গত কয়েকদিন বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের বিরুদ্ধে যেন একটি যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। ঘটনাটি কষ্টের, দুঃখের এবং অপমানের, কিন্তু এসবের সাথে যোগ হয়েছে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর অনেক মানুষের এক ধরনের নির্বিকার মনোভাব। আমার কষ্টটা অনেকটাই বেড়ে গেছে এটি দেখে। আমার অনেক বন্ধু ঘটনাটি নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছেন এবং প্রতিবাদী হয়েছেন, আবার অনেকের মধ্যেই কোনো তাপ উত্তাপ দেখিনি এ বিষয়ে। হতে পারে সবাই সব বিষয়ে কথা বলার মতো অবস্থায় থাকেন না বা বলতে পারেন না। তবে অনেকেই বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষকে মানুষই বলেই মনে করেন না, কাজেই এদের আক্রান্ত হওয়া নিয়ে প্রতিবাদী হওয়ার কিছু নেই। এই চিন্তাটি আমার মতো আরো অনেক মানুষের জন্যই কষ্টদায়ক অনুভূতির সৃষ্টি করে।
একটি টক শো শুনছিলাম টিভিতে। সেখানে জিটিভির সম্পাদক জনাব ইশতিয়াক রেজার একটি মন্তব্যে আমি চমকে গেলাম। তিনি খুব শক্তভাবে বললেন, বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ—এ ধারণাটি একটি মিথ। আমি অবাক হয়ে ভাবছিলাম, এ ধরনের কথা আমি আমার প্রচুর আত্মীয়-স্বজনের মুখে শুনেছি যখনি আমি বলতে চেয়েছি যে, বাংলাদেশের মানুষ আসলে অসাম্প্রদায়িক। মনে পড়ে ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদের ঘটনাটির পর যখন বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ হলো এর পরপরই নোয়াখালীর অজপাড়াগাঁয়ে বসবাসকারী আমার এক জ্ঞাতি দাদা সপরিবারে ভারতে চলে গেলেন। তাকে আমি বোঝাতে গিয়েছিলাম যে, ভারতে গেলে তার জীবন খুব সুখকর হবে না। তিনি উল্টো আমাকে বলেছিলেন, 'ভারতে জীবন সুখকর হবে না, তবে জীবন বাঁচবে'। এ কথাটি আমার জন্য খুব মর্মান্তিক ছিল, কারণ আমি সারাজীবন আমার জন্মস্থানের জন্য গর্ব করেছি এবং ভেবেছি আমরা একটি সুন্দর সমাজ তৈরি করতে পেরেছিলাম। ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে অবশ্য মনে করা হয়, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর এই বিষবৃক্ষের বীজ বপন করা হয় যখন সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেয়া হয়। দেশীয় রাজনীতির যে ডিসকোর্স সেটির খোলনলচে পরিবর্তন করে ফেলা হয় ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে। লক্ষণীয়, এই ডিসকোর্সের বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও শেখ হাসিনা এটিকে ঝেড়ে ফেলতে পারেননি পুরোপুরি। এর নেতিবাচক ফলাফল আমরা দেখতে পাচ্ছি এখন; আমি একটু পর আবারো এ বিষয়টি নিয়ে বলব।
