চ্যালেঞ্জগুলো কী?

মুহম্মদ দিদারে আলম মুহসিন
Published : 26 Sept 2021, 02:08 PM
Updated : 26 Sept 2021, 02:08 PM

আনন্দের বিষয়, দেশ কোভিড অতিমারির সর্বশেষ ধাক্কাটা সামলে উঠেছে। চলতি বছরের এপ্রিলমে থেকে শুরু করে দেশবাসী করোনাভাইরাসের দুটো তীব্র ছোবলের মুখোমুখি হলো। প্রথম দফায় উত্তাপটা ছড়িয়েছিল সাউথ আফ্রিকান বা বিটা ভ্যারিয়েন্ট। মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে হঠাৎ দেখা গেলসংক্রমণের হার ক্ষিপ্র গতিতে উর্দ্ধমুখী হচ্ছে। দেশে প্রথমবারের মতো দৈনিক সংক্রমণের সংখ্যা সাত হাজার এবং মৃত্যুর সংখ্যা শতক ছাড়িয়ে যায়। টানা কয়েক সপ্তাহ পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ২০ শতাংশ বা তার উপরে অবস্থান করে। 

মে মাসের শেষ নাগাদ ধাক্কাটা মিইয়ে আসলেও অভিজ্ঞ মহলের মনে কিছুতেই স্বস্তি আসছিল না। এর কারণ, পাশের দেশ ভারতে একই সময়ে যাবৎকালের ভয়াবহতম তাণ্ডব চালিয়ে যাচ্ছিল করোনাভাইরাসের ডেল্টা বা ভারতীয় ধরন। ধাক্কাটা বাংলাদেশেও আসবে তার আশঙ্কা এক রকম নিশ্চিতই ছিল। শুধু দেখার বাকি ছিল, কবে আসে এবং কতটা ভয়ংকর রূপে। তবে, খুব বেশি দিন লাগেনি। জুন মাসেই শুরু হয় আক্রমণটা। জুলাইঅগাস্টে রুদ্র মূর্তি ধারণ করে। এদেশের মানুষ টানা কয়েক সপ্তাহ প্রতিদিন দশ হাজারেরও বেশি নতুন সংক্রমণ দেখতে পায়, যা এক পর্যায়ে এমনকি পনের হাজারও ছাড়িয়ে যায়। দিনের পর দিন মৃত্যুর সংখ্যা দু উপরে অবস্থান করে। সেই সাথে শনাক্তের হার ছিল ৩০ শতাংশের ঘরে। সংক্রমণের এই তীব্রতা মৃত্যুর মিছিলে সারাদেশে হাহাকার পড়ে যায়। দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়।

বাংলাদেশে গেল বছরের মার্চে কোভিড অতিমারির সূচনার পর থেকে পর্যন্ত তিনটি পর্যায়ে প্রাণঘাতি ভাইরাস আঘাত হানে। প্রথম পর্যায়টি বিগত বছরের মার্চ মাসে দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের পর থেকে শুরু হয়ে প্রায় সারাটি বছর ধরে চলে। এই পর্যায়ে করোনাভাইরাসের আদি রূপটি মূল ভূমিকা পালন করেছে বলে ধরে নেওয়া যায়। দ্বিতীয় তৃতীয় আঘাত নিয়ে আমরা উপরে আলোচনা করেছি। চলতি সালের এপ্রিলমে সময় কালে দ্বিতীয় আঘাতটি এসেছিল এক অদ্ভুত ক্ষিপ্রতা তীব্রতায়- এমন এক সময় যখন মানুষ ভাবতে শুরু করেছিল, অতিমারির পাট বুঝি চুকেবুকে গেছে। ক্ষিপ্রতা তীব্রতায় মধ্য জুন থেকে মধ্য সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিস্তৃত তৃতীয় আঘাতটি এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, এটি দীর্ঘ সময় প্রলম্বিত হলে এদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা অর্থনীতির সামগ্রিক কাঠামো হয়তোবা পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়ত।

অবশেষে সেপ্টেম্বরে এসে অতিমারির সর্বশেষ সবচেয়ে তীব্র আঘাতটি প্রশমিত হয়ে এসেছে। মাঝখানে প্রায় এক মাস লকডাউনের সময়োচিত পদক্ষেপ এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে থাকবে। দেশে চলমান গণটিকাদান কর্মসূচিও নিঃসন্দেহে এতে কিছু অবদান রেখেছে। সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালের ্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কার বিজয়ী বিজ্ঞানী ফেরদৌসী কাদরী মনে করেন, দেশের ৬০ থেকে ৭০ ভাগ মানুষের শরীরে করোনা প্রতিরোধী হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হয়েছেযা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রেখেছে  

