হারুন স্যারের সাথে স্মৃতি

আরশাদ মোমেন
Published : 17 Oct 2021, 03:09 AM
Updated : 17 Oct 2021, 03:09 AM

স্কুল জীবন থেকেই আমার শিক্ষক ভাগ্য বরাবরই ভালো । আমার ছোটবেলার প্রথম ভাগটা কেটেছে মধ্যপ্রাচ্যে। দেশে ফেরার পর মা আমাকে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজের স্কুল শাখায়। কিন্তু এর আগে স্কুলে পড়ার অভিজ্ঞতা না থাকাতে আমার মা একজন গৃহশিক্ষক রেখে দিয়েছিলেন – তার নাম সাফারউদ্দিন আহমেদ।

ছোটবেলায় আমার একটা বাজে অভ্যাস ছিল,  একটা জিনিসের সাথে অন্য কিছু মিশিয়ে হাবিজাবি কিছু একটা বানানো।  এমন কিছু নেই যা এই অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে-  মায়ের লিপস্টিক, টর্চ- এর ব্যাটারি,  সাবান-গোলা পানি,  মশা মারার ওষুধ, পটাশ পারম্যাঙ্গানেট- সে এক অনেক লম্বা তালিকা। মা এ নিয়ে সাফারউদ্দিন স্যারের কাছে অভিযোগ করার পর উনি অনেক চিন্তা-ভাবনা করে আমার হাতে মাধ্যমিক পর্যায়ের ক্যামেস্ট্রি বইটা হাতে তুলে দিলেন। বললেন, কোনটার সাথে কী মেশাতে হয় এখান থেকে শিখতে পারবে। আমার চিন্তা-ভাবনার দিক এরপর থেকে একেবারেই  ঘুরে গেল। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার চেয়ে আমি তাত্ত্বিক জ্ঞান সম্পর্কে বেশি আগ্রহী হয়ে উঠলাম। ক্লাস সেভেনে ওঠার পর মায়ের উৎসাহেই  ভর্তি পরীক্ষা  দিয়ে ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হই।  শারীরিক কসরত নিয়ে বরাবরই আমার একটা অনীহা ছিল, এজন্য প্রথম দিকটায় কলেজে একদমই আমার মন বসতো না। তবে কলেজের লাইব্রেরিটা ছিল চমৎকার,  ছুটির দিনগুলোতেও খোলা থাকত। কলেজে বইয়ের সংগ্রহ ছিল চমৎকার- কলেজ পর্যায়ের বিজ্ঞানের বইতো ছিলই, পাশাপাশি ছিল বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের  বইও- গণিত, রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞান, ইতিহাস, অর্থনীতিসহ  সব কিছুরই। রসায়নের বই ঘাঁটতে গিয়ে দুটো জিনিস আবিষ্কার করলাম।  এক, উচ্চতর গণিত ছাড়া বিজ্ঞান নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি অসম্ভব আর রসায়নের সমস্ত জারিজুরির পেছনে আছে পদার্থবিজ্ঞান। যেমন, যোজনী বুঝতে গেলে  প্রথমে জানতে হয় পরমাণুর গঠন আর সেটা  বুঝতে গেলে জানতে হবে  পদার্থবিজ্ঞান।

বছরটা ছিল ১৯৭৯,  আইনস্টাইনের জন্মশত বার্ষিকী, আবার ওই বছরই আব্দুস সালাম পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল প্রাইজ পেলেন।  পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে আমার অনুসন্ধিৎসা আর  উৎসাহ জেগে উঠলো।  কলেজ লাইব্রেরিতে ছিল বাংলা একাডেমির বিজ্ঞানপত্রিকা আর প্রফেসর মোহাম্মদ ইব্রাহিমের বিজ্ঞান সাময়িকী পত্রিকা।  সেগুলো  উল্টেপাল্টে আবিষ্কার করলাম যে বাংলাদেশে এ এম হারুন-অর-রশিদ  নামে একজন পদার্থবিজ্ঞানী আছেন, যিনি এগুলো নিয়ে পত্রিকায়  নিয়মিত লেখেন, উনি নোবেলবিজয়ী বিজ্ঞানী আব্দুস সালাম- এর সাথে কাজ করেছেন আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।