সংখ্যাতাত্ত্বিক সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে যে কোনো সিদ্ধান্তে আসার ব্যপারে আমি সংখ্যাভিত্তিক তথ্যের ওপর নির্ভর করি অনেকটাই। ইশতিয়াক রেজার কথাটি শুনে ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ক রিপোর্টগুলো একটু নেড়েচেড়ে দেখার ইচ্ছে হলো। এসব রিপোর্ট থেকে কয়েকটি তথ্য এখানে শেয়ার করার লোভ সামলানো যাচ্ছে না আমার মতো রাজনীতি কম বোঝা মানুষদের সাথে। আমার বিশ্বাস, এই তথ্যগুলো আমাদের কিছুটা হলেও সাহায্য করবে আমরা উটপাখির মতো বালিতে মুখ ডুবিয়ে আছি কিনা তা বুঝতে।
প্রথমে দেখা যাক, দেশের ভেতরকার রিপোর্ট কী বলে। আইন ও শালিস কেন্দ্রের হিসেব মতে, ২০১৩ থেকে সেপ্টেম্বর ২০২১ পর্যন্ত মোট ৩৬৭৯টি সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, অর্থাৎ বছরে গড়ে প্রায় ৪৬০টি ঘটনা ঘটেছে গত আট বছরে। অন্য অর্থে, গড়ে ১.২৬টি ঘটনা ঘটেছে প্রতিদিন। এসব ঘটনায় ১১ জন খুন হয়েছেন এবং ৮৬২ জন আহত হয়েছেন। অর্থাৎ মোট ঘটনার সাপেক্ষে শারীরিক ক্ষতির (যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণ ছাড়া) হার ২৪%। এ ছাড়া ধর্ষণ, যৌন নির্যাতন, মন্দিরে হামলা এবং লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। রিপোর্টটিতে এসব ঘটনার নির্দিষ্ট সংখ্যা উল্লেখ করা আছে। ২০১৪ সালের নির্বাচন পরবর্তী সময়ে ৭৬১টি বাড়ি, ১৯৩টি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান এবং ২৪৭টি মন্দির আক্রান্ত হয়েছিল। মজার ব্যাপার হলো, এই এতগুলো ঘটনার পরও একটিও মামলা হয়নি বা বিচার হয়নি কোনো ঘটনার। ভাবা যায় এমন অবস্থা কোনো সভ্য দেশে?
এবার দেশের বাইরের রিপোর্টগুলোর কথা একটু বলা যাক। বিশ্বব্যাংকের 'ফ্রিডম অব রিলিজিয়ন' নামের রিপোর্টে উদ্বেগজনক তথ্য পাওয়া যায়। দেখা যাচ্ছে ১৯৭৫ সালে ধর্মীয় স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ১০০ তে ৭৮ যেটি মোটামুটি ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত কম-বেশি একই রকম ছিল; ১৯৯৬ সালে এ স্কোরটি বেড়ে ৮৮-তে উন্নীত হয়; ১৯৯৭ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত সময়ে এটি ছিল ৮৬। লক্ষণীয় এই যে, ১৯৭৫ থেকে ২০০১ পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশের এই স্কোর আঞ্চলিক এবং বিশ্বের মিডিয়ান স্কোরের ওপরে ছিল যদিও ১৯৮৮ এবং ১৯৯১ সালে দুটি দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের বিদায়ের বছর (২০০১) এটি কমে গিয়ে ৭৯ হয়ে গিয়েছিল; মনে রাখা দরকার ২০০১ সালেই ঘটেছিল সেই হৃদয়বিদারক নির্বাচনোত্তোর সহিংসতার ঘটনাটি। এরপর থেকেই বাংলাদেশের পিছু হটা শুরু হয়। বিএনপি আমলে (২০০১-০৬) প্রতি বছর এটি বেশ খানিকটা করে কমতে কমতে ২০০৫ এবং ২০০৬ উভয় বছরেই ৬৮-তে নেমে আসে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০১২ পর্যন্ত এটি ৭৩ এ স্থির থাকে, কিন্তু ২০১৩ এবং ২০১৪-তে এটি ৬৮-তে নেমে আসে। দেখা যাচ্ছে, ২০১৫-তে এই স্কোরটি যেখানে ছিল ৬৫ সেটি বছর তিন-চারের মধ্যেই (২০১৯) হয়ে যায় ৪১। অবশ্য এই একই সময়ে আমরা ভারত এবং পাকিস্তানের চেয়ে বেশ ভালো আছি বলতে হবে যেখানে এই বিষয়ে ভারত এবং পাকিস্তানের স্কোর যথাক্রমে ৩১ এবং ২৮।
