একজন কাওসার চৌধুরীর মুখোমুখি

শিশির ভট্টাচার্য্যশিশির ভট্টাচার্য্য
Published : 15 Oct 2021, 05:50 PM
Updated : 15 Oct 2021, 05:50 PM

প্রামাণ্যচিত্রকার ও নাট্যাভিনেতা– আরও কিছু সম্পূরক গুণের মধ্যে কাওসার চৌধুরীর ব্যক্তিত্বে কালক্রমে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠেছে এই দুই প্রধান পরিচয়। গত চার দশক ধরে মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধাপরাধ ও বাঙালি জাতিসত্তার বিচিত্র বৈশিষ্ট্যের স্বাক্ষর বহনকারী বিপুল এক চলচ্চিত্র আর্কাইভ তিনি গড়ে তুলেছেন আক্ষরিক অর্থে নিজের হাতে, নিজের ক্যামেরায় নিজের চোখ রেখে। কাওসার চৌধুরীর মুখোমুখি হয়েছিলাম সম্প্রতি, ওর স্বগৃহে, এক অন্তরঙ্গ সাক্ষাৎকারে।

নাটক তো করছি সেই ১৯৬১ সাল থেকে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যবইয়ে একটা টেক্সট ছিল, 'আমচোর আনোয়ার'। সেটারই নাট্যরূপে আমি আনোয়ারের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলাম। চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত উপজেলা মহেশখালির ততোধিক প্রত্যন্ত এক গ্রাম মাতারবাড়িতে আমার জন্ম ও বাল্যশিক্ষা। চট্টগ্রাম শহরে হাই স্কুল আর কলেজ শেষ করেছি সত্তরের দশকে। তারপর পাড়ি জমাই ঢাকা শহরে। প্রথম দিন রাত কাটাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদে। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, ঘুম ভেঙে গেল মৌলভি সাহেবের চিৎকারে: 'সালাত, সালাত'। ঘুমচোখে বলেছিলাম, 'এখন সালাদ খামু না!'

আইনে ভর্তি হয়েছিলাম প্রথমে। কয়েক দিন ক্লাস করেই মনে হলো, এটা কোনো সাবজেক্ট হলো! 'দুর্গতকে রক্ষা করো দুর্জনেরে হানো!' আইন প্রণীত হয়েছিল দুর্বলকে রক্ষা করার জন্যে, কিন্তু দুর্জন এই আইন কিনে ফেলছে, আইনের প্রয়োগ করবে যে বিচারক ও রাষ্ট্র, সেগুলোও হয়তো কেনার চেষ্টা করছে। বীতশ্রদ্ধ হয়ে আইন ছেড়ে চলে গেলাম বাংলায়। ইতোমধ্যে কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে নাটকের দলে যোগ দিয়েছি। কয়েক বার দলবদল করে থিতু হয়েছি নাগরিকে। উপস্থিত বক্তৃতা, খেলাধুলায় পুরস্কার-পদক পাচ্ছি। আবু হেনা মোস্তফা কামাল স্যার একদিন তার স্বভাবসিদ্ধ কণ্ঠে অতি শুদ্ধ উচ্চারণে বললেন, 'কাওসার, লেখাপড়া আপনাকে দিয়ে হবে না, আপনি নাটক করছেন, তাই নিয়ে থাকুন।'

ভবিষ্যতের জন্যে ডিগ্রি তো একটা দরকার। আমার করণীয় ও ভবিষ্যৎ নির্ধারণে 'মেডিকেল বোর্ড' বসল। বোর্ড সিদ্ধান্ত দিল, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতিই হবে আমার জন্যে উপযুক্ততম বিষয়। বেশি পড়াশোনা করতে হবে না, সময়মতো পরীক্ষা-টরীক্ষা দিলেই একটা সার্টিফিকেট মিলে যাবে। আমি নিজে কিন্তু খুব উপকৃত হয়েছি এই বিষয়টি পড়ে, বিশেষ করে ইসলামি স্থাপত্যের দিকে আমার মনোযোগ আকর্ষিত হয়েছিল। বুয়েটেও আমি স্থাপত্যের ক্লাস করতে যেতাম। ক্লাসে একদিন ধরা পড়ে গিয়েছিলাম। শিক্ষক মহোদয় বহিষ্কার করতে গেলে একাধিক জন এই দীন বহিরাগতের সমর্থনে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। ইসলামের ইতিহাস ছাড়া অন্য বিষয়ের ক্লাসেও হাজির থাকতাম কলাভবনে। আমাদের সময়ে বিখ্যাত সব শিক্ষকেরা ছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে– আহমেদ শরীফ, সরদার ফজলুল করিম, আনিসুজ্জামান, কবীর চৌধুরী, এমাজ উদ্দীন, মমিনুল হক চৌধুরী, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী… আমরা সব বিভাগের ছাত্রেরা তাদের ক্লাসে এসে আনতশিরে মন্ত্রমুগ্ধের মতো বক্তৃতা শুনতাম।