প্রথমে ইচ্ছে হলো উনার সাথে গিয়ে দেখা করি । কিন্তু একে তো  আমি রয়েছি ঢাকার বাইরে,  তার উপর কলেজের চার দেয়ালের মাঝে ব্যস্ত জীবন। পাশাপাশি ওই পর্যায়ের মানুষের সাথে যে কথা বলবো সে রকম জ্ঞানও নেই। স্যারের সাথে দেখা করার জন্য সুযোগ বা সাহস  কোনটাই কুলোলো না। বছর পেরিয়ে যায়, মাধ্যমিকের পড়াশোনার পাশাপাশি ক্যালকুলাস আর কলেজ লাইব্রেরির আর্থার বাইজারের লেখা মেইনস্ট্রিম অব ফিজিক্স  বইটা পড়তে থাকি। তবে  বইটা থেকে অনুশীলন করার খুব একটা অভ্যাস গড়ে উঠলো না। 

ক্লাস টুয়েলভে  ওঠার  পরপরই  আমাদের  ব্যাচের  শিক্ষার্থীদের সাথে কলেজ প্রিন্সিপাল- এর  একটা  প্রশাসনিক সংঘাত  লেগে যায়। তখন  জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসন চলছে।  আমরা কলেজ থেকে পালিয়ে সবাই ঢাকা চলে এলাম। দায়িত্ব নিয়ে আমাদের দলের অনেকেই  দেখা করল  কেন্দ্রীয়  ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের সঙ্গে। ততদিন হারুন স্যারের  সাথে দেখা করার মতো কিছুটা  সাহস সঞ্চয় করেছি এবং গণিতও শিখেছি। আমার একজন আত্মীয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকায় স্যারের প্রতিবেশী ছিলেন। তার মাধ্যমে স্যারের সাথে দেখা করার জন্য একটা অ্যাপয়েন্টমেন্টের জন্য অনুরোধ করলাম। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকার কারণে সেটা  সহজেই পেয়ে গেলাম।

তারিখটা খেয়াল নেই,  কিন্তু প্রথম দেখার অভিজ্ঞতাটা  আমার খুবই  ভালো মনে আছে। স্যার তখন ঢাকা  বিশ্ববিদ্যালয়ের নব-প্রতিষ্ঠিত কম্পিউটার সেন্টারের পরিচালক। বুয়েটেও এরকম একটা সেন্টার ছিল, যার দায়িত্বে ছিলেন জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যার।  স্যারের সাথে দেখার করার সময় বাবা সাথে গেলেন। ঢাকায় বাসা হলেও রাস্তাঘাট ভালো চিনি না। রুমের দরজাটা ঠেলে ভেতরে যেতেই দেখি মোটা, ভারী ফ্রেমের চশমা পড়া গম্ভীর চেহারার একজন বসে আছেন ডেস্কের ওপারে, খাতা কাগজ সামনে নিয়ে অংক করছেন। পরিচয় দেওয়ার পর জানতে চাইলেন, কেন পদার্থবিজ্ঞান পড়তে চাই, পদার্থবিজ্ঞানের কোন কোন ব্যাপারে  আগ্রহ আছে। এসব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করে শেষে জানতে চাইলেন, কোন কোন বই পড়েছি ইত্যাদি। তার একটা কথা মাথায় ঢুকলো যে অনুশীলনীগুলো না করতে পারলে কোনো কিছু শিখেছি তা দাবি করা যাবে না। সব কথাবার্তা শেষে যা বুঝলাম তাহলো যতই যা পড়ি না কেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় না টিকলে যা পড়তে চাই, সবই হবে আকাশকুসুম কল্পনা। বলতে দ্বিধা নেই, আমার পদার্থবিজ্ঞানে ক্যারিয়ার গড়ার ব্যাপারে আমার বাবার এক ধরনের সন্দেহ ছিল। সেটার কারণ ছিল তার এক সহকর্মী সম্পর্কে তার বিরূপ ধারণা, যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমানে লুপ্ত অ্যাপ্লাইড ফিজিক্স বিভাগ থেকে পাশ করেছিলেন। তবে ব্যক্তিত্বের সাথে পঠিত বিষয়ের কী সম্পর্ক সেটা আজও  আমি বুঝে উঠতে পারিনি। তবে ইতালিতে আমাকে দেখতে যাওয়ার সময় বিজ্ঞানী সালামের সাথে আমার বাবার সাক্ষাৎ হয়। এরপর পদার্থবিজ্ঞানের পরিধি নিয়ে বাবার ধারণার বিশাল পরিবর্তন ঘটে যায়।   