অন্য আরেকটি রিপোর্ট পর্যালোচনা করলেও কম-বেশি একই রকমের চিত্র পাওয়া যায়। ক্যাটো (CATO) ইন্সটিটিউট নামে একটি প্রতিষ্ঠান প্রতি বছর হিউম্যান ফ্রিডম ইনডেক্স প্রকাশ করে। আমার কাছে যে তথ্য আছে তাতে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের রিলিজিয়াস ফ্রিডম স্কোর ২০০৮ সালে ছিল ৬.১ যা কমে ২০১৮ সালে ৫.৭ এ নেমে আসে। হ্যারাস এবং শারিরীক নির্যাতনের ক্ষেত্রে ফ্রিডম স্কোরটি ৭.৫ থেকে কমে এই সময়কালে ৬.১ এ নেমে আসে। ২০১৮ সালে আইনগত এবং নিয়ন্ত্রণজনিত উপাদানটির ক্ষেত্রে এই স্কোরটি একই সময়ে ৪.৯ থেকে কমে ৪.১ এ নেমে আসে। ফ্রেজাইল স্টেট ইন্ডেক্স নামে আরেকটি খুব গুরুত্বপূর্ণ পরিমাপকের কথা এখানে উল্লেখ করা যায়। এখানেও দেখা যাচ্ছে, গত কয়েক বছরে ধর্মীয় এবং অন্যান্য নির্যাতন বিষয়ক যে পরিমাপকটি তারা ব্যবহার করে সেটি ক্রমান্বয়ে বেড়ে গেছে। খুব স্বাভাবিকভাবেই এই সংখ্যাগুলোর আলোকেই বলা চলে, আমার জন্মভূমি অসাম্প্রদায়িক—এ ধারণাটি আজকের বাস্তবতায় অনেকটাই অতীতের স্মৃতিচারণের বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
কেন হচ্ছে এমনটি? গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আইন ও শালিস কেন্দ্রের মতে, সবচেয়ে বেশি হামলা হয় হেফাজতের সাথে সরকারের আপসরফা পরবর্তী সময়ে, অর্থাৎ ২০১৪ পরবর্তী সময়ে। আবার অন্যান্য যে রিপোর্ট এখানে তুলে ধরা হলো সেগুলো থেকে একটি সিদ্ধান্তে আসা যায়। সংখ্যাতত্ত্বের ভিত্তিতে বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িকতার যুগ থেকে পুরোপুরি বিদায়পর্ব শুরু হয় দুই পর্যায়ে; প্রথমটি ২০০১ থেকে ২০০৬ এবং দ্বিতীয়টি ২০১৩ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত। ২০০১ থেকে ২০০৬-এ সাংবিধানিকভাবে এবং সে সময়কার রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রকদের আদর্শের কারণে সংখ্যালঘুদের মোটামুটি দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করা হয়। দেখার বিষয় হলো এই যে, এই অবস্থাটি পরিবর্তন হয়ে উন্নতির দিকে এগুচ্ছিলো ২০১২ সাল পর্যন্ত, কিন্তু ২০১৩ থেকে এটি কমতে থাকে এবং ২০১৯-এ এসে একেবারেই তলানীতে চলে যায়। আমার ধারণা ২০২১-এ বিশ্বব্যাঙ্কের রিপোর্টে বাংলাদেশের স্কোর আরো অনেক নীচে নেমে আসবে। ২০১২ সালে সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা সংযুক্ত হলেও ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে রেখে দেয়া হয়; এতে ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মানুষেরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকই থেকে যায় তাদের প্রিয় আওয়ামী লীগের শাসনামলেও। প্রশ্ন হচ্ছে, রাষ্ট্রের ধর্ম ইসলাম হলে অন্য ধর্মগুলোর অবস্থান কী হবে? দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতারা বলে থাকেন বাংলাদেশ চালিত হয় মদিনা সনদ অনুযায়ী। এ কথাটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের সাথে কি যায়? এটি অনেকটাই ভারতের অসাম্প্রদায়িক আদর্শের বিপরীতে রাম রাজত্ত্ব স্থাপনের অঙ্গীকারের মতো।
