শেখ হাসিনা: দ্য লেডি অব ঢাকা

মুহাম্মদ শফিকুর রহমান
Published : 27 Sept 2021, 06:00 PM
Updated : 27 Sept 2021, 06:00 PM

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার ওপর একটি ইংরেজি প্রবন্ধ লেখার জন্য এ শিরোনামটি ঠিক করে রেখেছিলাম। ২৮ সেপ্টেম্বরে তার ৭৪ তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে লেখাটির শিরোনামও একই রেখে দিলাম। কারণ, একজন বিদেশি সাংবাদিক যখন তাকে পরিচয় করিয়ে দেন তখন 'দ্য লেডি অব ঢাকা' বলেই পরিচয় করিয়ে দেন।

শত সাফল্যের পথ পেরিয়ে প্রায় এক যুগের কাছাকাছি হতে চললো শেখ হাসিনা জনগণের ম্যান্ডেটে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন অপ্রতিরোধ্য গতিতে। তবু তার বিরুদ্ধে কিছু অমানুষ, যারা চুরি-বাটপারি করে দেশে টিকতে না পেরে বিদেশের মাটিতে ঠাঁই নিয়েছে, কুৎসা রটিয়েই চলেছে। তারা শেখ হাসিনার সমালোচনা করতে গিয়ে এমন মিথ্যার আশ্রয় নেয়, এমন ভাষায় কথা বলে- শুনলেই যে কেউ নিশ্চিত হবেন যে, ওরা কোনও ভদ্র পরিবেশে জন্মায়নি বা বড় হয়নি। এদের 'অরিজিন' অবশ্যই রগকাটা-গলাকাটা জামায়াত ও শিবির। এর সাথে যোগ দিয়েছে সামরিক বাহিনী থেকে বরখাস্ত, পলাতক কিছু কুচক্রী সেনা কর্মকর্তা। এদের ভাষা অভিন্ন। এই কুচক্রী মহলের ক্রমাগত কুৎসার বিপরীতে শেখ হাসিনার কৌশল কেবল উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাওয়া।

শেখ হাসিনার জন্ম দেশ বিভাগের অল্প কয়েকদিন পর, ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর তার পৈতৃক বাড়ি গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে। ওই বছরই বঙ্গবন্ধু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইসলামিয়া কলেজে) গ্রাজুয়েশন ডিগ্রি অর্জন করে ঢাকায় ফিরে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে (এলএলবি) ভর্তি হন। তখন বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু সেই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন এবং অল্পদিনেই নেতৃত্বে চলে আসেন। এরপরেই শুরু হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলন। বঙ্গবন্ধু এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে গ্রেপ্তার হন। শুরু হয় তার কারাজীবন, ৫ দিন বাসায় তো থাকেন, তো ৫০ দিন কারাগারে। শুনেছি বঙ্গবন্ধু এক মামলা থেকে জামিন নিয়ে বাসায় গেলে পরে দুই-একদিনের মধ্যে আবার গ্রেপ্তার হতেন বলে কারাগারে যাবার প্রস্তুতি হিসেবে জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা তার দৈনন্দিন ব্যবহার্য কাপড়-চোপড়, সাবান, ব্রাশ, পেস্ট ইত্যাদি দিয়ে সুটকেস সাজিয়ে রাখতেন।। এইভাবে শেখ হাসিনা বড় হয়েছেন। তার রাজনীতির পাঠ শুরু ঘর থেকেই।

টুঙ্গিপাড়া গ্রামটিও ছিল অসাধারণ। গাছগাছালির ছায়া পরিবেষ্টিত। একদিকে মধুমতি, আরেকদিকে বাইগার বাঘিয়া- এই দুই নদীর সংযোগ খালপাড়ে শেখ বাড়ি। আড়াই শ বছর আগে ইরাক থেকে প্রথমে দিল্লি এবং পরে খুলনা হয়ে এই গ্রামে এসে বসবাস করতে শুরু করেন বঙ্গবন্ধুর পূর্বপুরুষেরা। পরিবারে লেখাপড়ার চল ছিল প্রধান। খেলাধুলা, সংগীত, সংস্কৃতি, ধর্মীয় চর্চার দিক থেকেও বাঙালি মুসলিম পরিবার হিসেবে তারা দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। কোন তুলনাই হয়না কারো সাথে। 