মুক্তিযুদ্ধ নিজের চোখের সামনে দেখেছি, মুক্তিযুদ্ধে অংশও নিয়েছি। একটি কবিতা লিখেছিলাম বছর বিশেক আগে। কবিতাটির শিরোনাম 'চুমকি'। সুদীর্ঘ এই গদ্য কবিতা পড়ে প্রথমে মনে হবে, এর বিষয় কিশোর প্রেমিকের প্রিয়তমা কোনো নারী। কিন্তু উপসংহারে (কবিতারও উপসংহার আছে, বুঝুন কত লম্বা এই কবিতা!) গিয়ে দেখা যায়, নারী নয়, কবিতার উপজীব্য ১৯৭১ সালে আমার ব্যবহৃত, ত্রিশ বছর ধরে অব্যবহৃত, জংধরা একটি স্টেনগান যার আদরের ডাকনাম 'চুমকি'।

বেশির ভাগ মুক্তিযোদ্ধার বিবেচনায় মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। আমার বিবেচনায় কোনো মুক্তিযুদ্ধ এত তাড়াতাড়ি, মাত্র নয় মাসে শেষ হবার বিষয় নয়। মুক্তি মানে তো শুধু পাকিস্তানিদের শোষণ থেকে পরিত্রাণ নয়। একটি সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, বাঙালি জাতীয়তাভিত্তিক বাংলাদেশ যতদিন প্রতিষ্ঠিত না হবে, মুক্তিযুদ্ধ ততদিন জারি থাকবে। প্রজন্মান্তরে চলবে, চলছে এই যুদ্ধ, আমাদের জ্ঞাত কিংবা অজ্ঞাতসারে।

'তাড়াতাড়ি ছবি শেষ করুন। সবার তো বয়স হচ্ছে!' মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেখা হলেই তাড়া দিতেন। সত্য বটে, আজ থেকে কয়েক দশকের মধ্যেই সর্বশেষ মুক্তিযোদ্ধা এবং রাজাকারটিও পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে। যারা কথা বলেছেন আমার বিভিন্ন প্রামাণ্যচিত্রে, গত চল্লিশ বছরে, তাদের সিংহভাগ ইতোমধ্যে গত হয়েছেন। বাকিরাও গত হবেন অল্প কিছু দিনের মধ্যে, বিদায় নেব আমি নিজেও। আর কিছুদিন পরেই শহীদের সংখ্যা তিন হাজার, ত্রিশ হাজার, নাকি ত্রিশ লাখ– এই উত্তপ্ত কুতর্ক থেমে যাবে চিরদিনের মতো।

ব্যক্তি নয়, তথ্যও নয়, প্রমাণ সেদিন থেকে একা কথা বলবে। মুক্তিযুদ্ধের অজস্র প্রমাণের মধ্যে অল্প কয়েকটি মাত্র আমি পরবর্তী প্রজন্মের হাতে তুলে দিয়ে গেলাম। পরবর্তী প্রজন্মও তথ্য সংগ্রহ করবে বৈকি এবং প্রমাণ দিয়ে সেই সব তথ্যকে তারা সত্যও প্রমাণ করবে। তাদের তথ্য আর আমাদের তথ্য, তাদের প্রমাণ আর আমাদের প্রমাণ মিলিয়ে পরবর্তী এবং তৎপরবর্তী প্রজন্ম সিদ্ধান্ত নেবে, একাত্তর সালে আসলেই কি মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল? যদি হয়ে থাকে, তবে কী ছিল সেই যুদ্ধের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য? তারা আরও জানতে চাইবে, মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য আদৌ বাস্তবায়িত হয়েছে কিনা। যদি না হয়ে থাকে, তবে সেই সব লক্ষ্য বাস্তবায়নে কী কী করণীয়। এভাবে প্রজন্মান্তরে বাঙালির মুক্তির যুদ্ধ চলমান থাকবে।

