ইনডেমনিটি: বিচারব্যবস্থা ও রাজনীতিকে কলুষিত করার ঘৃণ্য অধ্যায়

তন্ময় আহমেদ
Published : 1 Sept 2021, 11:43 AM
Updated : 1 Sept 2021, 11:43 AM

অগাস্ট, শোকের মাস, অশ্রুকাতর স্মৃতির মাস। তবে এবার বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এই মহালগ্নে শোকের চাদর থেকে বেরিয়ে তীব্র শক্তিরূপে আর্বিভূত হয়েছিল অগাস্ট। দেশ-বিদেশজুড়ে আপামর বাঙালির অনল অশ্রু খুঁজে ফিরেছে বঙ্গবন্ধুর বর্বর ঘাতকদের। আকাশে-বাতাসে রণে উঠেছে জাতির পিতার পলাতক খুনিদের বিচার-সম্পন্নের দাবি। এমনকি খুনি রাশেদ চৌধুরী ও নূর চৌধুরীকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডাতেও বিক্ষোভ করেছেন প্রবাসীরা। বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ এবং বাঙালির মুক্তির ইতিহাসকে যারা ভুলিয়ে দিতে চেয়েছিল, তাদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে আবার জেগে উঠেছে নতুন প্রজন্ম। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দায়মুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা ও রাজনীতিতে যে অপসংস্কৃতি শুরু হয়েছিল, সেখান থেকে বেরিয়ে আসার জন্য বুক চিতিয়ে লড়ছে তারুণ্য।

তবে এবারের অগাস্টজুড়ে যখন বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনিদের ফিরিয়ে আনার কথা উচ্চারিত হচ্ছিলে, ঠিক তখনও বাংলাদেশের কিছু রাজনৈতিক দল বঙ্গবন্ধুকন্যা ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে বিষোদগারে লিপ্ত ছিল। ন্যূনতম সৌজন্যতাটুকুও দেখায়নি তারা। বিষয়টি হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই। কারণ এর শেকড় অনেক গভীরে প্রোথিত। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর প্রথমে খন্দকার মোশতাক ইনডেমনিটি জারি করে খুনিদের দায়মুক্তি দেন। এরপর জেনারেল জিয়াউর রহমান সংবিধান সংশোধন করে ইনডেমনিটিকে আইনে পরিণত করে ঘাতকদের বিচারের রাস্তা বন্ধ করে দেন। সেই থেকেই শুরু বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি, সেই থেকেই শুরু প্রতিহিংসার রাজনীতি। সেই ধারাবাহিকতায় জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠা করা দল বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময়, ২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট গ্রেনেড হামলা করে হত্যার চেষ্টা করে তৎকালীন প্রধান বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে। এমনকি বাধাগ্রস্ত করা হয় সেই বিচারপ্রক্রিয়াও। এসবের মধ্য দিয়ে যেনে এদেশের গণমানুষের সুবিচার পাওয়ার ব্যবস্থা চিরকালে স্তব্ধ করে দেওয়ার অপচেষ্টা করা হয়েছিল।

কিন্তু দিন বদলে গেছে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য দীর্ঘ সংগ্রাম হয়েছে। উগ্রতার কালোছায়া থেকে বেরিয়ে এসে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। গণমানুষের জীবনমান উন্নয়নের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চলছে। সোনার বাংলা ক্রমেই পরিণত হচ্ছে ডিজিটাল বাংলাদেশে। কিন্তু চিরস্থায়ী কলঙ্কের যে দাগ লেগে গেছে জাতির ইতিহাসে, তা মোছা যায় না। একারণেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও আইনের শাসনের প্রসঙ্গ উঠলেই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবে ১৫ অগাস্ট এবং পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ। আসুন সংক্ষেপে একটু ঘুরে আসি ইতিহাসের সেই দুর্ভাগ্যজনক অধ্যায় থেকে।

সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা ও খুনিদের দায়মুক্তি

১৫ অগাস্ট, ১৯৭৫। নির্মমভাবে হত্যা করা হয় বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তার পরিবারের সদস্যদের। এমনকি বর্বর ঘাতকদের হাত থেকে কোনো নারী ও শিশুও রেহাই পায়নি। শুধু বিদেশে থাকার কারণে ভাগ্যগুণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা। কিন্তু এই নির্মম হত্যাযজ্ঞের পরেও ক্ষান্ত হয়নি ষড়যন্ত্রকারীরা। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে খুনিদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে দেয় তারা। স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাকের নির্দেশে ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর, সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে জারি করা হয় 'ইনডেমনিটি' বা দায়মুক্তি অধ্যাদেশ। যার সহজ অর্থ হলো- বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারকে যারা হত্যা করেছে; সব বিচার থেকে তাদের দায়মুক্তি দেওয়া হলো; অর্থাৎ, বঙ্গবন্ধু হত্যার ঘটনায় কেউ বিচার চাইতে পারবে না।