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। তৎকালীন ইপিআর-এর ওয়ারলেস এর মাধ্যমে সেটি দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এরপরই পাকিস্তানি জান্তা সরকার বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালী কারাগারে নিয়ে বন্দি করে। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তারের আগেই শেখ কামাল ও শেখ রেহানাকে বঙ্গবন্ধু ধানমণ্ডিতে শেখ হাসিনা ও তার স্বামী এম এ ওয়াজেদ মিয়ার বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তখন জাতির পিতা জানতেন না যে, শেখ জামাল ৩২ নম্বরেরই একটি কক্ষে ঘুমাচ্ছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তারের সঙ্গে সঙ্গেই বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব শিশুপুত্র রাসেল ও শেখ জামালকে সঙ্গে নিয়ে পাশের আরেকটি বাড়িতে সরে যান।   

প্রায় মাস দেড়েক পরে তাদের খুঁজে বের করে ১৮ নং সড়কের একটি বাড়িকে সাবজেল বানিয়ে বন্দি করা হয়। শেখ কামাল আগেই যুদ্ধে গিয়েছিলেন, অগাস্টের ৫ তারিখে শেখ জামালও বন্দি অবস্থা থেকে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রথম দিনগুলোয় শেখ হাসিনা ছিলেন সন্তানসম্ভবা। প্রথম সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয় গর্ভে, প্রাণপ্রিয় পিতা বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে, খুনসুটির সঙ্গী পিঠাপিঠি ভাই শেখ কামাল মুক্তিযুদ্ধে- তার খবর পাওয়া যাচ্ছে না, পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে বন্দি মা, ছোটভাই রাসেল, শেখ রেহানা ও শেখ জামাল; এমন কঠিন সময় পার করেছেন শেখ হাসিনা। সারাক্ষণ চলেছে পাকিস্তানি বাহিনীর মানসিক নিপীড়ন। আজকের শেখ হাসিনা তো, সেই মানসিক সংগ্রামের পরিণত রূপ। শেখ পরিবারের এ সংগ্রাম ও দেশ প্রেমের উদাহরণ কয়টাই বা রয়েছে। 

বাংলাদেশে পাকিস্তানপন্থিরা শেখ পরিবারের বিপরীতে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়াকে উপস্থাপনের চেষ্টা করে। কতটুকু হাস্যকর এ বিষয়টা তা একটি ঘটনা উল্লেখ না করলেই নয়। জিয়া যখন চট্রগ্রাম থেকে ভারতে গিয়ে বেগম জিয়াকে নিয়ে যাবার জন্যে মুক্তিযোদ্ধাদের দুইটি গ্রুপকে পাঠান, তখন বেগম জিয়া যেতে অস্বীকার করেন। বরং এমনও নাকি মন্তব্য করেন- মুক্তিযুদ্ধ-ফুদ্ধ কিছুনা,অচিরেই পাকিস্তান আর্মি সব ঠিক করে দেবে, বরং জিয়াকেই বলো ফেরত আসতে। এই বলে তিনি চট্রগ্রাম থেকে ঢাকায় চলে আসেন এবং ক্যান্টনমেন্টে আশ্রয় নেন। শুনেছি, যে দুইটি মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপ বেগম জিয়াকে ভারতে নিয়ে যাওয়ার জন্য গিয়েছিল সেই দুই গ্রুপে নেতৃত্ব দেন সাপ্তাহিক বিচিত্রা সম্পাদক শাহাদাত চৌধুরী এবং কুমিল্লার মুক্তিযোদ্ধা খায়রুল আলম বাদল। খায়রুল আলম বাদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সহপাঠী, শেখ হাসিনারও। বছর দুয়েক আগে আমার বনানীর বাড়িতে ক্লাসমেইটদের এক পুনর্মিলনীতে তিনি এ কাহিনী বর্ণনা করেন। তার কিছুদিন পরই তিনি মারা যান। মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে ৫০ বছর আগে। এরই মধ্যে বেশিরভাগ মুক্তিযোদ্ধাই মারা গেছেন। বড়জোর আর ১০ বছর, এরপর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা হাতে গোণা যাবে। তাই এসব আড়ালে থাকা সত্য প্রকাশের সময় এখন। 