দক্ষিণ এশিয়ার, বাঙালি জাতির রাজনৈতিক ইতিহাসে ২৫ মার্চ ১৯৭১ রাত একটি মাইলফলক। এই বিশেষ রাতে বহুযুগের জন্যে এই অঞ্চলের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি স্থির হয়ে গেছে। এই রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বিশেষ করে জগন্নাথ হলের ওপর আক্রমণ পরিচালনা করেছিল। পৃথিবীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় যেটি জাতির ওপর প্রথম আঘাতটি মাথা পেতে নিয়েছে। পাকিস্তানিরাও প্রথম আঘাত দেবার জন্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেই বেছে নিয়েছিল, কারণ তারা জানত, কোথায় লুকিয়ে আছে বাংলাদেশের প্রাণভোমরা, তখনও, এখনও।

এই বিশেষ ঘটনাটিকে উপজীব্য করে আজ থেকে কুড়ি বছর আগে আমি একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছিলাম: 'সেই রাতের কথা বলতে এসেছি!' এই ছবির এডিটিং-এর খরচ নির্বাহ করার জন্যে নিজের গাড়িটি আমাকে বিক্রি করে দিতে হয়েছিল। নেপালে এই ছবি পুরস্কার পেয়েছে, আমেরিকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য হয়েছে, কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, যে বিশ্ববিদ্যালয়টি এই ছবির বিষয়বস্তু, সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ছবি খুব একটা সমাদৃত হয়নি। আমাদের দেশের শিক্ষিত ব্যক্তিদের ইতিহাস-বিমুখতা আমাকে হতাশ করে, কিন্তু কী আর করা যাবে।

স্থান-কাল-পাত্র। যুদ্ধাপরাধের সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ অনন্য– এত অল্প কালে, এত বেশি পাত্র এমন ভয়ঙ্কর যুদ্ধাপরাধের শিকার হয়নি সম্ভবত, কোনো স্থানে, কোনো কালে। বাংলাদেশের সব জায়গায় যুদ্ধ হয়নি, কিন্তু বাংলাদেশের এমন এক ইঞ্চি মাটিও হয়তো নেই, যেখানে যুদ্ধাপরাধ হয়নি। আমরা যারা 'বাংলাদেশ' নামক স্থানের উত্তরাধিকারী এবং স্বত্বাধিকারী, তাদেরকে এই রাষ্ট্রের জন্মযুদ্ধের ইতিহাস যেমন জানতে হবে, তেমনি জানতে হবে, এখানে সংঘঠিত যুদ্ধাপরাধের ইতিহাস, যাতে কখনই আর এই অপরাধের পুনরাবৃত্তি হতে না পারে এই দেশে। 'বধ্যভূমিতে একদিন' প্রামাণ্যচিত্রে এই ইতিহাসটাই তুলে ধরা হয়েছে প্রত্যক্ষদর্শীদের জবানে।