এইচএসসি-র পর ঢাকা  বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। এরপর থেকে শুরু হলো সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে স্যারের কাছ থেকে শেখা। হারুন স্যার একজন সকালের পাখি ছিলেন। স্যারকে বরাবরই  ক্লাস নিতে দেখেছি সকাল ৮টায়। হোক তা  এমএসসি-র ক্লাস বা বিএসসি প্রথম বর্ষের ক্লাস। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর দুটো নতুন জিনিসের সাথে পরিচিত হলাম। এক হলো সেশন জট আর দুই হলো এরশাদ ভ্যাকেশন। অবশ্য দ্বিতীয় ব্যাপারটা প্রথম ব্যাপারে প্রভূত অবদান রাখলেও এরশাদ শাসনের আগ থেকেই সমস্যাটা বিদ্যমান ছিল। কিন্তু এরশাদ আমলেই সেশন জটের আকার মারাত্মক হয়েছিল।  ফলে, ১৯৮৬ সালের জানুয়ারি নাগাদ ভর্তি শেষ হলেও, প্রথম বর্ষের ক্লাশ শুরু কবে হবে- এই প্রশ্নের জবাব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ দিতে পারতেন না। আমার এই অভিজ্ঞতা না থাকায় স্যারকে জিজ্ঞাসা করলাম, এসময়টা কী করবো? স্মিত হেসে হারুন স্যার যা  বলেছিলেন তার মর্মার্থ ছিল: পড়াশোনা করো, এগুলো চিন্তা করে সমাধান করতে পারবে না।

তার অনুপ্রেরণাতেই আমি  ক্লাশ করা শুরু করি। প্রথম  বর্ষে নয়, এমএসসি-র ক্লাশ দিয়ে। কারণ প্রথম বর্ষের ক্লাস কবে শুরু হবে কেউ জানে না। আমার দিব্যি মনে আছে স্যারের কোর্সটির কথা। স্যার গ্রুপ থিওরি পড়িয়েছিলেন। সকাল ৮টায় ক্লাস থাকলেও স্যার ঝমঝম বৃষ্টির মাঝেও ক্লাস শুরু হওয়ার আগ থেকেই তার নতুন পদার্থবিজ্ঞান বিল্ডিংয়ের ( এটাকে যদিও সবাই ট্রিপল ই বিল্ডিং বলে, তবে এটা পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের জন্যই নির্মিত হয়েছিল) অফিসে উপস্থিত থাকতেন। স্যারের কাছ অনেক কিছুর তালিম পেলেও তার এই সময়ানুবর্তিতা আমি মোটেও রপ্ত করতে পারিনি। 

১৯৮৮ সালে বিএসসি সম্মান শেষ হওয়ার কথা থাকলেও আমাদের ব্যাচের সেই ডিগ্রি পেতে লেগে যায় ১৯৯১ সাল। তিন বছরের কোর্স শেষ হয়েছিল সাড়ে পাঁচ বছরে। সে হিসেবে হারুন স্যারের সাথে আমি আমার ডিগ্রির জন্য প্রয়োজনীয় সময়ের চেয়ে আরও আড়াই বছর বেশি সময় কাটিয়েছি। সেটা আমার ছাত্রজীবনের এক পরম পাওয়া। দুটো ঘটনা বলি। ১৯৮৯ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক বোস সিম্পোজিয়াম। অন্যান্যদের পাশাপাশি সেই সম্মেলনে এসেছিলেন হারুন স্যারের পুরোনো বন্ধু UCLA- এর অধ্যাপক ক্রিস ফ্রন্ডাল। তিনি পল ডিরাকের আবিষ্কৃত 'Singleton' নামের একটি বিশেষ তাত্ত্বিক কণাদল নিয়ে কাজ করছিলেন। আমি তখন দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছি, কিন্তু এরশাদীয় ভ্যাকেশনে ক্লাশ বন্ধ। স্যার আমাকে ডেকে বললেন, "তুমি তো মেসন কণা নিয়ে কিছু পড়াশোনা করেছ, এবার একটা ক্যালকুলেশন করো।" সেই কাজটা আমি দু সপ্তাহে শেষ করেছিলাম আর ওই সম্মেলনে সেই কাজটা আমি উপস্থাপন করেছিলাম। যদিও কার্জন হলে হারুন স্যার রাশভারী হিসেবে পরিচিতি ছিলেন, ওই সময়টায় আমি বুঝতে পেরেছিলাম, এটা শুধু তার বাইরের খোলস, ভেতরটা আসলে সম্পূর্ণ ভিন্ন। তা নাহলে আমাকে ক্রিস ফ্রন্ডালের সামনে তিনি দাঁড় করানোর সাহস দেখাতেন না। 