আমার সৌভাগ্য হয়েছিল শেখ হাসিনাকে কাছ থেকে দেখার। তার শৈশব কেটেছে গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সেখান থেকে পঞ্চাশের দশকে বাবা-মায়ের সাথে ঢাকায় চলে এসে প্রথমে গোপীবাগের নারীশিক্ষা মন্দিরে ক্লাস থ্রিতে ভর্তি হন। এর কিছুদিন পর আজিমপুর গার্লস হাই স্কুল এবং এখান থেকেই এসএসসি পাশ (১৯৬৫) করেন এবং এর পর ইডেন গার্লস কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন। এখান থেকে উচ্চ মাধ্যমিক (১৯৬৭) পাস করে ওই বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অনার্সে ভর্তি হন। ওই বছর আমিও একই বিভাগে প্রথম বর্ষে ভর্তি হই এবং এইভাবেই আমার সুযোগ হয় তাকে খুব কাছ থেকে দেখার। এর সঙ্গে একটা কথা বলা দরকার, ইডেনে অধ্যয়নকালে (যা বর্তমানে বদরুন্নেসা কলেজ) শেখ হাসিনা ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হন।

তখন বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা দেয়া হয়ে গেছে। পাকিরা 'তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র' মামলা দিয়ে বঙ্গবন্ধুসহ বেশ কয়েকজন সামরিক অফিসারকে ফাঁসি দেওয়ার ষড়যন্ত্র শুরু করে। আমরা 'তথাকথিত ষড়যন্ত্র মামলা' এজন্য বলি যে- তা ষড়যন্ত্র ছিল না, ছিল বাংলাদেশ স্বাধীন করার বঙ্গবন্ধুর পরিকল্পনার অংশ। সাবেক ডেপুটি স্পিকার কর্নেল এম শওকত আলী তার গ্রন্থে এ কথা প্রকাশ করেছেন। তিনিও 'আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা'র আসামি ছিলেন, আজ আর বেঁচে নেই। আগেই বলেছি শেখ হাসিনার শৈশব কেটেছে টুঙ্গিপাড়ার গ্রামের বাড়িতে। এখানে দাদা শেখ লুৎফর রহমান ও দাদি শেখ সায়েরা খাতুনের আদর-যত্নে এবং ধর্মীয় শিক্ষা অর্জন করেন। যেদিন গ্রাম ছেড়ে চলে আসছিলেন, সেদিন তার গ্রামের খেলার সাথীরা- যাদের সাথে একসঙ্গে ধানক্ষেতের আইল দিয়ে স্কুলে যাতায়াত করতেন, দুই বেণী উড়িয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে বাড়ি ফিরতেন- খাল পাড় দিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে বন্ধুকে বিদায় জানিয়েছিলেন চোখের জলে। 

অজান্তে শেখ হাসিনার চোখ থেকেও দুই ফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়েছিল। আর তাইতো পরবর্তীকালে দেখেছি তিনি একদিনের জন্যও গ্রাম ভোলেননি। বরং দাদা-দাদী ও বঙ্গবন্ধুর কবর সেখানে থাকায় আরও বেশি টান অনুভব করতে থাকেন এবং বারবার টুঙ্গিপাড়ায় যেতে থাকেন। শেখ হাসিনার দাদার অনেক জমি-জমা ছিল এবং বছরে শতশত মণ ধান হতো, গোলা ভরে যেত। কাহাত বা দুর্ভিক্ষের সময় বঙ্গবন্ধু যেমন গ্রামের গরিবদের জন্য ধানের গোলা খুলে দিতেন, তেমনি শেখ হাসিনাও পিতার মতো গরিবদের মধ্যে বিতরণ করতেন।। আমি বহুবার শেখ হাসিনার সাথে টুঙ্গিপাড়ায় গিয়েছি, আমি দেখেছি- প্রতিবেশী গরিব ঘরের বউ-ঝিরা দৌড়ে 'রাজার মাইয়া আইছে' বলে বাড়িতে চলে আসতেন। শেখ হাসিনা সবার কুশলাদি জেনে তারপর ঘরে ঢুকতেন।

