বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৪ সালের মে মাসের মাঝামাঝি যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভার সদস্য হয়েছিলেন। কিন্তু ১৫ দিন যেতে না যেতেই তাকে যেতে হয় কারাগারে, মুসলিম লীগের নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারের রোষের শিকার হয়ে। মুক্তিলাভ করেন ১৮ ডিসেম্বর। চতুর্থ সন্তান শেখ রেহানার জন্ম পরের বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর। এর কয়েকদিন আগে ২৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু করাচিতে পাকিস্তান গণপরিষদের সভায় যোগ দিয়েছিলেন। ৩ সেপ্টেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীসহ অংশ নেন করাচির এক জনসভায়। এ মাসে আরও কয়েকবার তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে গণপরিষদ সভা ও অন্য রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়েছেন। পূর্ব পাকিস্তানে থাকলে সেখানেও তার ব্যস্ততা চোখে পড়ার মতো।
১৯৫৪ সালের মে মাসে চক্রান্ত করে শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে দেওয়ার পর মন্ত্রিসভার সদস্যদের মধ্যে কেবল শেখ মুজিবুর রহমানকেই গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের দিনের স্মৃতি অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থে লিখেছেন এভাবে স্ত্রীকে বলছেন, 'তোমাকে কি বলে যাব, যা ভাল বোঝ কর, তবে ঢাকায় থাকলে কষ্ট হবে, তার চেয়ে বাড়ি চলে যাও।' [পৃষ্ঠা ২৭১]
১৯৫৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগ নেতা আতাউর রহমান খান পূর্ব পাকিস্তানে নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করেন। একাধিক গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর বঙ্গবন্ধুর হাতে। কিন্তুই দলের কাজে বেশি সময় দেওয়ার জন্য তিনি মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন ১৯৫৭ সালের ৩০ মে। মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান তা গ্রহণ করেন ৮ অগাস্ট। চীন সফরের কারণে পদত্যাপত্র গ্রহণ বিলম্বিত হয়। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রের বিধান ছিল এভাবে- একই ব্যক্তি দলের গুরুত্বপূর্ণ পদ ও মন্ত্রী থাকতে পারবেন না। ১৯৫৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে কাগমারিতে আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে পূর্ব পাকিস্তান কমিটির সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী শেখ মুজিবুর রহমানকে একটি পদ ছেড়ে দেওয়ার আহ্বান জানান প্রকাশ্যেই। এ ধরনের ক্ষেত্রে দলীয় পদ ছেড়ে দেওয়াই রেওয়াজ। বঙ্গবন্ধুর বয়স তখন ৩৭ বছর। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করুন, এমন প্রস্তাব ছিল। সে সময় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তার মন্ত্রিসভায় শেখ মুুজিবুর রহমানের যোগ দেওয়ার প্রস্তাবও ছিল। কিন্তু তিনি দলের পদ রাখলেন, মন্ত্রিত্ব ছাড়লেন, যা দশকের পর দশক ধরে আমাদের রাজনীতিতে অনন্য নজির হয়ে রয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর বয়স যখন ২৮ বছর, সবেমাত্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হয়েছে। তিনি কলকাতা থেকে বিএ পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম পড়ার জন্য আইন বিভাগে ভর্তি হয়েছেন। সবে মাত্র জন্ম হয়েছে প্রথম সন্তান হাসিনার। মুসলিম লীগের কাজেই তিনি যুক্ত। তবে রাষ্ট্র্রভাষা হিসেবে বাংলাকে গ্রহণ এবং মুসলিম লীগকে নওয়াব পরিবারের কব্জা থেকে মুক্ত করাসহ বিভিন্ন ইস্যুতে স্বাধীন মতামত দিয়ে চলেছেন। এ সময়েই তার পেছনে সর্বক্ষণ গোয়েন্দা লাগিয়ে রাখা হয়। তিনি কোথায় যাচ্ছেন, কী করছেন- সব জানতে ব্যস্ত কয়েকজন গোয়েন্দা। সেলুনে গেলে গোয়েন্দা, সিনেমা হলে বা বন্ধুর বাড়িতে গেলেও সঙ্গী গোয়েন্দা। এমনকি ১৯৫৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সরকার গঠিত এবং কেন্দ্রে সোহরাওয়ার্দী সাহেব প্রধানমন্ত্রী থাকার পরও গোয়েন্দারা তাকে অনুসরণ থেকে বিরত হয়নি।
