হিন্দুরা তাহলে কী করবে?

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 20 Oct 2021, 12:20 PM
Updated : 20 Oct 2021, 12:20 PM

ভাবছি খুব যত্ন করে কয়েকটা কবিতা লিখব। তারপর,

একটা কবিতার নাম দেবো ব্রাহ্মণ, একটা কবিতার নাম দেবো ক্ষত্রিয়।

একটা কবিতার নাম বৈশ্য রাখবো, একটা কবিতার নাম থাকবে শুদ্র।

আলাদা করে দুটো কবিতার নাম রাখবো, হিন্দু আর মুসলিম।

আর সবশেষে যে কবিতাটা লিখব, তার নাম দেবো মানুষ।

তারপর তোমাদের হাতে চাবি দিয়ে, সবকটা কবিতাকে একসাথে রেখে,

দশ-দশটা বছর ধরে একটা লোহার বাক্সে তুলে রাখবো।

নির্ধারিত দিনে বাক্সটাকে খুলে, সবকটা কবিতাকে আলাদা করে দেখো,

দেখো, মানুষ নামের কবিতাটাকে কেউ খুন করতে পেরেছে কিনা।

যদি পারে, তবে আমি খুনি, তবে তোমরা আমাকে ফাঁসি দিতে পারো।

তা নাহলে তোমরা সবাই সবার আত্মীয়। তা না হলে তোমরা সবাই সবার বন্ধু।

—রুদ্র গোস্বামী

কবিরা বড়ই অবুঝ। কত সুন্দর করে 'মানুষ' কথাটার মাহাত্ম্য নিয়ে বলেন, লেখেন। কিন্তু আমাদের সমাজটা এখন আর মানুষের কই! হয়ে গেছে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানের; ধর্মই যাদের প্রধান পরিচয়।

এদের মধ্যে কেউ সংখ্যাগুরু, কেউ সংখ্যালঘু। এক সম্প্রদায় আরেক সম্প্রদায়কে ঘৃণা করে। নানা ছলে একে-অপরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। যেমন পড়েছে কুমিল্লায়, নোয়াখালীতে, চট্টগ্রামে, সবশেষ রংপুরে। 

এর আগে রামু জ্বলেছিল গুজবে! সাইদীর ফাঁসির রায়ের পর আগুনে পুড়েছে চট্টগ্রামের বাঁশখালী, সাতকানিয়া, সীতাকুণ্ড, সাতক্ষীরা, সিরাজগঞ্জ, নোয়াখালীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের অসংখ্য হিন্দু পরিবার। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া চলার সময় নির্মমভাবে খুন হয়েছিলেন চট্টগ্রামের বাঁশখালীর বৃদ্ধ দয়াল হরি শীল, সিলেট নগরীর জগৎ জ্যোতি তালুকদার, মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার দাসের বাজার ইউনিয়নের সুশীল বিশ্বাস এবং নোয়াখালীর প্রকৌশলী সুমন ভৌমিক। ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল হাজারো হিন্দু পরিবারের। 

আক্রান্ত হয়েছে অভয়নগর, নোয়াখালী, ঠাকুরগাঁওসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বহু হিন্দু পরিবার। সবশেষ 'আওয়ামী লীগের ওপর ঝাল ঝাড়তে' ফেইসবুকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ এনে কুমিল্লার নাসিরনগর, গাইবান্ধা, পাবনার সাঁথিয়া, ভোলা, শাল্লাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দুদের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, উপাসনালয়ে হামলা চালানো হয়েছে। কোথাও কোথাও মাইকে ঘোষণা দিয়ে হাজার হাজার লোক জড়ো হয়ে হিন্দুদের গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে। পুলিশ-প্রশাসন ঠেকাতে পারেনি। কেউ বাধাও দেয়নি। 

এদেশের হিন্দুরাই কি তবে সবচেয়ে অসহায়? তাদের বেঁচে থাকা কেবল মার খাওয়ার জন্য? লুণ্ঠিত, প্রহৃত, ধর্ষিত হওয়ার জন্য? জানি, অনেকেরই সত্য স্বীকার করতে কষ্ট হবে।

আক্রান্ত কেউ যদি এখন মনে করেন যে, 'বাংলাদেশ উন্মত্ত ধর্মবাদী'দের দেশে পরিণত হতে চলেছে, তাকে 'ভুল' বলবেন কীভাবে?

