বিন্দু বিন্দু জল' যুক্ত হয়ে ১৯৪৭ সাল থেকে অদ্যাবধি সাম্প্রদায়িকতার এক অতল সাগর সৃষ্টি হয়েছে যাতে ডুবে মরতে যাচ্ছে পুরো জাতি। পশ্চিমবঙ্গেও অনুরূপ প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে বটে, কিন্তু সেটা বাংলাদেশের সমস্যা নয়। আমরা চাই, বাংলাদেশ ভারতের জন্য অনুকরণীয় উদাহরণ হয়ে উঠুক, কিন্তু আমরা চাই না, ভারতের অপকর্মকে অজুহাত হিসেবে গ্রহণ করুক বাংলাদেশের কোনও দুষ্কৃতি।

মানুষ কমবেশি অপরাধপ্রবণ। কোনো কোনো চোরা অবশ্যই ধর্মের কাহিনী শুনতে চাইবে না। রোগের নিরাময় অপেক্ষা নিবারণ উত্তম। উপযুক্ত গোয়েন্দা ব্যবস্থা সুযোগসন্ধানীদের অপকর্ম নিবারণে অন্যতম একটি অস্ত্র। রাজাকে তিন সেট গুপ্তচর রাখার নিদান দিয়েছিলেন চাণক্য। প্রথম ও দ্বিতীয় সেট পরস্পরের অপরিচিত থাকবে। প্রথম ও দ্বিতীয় সেট ঠিকঠাকমতো কাজ করছে কিনা দেখবে তৃতীয় সেট। তিন সেটের গোয়েন্দাপ্রধানের সঙ্গে আলাদাভাবে কথা না বলে রাজা রাতে শুতে যাবেন না। প্রাক্তন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত বীনা সিক্রি বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থার ব্যর্থতার কথা সরাসরি বলেছেন। পিলখানা বিদ্রোহ, নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ সফর এবং এ বারের দুর্গাপূজায় সংঘঠিত পরিকল্পিত অপকর্ম আগে থেকে আঁচ করতে না পারা প্রশাসনের ব্যর্থতার টুপিতে তিনটি কালো পালক বটে।