স্ত্রী চতুর্থ সন্তানের জন্ম দেবেন- কিন্তু তিনি ব্যস্ত রাজনৈতিক কমকাণ্ডে। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় গণপরিষদের সদস্য হিসেবে তিনি বার বার যাচ্ছেন করাচি। সে সময় পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের ওপর চলছে সরকারের নির্যাতন। অনেক নেতা-কর্মী জেলে। তিনি গণপরিষদে সোচ্চার এ সবের বিরুদ্ধে।
বঙ্গবন্ধু পরিবারের প্রতি যত্নশীল ছিলেন। তবে দল ও দেশ ছিল সবার ওপরে। অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা ও আমার দেখা গণচীন গ্রন্থের নানা স্থানে রয়েছে পরিবারের প্রতি দরদী মনের বিবরণ। কারাগার থেকে স্ত্রী এবং পুত্রকন্যাদের কাছে লেখা অনেক চিঠি গোয়েন্দারা আটকে দিয়েছিল। এখন তা গোয়েন্দা প্রতিবেদনের বিভিন্ন খণ্ডে প্রকাশিত হচ্ছে। শেখ জামালের জন্মের সময়েও তিনি টুঙ্গিপাড়ায় গ্রামের বাড়িতে অবস্থান করতে পারেননি। গোয়েন্দা প্রতিবেদনের সূত্রে জানতে পারিÑ পুত্রের জন্ম সংবাদ পেয়ে স্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে লিখেছেন, ভাসানী সাহেবের সঙ্গে পাবনা চললাম। [ গোয়েন্দা প্রতিবেদন, তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৩৩]
স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের যিনি জন্ম দেবেন, আপামর মানুষের মুক্তির জন্য যার নিরলস সাধনাÑ তাঁর জীবন তো এমনই হওয়ার কথা।
শেখ রেহানার জন্মের তিন বছর পূর্ণ না হতেই ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পাকিস্তানে নিষ্ঠুর সামরিক শাসন জারি হয়। শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হন ১২ অক্টোবর। এর আগে বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের কারাগার 'দেখা' হয়েছে হাসিনা, কামাল ও জামালকে নিয়ে। গোয়েন্দা প্রতিবেদন সূত্রে আমরা জানতে পারি, ১৯৫৮ সালের ২০ নভেম্বর তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে 'দেখা' করেন চার সন্তান নিয়ে। শিশু রেহানার এটাই ছিল প্রথম কারাগার দর্শন। পিতার দর্শন পাওয়ার আবেদনে তার বয়স উল্লেখ করা হয়েছিল ২ বছর ১১ মাস। [প ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৭১]
এ বয়সেই জেল-দর্শন। এমনটি আমরা দেখে বঙ্গবন্ধুর অন্য সন্তানদের ক্ষেত্রেও। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হন। তখন একমাত্র সন্তান হাসিনার বয়স কয়েক মাস। ১৯৪৯ সালে গ্রেফতার হন দুই বার। প্রথম বাওে কারাজীবন স্থায়ী হয় দুই মাসের বেশি। বছরের শেষ দিনে ফের কারাগারে, যা স্থায়ী হয় আড়াই বছরের মতো।
১৯৫৮ সালের নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে মায়ের সঙ্গে কারাগারে গিয়ে ফের পিতৃদর্শন ঘটে শেখ রেহানার। গোয়েন্দা রিপোর্ট সূত্রে আমরা জানতে পারি, এ দিন বেগম মুজিব স্বামীকে বলেনÑ সিদ্ধেশ্বরী এলাকার যে বাড়িতে তারা বসবাস করছেন, সেখানে পানির কষ্ট। আশপাশে ঝোপ-জঙ্গল। মশার উৎপাত। এখানে থাকা যাবে না। অন্য কোনো বাসা ভাড়া পাওয়াও কঠিন। কারণ শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারকে কেউ বাসা ভাড়া দিতে চায় না। বঙ্গবন্ধু স্ত্রীকে পরামর্শ দেন- ডিসেম্বরে ছেলেমেয়েদের স্কুল ফাইন্যাল পরীক্ষার পর তাদের নিয়ে গ্রামের বাড়িতে চলে যেতে। [প ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৭৯]
পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক মন্ত্রী এবং দলের পূর্ব পাকিস্তান শাখার প্রাণপুরুষের পরিবারের মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই! অথচ এ সময়েই সামরিক সরকার তার বিরুদ্ধে 'অঢেল সম্পদ অর্জনের' মামলা করে। আদালতে সবগুলো মিথ্যা মামলঅ হিসেবে খারিজ হয়ে যায়।
বঙ্গবন্ধু এ কারাজীবন স্থায়ী হয় ১৯৫৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। এরপর নানা মেয়াদে কয়েক দফা কারাবাসের পর ১৯৬৬ সালের ৮ মে থেকে ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্র"য়ারি পর্যন্ত একটানা জেল। অভিযোগ রাষ্ট্রদ্রোহিতার। বঙ্গবন্ধু পরিবারের জীবন কেমন কেটেছে এ সময়, সেটা অনেকেরই অজানা। কলরেডী মাইক সার্ভিসের কর্ণধার হরিপদ ঘোষ আমাকে বলেছিলেন, ঢাকা নগর আওয়ামী লীগের নেতা গাজী গোলাম মোস্তফা এক শীতের সকালে কয়েকটি সোনার চুড়ি নিয়ে তার বাসায় হাজির- বেগম মুজিব পাঠিয়েছেন টাকার ব্যবস্থা করে দিতে। মামলার খরচ, সংসারের খরচ, দলের নেতা-কর্মীদের কত সমস্যা!
