বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনা: জাতিসংঘে অনন্য পরম্পরা

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 27 Sept 2021, 12:48 PM
Updated : 27 Sept 2021, 12:48 PM

প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে নিউইয়র্কস্থ জাতিসংঘ সদর দফতরে স্বাগত জানিয়ে মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস মন্তব্য করেছিলেন– "Welcome to your home." তিনি বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের প্রশংসা করতে গিয়ে 'miracle' শব্দটি ব্যবহার করেছেন। মিরাকল শব্দটির তাৎপর্য আমরা অন্যভাবেও বলতে পারি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত বিশ্ব নিয়ন্ত্রিত জাতিসংঘের একাধিক কর্মকর্তা মন্তব্য করছিলেন– বাংলাদেশ একটি বাস্কেট কেস। কেউ কেউ আরও এক ধাপ এগিয়ে বলেছিলেন বটমলেস বাস্কেট বা তলাবিহীন ঝুড়ি। এর জবাবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের নেতা হিসেবে ভাষণ প্রদানের পর ওয়াশিংটন সফরে গিয়ে দৃপ্তকণ্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন– 'বাংলাদেশ বাস্কেট কেস নয়। আমরা ঘুরে দাঁড়াব।' তাকে এ সুযোগ দেওয়া হয়নি। কিন্তু তার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা ৪৭ বছর পর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের মঞ্চে ভাষণ দিতে গিয়ে সেই ঘুরে দাঁড়ানোর চিত্র তুলে ধরেছেন, যা কেবল বাংলাদেশের জনগণ নয় গোটা বিশ্ব শুনেছে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে।

বিশ্ব সংস্থায় এ এক অনন্য পরম্পরা।

বঙ্গবন্ধু ভাষণ দিয়েছিলেন বাংলায়, জাতিসংঘ মঞ্চে অমর একুশের বীর গাথার রচয়িতা বাঙালির মাতৃভাষা সেই প্রথম ধ্বনিত হয়েছিল। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্র্রভাষা করার দাবিতে ছাত্র-জনতার আন্দোলন যখন প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছে, রাজপথ যখন উত্তাল, বঙ্গবন্ধু তখন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি। তিনি সেখান থেকেই আন্দোলনের কর্মসূচি প্রণয়নে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। আন্দোলন কর্মসূচির সঙ্গে সমন্বয় রেখে নিজেও শুরু করেন আমরণ অনশন। অমর একুশের আন্দোলন সফল হয়, তিনিও মুক্তিলাভ করেন। এর কয়েক মাস পর অক্টোবরে তিনি যান চীনে আয়োজিত এশিয়া-প্যাসিফিক শান্তি সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য। সেখানের বিশ্বমঞ্চে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তিনি বলেন বাংলায়, ইংরেজিতে অনুবাদ করে শোনান আওয়ামী লীগের নেতা আতাউর রহমান খান। 'আমার দেখা নয়াচীন' গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, 'বাংলা আমার মাতৃভাষা। মাতৃভাষা বক্তৃতা করা উচিত। কারণ পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলনের কথা দুনিয়ার সকল দেশের লোকই কিছু কিছু জানে।' [পৃষ্ঠা ৪৩]

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২৪ সেপ্টেম্বর ১৭তম বারের মতো জাতিসংঘ মঞ্চে যখন ভাষণ দিতে ওঠেন, তখন বাংলাদেশে মধ্যরাত। বিভিন্ন টেলিভিশন সরাসরি ভাষণটি প্রচার করে। ইউটিউব, ফেসবুক এবং আধুনিক প্রযুক্তির অন্যান্য মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী অগণিত মানুষ শুনেছে এ উদ্দীপনাপূর্ণ ভাষণ। তিনি বাংলাদেশের দারিদ্র্যচিত্র বদলে দেওয়ার কথা বলেছেন, করোনাভাইরাস মোকাবিলার জন্য যেসব অর্থনৈতিক প্রণোদনার পদক্ষেপ নিয়েছেন, তা তুলে ধরেছেন। জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ সকলে স্বীকার করে নিচ্ছে করোনার ভয়াবহ দুর্যাগে নানা দেশের অর্থনীতি যখন বিপর্যস্ত, সেখানে বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে আছে মাথা তুলে। জাতিসংঘ মহাসচিব যথার্থই বলেছেন– বাংলাদেশ একটি মিরাকল, একটি বিস্ময়ের নাম। তবে অনেকেই কিছুটা ঘুরিয়ে বলছেন– বাংলাদেশ একটি মডেলের নাম। আমাদের অর্জন যেসব কর্মপন্থা অনুসরণ করে– অনেক দেশ সেটা অনুসরণ করতে পারে।