এরপর, ১৯৭৯ সালের ৯ জুলাই, সংবিধান (পঞ্চম সংশোধনী) সংশোধন করে এই অধ্যাদেশকে আইনে পরিণত করেন সামরিক শাসক ও তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। এই আইনের মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত সংঘটিত সব অবৈধ হত্যা, গুম ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল প্রভৃতিকে বৈধতা দেওয়া হয়। ফলে সপরিবারের বঙ্গবন্ধু হত্যা, জেলের মধ্যে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা, সেনা সদস্যদের হত্যার বিচার বিচারের রাস্তা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। এমনিক বিচার চাওয়ার অধিকারও হারিয়ে ফেলে মানুষ।

খুনিদের শুধু দায়মুক্তি দিয়েই থেমে ছিল না ষড়যন্ত্রকারীরা, খন্দকার মোশতাক ১১ জন খুনিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চাকরি দেন। এরপর জিয়াউর রহমানের সময় প্রমোশন ও ব্যবসাবাণিজ্য করার সুযোগ দেওয়া হয় তাদের। এমনকি জেনারেল এরশাদের সময় ফ্রিডম পার্টি গঠন করে রাজনীতির নামে মাঠে অবাধ বিচরণের সুযোগ দেওয়া হয় এই খুনিদের। এমনকি খালেদা জিয়ার সময় রাষ্ট্রদূত পর্যন্ত বানানো হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর খুনিদের।

ইনডেমনিটি কী?

খন্দকার মোশতাকের স্বাক্ষরে জারি করা হয়েছিল ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ। পরে জিয়াউর রহমান এই অধ্যাদেশকে আইনে পরিণত করেন। বহুল চর্চিত ও বিতর্কিত এই কালো অধ্যায় সম্পর্কে একটু জানা যাক। আসলে ইনডেমনিটি আসলে কী এবং এটি প্রণয়নের উদ্দেশ্য কী ছিল, সেটি বিস্তারিত জানা প্রয়োজন।

মূলত, এই অধ্যাদেশে যা বলা হয়েছিল সংক্ষেপে তা হলো- ১৯৭৫ এর ১৫ অগাস্ট, সকালে যে সকল ব্যক্তি (ঐতিহাসিক) পরিবর্তন এবং সামরিক শাসন জারির উদ্দেশ্য যে সব কর্মকাণ্ড ঘটিয়েছিল এবং ঘটানোর পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছিল, তাদের বিরুদ্ধে কোনো দেওয়ানি, ফৌজদারি মামলা চলবে না, সুপ্রিমকোর্টসহ কোনো আদালতেই এবং কোর্ট মার্শালের নিয়মানুযায়ীও তাদের বিচার চলবে না। সোজা কথায় ওই তথাকথিত অধ্যাদেশ, যাকে ১৯৭৫ এর ১৯ নং অধ্যাদেশ হিসাব চিহ্নিত করা হয়েছিল, তার দ্বারা বঙ্গবন্ধু হত্যাকারী এবং হত্যা পরিকল্পনাকারীদের সকল প্রকার আইনের আওতা থেকে নিষ্কৃতি দেওয়ার একটি বেআইনি প্রচেষ্টা করা হয়। শুধু বঙ্গবন্ধুই নয়, ১৫ অগাস্ট সকালে তার পরিবারের সদস্যবর্গসহ অন্য যাদের হত্যা করা হয়, তাদের ব্যাপারে ঐ অধ্যাদেশের পরিধি টানা হয়।

বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পূর্বাপর

বঙ্গবন্ধু হত্যার দীর্ঘ দুই দশক পর, ১৯৯৬ সালে, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। এরপর ওই বছরের ১২ নভেম্বর, জাতীয় সংসদে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করা হয়। একইসঙ্গে, ১৯৯৬ সালের ২ অক্টোবর, বঙ্গবন্ধুর আবাসিক একান্ত সহকারী (পিএ) এ এফ এম মোহিতুল ইসলাম ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট সংঘটিত নারকীয় হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ধানমন্ডি থানায় একটি এফআইআর দায়ের করেন। ৩ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা সিআইডির কাছে হস্তান্তর করা হয় এবং তারা এই মামলার তদন্ত শুরু করে।

