শেখ হাসিনা: বহুদর্শী মানবিক নেতা

আসিফ কবীর
Published : 27 Sept 2021, 04:27 PM
Updated : 27 Sept 2021, 04:27 PM

ছোট-বড় সব প্রকৃতির নেতৃত্বের জন্য নেতাকে নৈতিকভাবে শক্তিমান ও বিতর্কমুক্ত হতে হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনবদ্য নেতৃত্বের নেপথ্য কারণ এটিই। নৈতিকতার প্রশ্নে তাকে কখনোই প্রশ্নবিদ্ধ করা যায়নি। এজন্য রাজনীতিতে প্রবেশের পর থেকে নেতৃত্ব প্রদান ও আস্থা ধরে রেখে তিনি সব সময় পারঙ্গমতা দেখাতে পেরেছেন। আর অত্যন্ত পরিশ্রমী হওয়ায় তিনি সুচারুভাবে তার দায়িত্ব পালন ও লক্ষ্য পূরণ করতে পেরেছেন। ভাল কর্মপরিকল্পনা, ধারাবাহিক ইশতেহার ও এর ভিত্তিতে দেশের উন্নয়ন-সমৃদ্ধি-সুনাম অর্জনকে সম্ভবপর করেছেন। বাংলাদেশ ও বিশ্ব ইতিহাসের ব্যাপক অধীত জ্ঞান তাকে সর্বসঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সবসময় অপ্রতিদ্বন্দ্বী অবস্থানে রেখেছে। পিতা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি, বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্বপ্নদ্রষ্টা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছ থেকে পাওয়া নিখাঁদ দেশপ্রেম ও রাজনৈতিক বুৎপত্তি তাকে অমিত সক্ষম করেছে। ধৈর্য্যশীলতা, স্মরণশক্তি, কৃতজ্ঞতাবোধ, নেতা কর্মীদের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে যথার্থ সিদ্ধান্ত প্রদান শেখ হাসিনাকে কীংবদন্তী নেতায় পরিণত করেছে। গণমানুষের জীবনঘনিষ্ঠ হওয়ার জন্য সাধারণের যাপিত জীবনের সমস্যা ও সংকট তিনি সমানুভূতিতে অনুভব করেন। তার আটপৌরে সত্তা ও বাস্তববোধের প্রয়োগে তিনি সীমিত সম্পদের সঠিক ব্যবস্থাপনা, সর্বোচ্চ উপযোগ গ্রহণ নিশ্চিত এবং ভারসাম্য বন্টনে যুগন্বয়ী হয়ে উঠেছেন। চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তিনি শপথ গ্রহণ করেন ৭ জানুয়ারি ২০১৯। জননেত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারের সর্বোচ্চ সাফল্য দেখতে চাই। যেন নিজেদের ইতোপূর্বের অর্জনের রেকর্ড নিজেরাই ভাঙ্গতে পারেন।

তার রাজনৈতিক সত্তাটিও অসাধারণ। তিনি নেতা-কর্মীদের পাশে থেকেছেন সর্বাবস্থায়, সর্বাত্মক। রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করেছেন সকল সংকট ও আঘাতের। কখনো ষড়যন্ত্র বা অপকৌশল আশ্রয়ী হননি। বঙ্গবন্ধু ও পরিবারের সদস্যদের হত্যার বিচারের জন্য প্রধানমন্ত্রী থেকেও বিশেষ কোনো ট্রাইব্যুনালে করেননি।

জীবন বিপন্ন করে দেশের ঝুঁকি হ্রাস করেছেন কয়েকবারই। চৌদ্দবার তার জীবননাশের চেষ্টা হয়। এক-এগারোর সময় ঝুঁকি ও হুমকি উপেক্ষা করে দেশে আসেন। মানুষও তাকে ভালবাসে সব উজাড় করে। গরীব রিকশাচালক হাসমত আলী তার সর্বস্ব দিয়ে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যার জন্য জমি কিনে দেন, নির্জন কারাবাসে টেলিভিশন দেখার সুযোগ করে দিতে সবকিছু বিক্রি করে একটা সাদাকালো টিভি সেট নিয়ে বিশেষ আদালতের ফটকে আসে নাম না জানা এক আওয়ামী লীগ কর্মী– শেখ হাসিনাকে ভালবেসে। হবিগঞ্জের চা শ্রমিকরা পঞ্চাশ পয়সা করে জমানো অর্থ দিয়ে একজোড়া সোনার বালা উপহার নিয়ে আসে (০৩-০৭-২০১২) গণভবনে শেখ হাসিনার জন্য।