হিন্দুদের ওপর সাম্প্রদায়িক সহিংসতা নিয়ে কিছু লিখলে, বলা হয়- "এগুলো রাজনীতি, অপপ্রচার। পৃথিবীর সব দেশে সংখ্যালঘুরা নির্যাতিত হয়। বাংলাদেশের হিন্দুদের চেয়ে ভারতের মুসলিমরা অনেক কষ্টে আছে।"

এ নিয়ে দেশের ক্ষয়িষ্ণু বামপন্থিদের কিছু বললে তারা বলেন, "সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার ব্যাপারে আমরা সবসময়ই সোচ্চার। আমরা সব মানুষের অধিকারের জন্য লড়াই করছি। আমরা হামলার বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়েছি। মিছিল করেছি। তাছাড়া নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব তো সরকারের। আমরা সরকারের প্রতিও দাবি জানিয়েছি।"

আওয়ামী লীগকে বললে তারা বলে, "জামায়াত-বিএনপি এ হামলা চালাচ্ছে। আমরা এর নিন্দা করি।" তারা হয়ত আক্রান্ত পরিবারের কাছে যাবেন, দুঃখ প্রকাশ করবেন, বিচারও চাইবেন।

বিএনপিকে বললে তারা বলে, "এটা আওয়ামী লীগের কারসাজি। ওরাই হিন্দুদের ওপর হামলা করে বিএনপির ওপর দায় চাপাতে চায়।" বিএনপিওয়ালারাও হিন্দুদের ওপর হামলা-নির্যাতনের প্রতিবাদ জানাবে।

প্রশাসন বলে, "তদন্ত চলছে। দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।"

এনজিওওয়ালারা বলে, "এটা সেনসেটিভ ইস্যু। পলিটিক্যাল ইস্যু। আমরা চাই সুশাসন। সুশাসন হলেই সবার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে।"

বন্ধুবান্ধবদের প্রশ্ন করলে কেউ দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেন, কেউ বা উদাস, বোবা হয়ে যান!

অনেকের উপলব্ধি হলো, আমাদের দেশের বাম এবং বিএনপিওয়ালারা হিন্দুদের বিশ্বাস করে না। তারা মনে করে, এরা 'আওয়ামী লীগের ভোটার'। সুতরাং এদের…। আবার আওয়ামী লীগের অনেকের ধারণা, 'আওয়ামী লীগের বাইরে এরা যাবে কোথায়!'

না, ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে ফেইসবুক-ব্লগেও তেমন গভীর লেখালেখি দেখি না। গাছ-বন্যপ্রাণী বাঁচাতে আন্দোলন হয়, সংখ্যালঘু বাঁচাতে হয় না। কোনও রাজনৈতিক দলই সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা ও সাংবিধানিক অধিকারের জন্য কোনও ধারাবাহিক প্রতিবাদ-সমাবেশ করার প্রয়োজন বোধ করে না।

বুদ্ধিজীবীরা বিষয়টিকে 'ক্লিশে' মনে করেন। এ নিয়ে লিখতে তাদেরও বুঝি আর উৎসাহ নেই। এদেশে এখন ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সমস্যা নিয়ে তাদেরই লিখতে হয়, যারা আক্রান্ত, বিপণ্ণ। অন্যরা গরজ দেখান না।

এদেশে সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের বিচার কতটা হয়েছে? সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এ ব্যাপারে 'প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ' তারা নিচ্ছে। কিন্তু কী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে? কতগুলো আক্রমণের ঘটনা দেশে ঘটল, আর কয়টার ব্যাপারে কী ব্যবস্থা নেওয়া হলো?

অনেকে আবার সংখ্যালঘুদের 'প্রতিরোধ' গড়ে তোলার আহ্বান জানাচ্ছেন। যারা এমন কথা বলছেন, তারা কি পরিবেশ-পরিস্থিতি আর হিন্দুদের বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে এ কথা বলছেন? নাকি সৌখিন বিপ্লবী চেতনায় গা-ভাসিয়ে? 

প্রতিকারহীনভাবে ধর্মীয় সংখ্যালঘু পরিবারের ওপর, বাড়িঘর-উপাসনালয়-ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ওপর আক্রমণ হচ্ছে। যারা প্রতিরোধের আহ্বান জানাচ্ছেন, তারা কি কখনও প্রতিরোধ করতে মাঠে নেমেছেন? কোনও সংখ্যালঘু পরিবারে হামলা হয়েছে বা হচ্ছে, সেই হামলা ঠেকাতে প্রগতিবাদী ভিন্ন ধর্মের কে কতটা ঝুঁকি নিয়েছেন বা আত্মত্যাগ করেছেন?

ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা বড় নিঃসঙ্গ, অসহায়। তাদের পাশে কেউ নেই! যাদের সামর্থ্য আছে, তারা নিরবে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। অনেকে গিয়েছেন এবং যাচ্ছেন। কিন্তু সহায়সম্বলহীন 'সংখ্যালঘুরা' কী করবে? কার কাছে সাহায্য চাইবে? তাদের পক্ষে কে দাঁড়াবে?

দয়া করে কেউ কি বলবেন, এদেশের হিন্দুরা, ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা, আশ্রয়-প্রশ্রয়-মনোবলহীন ৮ শতাংশ জনগোষ্ঠী এখন কী করবে?