১৯৬৭ সালের ২৩ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত জেলের ঘটনাবলীর বিবরণ দিয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন- 'ছোট মেয়েটা (রেহানা) বলল, আব্বা এক বৎসর হয়ে গেল।… বললাম আরও কত বৎসর যায় ঠিক কি?' [কারাগারের রোজনামচা, পৃষ্ঠা ২৩৩]
পরের পৃষ্ঠায় লিখেছেন, রেণু কয়েক সের চাউল, কিছু ডাউল, তেল, ঘি, তরকারি, চা, চিনি, লবণ, পিঁয়াজ ও মরিচ ইত্যাদি পাঠাইয়াছে।… ভালই হয়েছে। কিছুদিন ধরে পুরানা বিশ সেলে যে কয়েকজন ছাত্র বন্দি আছে তারা খিচুরি খেতে চায়।'
২৪৮ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, 'বড় ভাল লাগে সকলকে দিয়ে খেতে। কয়েদিদের একঘেয়ে পাক খেতে খেতে জীবন অতিষ্ঠ হয়ে গেছে।'
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তির পর শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির একচ্ছত্র নেতা, সবার প্রিয় বঙ্গবন্ধু। আওয়ামী লীগ তখন প্রধান রাজনৈতিক দল। ছাত্রলীগ প্রধান ছাত্র সংগঠন। শেখ হাসিনা ও শেখ কামাল ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী। কিন্তু সংগঠনের কোনো পদে নেই। বঙ্গবন্ধুও এটা চাইতেন না। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে তিনি কেবল পূর্ব পাকিস্তানের নয়, পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা। জনগণ নিশ্চিত হয়েছে যে তিনি স্বাধীনতার পথে চলেছেন। কিন্তু তাঁর স্ত্রী-পুত্র-কন্যা, কেউ মিছিল-সমাবেশে সামনের সারিতে নেই। মে ও নেই। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম' ঘোষণার মহাসমাবেশে পুত্র-কন্যারা লাখ লাখ মানুষের সঙ্গে, জনারণ্যে। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বঙ্গবন্ধু ফের কারাগারে, এবারে তার স্থান শত্রুরাষ্ট্র পাকিস্তানে। বেগম মুজিব এবারে নিজেই বন্দি দুই কন্যা, কনিষ্ঠ পুত্র এবং জামাতা ও নাতিকে নিয়ে। এই কঠিন সময়েও তিনি বাংলাদেশের প্রতি কর্তব্যবোধ সম্পর্কে পূর্ণ সচেতন- পুত্র কামাল ও জামালকে পাঠালেন রণাঙ্গনে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে।
মুুক্ত স্বদেশে ফের তিনি ঘরোয়া জীবন, পুত্র-কন্যাদের নিয়ে। কেউ রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে কিংবা বিদেশ সফরে দেখেনি তাকে। অথচ বিশ্বব্যাপী প্রচলিত রীতি এটাই।
১৯৭৪ সালের মার্চ মাসে শেরে বাংলা নগরে নতুন গণভবন তৈরি হয়ে যায়। ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কের ছোট বাড়ি ছেড়ে বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের নিয়ে গণভবনে উঠবেন, এটাই ধারণা করা হচ্ছিল। এ ক্ষেত্রে নিরাপত্তার বিষয়টি ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু মহীয়সী নারী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বলেন, সরকারি ভবনের আরাম-আয়েশে প্রতিপালিত হলে ছেলেমেয়েদের মন-মানসিকতা ও আচার-আচরণে অহমিকাবোধ ও উন্নাসিক ধ্যানধারণা সৃষ্টি হবে। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছ থেকে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। [সূত্র : ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ, পৃষ্ঠা ১৭৪]
অতএব, থেকে গেলেন অনিরাপদ বাসভবনে। ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্টের ঘাতকরা এ সুযোগই নিয়েছিল।