অক্লান্তকর্মা আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে গণমানুষের জন্য নিবেদিতভাবে শ্রম দিয়ে কোনোদিনই এক মুহূর্তের জন্যও ক্লান্তির ছাপ আড়াল করতে হয় না। বরং মা যেমন সংসারের সব কিছু, সবার আলাদা-আলাদা রুটিন ও অবস্থা খেয়াল রেখে, আনাজ-পাতির বাড়ন্ত অবস্থা মাথায় নিয়ে ঘরকন্যা পরিচালনা করেন, দেশটাও যেন প্রধানমন্ত্রী সেভাবেই চালান। জাতীয় অর্থনৈতিক কমিটির সভায় বরাদ্দ প্রদান বা বাজেট কমিটির আলোচনায় তার খোঁজ-খেয়ালে তেমনটিই মনে হয়। মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারের দু'টি স্প্যান অতিরিক্ত করা হলে মাটির তলদেশে প্রবাহমান সার্ভিস লাইনগুলো স্থানান্তর বা বন্ধ না করে জনদুর্ভোগ এড়ানো যাবে একনেক সভায় তা তিনিই বলে দেন। দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় ছাত্রী হোস্টেল হলে নারী শিক্ষার প্রসার হবে সেই অসাধারণ নির্দেশনা দিতে পারেন একমাত্র তিনিই। উপবৃত্তির টাকা মোবাইলযোগে সন্তানের মায়েদের কাছে প্রেরণ তার আরেক অনন্য উদ্ভাবন। আমাদের দেশের বহুল প্রচলিত আয়ুর্বেদিক বা ইউনানী চিকিৎসা ব্যবস্থা বাতিল না করে সাধারণ মানুষের আগ্রহ ও সাধ্যের কথা ভেবে বরং এই চিকিৎসাকে প্রতিষ্ঠানিকীকরণ অথবা পরিবার পরিকল্পনায় জোরারোপ না করে পশ্চিমা ও উন্নত দেশগুলোর নিম্ন বা ঋণাত্মক জন্মহার মাথায় রেখে দক্ষ জনশক্তি তৈরি শেখ হাসিনার দূরদর্শীতারই অনুপম উদাহরণ।

বিশ্ব ব্যাংকের অন্যায় সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে পদ্মা সেতু নিজেদের অর্থায়নে নির্মাণ বা জঙ্গি দমনের মতো অসাধ্য সাধনে রাজনীতি-অর্থনীতির বিশ্লেষকদের কাছে তার নেতৃত্বকে "রহস্যময়" করে তোলে। এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও পারস্পরিক সহায়তা বৃদ্ধি বেগবান করতে পশ্চিমাদের শেখ হাসিনার প্রতি আহ্বান তাকে করে তোলে বিশ্ব নন্দিত নেত্রী। পার্বত্য শান্তি চুক্তি, গঙ্গার পানি চুক্তি, সমুদ্র সীমার নিষ্পত্তি, দীর্ঘদিনের স্থল সীমানা সংক্রান্ত জাটিলতার সমাধান, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা এর যেকোনো একটি সাফল্যই তার অবিস্মরণীয় নেতা হতে যথেষ্ট ছিল। কিন্তু অর্জনের সোপানে সতত অগ্রসরমান থেকেছেন তিনি। আত্মপ্রসাদে থেমে পড়েননি।

বিশ্বনেতা, প্রধানমন্ত্রী, দলীয় প্রধানের বাইরেও তিনি একজন আটপৌরে অভিভাবক। অবসরে বই পড়েন, লেখালেখি করেন। জাতির পিতার স্মৃতি রক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করেন। তিনি নিসর্গপ্রেমী– ফুল, পাখি, প্রকৃতি ভালবাসেন। কৃষি খামার, বাগান করায় উৎসাহ দেন। নিজের হাতে রান্না-বান্না করেন প্রধানমন্ত্রী হয়েও। তিনি পোশাক-পরিচ্ছদ-ব্যবহার্যে রুচিশীল, মার্জিত কিন্তু বিলাসী নন। দেশী শাড়ি পরিধান করেন। সাধারণত শনিবারে নীল, রবিবারে সূর্যের মতো প্রভাময়, সোমবারে মেরুন, মঙ্গলবারে কমলা, বুধবারে সবুজ, বৃহস্পতিবারে হলুদাভ এবং শুক্রবারে উজ্জ্বল সোনালী বা রূপালী রঙ প্রধান শাড়ি পরে থাকেন।