এটা দুর্ভাগ্য যে বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘ মঞ্চে কেবল একইবারই কথা বলতে পেরেছেন। শেখ হাসিনা তার সর্বশেষ বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রসঙ্গ উল্লেখ করতে গিয়ে বাংলাদেশে সামরিক স্বৈরাচারী শাসকদের অগণতান্ত্রিক শাসনকালের কথা উল্লেখ করেছেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরবর্তী ৪৭ বছরের মধ্যে প্রায় তিন দশক বাংলাদেশের বুকে চেপে ছিল দুঃশাসন। শাসকরা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নজর দেয়নি। এমনকি ত্রিশ লাখ নারী-পুরুষ-শিশুর রক্তে অর্জিত দেশ থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পর্যন্ত বিলীন করার চক্রান্তেও লিপ্ত ছিল তারা। বাংলা ভাষা তখন উপেক্ষিত হচ্ছিল। হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীকে নিঃশর্ত আত্মসমর্পনে বাধ্য করার এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে বঙ্গবন্ধু দেশবাসীকে যে সংবিধান উপহার দিয়েছিলেন, সেটা বাংলা ও ইংরেজি– এই দুটি ভাষায় রচিত হয়েছিল। এ সংবিধানের ১৫৩ (৩) অনুচ্ছেদে স্পষ্ট বলা হয়– 'বাংলা ও ইংরেজি পাঠের মধ্যে বিরোধের ক্ষেত্রে বাংলা পাঠ প্রাধান্য পাইবে।'

কিন্তু ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের দল বিএনপি জাতীয় সংসদে সংবিধানের যে পঞ্চম সংশোধনী (যা পরে অবৈধ ঘোষিত হয়) অনুমোদন করে তাতে বলা হয়েছে– 'সংবিধানের বাংলা ও ইংরাজী পাঠের মধ্যে কোন বিরোধ, বৈপরিত্য, অসংগতি অথবা অসামঞ্জস্যতার ক্ষেত্রে, যতদূর তাহা উক্ত ফরমানসমূহ দ্বারা সংবিধানের কোন পাঠ কিংবা উহার উভয় পাঠের কোন সংশোধন, সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন অথবা বিলোপসাধন সম্পর্কিত হয়, ইংরাজী পাঠ প্রাধান্য পাইবে। [সংবিধানের এপ্রিল, ২০১৬ সালের মুদ্রণ, পৃষ্ঠা ২২৫]

ইউনেসকো ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। এখন বিশ্বের দুই শতাধিক দেশে ২১ ফেব্রুয়ারি গাওয়া হয় 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো ২১ শে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি…'। বিএনপির শাসনামলে ইউনেসকো এমন প্রস্তাব দিলে সেটা হিমাগারে পড়ে থাকত, সে বিষয়ে কারও সন্দেহ নেই। বাংলা ভাষা, বাঙালির গৌরবের মুক্তিযুদ্ধ, বিশ্বের বুকে দাঁড়িয়ে গর্বিত ও উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ– এ সব তাদের কাঙ্ক্ষিত নয়।

বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘে প্রদত্ত ভাষণে বলেছিলেন, 'আমাদের মতো দেশসমূহ, যাদের অভ্যুদয় সংগ্রাম ও ত্যাগের মধ্য দিয়ে, এই আদর্শে বিশ্বাসই তাদের বাঁচিয়ে রাখবে।' শেখ হাসিনা এ আদর্শে বিশ্বাস রেখেছেন বলেই আত্মনির্ভরশীলতার লক্ষ্য অর্জন করার পথে দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে যেতে পারছেন। বঙ্গবন্ধু বলতেন, ভিখারির দেশের মর্যাদা নেই। শেখ হাসিনা বিশ্বব্যাংকের হুমকি উপেক্ষা করে নিজের অর্থে পদ্মা সেতুর মতো সুবৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারছেন, কারণ তিনি জানেন এ দেশের জনগণ অন্যায়ের কাছে নত হবে না। কারণ তিনি জানেন, বাংলাদেশের পায়ের নিচে রয়েছে শক্ত জামিন। আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, বিদ্যুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ। নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বের সামনের সারির দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশ। প্রায় পাঁচ কোটি শিক্ষার্থী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাচ্ছে, যাদের প্রায় অর্ধেক ছাত্রী। করোনার মতো পরিস্থিতিতে যেন শিক্ষাজীবন অব্যাহত রাখা যায় সেজন্য আধুনিক প্রযুক্তি ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তা চেয়েছেন তিনি। দুটি খাতে এ সহায়তা আসতে পারে– প্রযুক্তি এবং শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ। শিক্ষকদের দক্ষতা বাড়লে সেটা ছড়িয়ে পড়বে শিক্ষার্থীদের মধ্যে। তিনি করোনোর ভ্যাকসিন উৎপাদন ও বিতরণে যে প্রকট বৈষম্য তার নিরসনে জাতিসংঘের উদ্যোগ আশা করেন। উন্নত বিশ্বের নেতৃত্ব এমন সংকটজনক সময়েও মানবতার ডাকে যথাযথ সাড়া দেয়নি– জাতিসংঘ মঞ্চে এ কথা বলতে হিম্মত প্রয়োজন হয়। তিনি এটাও বলেছেন– প্রযুক্তি হস্তান্তর ও মেধাস্বত্বে ছাড় দেওয়া হলে বাংলাদেশ তার শিল্প-সক্ষমতা কাজে লাগিয়ে স্বল্পমূল্যে স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের জন্য ভ্যাকসিন উৎপাদন করে দিতে প্রস্তুত রয়েছে।

বঙ্গবন্ধুকন্যা বিভিন্ন দেশে কর্মরত অন্য দেশের নাগরিকদের সমস্যাও তুলে ধরেন। করোনাকালে বহু দেশে প্রবাসী কর্মীদের ছাঁটাই করে ন্যায্য পাওনা বঞ্চিত করে স্বদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশে এ সময়ে রেমিট্যান্স প্রবাহ ভাল রয়েছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রেকর্ড পর্যায়ে– কিন্তু অনেক দেশে আমাদের কর্মীরা রয়েছে বহুবিধ সমস্যায়। যারা নানা দেশে কাজ করে অর্থনীতির চাকা সচল রাখায় অবদান রাখছেন– তাদের ন্যায্য স্বার্থ কেন উপেক্ষিত থাকবে?

জলাবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা মোকাবিলার জন্য তিনি বাস্তবসম্মত কর্মসূচি তুলে ধরেছেন। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আরও সক্রিয় ভূমিকা প্রত্যাশা করেছেন। তার দ্ব্যর্থহীন উচ্চারণ– এ সমস্যার সৃষ্টি করেছে মিয়ানমারের জান্তা সরকার। তাদেরই সমাধান করতে হবে। একইসঙ্গে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য তাদের আর্ন্তজাতিক আদালতের মাধ্যমে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

এভাবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হয়ে উঠেছেন কোটি কোটি মানুষের কণ্ঠস্বর। তবে সাধারণ পরিষদে বক্তব্য রাখলে কিংবা আকর্ষণীয় প্রস্তাব উপস্থাপন করলেই তা বাস্তবায়ন হয়ে যায় না। প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘ অধিবেশন উপলক্ষে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন। এতে সুফলও মিলবে। বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত বাংলাদেশের কূটনীতিকদের এ সব প্রস্তাব নিয়ে তৎপরতা বাড়ানোর সময় এসেছে। বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান সংহত হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখন বিশ্বের ন্যায়নিষ্ঠ ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নেতাদের তালিকায়। তার সততা ও নিষ্ঠা নিয়ে বাংলাদেশে কেউ সন্দেহ পোষণ করে না, বিশ্বেও তিনি গ্রহণযোগ্য ও পরম সম্মানিত ব্যক্তিত্ব। আমাদের কূটনীতিকরা এ সুবিধা কাজে লাগাতে নিশ্চয়ই তৎপর হবেন।