একেকটি ছবি করতে সময় লেগেছে হয়তো চার থেকে আট বছর বা তার চেয়ে কিছু বেশি, কিন্তু মনে মনে এই সব ছবির পরিকল্পনা করেছি আমি কয়েক দশক ধরে। গর্ভকাল প্রসবকালের তুলনায় দীর্ঘতর হওয়ারই কথা। কিন্তু প্রসব তো শুধু নয়, প্রসবযন্ত্রণাও আছে। 'সেই রাতের কথা'য় খরচ হয়েছিল লাখ পঁচিশেক টাকা, সেই সময়ের হিসাবে। 'বধ্যভূমিতে একদিন' ছবিতে খরচ হয়েছে সত্তর লক্ষ টাকা, এই সময়ের হিসেবে। 'মাত্র বিশ লাখ টাকা সরকারি অনুদানে কী হয়?' নিশ্চয়ই হয়, না হলে লোকে নিচ্ছে কেন এই টাকা, টাকা নিয়ে ছবিইবা করছে কীভাবে? আবার হয় না যে সেটাও তো সত্য, কারণ মুক্তিযুদ্ধ যে দেশের প্রধান প্রাণস্পন্দন, সেই দেশে মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্যচিত্র করতে গিয়ে স্ত্রীর অলঙ্কার, পৈত্রিক জায়গাজমি বিক্রি করে একজন নিবেদিতপ্রাণ চলচ্চিত্রকারকে নিঃস্ব হতে হয় কেন। যারাই ভালো ছবি করার ব্রত নিয়েছেন আমাদের দেশে, তাদের বেশির ভাগেরই এই অবস্থা। 'সরকার কি কোটি খানেক টাকা দিতে পারে না একেকটি ছবির জন্যে?' নিশ্চয়ই পারে, চাইলেই পারে, তবে এক্ষেত্রে সরকারের সদিচ্ছার অভাব আমি ততটা দেখি না, যতটা অভাব দেখি আমাদের নিজেদের সততা ও আন্তরিকতার।

তথ্যচিত্র আর প্রামাণ্যচিত্রের মধ্যে তফাৎ আছে। তথ্য আর প্রমাণেও আছে বিস্তর ফারাক। আমি তথ্যচিত্র নির্মাণ করছি না, প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করছি। 'বধ্যভূমিতে এক দিন' প্রামাণ্যচিত্রে খেয়াল করবেন, বার বার আমি কুশীলবদের জিগ্যেস করছি, 'পাকিস্তানি হানাদারেরা মেয়েদের ওপর অত্যাচার করেছে, বোমা তৈরি করার অপরাধে জীবন্ত মুক্তিযোদ্ধার বুক চিড়ে হৃদপিণ্ড উপড়ে নিয়ে এসেছে, ট্রেন থামিয়ে গরুছাগলের মতো জবাই করছে একেকজন মাড়োয়ারি হিন্দু নারী-পুরুষকে, এসব ঘটনা আপনি নিজের চোখে দেখেছেন?' স্থান-কাল-পাত্র। মুক্তিযুদ্ধের অত্যাচারের চাক্ষুস সাক্ষীরা নিজের মুখে বলছে: 'হ্যাঁ আমি নিজের চোখে দেখেছি, এই স্থানে, এই সময়ে এই পাত্র কিংবা পাত্রেরা এই সব কুকর্ম করেছে।' আমি প্রাণপণে প্রমাণ খুঁজে চলেছি – যেসব প্রমাণ পেয়েছি, সেগুলো রেখে যাচ্ছি আমার ছবিতে– এ কারণেই আমার ছবিগুলো প্রামাণ্য।

যদি লেখক হতাম, লিখে প্রমাণ রাখতাম (কথা আসলে সত্য নয়, কাওসার চৌধুরীর লেখার হাত চমৎকার!)। ক্যামেরার কাজটা যেহেতু শিখেছি, কমবেশি জানি, সেহেতু ছবি তুলেই প্রমাণ রেখে যাচ্ছি। 'নাহি বর্ণনার ছটা, ঘটনার ঘনঘটা, নাহি তত্ত্ব, নাহি উপদেশ। অন্তরে অতৃপ্তি রবে, সাঙ্গ করি মনে হবে, শেষ হয়ে হইল না শেষ!' প্যানোরামা, ফেড ইন, ফেড আউট, লং, মিডিয়াম, ক্লোজ শটের কারিকুরি কারও চেয়ে আমি কম জানি না। কিন্তু প্রামাণ্য চিত্রে প্রমাণ, চাক্ষুষ সাক্ষীর মুখের কথায় যে শক্তি থাকে, তার ঔজ্জ্বল্যে বাকি সব কিছু বাহুল্য মনে হয়। সুতরাং আমি সে পথে যাইনি। 'সহজ কথা যায় না বলা সহজে।' সহজভাবে সত্য কথা বলার চেষ্টা করেছি, কতটা সফল হয়েছি সেটা দর্শক বিচার করবেন।