শেখ হাসিনা ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ি ওঠেন ষাটের দশকের শুরুতে। তৎকালীন ডিআইটি রাজউক একটি প্লট বরাদ্দ দেয়। ওই প্লটের ওপর বেগম মুজিবের দেড়তলা বাড়ি নির্মাণ করে উঠে যান। বাড়ি বানানোর জন্য হাউজ বিল্ডিং কর্পোরেশন থেকে ২০ হাজার টাকা ঋণ নেন। ঋণের সব টাকা পরিশোধের আগেই ১৫ অগাস্টের ট্র্যাজেডি ঘটে যায়। যে কারণে ঋণের কয়েকটি কিস্তি না দেয়ায় বাড়ি নিলামে তোলা হয়। অবশ্য পরে সমাধান হয়। 

সেই রাতে বিদেশে থাকায় বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা রক্ষা পান। পরে তারা ভারতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর আশ্রয়ে থাকেন। ইন্দিরা গান্ধী শেখ হাসিনার স্বামী প্রখ্যাত পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম ওয়াজেদ আলী মিয়াকে একটি চাকরির ব্যবস্থা করে দেন। এরই মধ্যে ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার ব্যবস্থা করেন, ছোট বোন শেখ রেহানার বিয়ে  এবং সেইসঙ্গে বঙ্গবন্ধু হত্যার তদন্তে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কয়েকজন এমপির সাথে আলোচনা করেন। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্যরা বাংলাদেশে আসতে চাইলে জিয়া তাতে বাঁধা দেন, কারণ জিয়া ১৫ অগাস্ট হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিলেন। এরপর ১৯৮১ সালে ঢাকার হোটেল ইডেনে দলের কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ হাসিনাকে সর্বসম্মতভাবে সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। তারপর শেখ হাসিনা দেশে ফিরতে চাইলে জিয়া এই ক্ষেত্রেও বাঁধার সৃষ্টি করেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কন্যাকে বাঁধা দিয়ে রাখে এমন সাধ্য জিয়া কেন অন্য কোন মিয়ারও ছিল। এবং বাঁধা অতিক্রম করে ১৯৮১ সালের ১৭ মে শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আসেন। তখন তেজগাঁও এয়ারপোর্টে ইন্টারন্যাশনাল বিমান নামতো। সেদিন দিনভর ঝড়-বৃষ্টি ছিল এবং এই ঝড়ের মধ্যেই বিমানবন্দর থেকে শুরু করে প্রথমে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে সংক্ষিপ্ত ভাষণ শেষে ধানমণ্ডি ৫ নম্বরের বাসভবনে চলে যান।। সেদিন ঝড়-বৃষ্টি  উপেক্ষা করেও বিমানবন্দর থেকে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ হয়ে ধানমণ্ডি ৫ নম্বর পর্যন্ত রাস্তার দুই ধারে, গাছের ডালে, বাড়ির ছাদে, বারান্দায় কত লোক হয়েছিল অনুমান করা সম্ভব নয়; অর্ধকোটি হবেই, বেশিও হতে পারে। সারা দেশের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মী সাধারণ মানুষ নেত্রীকে একনজর দেখার জন্য রাজপথে জড়ো হয়েছিল।। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু যেদিন পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন ও দিল্লি হয়ে ঢাকা প্রত্যাবর্তন করেন কেবল সেদিনের সাথে তুলনা হতে পারে। অন্য কোনও জনসমাগমের সাথে নয়।