২০১৩ সালে হেফাজতের তাণ্ডবের কথা সবারই মনে আছে। ওই বছরই সরকার বিভিন্ন আপস ফর্মুলায় অনেকটাই ধর্মনিরপেক্ষতার মূল স্পিরিট থেকে সরে আসে। মনে রাখা দরকার ২০১৪-১৭ এই সময়ের মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকার স্কুলের কারিকুলামসহ অনেকগুলা বিষয়ে বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নেয়, যেগুলো মোটা দাগে দেশের প্রগতিশীল আদর্শের পরিপন্থী ছিল। এর ফলে ধর্মীয় স্বাধীনতার সূচক ক্রমশঃ নিম্নগামী হয়েছে। গত কয়েক বছরে এই ক্রমাবনতি খুবই দ্রুত ঘটেছে। আরো দেখা যায়, সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন চালু করলেও ওয়াজের নামে ধর্মীয় ঘৃণা ছড়ানো ভাইরাল হওয়া ওয়াজকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি এই যে, ২০১৩ সাল থেকে আজ পর্যন্ত যতগুলো ঘটনা ঘটেছে এগুলোর কোনো বিচার হয়নি এখন পর্যন্ত; বরং এসবের সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গ সরকারি দলের ছত্রছায়ায় ক্ষমতার আস্ফালন দেখিয়েই চলেছে; বিভিন্ন নির্বাচনে সরকারি দলের মনোনয়ন পেয়েছে; অন্যদিকে কাউকে কাউকে স্কেপগোট সাজিয়ে গ্রেপ্তার করে অনেকদিন জেলে পুরে রাখা হয়েছে (পাঠক নাসিরনগরের জেলে রসরাজের কথা চিন্তা করুন)। বর্তমান সময়ে পীরগঞ্জের ঘটনায় যে পরিতোষকে আটক করা হয়েছে তার বয়স মাত্র পনের, অথচ তাকে হাত-কড়া পরিয়ে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে যেখানে এ বয়সের কাউকে এভাবে গ্রেপ্তার করা যায় না, কারণ যদি এ কাজটি সে করেও থাকে এটিকে অপরাধ বলা যাবে না; এটি অপ্রাপ্ত বয়সের বিচ্যুতি (জুভেনাইল ডেলিংকুয়েন্সি) মাত্র এবং এ কারণেই তাকে হাত কড়া পরিয়ে গ্রেপ্তার করা যাবে না। পরিতোষের পরিবারের মতে, তার পক্ষে এ কাজ করা সম্ভব নয়। ঘটনা যাই ঘটুক, রাষ্ট্র তার আচরণে নিরপেক্ষতা দেখাতে পারেনি। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ধর্ম নিয়ে যেখানে নিরন্তর লাইভে ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে সেখানে এ কাজের সাথে জড়িত কাউকেই আজ পর্যন্ত গ্রেপ্তার বা তার বিরুদ্ধে মামলা করার একটি ঘটনাও ঘটেনি, অথচ একটি ফেসবুক পোস্টের জন্য ভিন্ন সম্প্রদায়ের এবং প্রগতশীল মানুষদের বিরুদ্ধে মামলা চলছে; চলছে হয়রানি এবং বিনাবিচারে দীর্ঘদিন কারাবরণ। প্রগতিশীল মানুষদের 'নাস্তিক' লেবেল দিয়েও চলেছে হয়রানি।