আরেকবার, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হলো বেশ লম্বা সময়ের জন্য। মনে হয়, ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ ছিল। আমি তখন থাকি কুর্মিটোলায়, বিমানবন্দর সংলগ্ন এলাকায়। তখন নিজ আগ্রহে সাধারণ আপেক্ষিকতা শিখছি। সদ্যপ্রয়াত আরেক নোবেলজয়ী স্টিভেন ভাইনবার্গের লেখা বই থেকে। কিন্তু লাইব্রেরির বই রিনিউ না করে দু সপ্তাহের বেশি রাখা যেত না। এই উটকো ঝামেলার কথা স্যারকে জানাতেই উনি তার নিজস্ব কপি আমার হাতে দিয়ে বললেন, 'যাও এখান থেকে পড়'। তখন ফটোকপি ছিল দুষ্প্রাপ্য, আর তার উপর বইটা ছিল ৮০০ পৃষ্ঠার। স্যারকে দেখতাম, উনি টানা দুই-আড়াই ঘণ্টা লিখে যেতে পারতেন। এমনই ছিল পড়াশোনার ব্যাপারে স্যারের ধৈর্য। তার অনেক কিছুই কপি করার চেষ্টা করতাম; ফাউন্টেন পেন ব্যবহার করা থেকে সুন্দর হাতের লেখা। শেষতক, নিউ মার্কেটের বুক ভিলার তিনটা ২৪ নম্বর খাতা ব্যবহার করে ভাইনবার্গের পুরো বইটাকেই হাতে কপি করেছিলাম। সময় লেগেছিল, কিন্তু লেখা শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত স্যার একটি বারও বইটা ফেরৎ দেয়ার তাগাদা দেননি। 

আমার একটা খেদ আছে যে, স্যারের কাছ ছয় বছরে ( ১৯৮৫- ১৯৯১) থেকে অনেক কিছুই  শিখেছিলাম, কিন্তু তাকে কখনোই নিয়মতান্ত্রিক কোর্স শিক্ষক হিসেবে পাইনি। তিনি কখনোই আমার কোনো পরীক্ষার খাতা মার্কিং করেননি, এমনকি থিসিস সুপারভাইজারও ছিলেন না। শেষের সুযোগটি পাইনি স্যারের কারণেই। তার বন্ধু প্রফেসর ফাহিম হোসেন যখন আবদুস সালামের গবেষণা কেন্দ্রে ডিপ্লোমা কোর্সের কো-অর্ডিনেটর হিসেবে নিযুক্তি পান, তিনি স্যারের কাছে ছাত্র চেয়ে চিঠি পাঠান। আমার আর পালানোর কোনো সুযোগ রইলো না। এমএসসি না করেই আমাকে দেশ ছাড়তে হলো। 

স্যার চলে গেলেন। কিন্তু তাকে জাতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উপযুক্ত সম্মাননা দিতে পারলো না। এই গ্লানি নিয়ে আমরা সবসময়ই বেদনা বোধ করতে থাকবো। না তাকে করতে পেরেছি জাতীয় অধ্যাপক, না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমেরিটাস অধ্যাপক। কারো প্রতি অশ্রদ্ধা না জানিয়ে বলছি, হারুন স্যারের তুলনায় অনেক কম যোগ্যতার লোক এরকম পদে আসীন হয়েছেন। তবে আমরা  যদি তার আদর্শগুলোকে ধরে রাখতে পারি, তবেই তার প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধা দেখানো হবে  বলে আমার বিশ্বাস। যা তার কাছ থেকে শিখেছি, তা হলো শিক্ষার কোনো শেষ নাই, এমনকি শিক্ষকের জন্যও।