প্রশ্ন হলো, করোনা অতিমারির ধাক্কাটাই কি শেষ, নাকি এরকম আরও আঘাত আসতে পারে? আর ধরনের পুনরাক্রমণ ঠেকাতে আমাদের করণীয়ই বা কী? প্রশ্নটি আরও বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে কারণে যে, প্রায় দেড় বছর বন্ধ থাকার পর সরকার ১২ সেপ্টেম্বর থেকে কিছুটা সতর্কতার সাথে স্কুলকলেজ খুলে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। ২৭ সেপ্টেম্বরের পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও খুলে দেওয়া যেতে পারে বলে নির্দেশনা এসেছে। তবে, শিক্ষামন্ত্রী সংক্রমণ বেড়ে গেলে প্রয়োজনে আবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হবে বলে সাবধান বাণী উচ্চারণ করেছেন। উল্লেখ করা যেতে পারে, পাশের দেশ ভারতসহ বিশ্বের অনেক দেশেই বিভিন্ন সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া কিংবা লকডাউন/ বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া পর সংক্রমণে আবার তেজি ভাব দেখা গেছে। এমনকি, কোথাও কোথাও পুনরায় বিধিনিষেধ আরোপ করতে হয়েছে।

করণীয় নির্ধারণ করতে হলে আগে কারণটা বুঝা জরুরি। কোভিড১৯ অতিমারি যে রোদবৃষ্টির খেল দেখাচ্ছে, মানে একটি ধাক্কা স্তিমিত হয়ে আসার পর যে পুনরায় নব বিক্রমে আরেকটি ধাক্কা আঘাত হানছে, বিজ্ঞানীরা মোটা দাগে এর দুটো প্রধান কারণ চিহ্নিত করেছেন। এক, অতিমারির এক একটি ধাক্কা স্তিমিত হয়ে আসা, এর ফলে বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া এবং স্কুল কলেজ খুলে দেওয়ার পর জনসাধারণের স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে অবহেলা গাছাড়া ভাব। দীর্ঘ দিন অবরুদ্ধ থাকার পর হঠাৎ ছাড়া পেয়ে জনসমষ্টির একটি অংশ কোন কিছুর তোয়াক্কা না করে বল্গাহীন আচরণ করতে শুরু করে। এতে করে গৃহকোণে আবদ্ধ থাকার সুবাদে এতদিন যারা অণুজীবের ছোবল থেকে বেঁচে গিয়েছিল তারা অণুজীবের সংস্পর্শে এসে আক্রান্ত হতে শুরু করে। 

দুই, মিউটেশন প্রক্রিয়ার ভাইরাসের নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্টের উদ্ভব, যাদের বেশিরভাগই বিশেষ কোন সমস্যা তৈরি না করলেও কোন কোনটি ভয়ংকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। বাংলাদেশে চলতি বছর অতিমারির যে দুটো ধাক্কা আসে, তা এধরনের ভিন্নতর ভ্যারিয়ন্টের কারণেই ঘটে। ভ্যারিয়েন্টগুলো প্রাথমিকভাবে বিশ্বের কোন একটি অঞ্চলে আবির্ভূত হয়ে থাকলেও তাদের অত্যধিক সংক্রমণশীলতার কারণে অতি অল্প সময়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, ভাইরাস যত বেশি জন থেকে জনান্তরে ছড়ায়, মিউটেশনের মাধ্যমে নতুন নতুন ধরনের উদ্ভবের সম্ভাবনাও ততই বাড়তে থাকে। কাজেই এটা ঠেকাতে হলে দরকার, দ্রুত সমগ্র জনসমষ্টিকে টিকার আওতায় নিয়ে আসা, যাতে ভাইরাস ছড়ানোর সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়। পাশাপাশি, পরিসংখ্যানের দিকে না তাকিয়ে সকলের মাস্ক পরিধান শারীরিক দুরত্ব বজায় রাখার মতো স্বাস্থ্যবিধির অনুসরণ অব্যাহত রাখাও জরুরি। কারণ, আপনি টিকার ডোজ সম্পূর্ণ করে থাকলেও ফের নতুন কোন ভ্যারিয়েন্টে যে সংক্রমিত হবেন না তার কোন নিশ্চয়তা নেই।

স্কুলকলেজ ইতোমধ্যে খুলেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও শিগগির খুলতে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের চোখেমুখে প্রবল উচ্ছাসআনন্দ। অভিভাবক মহল তথা আপামর জনসাধারণও ফেলছে স্বস্তির নিঃশ্বাস। প্রশ্ন হলো, আনন্দউচ্ছাস স্থায়ী হবে তো? পুনরায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়ার মতো পরিস্থিতির উদ্ভব হবে না তো? কী করা চাই? কোভিড১৯ এখন আর নতুন কিছু নয়। সবাই কমবেশি জানেবুঝে, কী থেকে কী হয়, রক্ষাকবচই বা কী? তবে, উপরের আলোচনা থেকে এটি নিশ্চয়ই স্পষ্ট হয়েছে যে, এর পরেও ঝুঁকি থেকে যাবে। একটু অসতর্ক হলেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সংক্রমণ বিস্তারের হট স্পটে পরিণত হতে পারে। সতর্কতা হিসেবে সরকার শিক্ষকশিক্ষার্থী কর্মকর্তাকর্মচারীদের শতভাগ টিকা গ্রহণ নিশ্চিত করে তারপরেই কেবল বিশ্ববিদ্যালয় খোলার জোরালো নির্দেশনা দিয়েছে। খোলার পরে মূল চ্যালেঞ্জটি হবে, মাস্ক পরিধান, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা জনসমাগম পরিহারের মতো বিষয়গুলো নিশ্চিত করা।