আগেই বলেছি, আমার সৌভাগ্য হয়েছিল শেখ হাসিনাকে কাছ থেকে দেখার। বলেছিলাম এজন্য যে আমরা সহপাঠী ছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখন বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা আন্দোলন ও আগরতলা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে ৬ দফা ও ১১ দফা ভিত্তিক গণঅভ্যুত্থান শুরু হয়ে গেছে। ক্যাম্পাস কেন্দ্রিক আন্দোলনের নেতা ছিলেন তোফায়েল আহমেদ, আসম আব্দুর রব, আব্দুল কুদ্দুস মাখন, তাদের পেছনে ছিলেন শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক, সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, হায়দার আকবর খান প্রমুখ। নারী নেতৃবৃন্দের মধ্যে ছিলেন মমতাজ বেগম, রাফিয়া আক্তার ডলি, দীপা দত্ত, শেখ হাসিনা নাসিমুন আরা হক মিনু, আয়েশা খানম প্রমুখ। প্রতিদিন সকালে ক্লাসে গিয়েই 'ইয়েস স্যার' বা 'ইয়েস ম্যাম' বলে হাজিরা দিয়েই আমরা বেরিয়ে পড়তাম। সকাল থেকে রাত অবধি মিছিল-মিটিং হত। শেখ হাসিনা এইসব মিছিলে অংশ নিতেন। এমনকি পুলিশের সাথে সংঘর্ষের সময়ও পেছনে দৌড়াতেন না। শেখ হাসিনাকে তখন সবাই 'হাসিনা শেখ' বলে ডাকতেন। এর মধ্যেও তিনি যথারীতি লেখাপড়া চালিয়ে যান, শুধু তাই নয় তিনি এবং শেখ কামাল দুইজনেই ছায়ানটে গান শিখতেন। 

সম্প্রতি বিটিভির একটি টকশোতে আমাদের সাথে প্রখ্যাত রবীন্দ্র সঙ্গীতজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ডক্টর রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা অংশ নেন। তিনি বলছিলেন, বদরুন্নেসা আহমদের কন্যা শিলু এবং বেগম সুফিয়া কামালের কন্যাসহ একসঙ্গে শেখ হাসিনা ও শেখ কামাল ছায়ানটে যেতেন। গানের ক্লাস করতেন। সর্বোপরি রাষ্ট্রনেতা হিসেবে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রাম শহর নদী-নালা চিনতেন। কোন জমিতে কী ফসল ভালো হয়, কোন নদীতে কী কী মাছ হয়- সব গ্রামবাংলা ঘুরে ঘুরে আয়ত্বে এসেছে শেখ হাসিনার। তার অর্থনৈতিক ও অবকাঠামো উন্নয়নের রহস্য তা-ই।

শেখ হাসিনা সাধারণের মাঝে অসাধারণ। কারণ শেখ হাসিনা বাংলাদেশের এক নম্বর পরিবারের সন্তান হয়েও অত্যন্ত সাধারণ তাঁতের শাড়ি পরে ক্লাসে আসতেন। কখনো সালোয়ার-কামিজ পরতে দেখেনি। আর দশজন নারীর মত সাদামাটা জীবন। ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের বাড়ির পরিবেশ ছিল তেমনি সাদামাটা। জিয়া সরকার যেদিন বাড়ি শেখ হাসিনার কাছে হস্তান্তর করেন সেদিন ইত্তেফাকের রিপোর্টার হিসেবে বাড়ির অভ্যন্তরে দেখেছি। দেখে অবাক হয়েছি, ওই বাড়িতে একটা দামি সোফা বা ক্লজেট ছিল না। দামি জিনিস বলতে বঙ্গবন্ধুর পড়ার ঘরে বই। আর ওই একই 'দামি বস্তু' শেখ হাসিনা, শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রেহানা এবং রাসেলের ঘরেও শোভা পাচ্ছিল। কেবল কামাল-জামাল-রাসেলের ঘরে অতিরিক্ত সংগীত ও খেলার সরঞ্জাম ছিল। সর্বশেষ যে কথাটি আমি বলবো, শেখ পরিবারের বাড়ির পরিবেশ একেবারেই শিক্ষিত রুচিবান মধ্যবিত্ত পরিবারের মতো ছিল। এইভাবেই তারা সবাই সাধারণের মাঝে অসাধারণ। আর শেখ হাসিনা চতুর্থ মেয়াদে সরকার পরিচালনা করে সফলতা দিয়ে বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করে হয়ে উঠেছেন 'দ্য লেডি অব ঢাকা'।