এ ঘটনাগুলো প্রমান করে বাংলাদেশ গত প্রায় এক দশক ধরে প্রগতির উল্টো পথে হাঁটছে। বাংলাদেশে যেন অলিখিতভাবে ব্লাসফেমি আইনের প্রয়োগ হচ্ছে কিছুদিন পরপর। আমরা কি এমনটি আশা করেছিলাম স্বাধীন বাংলাদেশে যখন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায়? ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি শেখ হাসিনা বর্তমান অবস্থাটি চলমান থাকুক তা চান না, কিন্তু তিনি আসলে ক্ষমতার রাজনীতিতে অনেকটাই অসহায়। ১৯৭৫ এর পর যে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক সংস্কৃতিটি চালু ছিল সেখান থেকে বেরিয়ে আসা এদেশের রাজনীতির জন্য এখনো অনেকটাই কঠিন। এটিকে আমরা সমাজবিজ্ঞানের ভাষায় "রাজনৈতিক সংস্কৃতির জড়তা" (ইনারশিয়া অব পলিটিক্যাল কালচার) বলতে পারি যা পরিবর্তিত হতে অনেক সময়ের প্রয়োজন হয়। আমার নিজের ধারণা, অবস্থার অনেক পরিবর্তন হলেও এখনো বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ধর্মভিত্তিক চিন্তাচেতনা থেকে বেরুতে পারেনি পুরোপুরি ওই জড়তার কারণে।
গত আট-দশ বছরে সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের বড় ঘটনা ঘটেছে অনেকগুলো। এর আগে সময়ের এবং সংখ্যার হিসেবে এত ঘটনার খবর পাওয়া যায় না; এই ব্যাপারটি তাৎপর্যপূর্ণ বর্তমান সরকারের জন্য যেখানে আওয়ামী লীগকে সংখ্যালঘুবান্ধব দল মনে করা হয়। বিচারহীনতা এবং অস্বীকার বা ডিনায়ালের যে সংস্কৃতি তার কারণে কোনো ঘটনারই বিচার হয়নি। এর ফলে যারা এসব কাজ করে তাদের জন্য বাংলাদেশ একটি অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। বিষয়টা যেন অনেকটাই সামাজিক বিনোদনের মতো ব্যাপার। আমেরিকায় এক সময় আফ্রিকান আমেরিকানদের লিঞ্চিং-এর সম্মুখীন হতে হতো কোনো বিচার আচার ছাড়াই; এসব ঘটনার আয়োজক এবং দর্শক বা অংশগ্রহণকারীদের মনোভাবও ছিল অনেকটা সামাজিক বিনোদন মেলায় অংশ নেয়ার মতো। আমার নিজের মনে হয়েছে, বাংলাদেশেও এ মনোভাব আস্তে আস্তে ছড়িয়ে যাচ্ছে এখানে সেখানে।
ঐতিহাসিকভাবেই বাংলাদেশের হিন্দু জনগোষ্ঠীর একটি অংশ নিরাপত্তার অভাব এবং অবিশ্বাসজনিত কারণে ভারতের সাথে অর্থনৈতিকভাবে সম্পৃক্ত। আবার সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর একটি অংশ মনে করে, সংখ্যালঘু বিশেষ করে হিন্দুদের আসল বাসভূমি ভারত, বাংলাদেশ নয়– কাজেই এদের ভারতেই চলে যাওয়া উচিত। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত ফ্যাক্টর খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। একটি একাডেমিক ক্যাম্পের মতে, বাংলাদেশের মানুষদের একটি বড় অংশ সবসময়ই ভারতবিরোধী; এর পেছনে ঐতিহাসিক কারণের সাথে এতদঞ্চলে ভারতের বড়ভাইসুলভ আচরণও অনেকাংশে দায়ী। এ বিষয়টি পরে কোনো এক সময় আলোচনা করা যাবে। শুধু সংক্ষেপে এটুকুই বলা যায় যে, এই ভারতবিরোধিতার সরাসরি ঋণাত্মক প্রভাব পড়েছে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের ওপর। আমাদের সমাজে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের যে অংশটি নিয়ে আজ আমি কথা বলছি তারা মূলত তাদের নিজেদের দেশের হিন্দুদের ভারতের সাথে এক করে দেখে। এরই ফলে দেখা যায়, এ জাতীয় ঘটনা ঘটলেই এরা ভারতের উদাহরন টানেন, যেন ভারতের মুসলিম নির্যাতন বাংলাদেশের হিন্দু নির্যাতনকে