পরীর পাহাড় তথা কোর্টবিল্ডিং নিয়ে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন ও আইনজীবীরা পরষ্পর মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে। চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতি সেখানে নতুন দুটি ভবন তৈরির উদ্যোগ নিলে তা নিয়ে আপত্তি তোলে জেলা প্রশাসন। সমিতির ওই দুই নতুন স্থাপনা নির্মাণকে জেলা প্রশাসন বলছে 'ঝুঁকিপূর্ণ'। আর সমিতির দাবি, নিয়ম মেনে 'অনুমোদন' নিয়েই তারা ভবন করছেন। পরীর পাহাড়ে আইনজীবীদের চেম্বারের জন্য নতুন দুটি ভবন নির্মাণ নিয়ে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপটে চলতি বছরের ১৯ সে্প্টেম্বর সংবাদ সম্মেলন করে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতি। এতে সমিতির সাধারণ সম্পাদক জিয়া উদ্দিন বলেন, "মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে আমাদের সমিতির যে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক মিথ্যা তথ্য দিয়ে তা বিনষ্টের অসৎ উদ্দেশ্যে অপপ্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে জেলা প্রশাসন।" সমিতির সভাপতি এনামুল হক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, "গণমাধ্যমে দেখেছি জেলা প্রশাসক একটি গোপন প্রতিবেদন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দিয়েছেন, সেখানে সব বক্তব্য মিথ্যাচার। প্রতিবেদনে বলেছেন, আমাদের ভবনগুলো অবৈধ। অথচ সিডিএ বলেছে সেগুলো অনুমোদিত। প্রতিবেদনে কোর্ট বিল্ডিং এলাকায় অননুমোদিত ৩৫৩টি অবৈধ স্থাপনার কথা আছে। সেগুলো থেকে জেলা প্রশাসন নিয়মিত ভাড়া নেয়। প্রতিবেদনে নতুন ভবনে চেম্বার বরাদ্দের জন্য ১২ কোটি টাকা আদায়ের যে কথা বলা হয়েছে, এ পর্যন্ত একটি টাকাও সংগ্রহ করা হয়নি।" লিখিত বক্তব্যে সমিতির সাধারণ সম্পাদক জিয়া উদ্দিন আরও বলেন, "সমিতির ভবনগুলো মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রণালয়ের অনুদানে এবং সমিতির নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত। ভবন অবৈধ হলে প্রধানমন্ত্রী বা অন্য কোনো মন্ত্রণালয় অনুদান দিত না।"
ইতোমধ্যে পরীর পাহাড়ে নতুন স্থাপনা নির্মাণ না করতে এবং অবৈধ স্থাপনা অপসারণ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করা হলে তাতে প্রধানমন্ত্রী সায় দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
বছর তিনেক আগে, স্টেশন রোড ধরে নিউ মার্কেটের দিকে আসছিলাম। নূপুর মার্কেটের কাছাকাছি এসে নিউ মার্কেটের দিকে চোখ পড়তেই একটু অবাক হলাম। নিউ মার্কেটের ঠিক উপরে কোর্ট বিল্ডিংয়ের এই পাশটায় একটা বহুতল ভবন উঠে গেছে কখন খেয়াল করিনি। মনে করলাম, বছর দুয়েকের মধ্যে এই পথে আসিনি, এরই মধ্যে উঠে গেছে ভবনটি! দূর থেকে দেখলে যে কারও মনে হবে ভবনটি বোধহয় নিউ মার্কেটের লাগোয়া। আসলে তা নয়। কোর্ট বিল্ডিংয়ের ভবনটি তৈরি হয়েছে পাহাড়ের উপর। ভবনটি অনেক উঁচু ও দীর্ঘ। ভঙ্গুর মাটির পাহাড়ের কিনারে এমন বড় একটি স্থাপনা দেখে বিস্মিত হলাম।