বাংলাদেশের বিদ্যমান বাস্তবতা ও আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দশটি উদ্যোগ নিয়েছেন। যা অত্যন্ত দর্শন সঞ্জাত ও আবেদনপূর্ণ– এক অর্থে ধ্রুপদী। এক. একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প দুই. ডিজিটাল বাংলাদেশ তিন. নারীর ক্ষমতায়ন চার. কমিউনিটি ক্লিনিক ও শিশু বিকাশ পাঁচ. সবার জন্য বিদ্যুৎ ছয়. আশ্রায়ণ প্রকল্প সাত. সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি আট. শিক্ষা সহায়ক কার্যক্রম নয়. বিনিয়োগ বিকাশ এবং দশ. পরিবেশ সুরক্ষা।

আমাদের দেশের বিরাট জনগোষ্ঠী কওমি মাদ্রাসায় শিক্ষা গ্রহণ করে। এ শিক্ষা ব্যবস্থায় পাঠ সম্পন্নকারীদের মূলধারায় যুক্ত রাখতে তিনি কওমি শিক্ষার স্বীকৃতি প্রদান করেন। সব্যসাচী মানুষ হিসাবে বৌদ্ধ ধর্মগুরুগণ তার সফরসঙ্গী হিসাবে আকাশপথে ভ্রমণকালে তাদের নির্দিষ্ট সময়ের পর খাবার গ্রহণে মানার কথা স্মরণ করিয়ে এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষকে ধর্মগুরুদের সুবিধামতো খাবার পরিবেশনের নির্দেশনা দেন। একই রকম সংবেদনশীলতা প্রকাশ পায় গণভবনে আগত অনাথ শিশুদের মুখে তুলে আপ্যায়নে, দর্শনার্থী বয়োবৃদ্ধদের আসা-যাওয়ার সময় বিশেষ খেয়াল রাখায়, নিমতলীর অগ্নিকাণ্ডের পর তিন কন্যার ভেঙ্গে যাওয়া বিবাহের সম্বন্ধ পুনর্স্থাপনে, রানা প্লাজা থেকে ঊনিশ দিন পর উদ্ধার হওয়া রেশমা আক্তারকে দেখতে গিয়ে…। মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত দশ লক্ষাধিক বিদেশী নাগরিককে সোয়া এক বছরের বেশি সময় ধরে উদার হস্তে ভরণ-পোষণের ব্যবস্থায় তার মানবিকতার স্বীকৃতি দেশ ছাপিয়ে আজ বৈশ্বিক।

সভা ও আলোচনায় নিজের উপলব্ধি ও বাস্তব জ্ঞান থেকে কথা বলেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ একুশ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকাকালীনই সারাদেশ সফর করে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা ও বিস্তারিত হোমওয়ার্ক প্রসূত উন্নয়ন ভাবনার বাস্তবায়নে অন্তঃপ্রাণ থাকেন। সন্তান লালন পালন, মাতৃদুগ্ধ পান, শিশু শিক্ষা, শারীরিক প্রতিবন্ধিত্ব, স্কুল মিল, শিল্প সংস্কৃতির বিকাশ ও চর্চা, মানস গঠন বিষয়ে তার বক্তব্যে অনুভব করা যায় তার গভীর সংবেদনশীলতা ও মমত্বকে। হাওড় অঞ্চল, পার্বত্য জেলা, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের অধিকার প্রভৃতি পৃথক ভূ-বৈচিত্র্য ও সমাজের স্বতন্ত্র্য সমস্যা ও উত্তরণের উপায় বা করণীয় নিয়ে সেরা নির্দেশনা প্রদান প্রতিনিয়ত শেখ হাসিনাকে বাঙালির আটপৌরে অগ্রজা প্রতীম তথা 'আপা' হিসাবে আমাদের অরও আপন, অতি কাছের মানুষ করে তোলে।

কোভিড-১৯ পরবর্তী বাস্তবতায় তার নেতৃত্বের বিভা প্রত্যক্ষ করেছি আমরা। তার পঁচাত্তরতম জন্মদিনে দীর্ঘায়ু ও সুস্বাস্থ্য কামনা করি।