১৯৯৭ সালের ১৫ জানুয়ারি সিআইডি এই মামলায় ২০ জনকে অভিযুক্ত করে মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। ১৯৯৭ সালের ১ মার্চ ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আইনগত আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করার পর বিচারকার্যের জন্য মামলাটি ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতে পাঠান। ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর মামলার রায়ে বিচারক কাজি গোলাম রসুল ১৫ জনকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। ২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল হাইকোর্টের রায়ে ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল থাকে। তাদের মধ্যে আসামি আজিজ পাশা ২০০২ সালে পলাতক অবস্থায় জিম্বাবুয়েতে মারা যান। তবে, ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার গঠন করলে আবারও থমকে দাঁড়ায় বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার। এমনকি চাকরিচ্যুত ও দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি আজিজ পাশাকে মরণোত্তর চাকরি ফিরিয়ে দিয়ে অবসর সুবিধা দেওয়া হয়। এমনকি আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর জেলহত্যা মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি খায়রুজ্জামানকে গ্রেফতার করে এবং তার বিচারপ্রক্রিয়া চলমান ছিল। তবে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের ফলে, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার তাকে মুক্তি দিয়ে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত হিসেবে পাঠায়।

এছাড়াও ১৯৮৮ সালে বঙ্গবন্ধুর স্বীকৃত খুনি বজলুল হুদাকে মেহেরপুর থেকে সংসদ সদস্য বানিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান পরবর্তী সামরিক শাসক জেনারেল এইচ এম এরশাদ। এমনকি ১৯৮৬ সালে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি ফারুককে তার বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন করার সুযোগও দেন তিনি। এরপর বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে একটি বিতর্কিত নির্বাচনের আয়োজন করেছিলেন ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। সেই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর আরেক আত্মস্বীকৃত খুনি রশীদকে কুমিল্লা থেকে সংসদ সদস্য করে এনে বিরোধীদলের নেতা বানানোর পাঁয়তারা করা হয়েছিল বিএনপি-জামায়াতের পক্ষ থেকে।

তবে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গঠন করলে ফের গতি ফেরে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার। উচ্চ আদালতে ২৯ দিন শুনানির পর, ২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করে। হাইকোর্টে দেওয়া রায় বহাল রেখে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৫ আসামির দায়ের করা আপিল আবেদন খারিজ করে দেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ। রায়ে পঁচাত্তরের ১৫ অগাস্ট সপরিবারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা মামলায় ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন উচ্চ আদালত। ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের মধ্যে সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান, আর্টিলারি মহিউদ্দিন আহমদ, বজলুল হুদা এবং ল্যান্সার এ কে এম মহিউদ্দিনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। পরবর্তীতে ২০২০ সালে আরেক খুনি আব্দুল মাজেদকে গ্রেফতার করে ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে।

কিন্তু দীর্ঘ দিন পেরিয়ে গেলেও দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি বঙ্গবন্ধুর পলাতক ৫ খুনিকে। খুনি রাশেদ চৌধুরী, রিসালদার মোসলেমউদ্দিন, নূর চৌধুরী, খন্দকার আব্দুর রশীদ, শরিফুল হক ডালিমের অবস্থান খুঁজছে সরকার। সামরিক বাহিনীতে মধ্যমমানের পদে কর্মরত এই খুনিরা বিভিন্ন সময় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে অগাস্টের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে বিভিন্ন সাক্ষাৎকার দিয়েছে। এছাড়াও বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় আসামি ও সাক্ষীদের বয়ান থেকেও উঠে এসেছে নানারকম তথ্য। তারা সকলেই এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে আরো একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বা বসের সমর্থন ছিল বলে জানিয়েছে। সিআই-এর অবমুক্তকরণ তথ্য এবং তৎকালীন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের লিখিত গ্রন্থ থেকেও জানা যায়, এই বর্বর হত্যাকাণ্ডের পেছনে আরো প্রভাবশালী শক্তি ও ব্যক্তিও জড়িত। জাতির পিতাকে হত্যার ৩৫ বছর পরও যদি তার খুনিদের বিচার সম্ভব হয়, তাহলে একসময় নিশ্চয়ই এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যের কুশীলবদের মুখোশও উন্মোচিত হবে, বিচারের মুখোমুখি করা হবে তাদেরও। আর তাহলেই কলঙ্কমুক্ত হবে বাংলার রাজনৈতিক সংস্কৃতি, গতিশীল হবে বিচারব্যবস্থা। সেই সুদিনের অপেক্ষায়…