১৯৮৪ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত আমার জীবনের উল্লেখযোগ্য একটি সময় নিউ মার্কেটে কাটিয়েছি। মার্কেটের পেছনের দিকেই আমরা বসতাম। আড্ডা দিতাম। কোর্ট বিল্ডিংয়ের যে অংশে এখন ভবনটি হয়েছে তার বিপরীতে। পাহাড়ের এই অংশে কোনো স্থাপনা ছিল না। আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে কিছু কিছু বেড়ার ঘর উঠতে শুরু করে। ক্রমে ক্রমে পাহাড়ের ঢালু এই অংশটি এক প্রকার বস্তিতে পূর্ণ হয়ে যায়। অতি বর্ষণে এই অংশের মাটি ধসে যেতে দেখেছি কয়েকবার। দুই-তিনবার পাহাড় ধসে নিউ মার্কেটের 'প্রটেকশন ওয়ালও ভেঙে যেতে দেখেছি। ওই জায়গার উপরেই এখন মস্ত ভারী একটি দালান উঠে গেছে।
এখন যেটা কোর্ট বিল্ডিং তার পূর্ব নাম ছিল পরীর পাহাড়। সে নামও খুব বেশি প্রাচীন নয়। তা নামকরণে বোঝা যায়। কারণ পরী শব্দটি মুসলিমরা ব্যবহার করে থাকে। এর আগেও এই পাহাড় বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিল। বিভিন্নজনের মালিকানায় ছিল। ব্রিটিশরাও এটাকে 'ফেয়ারি হিল' বলত। অনেক আগে পাহাড়টি পর্তুগিজ ডাকাত তথা জলদস্যুদের আড্ডাখানা ছিল। ব্রিটিশ সরকার প্রথমে এই পাহাড়ের চূড়া কিছুটা সমতল করে এর উপরে প্রশাসনিক ভবন নির্মাণ করে। এখন এটি আদালত ভবন, বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসনের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ব্রিটিশরা এই ভবন গড়ে তোলার সময় পাহাড়ের ভারসাম্য নষ্ট করেনি। ভবন তৈরির সময়ে পাহাড়ের মূল কাঠামো অক্ষুণ্ন রেখেছে। পাহাড়ের মূল সৌন্দর্যও নষ্ট করেনি। ফলে দীর্ঘকাল ধরে পরীর পাহাড় বা কোর্টবিল্ডিং একটি অন্যতম পর্যটন স্পট বা বিনোদন ক্ষেত্র ছিল। বিকেল ও সন্ধ্যায় অনেকেই এর সৌন্দর্য দেখতে যেতেন। এর উপর থেকে নগর দেখতে যেতেন। এক সময় কোর্ট বিল্ডিং থেকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বে তাকালে গলার হারের মতো বয়ে যাওয়া কর্ণফুলীকে দেখতে পাওয়া যেত।
দীর্ঘদিন পরীর পাহাড় অক্ষত ছিল। সময়ের সাথে সাথে এই পাহাড় হারাতে থাকে তার অঙ্গ। এখন পাহাড়টি ইট-বালু-সিমেন্টের বস্তিতে পরিণত হয়েছে। পাকিস্তান আমলেই এই পাহাড়ের পাদদেশে স্থাপনা তৈরি শুরু হয়। ফলে কাটা হতে থাকে পাহাড়টি। পাহাড়ের পূর্ব পাশে প্রথমে গড়ে তোলা হয় তৎকালীন পাকিস্তান আমলে 'স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান' এর শাখা যা স্বাধীনতার পর 'বাংলাদেশ ব্যাংকে' রূপান্তরিত হয়। এরপর এর চারপাশে গড়ে উঠতে থাকে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়। সিডিএ ভবন। তার পাশে বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন ভবন, চট্টগ্রাম জেনারেল পোস্ট অফিস, বিপণি বিতান বা নিউ মার্কেট, মিউনিসিপ্যাল হাই স্কুল, পৌর জহুর হকার মার্কেট ইত্যাদি। এভাবে এক সময় এই পাহাড়ের চারপাশের বিশাল অংশ কাটা পড়ে গেল। গড়ে ওঠে বিভিন্ন ভবন ও স্থাপনা। এই করতে করতে এ পাহাড়টি এখন ভারসাম্য ঝুঁকিতে আছে।