লক্ষ্যে শ্রেণিকক্ষে অর্ধেক কিংবা একতৃতীয়াংশ ছাত্রছাত্রী নিয়ে ক্লাস পরিচালনা করতে হতে পারে। এক্ষেত্রে প্রয়োজন দেখা দিতে পারে শিফটিং কিংবা একই সাথে অনলাইনঅফলাইন (হাইব্রিড) পদ্ধতিতে ক্লাস নেওয়ার। হলগুলোতে এতদিন যে গণরুম কিংবা ডাবলিংফ্লোরিং সংস্কৃতি চলে এসেছে তা আর চালিয়ে নেয়ার সুযোগ নেই। প্রশ্ন হলো, ছেলেমেয়েগুলো তাহলে যাবে কোথায়? প্রশাসন দায়িত্বটা কাঁধে নিলে একটি সমাধান অবশ্যই বেরিয়ে আসবে। তবে, আগে থেকেই একটি পরিকল্পনা থাকা চাই। ডাইনিং, ক্যান্টিন, ক্যাফেটেরিয়াসহ ক্যাম্পাস এর আশপাশের খাবার দোকানগুলো হতে পারে যুগপৎ অনিয়ন্ত্রিত জনসমাগম এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশনজনিত কারণে সংক্রমণ বিস্তারের একটি উৎস। সুনির্দিষ্ট বিস্তৃত কর্মপরিকল্পনা ব্যতিরেকে এদিকটার যথার্থ ব্যবস্থাপনা সহজ হবে না। অনেক দিন পর ক্যাম্পাস খোলার সূবাদে শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই হলেচত্বরে, দোকানপাটে অহেতুক জমায়েত করে আড্ডা দেয়ার প্রবণতা দেখা যাবে। এটাকেও নিয়ন্ত্রণের বিষয় বিবেচনা করতে হবে।

আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষকশিক্ষার্থীরাই সমাজের সবচেয়ে সচেতন প্রাগ্রসর অংশ। ঐতিহ্যগতভাবে, এরাই জাতির যেকোনও ক্রান্তিলগ্নে চিন্তাচেতনার জগতে নেতৃত্ব দিয়ে এসেছেন। কাজেই, উপরে উল্লেখিত বিষয়গুলোর ব্যাপারে তারা মোটেই অসচেতন নন। কিন্তু, এতদসত্ত্বেও আপনি হয়তো দেখবেন, একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এক্ষেত্রে অহেতুক গাফিলতি করছে। ভাবখানা অনেকটা এরকম: কী আর এমন হবে? একারণে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ক্যাম্পাসে স্বাস্থ্যবিধি পালন নিশ্চিতে বিশেষ পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে সবসময়একটি প্রক্টরিয়াল টিম কাজ করে থাকে। তবে, আলোচ্য ক্ষেত্রে জনবল কাজের ধরনের নিরিখে তা যথেষ্ট কিনা বিবেচনার প্রয়োজন রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা স্বেচ্ছায় সাগ্রহে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে না দিলে জোরজবরদস্তি করে তাদের নিয়মকানুন মানানো সহজ নাও হতে পারে। একারণে, বিভিন্ন বিভাগ, হল সর্বোপরি সমগ্র ক্যাম্পাসের জন্য শিক্ষকশিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক পেট্রল টিম গঠনের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা যেতে পারে।

আমাদের দেশের বাস্তবতায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যম্পাসগুলো অনেকটা বারুদতুল্য। হঠাৎ করে খুব ছোট্ট একটি ঘটনাও এখানে বিশাল অস্থিরতার জন্ম দিতে পারে। সব ধরনের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার পরও ক্যাম্পাস খোলার পর কিছু শিক্ষকশিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পড়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। ক্ষেত্রবিশেষে হাসপাতালে ভর্তিরও প্রয়োজন হতে পারে। একটিমাত্র দুর্ঘটনাও মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিতে পারে। একারণে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে কোভিড১৯এর উপসর্গ দেখা দিলে তাৎক্ষণিক পরীক্ষা প্রয়োজনীয় চিকিৎসার একটি ব্যবস্থা থাকা জরুরী। কোভিড১৯ অতিমারি বিশ্বময় নীতিনির্ধারকদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করতে বাধ্য করেছে। পরিবর্তিত এই বাস্তবতায় দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে বিদ্যমান মেডিকেল সেন্টারগুলোকে অত্যাধুনিক সুযোগসুবিধাসম্পন্ন একএকটি ছোটখাট হাসপাতালে রূপান্তরের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। এগুলো বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের পাশাপাশি আশপাশের লোকালয়গুলোকেও স্বাস্থ্যসেবা দিতে পারবে। বিশ্বের অনেক দেশেই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো ধরনের সেবা দিয়ে থাকে। আমাদের দেশে এটি চালু করা গেলে প্রচলিত ধারার সরকারিবেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোর ওপরও চাপ কমবে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট বিষয়াদিতে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরাও এখানে বিভিন্ন দিকে হাতেকলমে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পাবে।