জিয়া কেন ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করেননি?

বিভুরঞ্জন সরকারবিভুরঞ্জন সরকার
Published : 26 Sept 2021, 01:06 PM
Updated : 26 Sept 2021, 01:06 PM

১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল। সেনাবাহিনীর কিছু উশৃঙ্খল জুনিয়র অফিসার এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি বদলে দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ওই সকালেই রাষ্ট্রপতির পদ দখল করেছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ, যিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার একজন সদস্য এবং আওয়ামী লীগের একজন পুরনো নেতা। মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যারা শপথ নিয়েছিলেন তারা সবাই ছিলেন বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভারও সদস্য। ফলে প্রাথমিকভাবে এটা অনেকেরই মনে হয়েছিল যে, তাহলে কি বঙ্গবন্ধুকে আওয়ামী লীগই হত্যা করলো? ঘাতকরা পরিকল্পিতভাবেই এটা করেছিল। এখনও বঙ্গবন্ধু হত্যায় জিয়াউর রহমানের ভূমিকার বিষয়টি সামনে আসলে আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপির তরফ থেকে তারস্বরে বলা হয় যে, ওই ঘটনায় কোনো দায় নেই, ওটা করেছিল আওয়ামী লীগই। আর বিএনপিকে তো এ ব্যাপারে কোনোভাবেই জড়ানো যায় না। বিএনপির তখন পয়দাই হয়নি।

বিএনপির কথাও মিথ্যা নয়। কারণ জিয়াউর রহমান সত্যি বন্দুক হাতে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বুকে গুলি ছোঁড়েননি। তিনি একেবারে ধোয়া তেঁতুলের বিচির মতো পরিচ্ছন্ন। কিন্তু যারা হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারী, ষড়যন্ত্রের কুশীলব হিসেবে নিজেরাই সদর্পে স্বীকার করেছেন, তাদের দুইজন ফারুক এবং রশিদ দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর বিদেশি সংবাদমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়ে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ এবং তাদের প্রতি তার সমর্থনের কথা জানিয়েছেন। তখন জিয়া ক্ষমতার কেন্দ্র থেকেও আত্মস্বীকৃত খুনিদের বক্তব্য অস্বীকার করেননি। এমন বক্তব্য দেওয়ার জন্য তাদের কাছে কোনো ধরনের কৈফিয়ত তলব না করে উল্টো তাদের প্রটেকশন দিয়েছেন এবং বিদেশি মিশনে কূটনৈতিক হিসেবে নিযোগ দিয়ে নিরাপদ জীবন যাপনের ব্যবস্থা করেছেন।

শুধু এটুকুই নয়, ১৫ অগাস্ট সকালে জিয়াউর রহমানকে বঙ্গবন্ধু হত্যার মতো ভয়াবহ ঘটনার খবর দেওয়ার পরও তিনি ছিলেন নির্বিকার এবং অবিচল। এ থেকে কি মনে হয় না যে, এই খবর তার কাছে অপ্রত্যাশিত ছিল না, তিনি জানতেন এমনটা হবে!

আরও কথা আছে। মোশতাককে রাষ্ট্রপতি পদে বসালেও তখন সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করছিল খুনি চক্র। তারা বঙ্গভবনের দখল নিয়ে মোশতাককে তাদের হুকুম মতো কাজ করতে বাধ্য করতেো। মোশতাক ছিলেন আসলে খুনিদের হাতের পুতুল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সময় সেনাবাহিনী প্রধান ছিলেন জেনারেল শফিউল্লাহ, জিয়া ছিলেন উপপ্রধান। তো, হত্যাণ্ডের ৯ দিনের মাথায় জিয়াকে ২৪ অগাস্ট মোশতাক সেনাপ্রধান নিয়োগ করলেন কী বুঝে? নাকি খুনি চক্রের সঙ্গে জিয়ার পূর্ব যোগাযোগ এবং হত্যাকাণ্ডের পর সেনাবাহিনীকে শান্ত রাখার পুরস্কার হিসেবেই জিয়াকে সেনাপ্রধান করা হয়েছিল?