বৈধতা প্রদান করে। সংখ্যালঘু বিশেষ করে হিন্দুদের মাঝে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা অবিশ্বাস এবং নিরাপত্তাহীনতার অনুভবের কারণে ভারতে অর্থনৈতিক যে যোগসূত্র তৈরি হয়েছে সেটিও একটি অংশের গাত্রদাহের কারণ। মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশের মানুষ ইউরোপ-আমেরিকায় বাড়ি ঘর করলে সমস্যা নেই, কিন্তু ভারতে করলেই সমস্যা। এখানে যুক্তির চেয়েও যে ঐতিহাসিক অবিশ্বাসের একটি ব্যাপার হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে তৈরি হয়েছিল তা থেকে যেন মুক্তি নেই। এই অবিশ্বাস থেকেই সৃষ্টি হয়েছে সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক দূরত্বের (সোশ্যাল অ্যান্ড কালচারাল ডিস্ট্যান্স) দুই গোষ্ঠীর মধ্যে এবং এটিরই একটি প্রতিফলন আমরা ইদানীংকালে বেশি দেখতে পাচ্ছি।
কেন এটি এখন বেশি ঘটছে? আমি আগেই বলেছি মোটাদাগে সরকারের কিছু আপস ফর্মুলা তার কারণ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আওয়ামী লীগ কি সংখ্যালঘুদের জন্য কিছু করেনি? এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বর্তমান সরকার কাঠামোগত দিক থেকে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার যে আমলাতান্ত্রিক বলয় তার অংশীদার করেছে অতীতের যে কোনো সরকারের চেয়ে অনেক বেশি। এটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি বড় কমিটমেন্টের কারণেও ঘটেছে। তার এই কাজ মধ্যবিত্ত এবং শিক্ষিত হিন্দু জনগোষ্ঠীর জন্য খুবই ভালো একটি খবর। তার সরকারের এই নৈতিক অবস্থান যেটি যোগ্যতার ওপর জোর দিয়ে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে যে ডিসক্রিমিনেশানের ব্যাপারটি ছিল সেটি অনেকটাই দূর করেছে। আমি মনে করি এটিও এই সংখ্যালঘু বিশেষ করে হিন্দুদের ওপর একটি অংশের রাগের কারণ। মনে রাখা দরকার, যে কোনো সীমিত সম্পদের দেশে গোষ্ঠী সংঘাতের কারণ এই উপাদানের মধ্যে নিহিত। বর্তমান সরকারের সময় সংখ্যালঘু বিশেষ করে হিন্দুদের আমরা সমাসীন দেখছি সচিবের মর্যাদার পদগুলোতে; পুলিশের অতিরিক্ত আইজি, ডিআইজি, এসপি পদে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ বর্তমানে কর্মরত। আমি শুনেছি, পররাষ্ট্র ক্যাডারে সংখ্যালঘুরা নিয়োগ পাচ্ছে যা আগে কখনো ঘটেনি। আমার পিতা যখন কর্মরত ছিলেন সে সময় মনে আছে, তারা যুগ্ম সচিব পর্যন্ত যেতে পারলেই খুশি থাকতেন; আমার মনে আছে, আশির দশকের শেষাবধি পর্যন্ত মাত্র দু'জন হিন্দু যুগ্ম সচিব ছিলেন সে সময়ের পুরো প্রশাসনে। আর আজ প্রচুর যুগ্ম এবং অতিরিক্ত সচিবের কথা আমরা জানি যারা ধর্মীয় বিশ্বাসে হিন্দু এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের।