মাত্র দুই সপ্তাহ আগে জার্মানি যাওয়ার কারণে দুই বোন প্রাণে বেঁচে যান। বঙ্গবন্ধু অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে নিজের সম্পর্কে লিখেছেন, 'সাগরে শয়ন যার শিশিরে কি ভয় তার।' [পৃষ্ঠা ২০৮] বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর তাঁর দুই কন্যার জীবনেও তা কী নির্মম সত্য হয়ে ওঠে! বছরের পর বছর উদ্বাস্তুর জীবন দুই জনের। সেনাশাসক জিয়াউর রহমান তাদের বাংলাদেশ আসতে দিতে রাজি নন, ৩২ নম্বরের বাড়িতে ওঠার তো প্রশ্নই আসে না। ১৯৭৬ সালের ৪ অগাস্ট সামরিক আইন জারি হয়Ñ কোনো ব্যক্তি, রাজনৈতিক দল বা সামাজিক সংগঠন শেখ মুজিবের নামও নিতে পারবে না, প্রশংসা করার তো প্রশ্নই আসে না। জয় বাংলা স্লোগান নিষিদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের কথা বলা নিষিদ্ধ। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের দুই মাস যেতে না যেতেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চারনেতাকে হত্যা করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের শত শত নেতা-কর্মী কারাগারে। অনেক রাজনৈতিক পরিবারের সদস্যর জীবন অনিরাপদ। আওয়ামী লীগ বিপর্যস্ত একটি দল হয়ে পড়েছে। এমন পরিবেশে ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শেখ হাসিনা দলের হাল ধরেন। চরম ঝুঁকি নিয়ে চলে আসেন প্রিয় স্বদেশে। শেখ রেহানা বড় বোনের সঙ্গে আছেন, কিন্তু দলের কোনো দায়িত্বে নেই। লন্ডনে কঠিন জীবন তাঁর। পড়াশোনা করেছেন। বিয়ে করেছেন। কিন্তু জীবনযাত্রায় অতি সাধারণ। ট্রেনে-বাসে চলাচল করেন। ছোট বাসায় কষ্টে জীবন কাটে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে বিশ্বসমাজে সোচ্চার তিনি। দুই কন্যা ও পুত্রকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে গড়ে তুলছেন। পুত্র রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক একবার ঘরোয়া এক আলোচনায় বলেছেন, আশির দশকে বাংলাদেশের বিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্য হওয়াকে বাংলাদেশের সামরিক জান্তা কী 'অপরাধের দৃষ্টিতে' দেখে। মোশতাক-জিয়াউর রহমানের জারি করা কুখ্যাত ইনডেমনিটি আইনের কারণে এদেশে বঙ্গবন্ধু হত্যার এমনকি বিচার দাবি করা যায় না।
কিন্তু বঙ্গবন্ধুকন্যারা হাল ছাড়েননি। যে বাংলার মানুষকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না বলে বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ দৃঢ়সংকল্প ব্যক্ত করেছিলেন, সেই জনগণ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বিস্ময়। কিন্তু এটাও কম বিস্ময়ের নয় যে শেখ রেহানা অগ্রজের সাড়ে চার দশকের প্রতিটি কাজে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত থাকার পরও কীভাবে নিজেকে রাষ্ট্রীয় কিংবা দলীয় দায়িত্ব থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন। ঠিক যেমনটি করেছিলেন তার মা। তার পুত্র-কন্যারা নিজ গুণে স্ব-মহিমায় ভাস্বর। বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্য- এ গর্ব তাদের। কিন্তু নিজেদের ভিত নিজেরাই তৈরি করে নিয়েছেন তারা। আমাদের বুঝতে সমস্যা হয় না জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা মহিয়সী নারী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবই এ সবের প্রেরণা। বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় শেখ রেহানার অবদান যে কেউ খোলা সাদা চোখেই দেখতে পাবে। কিন্তু সামনের সারিতে নেই। রাষ্ট্রীয় সফরে নেই। ত্যাগে আছেন, ভোগে নেই। আমরা এটাও বলতে পারি যে দূরে কিংবা আড়ালে যেভাবেই থাকুন, তিনি আছেন বাংলাদেশের সমৃদ্ধি-অগ্রযাত্রার সকল কাজে প্রেরণা হয়ে। তাঁর জীবন সংগ্রাম প্রতিটি মানুষের কাছেই প্রেরণা।