কোনো ছবির সম্পাদনাই সহজ নয়, তবে আমার ছবিগুলোর সম্পাদনা কঠিনতর এ কারণে যে এর রাশের পরতে পরতে এক রাশ আবেগ মিশে আছে। একে তো মুক্তিযুদ্ধ, এমনিতেই আমার আবেগের বিষয়, তার ওপর বধ্যভূমির স্মৃতি মানেই তো মানুষের চরমতম কষ্টের কাহিনি। 'আর আওয়ামি লীগ করবি?' জিজ্ঞেস করতে করতে কলেজ পড়ুয়া যুবক ছেলের গলাটা কেটে মাথার ওপর কাটা ধড়টা উল্টে ধরে বিধবা মাকে রক্ত দিয়ে গোসল করিয়েছে রাজাকারেরা 'আল্লাহু আকবর' ধ্বনি দিতে দিতে। সদ্যবিবাহিতা বধূর স্বামীকে ব্রাশফায়ারে হত্যা করেছে তার চোখের সামনে, বাসরঘরের অদূরে।

'আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল, শুধাইল না কেহ।' পঞ্চাশ বছর ধরে এমন সব স্মৃতি আঁকড়ে বেঁচে থাকা আক্ষরিক অর্থেই 'সর্বহারা' একেক জন নারী-পুরুষের কথা ও অভিব্যক্তি ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে পুনরাবৃত্তভাবে হজম করে যাওয়া কি সোজা কথা! সম্পাদনার আগে বার বার রাশ না দেখেও তো আমার উপায়ন্তর নেই। আমি পরিচালক, আমারই ছবি, আমাকে তো রাশ দেখতেই হবে। কিছুক্ষণ দেখেই চোখ ভিজে আসতে থাকে। হৃদয়ের বাষ্প অনতিবিলম্বে শ্রাবণের ধারার মতো দু চোখ বেয়ে নামতে থাকে।

ফরাসি ঐতিহাসিক মিশলে বলেছিলেন, 'পণ্ডিতেরা সর্বদা কষ্ট পায়, কিন্তু এই কষ্ট তাদের বাঁচার অন্যতম উপলক্ষ্যও বটে'। কাওসার চৌধুরী বলতে থাকেন, কী করব, আমি নিজেই বেছে নিয়েছি এই কষ্টের জীবন। আমি কাঁদি, আমার সম্পাদক কাঁদে, আশেপাশে আর যারা আছে, তারাও কাঁদে। অল্প কিছুক্ষণ দেখে, কেঁদে কেটে মন এতটাই ভার হয়ে যায় যে আর কাজ করতে পারি না। চোখ বন্ধ করে এডিটিং প্যানেলের পাশেই মেঝেতে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ি কিংবা বেঙ্গল ফাউন্ডেশনে গিয়ে খানিকটা আড্ডা দিয়ে আসি।

কমপক্ষে ছয় রকমের প্রামাণ্যচিত্র আছে, গুরুরা শিখিয়েছেন। আরে না না (হাসি) ভয় নেই, কোনো তাত্ত্বিক আলোচনায় আমি যাচ্ছি না। যে প্রামাণ্যচিত্রগুলো বানিয়েছি, নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকেই বানিয়েছি, কাউকে কিছু বলতে প্ররোচিত করিনি, বাধ্য করিনি কিছু বানিয়ে বলতে। কিন্তু এটা তো ঠিক যে মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে আমার নিজের একটা অবস্থান, একটা থিসিস তো অবশ্যই আছে। থিসিসটা হচ্ছে: একাত্তর সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালিদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন-হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। আমি যেহেতু মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক, সেহেতু এমন সব প্রমাণ আমি একত্র করতে চাই, যেগুলো প্রধানত আমার এই থিসিসের পক্ষেই যায়। এই থিসিসের বিপরীতে 'অ্যান্টিথিসিস' উপস্থাপন করতে চান, এমন লোকজনও আছেন বৈকি। তারা তাদের মতো করে প্রমাণ সংগ্রহ করবেন, প্রামাণ্যচিত্র বানাবেন, কেউ কেউ ইতোমধ্যে বানিয়েছেনও নিশ্চয়ই। দুই দিকের প্রমাণ, প্রামাণ্যচিত্র দেখে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যাতে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে, সে লক্ষ্যেই গত চার দশক ধরে প্রমাণ সংগ্রহ করে যাচ্ছি আমি।