১৯৬৪ সাল থেকে নিউ মার্কেটের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। তখন আইউব খানের আমল। এই জায়গাটি ছিল একটি চুনার গুদাম। একটি আধুনিক শপিং মল গড়ে তোলার লক্ষে এই জায়গাটি বেছে নেওয়া হয়। সম্ভবত ১৯৬৬ সালে মার্কেটটি উদ্বোধন করা হয়। তখন বলা হতো এটি ছিল দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বড় ও আধুনিক মার্কেট। কথাটি হয়তো মিথ্যা ছিল না। ফিদা হোসেনের নকশা করা এই মার্কেটটি সবদিক থেকেই ছিল আধুনিক। প্রথম চলমান সিঁড়ি স্থাপিত হয়েছিল এই মার্কেটে। যা দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে এমনকি অন্য জেলার মানুষও এ মার্কেটে আসতেন। মার্কেটটি উদ্বোধনের আগে এর জন্য সুন্দর নাম দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছিল। 'বিপণি বিতান' নামটি তা থেকেই নির্বাচিত করা হয়েছিল এবং নামদাতাকে পুরস্কৃত করা হয়েছিল । ভবনটির স্থাপত্য, নির্মাণ শৈলী সবকিছুই ছিল অত্যন্ত আধুনিক ও সুদূরপ্রসারী চিন্তার। মার্কেটটি নির্মাণের সময় পাহাড় কাটতে হলেও কিছুটা বিধান মানার চেষ্টা করা হয়েছিল। মার্কেটের পূর্বদিকটা পাহাড়। যে কারণে মার্কেটটি পশ্চিম অংশ থেকে ধাপে ধাপে পূর্বদিকে উঁচু। ভূমিকম্পে পুরো ভবন যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে কারণে আলাদা আলাদা ভবনের সমন্বয়ে গড়ে তোলা হয়েছিল পুরো মার্কেটটি। এটি যখন নির্মাণ করা হয় তখন শীতাতপ ব্যবস্থার এত প্রসার ঘটেনি। কিন্তু এই মার্কেট নির্মাণকালে এর ভেতরে যথেষ্ট আলো-বাতাস থাকার ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। যে কারণে মাঝখানে খালি রেখে বৃত্তাকারে তৈরি করা হয়েছিল মার্কেটটি যেন প্রত্যেকটা দোকান পেছনের অংশ খোলা রেখে বায়ু ও আলোর পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করতে পারে। এছাড়া কয়েকটা দোকানের পর খোলা জায়গা ছিল বায়ু চলাচলের জন্য। কেনাকাটা করতে আসা ক্রেতারা যেন বিশ্রাম নিতে পারেন সে পরিকল্পনা মাথায় রেখে। মার্কেটের গোল চত্বরে করা হয়েছিল বাগান। মালামাল পরিবহনের জন্য গাড়ি ও ট্রলি ওঠার ব্যবস্থাও ছিল। দুই সারির দোকানের মাঝখানে চলাচলের প্যাসেজও অনেক প্রশস্ত। মার্কেটের মূল ভবনের পেছনে পাহাড় সংলগ্ন জায়গায় ছিল বি ব্লক। শুনেছি সেখানে কাঁচা বাজারের জন্য দোকান করা হয়েছিল। মার্কেটের টয়লেটও ছিল বি ব্লকে। এখন বি ব্লক ভেঙে সেখানে বহুতল শপিং মল করা হয়েছে। আর -মূল মার্কেটের নকশা পরিবর্তন করে দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় টয়লেট স্থাপন করা হয়েছে।
বিপণি বিতানের নকশা বিকৃত করার কাজটি শুরু হয়েছিল গত শতকের আশির দশকে এরশাদের শাসনামল থেকে। ভেন্টিলেশনের জন্য খোলা রাখা জায়গাগুলো দোকান করে বেঁচে দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে এ মার্কেটের স্থাপত্যকলার অর্থাৎ মূল নকশাকে এতই বিকৃত ও পরিবর্তিত করা হয়েছে যে এর আসল চেহারা কেমন ছিল তা এখন দেখে বোঝার উপায় নেই। এক সময়ের সবচেয়ে অভিজাত শপিং মলটি এখন জীর্ণ-শীর্ণ হতে চলেছে। এটিও এখন গুদাম ঘরে পরিণত হচ্ছে। ফলে ক্রেতা শূন্য হয়ে পড়েছে এক সময়ের বহুল আকর্ষণীয় বিখ্যাত বিপণি বিতান।
