বঙ্গবন্ধু ও একটি প্যারাডাইম শিফট

তানভীর হাসান সৈকত
Published : 17 Sept 2021, 09:31 AM
Updated : 17 Sept 2021, 09:31 AM

বাংলাদেশের স্বাধীনতার আকাশের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বাঙালি জাতিকে কেবল স্বাধীনতাই এনে দেননি; বাংলার রাজনীতি, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, শিক্ষা তথা পুরো সমাজ ব্যবস্থায় এনে দিয়েছেন এক আমূল পরিবর্তন।

২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসন-শোষণের শেকল থেকে মুক্ত হয়েও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি বাঙালিরা; মোকাবিলা করতে হয়েছে পাকিস্তানি শাসনের জুলুম ও বঞ্চনা। দীর্ঘদিনের সেই ভেঙে পড়া অর্থনীতি, রাজনীতি আর সমাজকে নতুন উদ্যমে গড়ে তোলেন বাংলার সূর্যসন্তান শেখ মুজিব।

স্বাধীনতার আগে বাঙলার যে অবস্থা ছিল সেখান থেকে বাংলাদেশের যে আমূল পরিবর্তন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান করেছেন সেটাকেই একটা 'প্যারাডাইম শিফট' বলা যেতে পারে। একজন রাজনীতিক হয়েও কৃষি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি বা শিক্ষাখাতের খোলনলচে বদলে দিতে যে সমস্ত সিদ্ধান্ত বঙ্গবন্ধু নিয়েছিলেন, তাতে নিঃসন্দেহে বলা যায়, তিনি ছিলেন পুরোদস্তুর একজন দক্ষ রাষ্ট্রপরিচালক।

বাংলাদেশকে একটি স্বনির্ভর দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে এবং বাংলার মানুষকে  ক্ষুধা ও দারিদ্র্য থেকে মুক্ত করতে সবুজ বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ভাষণে বঙ্গবন্ধু কৃষি বিপ্লবের কথা বলেছিলেন। কৃষি শিক্ষায় সবাইকে আকৃষ্ট করতে ও আধুনিক কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে তিনি কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণির মর্যাদা প্রদান করেন। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে ৫০০ কোটি টাকা উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ ছিল, যার মধ্যে ১০১ কোটি টাকা কৃষির জন্য বরাদ্দ করেন। তিনি কৃষিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান যেমন- বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন, তুলা উন্নয়ন বোর্ড প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া কৃষিক্ষেত্রে ভর্তুকি, উন্নত সেচ ব্যবস্থা, উন্নত সার ব্যবহারে কৃষকদের উৎসাহিত করেন তিনি। বাংলাদেশের বর্তমান যে আধুনিক কৃষি ব্যবস্থা তা বঙ্গবন্ধুর হাত ধরেই শুরু হয়েছিল। কৃষিনির্ভর দেশ হওয়ায় বাংলার ভঙ্গুর কৃষি ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করেন তিনি।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন তার মূল কথা ছিল মুক্তি। এই মুক্তিধারায় রাজনৈতিক স্বাধীনতা ছাড়াও সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির কথা বলেছিলেন তিনি। সাধারণ মানুষ ও তাদের কল্যাণই ছিল বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রচিন্তার মূল বিষয়। ১৯৭৫ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে দ্বিতীয় বিপ্লবের রুপরেখা তথা বৈষম্য কমিয়ে আনা ও সমবায় গড়ার রূপরেখা দেন বঙ্গবন্ধু। দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েই বঙ্গবন্ধু মনোনিবেশ করেন স্বদেশের পুনর্বাসন ও রাষ্ট্র গঠনে। দেশের ভেঙেপড়া ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিলগ্নীকরণের প্রক্রিয়া শুরু করেন। এছাড়াও ভূমির মালিকানা সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করে দেন।

স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের অবকাঠামো ছিল খুবই নাজুক। যুদ্ধের ফলে দেশের বেশিরভাগ সড়ক, বন্দর, সেতু বিধ্বস্ত ছিল। শিল্প কলকারখানাও প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত ছিল। তার ওপর বন্যায় দেশের মোট জনগোষ্ঠীর জন্য কাঙ্ক্ষিত ফসল উৎপাদনও সম্ভব হয়নি। বহিঃবিশ্বের অর্থনীতির অবস্থাও খুব ভাল ছিল না যেকারণে বিদেশি সহায়তা পাওয়ার জন্যও বেগ পেতে হচ্ছিল। বঙ্গবন্ধুর শক্তিশালী নেতৃত্বে বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশের পুরনো ঋণের দায়-দেনার সমঝোতা হয়। তাই অনেক কষ্ট করেই খাদ্য সংকট মোকাবেলা করতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর বিচক্ষণ নেতৃত্বে ১৯৭৪ সালের মূল্যস্ফীতি ৬০ শতাংশ থেকে ১৯৭৫ সালের ৩০-৩৫ শতাংশ নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছিল। মাত্র তিন বছরেই তিনি বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ৯৩ ডলার থেকে ২৭১ ডলারে উন্নীত করতে পেরেছিলেন। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যে ভাষণটি দিয়েছিলেন তাতেই প্রতিফলিত হয়েছিল তার গণমুখী অর্থনৈতিক দর্শন। বাংলাদেশের জন্য আত্মনির্ভরশীল অর্থনীতি গড়ার পাশাপাশি তিনি একটি ন্যায্য আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রবক্তা ছিলেন।

একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে বঙ্গবন্ধু ফিরে এসে প্রথমেই সংবিধান রচনা করলেন আর সেই সঙ্গে প্রণয়ন করলেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি। তার দেওয়া পররাষ্ট্রনীতির মৌলিক কথা—'সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়' এবং 'বন্ধুত্বপূর্ণ সহাবস্থান' বিশ্বাস করেই আজকের বাংলাদেশ বিশ্ব সমাজের সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন চিন্তা-চেতনায় দূরদর্শী একজন রাজনৈতিক নেতৃত্ব।  ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে সাথে সাথেই তিনি দেশে আসেননি। তার দূরদর্শী চিন্তার কারণে তিনি প্রথমে লন্ডন পরবর্তীতে ভারত হয়ে বাংলাদেশে আসেন। লন্ডন ও ভারত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে ফেরার পথে দিল্লিতে বিশাল নাগরিক সংবর্ধনায় বঙ্গবন্ধু বলেন- আজ বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। বাংলাদেশ ও ভারতবর্ষ পাশাপাশি ভাই ভাই হিসেবে বাস করবে শান্তিপূর্ণভাবে। সেদিন বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করা হয়েছিল- শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আপনার আদর্শের মিল কেন? বঙ্গবন্ধু জবাবে বলেছিলেন- এটা আদর্শের মিল, নীতির মিল, এটা মনুষ্যত্বের মিল, এটা বিশ্বশান্তির জন্য মিল। বঙ্গবন্ধুর এ কথা শুনে সেদিন সমবেত জনতা করতালিতে ফেটে পড়েছিল।

বর্তমানে বাংলাদেশের আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার বীজ বুনে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। স্বাধীন বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে আধুনিকায়ন করতে একটি গণমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করেছিলেন তিনি। ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর মোট আটটি শিক্ষা কমিশন প্রতিবেদন পেশ করে। কিন্তু সবগুলো কমিশনই ছিল বাঙালিদের মূল চেতনা, সমাজ-সংস্কৃতি ও কৃষ্টি বিরোধী। ১৯৭০ সালের নির্বাচনী বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু সুষ্ঠু সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য শিক্ষাখাতে বিনিয়োগের কথা বলেন সুস্পষ্ট করে। সে আলোকে ১৯৭৪ সালে একটি সুদূরপ্রসারী শিক্ষা ব্যবস্থার লক্ষ্যে তিনি কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। পাশাপাশি ১৯৬২ সালের আইয়ুব খান প্রণীত অধ্যাদেশ বাতিল করেন এবং ১৯৭৩ সালে উচ্চ শিক্ষা প্রসারে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীন পেশা ও বিশ্ববিদ্যালয়কে মুক্তবুদ্ধির চর্চা কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তৎকালীন দেশের চারটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধুর অটল অবস্থানের কারণেই আজ আমরা এই আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা পেয়েছি।

বাঙালি জাতির সাহিত্য-সংস্কৃতির চেতনায় বঙ্গবন্ধু এক বিরাট পরিবর্তন নিয়ে আসেন। তার অভিমত ছিল জনগণই সাহিত্য শিল্পের উৎস। জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কোনোদিন কোনো মহৎ সাহিত্য বা উন্নত শিল্পকর্ম সৃষ্টি হতে পারে না। তিনি বাংলার জনগণের জীবনব্যবস্থা সাহিত্যের মাধ্যমে তুলে ধরতে বলেন। সাহিত্য লেখনীর মাধ্যমে দুর্নীতির মুখোশ উন্মোচন করে একটি সত্য ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলার কথা তিনি বলেন।

সুশাসন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য জনগণের অংশগ্রহণ অপরিহার্য। আর তরুণদের অংশগ্রহণ ছাড়া কখনোই সত্য সুন্দর একটি সমাজ গঠন করা সম্ভব নয়। বঙ্গবন্ধু যেমন নিজের তরুণ বয়সেই সকল অন্যায়, অবিচার, মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্য-ন্যায়ের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন তেমনি তিনি সবসময় চাইতেন বাংলার তরুণ সমাজও যেন এই দেশের হাল ধরতে পারে। প্রতিটি রাজনৈতিক আন্দোলনে তিনি তরুণদেরকে উৎসাহিত করেছেন অংশগ্রহণের জন্য। শত বাধা অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোষহীনতার দীক্ষা তিনি এ দেশের তরুণদের দিয়েছেন।

বাঙালি সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে প্যারাডাইম শিফট বা মৌলিক পরিবর্তন ঘটিয়েছিলেন, একজন সুনাগরিক হিসেবে আমাদের সকলেরই উচিত সুজলা-সুফলা এই বাংলাদেশের সমাজ, শিক্ষা ব্যবস্থা, অর্থনীতি, পররাষ্ট্রনীতি ও উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় সেই পরিবর্তনের ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।