জিয়া যদি সত্যি নির্দোষ হয়ে থাকেন, তার অবস্থান যদি হত্যা-ক্যুয়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা বদলের পক্ষে হয়ে থাকে, তিনি যদি আইনের শাসনের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে থাকেন, তাহলে তো তার উচিত ছিল খুনিদের আইনের আওতায় আনা। কিন্তু বাস্তবে কী হলো? তিনি সেনাপ্রধান হওয়ার এক মাস দুই দিন পর ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর হত্যাকারীদের সুরক্ষার জন্য ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেন স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি, খুনিদের ক্রীড়নক খন্দকার মোশতাক। এটা কি বিশ্বাসযোগ্য যে সেনাপ্রধানের গ্রিন সিগনাল বা অনুমোদন ও পরামর্শ ছাড়া মোশতাক ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেছিলেন? বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই এই কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারির আদ্যোপান্ত না জানার সুযোগ নিয়ে বিএনপির নেতা-কর্মী-সমর্থক-অনুসারীরা প্রচার করেন, খন্দকার মোশতাক ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেছেন, এতে পরবর্তী সময়ে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের দায় কোথায়? যদি তর্কের খাতিরে এটা ধরে নেওয়া হয় যে, সত্যি সেনাপ্রধান জিয়া ইনডেমনিটির বিষয়ে কিছু জানতেন না  তাহলে পরের ঘটনাবলীর প্রতি আমাদের চোখ দিতে হবে।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খন্দকার মোশতাকের বাদশাহী ছিল মাত্র ৮৩ দিনের। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর খালেদ মোশারফফের অভ্যুত্থান এবং ৭ নভেম্বর তার পাল্টা অভ্যুত্থানের পর জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ন্ত্রণকারী হিসেবে আবির্ভূত হন। ওই সময় বিচারপতি আবু সা'দাত মোহাম্মদ সায়েম রাষ্ট্রপতি ছিলেন। ১৯৭৬ সালের ২৯ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি সায়েম জেনারেল জিয়াউর রহমানের কাছে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব হস্তান্তর করেন। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল সায়েম রাষ্ট্রপতির পদ থেকে সরে দাঁড়ান এবং জিয়া রাষ্ট্রপতি হন। ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সামরিক আইনের অধীনে দেশে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে জিয়াউর রহমানের দল নবগঠিত বিএনপি দুই-তৃতীয়াংশ আসনে বিজয়ী হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশসহ চার বছরে সামরিক আইনের আওতায় সব অধ্যাদেশ, ঘোষণাকে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে আইনি বৈধতা দেওয়া হয়। সংশোধনী পাস হয় ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল। সংসদে উত্থাপিত আইনটির নাম ছিল 'সংবিধান (পঞ্চম সংশোধনী) আইন, ১৯৭৯'। এ সংশোধনীর মাধ্যমে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে বৈধতা দেওয়ায় ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্টের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত অপরাধীরা দায়মুক্তি পেয়ে যায়।

অর্থাৎ খন্দকার মোশতাকের জারি করা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটি জিয়াউর রহমানের শাসনামলে বৈধতা দেওয়া না হলে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল সামরিক আইন প্রত্যাহারের সঙ্গে সঙ্গেই ১৫ অগাস্টের খুনিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যেত। জিয়াউর রহমানই ব্যবস্থা নিতে পারতেন। কিন্তু জিয়াউর রহমান ব্যবস্থা নেওয়া দূরে থাক, ভবিষ্যতে কেউ যেন ব্যবস্থা না নিতে পারে পাকাপাকিভাবে সে ব্যবস্থাও করে দেন।

প্রশ্ন হতে পারে জিয়া কেন এটা করলেন? এতে তার কী স্বার্থ? উত্তর হচ্ছে, জিয়া জানতেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হলে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে। তার সংশ্লিষ্টার বিষয়টিও আর গোপন থাকবে না। তাই অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবেই ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটি সংবিধানে জুড়ে দিয়ে এই প্রচারও চালানো হয় যে, যেহেতু ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ সংবিধানের অংশ হয়ে গেছে তাই এই আইন আর পরিবর্তন বা বাতিল করা যাবে না। সম্ভবত জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পরও বিচারপতি আবদুস সাত্তার, এরশাদ এবং ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এলেও ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটি বাতিল বা রহিত করেননি কিংবা উদ্যোগও নেননি। তারা হয়তো এটা বুঝতে পারেননি যে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় ফিরে আসবে এবং খুনিদের বিচার বাংলার মাটিতে হবে। ইতিহাসের প্রতিশোধ বড়ই নির্মম হয়ে থাকে। 

খন্দকার মোশতাক এবং জিয়াউর রহমান ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে বা বহাল রেখেই বসে থাকেননি। সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকারী খুনিদের নানাভাবে পুরস্কৃতও করেছিলেন। এমনকি খুনিদের যোগ্যতা না থাকার পরও নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশের বিভিন্ন দূতাবাসে ভিন্ন ভিন্ন কূটনৈতিক পদে। কাকে কোথায়, কোন পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল তার তালিকা:

১. লে. কর্নেল শরিফুল হককে (ডালিম) চীনে প্রথম সচিব।

২. লে. কর্নেল আজিজ পাশাকে আর্জেন্টিনায় প্রথম সচিব।

৩. মেজর এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদকে আলজেরিয়ায় প্রথম সচিব।

৪. মেজর বজলুল হুদাকে পাকিস্তানে দ্বিতীয় সচিব।

৫. মেজর শাহরিয়ার রশিদকে ইন্দোনেশিয়ায় দ্বিতীয় সচিব।

৬. মেজর রাশেদ চৌধুরীকে সৌদি আরবে দ্বিতীয় সচিব।

৭. মেজর নূর চৌধুরীকে ইরানে দ্বিতীয় সচিব।

৮. মেজর শরিফুল হোসেনকে কুয়েতে দ্বিতীয় সচিব।

৯. কর্নেল কিসমত হাশেমকে আবুধাবিতে তৃতীয় সচিব।

১০. লে. খায়রুজ্জামানকে মিসরে তৃতীয় সচিব।

১১. লে. নাজমুল হোসেনকে কানাডায় তৃতীয় সচিব।

১২. লে. আবদুল মাজেদকে সেনেগালে তৃতীয় সচিব।

জিয়ার পর জেনারেল এরশাদ এবং তারপর খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসেও খুনিদের সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা দান বন্ধ না করে তাদের কাউকে কাউকে রাজনীতি করার সুযোগ করে দিয়েছেন আওয়ামী লীগকে মোকাবিলা করার জন্য। এরশাদ পতনের পর খালেদা জিয়ার আমলে আওয়ামী লীগ চেষ্টা করেও ইনডেমনিটি আইন বাতিলে সফল হয়নি খালেদা সরকারের অসহযোগিতার কারণে। তৎকালীন আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী মির্জা গোলাম হাফিজ বলেছিল, ইনডেমনিটি বিল এতটাই জটিল বিষয় যে এটার জট খোলা সহজ কম্ম নয়। 

নানারকম বিরোধিতা, ষড়যন্ত্র, প্রতিবন্ধকতা পার করে ১৯৯৬ সালের ১২ জুন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার প্রক্রিয়া শুরু করতে আইনি বাধা অপসারণের প্রক্রিয়া হিসেবে সংবিধান বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে 'ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ রহিতকরণ বিল' ১৯৯৬ সালে সপ্তম সংসদে উত্থাপন করা হয়। ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর আইনটি সংসদে পাস হয়। ১৪ নভেম্বর রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের পর এটি পরিপূর্ণভাবে আইনে পরিণত হয়। ফলে মোশতাকের জারি করা এবং মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের সময় বৈধতা পাওয়া ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটি বিলুপ্ত বলে গণ্য হয়। এভাবেই ওই ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বিলুপ্ত করার পরই শুরু হয় বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার কাজ।

অনেক বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার কাজ শেষ হয়েছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত দৃঢ়তা এবং বঙ্গবন্ধুর অকৃত্রিম দরদি কর্মীসমর্থকদের অবিচল আস্থায় খুনিদের দণ্ড হয়েছে, জাতি কলঙ্কমুক্ত হয়েছে। তবে কয়েকজন খুনি এখনও দেশের বাইরে পালিয়ে আছে। তাদের দেশে ফিরিয়ে এনে দণ্ড কার্যকর করতে সরকারকে তৎপরতা বাড়াতে হবে। আর সেই সঙ্গে বঙ্গবন্ধু হত্যায় জিয়াসহ আর কারা কারা, কীভাবে জড়িত ছিলেন তা বের করার জন্য একটি বিশেষ কমিটি গঠনের কাজটি দ্রুত করতে হবে। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় জিয়ার নাম যুক্ত না করায় বিএনপি এখনও বড় গলায় কথা বলতে পারছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতির জনক জিয়াউর রহমানের সমর্থকরা দেশে বিচার নেই বলে চোপাচাপা মারতে পারছে। মনে রাখা প্রয়োজন যে, শেখ হাসিনা ছাড়া আর কারো পক্ষে জিয়ার মুখোশ উন্মোচনের কাজটি সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। কেবল অগাস্ট মাস এলেই জিয়ার প্রসঙ্গ সামনে না এনে তার সম্পর্ক সত্য সন্ধানে ব্রতী হওয়া শ্রেয়। ২৬ সেপ্টেম্বর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে দেশে যে কালো অধ্যায়ের সূচনা করা হয়েছিল তেমন দিন যেন দেশে আর ফিরে আসতে না পারে সেটা নিশ্চিত করতে হবে।