বি ব্লকের যে জায়গায় এখন বহুতল মার্কেট ঠিক তার উপরেই কোর্ট বিল্ডিংয়ের নতুন বহুতল ভবনটি। পরীর পাহাড়ের ওই অংশটি এখন ভীষণ ভারী ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আমি জানি না নির্মাণকারী কর্তৃপক্ষ কোন যুক্তি ও ভরসায় ভঙ্গুর পাহাড়ের উপর এমন ভারী স্থাপনা তৈরি করেছেন তা-ও পাহাড়ের একেবারে খাদের কিনারে। অনেকের মনে থাকার কথা গত শতকের শেষের দিকে পুরাতন কোর্ট বিল্ডিং ভেঙে সেখানে নতুন ভবন তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। কেউ কেউ যুক্তি দেখিয়েছিলেন, ভবনটি যে কোনও সময় ভেঙ্গে পড়তে পারে। সে সময়েই চট্টগ্রামের নাগরিক সমাজ আন্দোলন করেছিল ঐতিহ্যবাহী ভবনটি রক্ষার দাবিতে। পরবর্তীতে সরকার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে। পুরাতন ভবন সংস্কার করে এর পেছনে নতুন ভবন তৈরির অনুমোদন দেয়। এরপর থেকে কোর্ট বিল্ডিংয়ে একের পর এক বহুতল ভবন তৈরি হতে থাকে। এখন কোর্ট বিল্ডিং দালানের বস্তিতে পরিণত হয়েছে। ওখানে ঢুকলে আমি এখন পথ হারিয়ে ফেলি।
আমি নতুন ভবন নির্মাণ বা নতুন কার্যালয় স্থাপনের বিরোধিতা করছি না। দেশের বিচার বিভাগের আয়তন বেড়েছে। আদালতের সংখ্যা বেড়েছে, বিচারক, আইনজীবী ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী বেড়েছে। এঁদের সংস্থান করতে হবে। এর জন্য নতুন ভবন তৈরি করতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো কিছু কিছু আদালত কি অন্যত্র স্থাপন করা যেত না? বিভাগীয় কমিশনার জেলা প্রশাসকদের কার্যালয় কি অন্যত্র স্থাপন করা যেত না? তার মানে এই পাহাড়কে এমন ভারাক্রান্ত, জর্জরিত ও ঝুঁকিপূর্ণ করে না তুলে কি অন্য উপায় ছিল না?
যাদের হাতে নগর পরিকল্পনার ভার, যাদের হাতে পরিকল্পিত নগর উন্নয়নের ভার, যাদের হাতে পুরো জেলা শাসনের ভার, যাদের হাতে বিচারের ভার, তারা আমার চেয়ে অনেক শিক্ষিত, বোদ্ধা, জ্ঞানী, প্রজ্ঞাবান। তারা ক্ষমতাবানও বটে। তারা আমার মতো একজন সাধারণের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে চলেন না। খুব সাধারণ মানুষ হিসেবে আমার মনে হয়েছে বিপণি বিতানের মতো এত সুন্দর ও ঐতিহ্যবাহী স্থাপনার মূল নকশা বিকৃত করা ঠিক হয়নি। আমার মনে হয়েছে পরীর পাহাড় বা কোর্ট বিল্ডিংয়ে এত বড় বড় ভবন তৈরি করা ঠিক হয়নি।
সাম্প্রতিক কিছু পাহাড় ধসের পরে আমাদের দেশের পাহাড়ের গঠনপ্রকৃতি, পাহাড় কাটা, পাহাড়ের পাদদেশে বসতি স্থাপন ইত্যাদি নিয়ে নতুনভাবে ভাবতে হচ্ছে। আমাদের পাহাড়গুলো বেলে-দোআঁশ মাটি দিয়ে গঠিত। তাই ভঙ্গুর ধরনের। কয়েকদিন বৃষ্টি পড়লে ধসে যায়। এঁটেল মাটি হলো শক্ত। পানি ধরে রাখে না। উপর দিয়ে প্রবাহিত করে দেয়। বালিমাটি পানি ধরে রাখে এবং পানি ধরে রাখতে গিয়ে এক সময় ভারী হয়ে ধসে পড়ে। পাহাড়ে যারা বাস করে তারা তা জানে। পাহাড়ের মাটি একটু ছুঁয়ে দেখলে সহজেই তা বোঝা যায়। এর জন্য মৃত্তিকা বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার নেই। আমরা যে পাহাড় ব্যবস্থাপনায় ভুল করছি এবারের ব্যাপক পাহাড় ধস তা বুঝিয়ে দিয়ে গেল।