সহকর্মীরা আমার কাজের মূল্যায়ন করে কিনা জানতে চাইছেন? আমার প্রামাণ্যচিত্র নিয়ে তারা কী ভাবেন, জানি না। তবে 'গ্যালিলিও', 'নূরলদীনের সারা জীবন' এই সব বিখ্যাত নাটকের কথা খুব মনে পড়ে। শেক্সপিয়রের হ্যামলেট নিয়ে কলকাতা গিয়েছিলাম নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ের সঙ্গে। সেবার আমি হ্যামলেটের পিতৃব্য ক্লডিয়াসের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলাম। আমার অভিনয়ের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন আসাদুজ্জামান নূর। কোলকাতার কাগজেও প্রশংসাসূচক বক্তব্য লেখা হয়েছিল। একের প্রশংসায় অন্যের ইর্ষান্বিত হওয়া অসম্ভব নয়। একজন শিল্পীর জীবনে, সাফল্যের সিঁড়িতে ওঠানামায় সহশিল্পীদের এই সব প্রশংসা এবং ইর্ষার ইতি বা নেতিবাচক প্রভাব তো কিছু থাকেই।

চলচ্চিত্র জগতে গুরু আলমগীর কবিরের অনেক ছাত্রের মধ্যে আমি একজন। তিনি একটি ফিল্ম ইনস্টিটিউট খাড়া করেছিলেন আশির দশকে। এই ইনস্টিটিউট থেকে আমাদের ব্যাচে জনা চল্লিশেক পরীক্ষা দিয়ে জনা পনেরো হয়তো পাশ করেছিলাম, ভর্তি হয়েছিল আরও অনেক। ৩৫ মিলিমিটার, ১৬, ৮– সেলুলয়েডের সব ফরম্যাটেই কাজ শিখেছিলাম গুরুর কাছে। সেই জ্ঞান কাজে লাগিয়ে চলচ্চিত্রের সবগুলো ফর্মেই কমবেশি কাজ করেছি, টেলিভিশনে হয়তো একটু বেশি, সিনেমায় হয়তো খুবই কম।

একাশি সাল থেকে ভিডিও করছি। প্রথম দিকে পেটের দায়ে বিয়ের অনুষ্ঠানও রেকর্ড করতে হয়েছে। কিছুটা স্বচ্ছলতা আসার পর এক সময় এমন সব বিষয় ধারণ করেছি আমার নিজের ক্যামেরায়, কোনো না কোনোভাবে যেগুলোর একটা আর্কাইভ ভ্যালু আছে, অন্ততপক্ষে আমার দৃষ্টিতে। গত চল্লিশ বছরে বহু বিচিত্র বিষয় আমি রেকর্ড করেছি– রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে শিলাইদহের কুঠিবাড়ির অন্ধ গায়ক, রাতের ঢাকার প্রমোদবালা, কার না সাক্ষাৎকার নিয়েছি আমি। শেখ হাসিনার আশির দশকের জনসভা, গ্রামীণ ধর্মীয় উৎসব, বীরাঙ্গনা-মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতিচারণ… বাংলাদেশের এত শত প্রামাণ্য ভিডিও ডকুমেন্ট, জানি না, আমি ছাড়া আর কার কাছে আছে এই দেশে।

প্রামাণ্য ডকুমেন্টের এই বিপুল, বিচিত্র, পর্বতপ্রমাণ সংগ্রহের নামকরণ, তালিকাকরণ এবং সংরক্ষণ দরকার, জাতি ও রাষ্ট্রের স্বার্থেই দরকার। জানি না, এই কর্মযজ্ঞ সমাপ্ত করার উপযুক্ত আর্থিক ও শারিরীক সামর্থ্য আমার একার থাকবে কিনা কিংবা এর জন্যে যথেষ্ট সময়ও আমি পাব কিনা। ভয়ের কথা হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের এই ব্যক্তিগত আর্কাইভের ওপর স্বাধীনতাবিরোধীদের কুনজর রয়েছে। ক্লান্ত মুক্তিযোদ্ধাদের দিক থেকে যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু অক্লান্ত, আপসহীন রাজাকারদের প্রতিশোধস্পৃহা বিন্দুমাত্র কমেনি। আমার বাড়ি থেকে একাধিক বার চুরি হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের, বধ্যভূমির প্রামাণ্যচিত্র। এডিট করার বাহানায় শত্রু এসে ফুটেজ ডিলিট করে গেছে কয়েক বার, নষ্ট করে গেছে আমার হার্ডডিস্ক। এভাবে শত শত ঘন্টার শুটিং হারিয়ে গেছে। আমি কিন্তু দমে যাইনি। যেভাবেই হোক, ছবি শেষ করেছি।