এই বিষয়গুলোই এক ধরনের ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে অনেকের মনেই। যুক্তরাষ্ট্রে আমি অনেক বন্ধুকে বলতে শুনেছি, দেশটা এখন হিন্দুরা চালায়; সব বড় বড় জায়গায় তারা। যারা এমনটি বলছে তারা কিন্তু প্রত্যেকেই শিক্ষিত এবং প্রতিষ্ঠিত মানুষ। আমার ধারণা, এ জাতীয় কথা একটি বড় অংশের মানুষেরই চিন্তার প্রতিবিম্ব। এর কারণটি আসলে কী? সমাজ এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি জনপ্রিয় চিন্তা হচ্ছে এই যে, তৃতীয় বিশ্বের বেশির ভাগ রাষ্ট্রে আমলাতন্ত্রই ক্ষমতার মূলকেন্দ্র নিয়ন্ত্রণ করে। এটি এখনো এসব দেশের ক্ষেত্রে সত্যি; তবে রাজনৈতিক এলিটদের সাথে এক ধরনের জোট বেঁধেই এই ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ এবং এর প্রয়োগটি ঘটে থাকে। এই ব্যাপারটি বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ক্ষেত্রে আরো বেশি সত্য। শক্তিশালী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় যেখানে আমলাতন্ত্রই সকল ক্ষমতার কেন্দ্রে সেখানে সংখ্যালঘুদের এই উত্থান মেনে নেয়াও অনেকের জন্য কঠিন। সীমিত সম্পদের দেশে এমনটি ঘটতে পারে। অনেকেই এই ঘটনাটির মাঝেও ভারত ফ্যাক্টরকে মূখ্য বিষয় মনে করেন; অর্থাৎ ভারতের প্রভাবেই বর্তমান সরকার সংখ্যালঘুদের বড়বড় জায়গায় পদায়ন করছে বলে এরা মনে করেন। কাজেই ভারতের প্রতি যে সন্দেহ বা অবিশ্বাস সেটি হিন্দুদের ওপর গিয়ে পড়ে এবং এরই ফল হচ্ছে দেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন বিষয়ে তাদের উদাসীনতা। তবে এটি আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে এবং গোষ্ঠীগত হিংসাত্মক মনোভাবের কারণ হিসেবে এটি চলে যাবে বলেই ধারণা করি।
মোটামুটিভাবে আমাদের দেশের ভেতরকার কারণের সাথে বৈশ্বিক কারণগুলোও বিবেচনায় নিতে হবে। লক্ষ্য করলে দেখা যায়, ২০০১ সালের পর সারা পৃথিবীতে ধর্মীয় মৌলবাদ এবং সন্ত্রাসের যে তাণ্ডব দেখা যায় তারই অবধারিত ফলাফল হিসেবে বাংলাদেশেও এই আদর্শটি ছড়িয়ে পড়ে বা ছড়িয়ে দেয়া হয়। জনপ্রিয় ইসলামের যে সুফীবাদী ভিত্তিটি অন্যান্য মুসলিমপ্রধান দেশ থেকে বাংলাদেশকে আলাদা করেছিল সেটি মোটামুটি অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয় ওয়াহাবী মতাদর্শ ছড়িয়ে দেয়ার কারণে। এই কারণেও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি যে বন্ধুত্ত্বমূলক দৃষ্টভঙ্গী ছিল সমাজে সেটি পাল্টে যায় দ্রুত এবং ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির যে জড়তা সেটি আরো শক্তপোক্ত হয়েছে।
আমি এই পুরো লেখাটিতে কোনো সমাধান প্রস্তাব করিনি এবং এটি আমার লেখার মূল উদ্দেশ্যও ছিল না। আমি শুধু সমস্যাগুলোর কথা বলেছি যেন কিছুটা বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গী থেকে বিষয়টিকে দেখা যায়। সমস্যাগুলো নিয়ে কাজ করলে নীতিনির্ধারকরা নিশ্চয়ই সমাধানে পৌঁছুতে পারবেন একদিন এবং বাংলাদেশ প্রকৃত অর্থেই অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির সমাজ হয়ে উঠবে। আমরা সেদিন বলতে পারব, এই অসাম্প্রদায়িকতার দাবিটি মিথ নয়, সত্যি স্বরূপ আমাদের এই মাতৃভূমির।