গত ২০ বছরে ১১০টি পাহাড় হারিয়ে গেছে। গত শতকের আশির দশকের শুরুতে নগরীতে ১৩০টি পাহাড়ের চূড়া চিহ্নিত করা হয়েছিল। চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো এ অঞ্চলের পরিবেশ, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অংশ। এগুলো হারিয়ে গেলে আমাদের অনেক কিছু হারিয়ে যাবে। এ বাস্তবতা যদি এখনো অনুধাবন করতে পারতাম কিছুটা রক্ষা হলেও পেতাম।
কিছুদিন আগে ঘাটফরহাদবেগে পাহাড়ের সামান্য অংশ বসত ঘরসহ ধসে পড়েছিল। সেখানে পাহাড়ের অনেক গভীরে স্থাপন করা পয়নিষ্কাশনের একটি পাইপ দেখে অবাক হয়েছি। ভাবছি ব্রিটিশরা এই নগর উন্নয়ন করার সময় এর প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের কথা মাথায় রেখেছিল। একটি পাহাড়ি এলাকার পয়নিষ্কাশনের বিশেষ পদ্ধতির কথা মাথায় রেখেছিল। তারাও পাহাড় কেটে অনেক স্থাপনা গড়ে তুলেছিল। তবে তা পাহাড়ের সৌন্দর্য, ভারসাম্য ঠিক রেখে। ব্রিটিশরা ছিল পরদেশি। ওরা আমাদের প্রকৃতি নিয়ে, ভবিষ্যৎ নিয়ে এতটা ভাবতে পারলে আমরা আমাদের জন্য ভাবতে পারিনি কেন? পারছি না কেন?
২০১০ সাল থেকে নতুন আদালত ভবনে বিচারিক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। পুরাতন ভবনটিতে বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকসহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তর। সম্প্রতি এসব অফিসসহ সরকারি ৪৪টি দপ্তর কালুরঘাটে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পুরাতন আদালত ভবনসহ পরীর পাহাড়কে হেরিটেজ ঘোষণার একটি প্রস্তাব সরকার বিবেচনা করছে। প্রস্তাবটি প্রশংসনীয়। তবে সবার আগে প্রয়োজন সুষ্ঠু ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। পরীর পাহাড়সহ চট্টগ্রামের অনেক ঐতিহ্য বিলীন হওয়ার পথে, অনেককিছু ইতিমধ্যে বিলীন হয়ে গেছে। সবকিছুই ঘটেছে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অভাবে। অনেক সময় পরিকল্পনা থাকলেও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে কাাজের কাজ কিছু হয়নি। পরীর পাহাড় রক্ষায় উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন ছিল ৪০/৫০ বছর আগে। ইতিমধ্যে যা ক্ষতি হওয়ার তা হয়ে গেছে। এই পাহাড়কে আর ৪০ বছর আগের অবস্থানে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তবে এখন থেকে পদক্ষেপ নেওয়া হলে অন্তত কঙ্কালটা রক্ষা পাবে।
একটি কথা বলে শেষ করতে চাই, সম্প্রতি আরেকটি হেরিটেজ চট্টগ্রাামের সিআরবি এলাকায় একটি বেসরকাারি হাসপাতাল নির্মাণের জন্য একটি চুক্তি করেছে সরকার। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে আন্দোলন করছেন চট্টগ্রামবাসী। এ চুক্তি থেকে সরকার সরে না এলে সিআরবিকে পরীর পাহাড়ের ভাগ্য বরণ করে নিতে হবে।