দুটি টিভি নাটক পরিচালনা করেছিলাম, সেও দুই দশক হয়ে গেল। শ তিনেক নাটকে ও অনুষ্ঠানে ক্যামেরাম্যান ছিলাম। টেলিভিশনে শ খানেক নাটকে অভিনয় করেছি। দেখা হলে এখনও লোকে বলে, 'আহা, ওমুক নাটকে আপনার কী অভিনয়!' 'আমি শুনে হাসি, আঁখি জলে ভাসি!' অভিনয় করতে আমার ডাক পড়েনি গত কুড়ি বছর, না বাংলাদেশ টেলিভিশনে, না কোনো চ্যানেলে। কোনো দুঃখ বা অভিযোগ নেই। উদীয়মান সূর্যের চেয়ে অস্তায়মান সূর্যের তারিফ কম হবে– জীবনের এটাই স্বাভাবিক নিয়ম নয় কি?

(হাসি) ভাববেন না, বয়স হয়েছে বলে কিংবা এই করোনা-আকালে ভয় পেয়ে এসব হতাশাব্যঞ্জক কথা বলছি। আরও কিছুদিন নিশ্চয়ই বাঁচব, আরও কিছু ভালো কাজ নিশ্চয়ই করব, শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে, মিত্রদের শুভেচ্ছায়, কী বলেন? না, না, আসলেই আমার কোনো আফসোস নেই। এই দেশের অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ আর ভালোমন্দের সঙ্গে জীবনটাকে জড়িয়ে নিয়েছিলাম শৈশবেই, স্বজ্ঞানে, স্বেচ্ছায়। 'যেন এই দেশেতে জন্মি আবার, এই দেশেতে মরি!' নিজের কাজটুকু ঠিকঠাক মতো করে এই দেশের মাটিতে চোখ বুজতে পারলে আর কিছু চাই না।

সুলতানী কিংবা মোঘল আমল হলে খাসমহল থেকে একজন কাওসার চৌধুরীকে দেওয়া হতো 'রায়গুনাকর' বা অনুরূপ কোনো উপাধি। আমাদের এই পোড়া সময়ে না আছে সেই রাম, না আছে অযোধ্যায় গুণীর গুণের সামান্যতম আদর। 'সত্যিকারের বীর তারাই, যারা কখনই পুরস্কৃত হন না, কেউ যাদের চেনে না।'– পড়েছিলাম শৈশবে এক ইংরেজি কবিতায়। কথাগুলো বলতে চাইছিলাম, সান্ত্বনা হিসেবে নয়, জাতির পক্ষ থেকে আক্ষেপ হিসেবে, নিরবে-নিভৃতে, কারও বিশেষ তোয়াক্কা না করে, এক মনে কাজ করে যাওয়া আমাদের সময়ের এই 'হিরো'-টিকে যাকে আমরা অতি কাছের কয়েকজন (যারা নিজেরাও ঠিক শিশু নই) আদর করে 'বুড়ো' বলে ডাকি। আমাকে থামিয়ে দিয়ে বুড়োর মুখ থেকে বেরোল সুনীলের একটি কবিতা, যে কবিতাটি চমৎকার, জলদগম্ভীর কণ্ঠে আবৃত্তি করতে শুনেছি তাকে বহুবার: 'যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অঙ্গুলি ছোঁয়াবো, আমি বিষপান করে মরে যাবো, বিষণ্ন আলোয় এই বাংলাদেশ, নদীর শিয়রে ঝুঁকে পড়া মেঘ, প্রান্তরে দিগন্ত নির্নিমেষ– এ আমারই সাড়ে তিন হাত ভূমি।'