করোনাভাইরাস: কবে আর কীভাবে খুলবে স্কুল?

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 22 July 2021, 02:50 PM
Updated : 22 July 2021, 02:50 PM

করোনাভাইরাস মহামারীর ঊর্ধ্বমুখী গতি অব্যাহত। দ্বিমত নেই,  পরিস্থিতির সবচেয়ে বড় শিকার, অন্তত আমাদের দেশে, স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা। না, ওরা মোটেও ভালো নেই। গত প্রায় এক বছরে যত শিক্ষক-অভিভাবকের সঙ্গে কথা হয়েছে, সবার মুখে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এ কথাটা শুনতে হয়েছে, 'করোনা কবে যাবে বলুন তো? আর তো ভালো লাগছে না! বাচ্চাগুলোর কী হবে? ওদের যে কিছুতেই পড়ার টেবিলে বসাতে পারছি না!' একজনদুজন নয়, অনেকের কাছ থেকে এই মন্তব্য শুনতে হয়েছে। সবচেয়ে বেশি উদ্বেগে আছেন প্রাথমিক শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বাবা-মা ও শিক্ষকরা। 

বিক্ষিপ্তভাবে নানা জনে নানা চেষ্টা করছেন, যাতে স্কুল বন্ধ থাকা অবস্থায় লেখাপড়ার সঙ্গে বাচ্চাদের সংযোগটা বজায় রাখা যায়। জুমে ক্লাস নেওয়া, হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের সাহায্যে যোগাযোগ, ফোনে কথা, মাবাবাদের পাঠ্য বিষয় বুঝিয়ে দেওয়া, বাড়িতে কাজ করার জন্য ওয়ার্কশিট বানিয়ে পাঠানো ইত্যাদি নানা পদ্ধতিতে শিশুপাঠ অব্যাহত রাখার চেষ্টা চলছে। কিন্তু শেষ বিচারে এগুলো শিক্ষাকার্যক্রমকে অব্যাহত রাখতে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে বলে মনে হয় না। এগুলো যেন বঙ্গপোসাগরে এক বিন্দু জল ঢালা। কয়জনের স্মার্টফোন আছে? কয়জনই বা ইন্টারনেটের সুবিধা পায়?

ইউনিসেফ প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক সমীক্ষা থেকে জানা যায়সারা পৃথিবীর অন্তত ৩০ শতাংশ বাচ্চার কাছে ফোন বা ইন্টারনেটের সুবিধা নেই। বাংলাদেশে এই অনুপাতটা বেশি ছাড়া কম নয়। সমীক্ষা বলছে, বঞ্চিতদের তিনচতুর্থাংশই গ্রামাঞ্চলের এবং দরিদ্র পরিবারের। শুধু গ্রামে নয়, শহরেও বহু শিশুর কাছে স্মার্টফোনজাতীয় সুবিধা স্বপ্নের ব্যাপার। ফলে একটা দুশ্চিন্তা এই যে, দীর্ঘ দিন স্কুলের সঙ্গে সংযোগবিচ্ছিন্নতার কারণে বাচ্চাদের অনেকেই স্কুলছুট হয়ে যাবে। পৃথিবীর অভিজ্ঞতাও তাই বলে। ইবোলা মহামারির কারণে সাত মাস স্কুল বন্ধ ছিল লাইবেরিয়ায়, স্কুলছুট হয়েছিল ২৫ শতাংশ। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, আমাদের দেশে অনুপাতটা অনেক বেশি হবে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা মনে করছে, ২০০০ সালের পর বিশ্বে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে কমে যাওয়া শিশুশ্রমের হার আবার উল্টো পথ নিতে পারে। অচিরেই বিশ্বে এবং বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে বহু শিশুকে সস্তা মজুরের বাজারে দেখতে পাওয়া যাবে।

সেই সঙ্গে দুঃস্বপ্নের মতো নেমে আসছে আর এক সঙ্কট। একটা গোটা প্রজন্ম পাঠের অন্তর্গত বিষয়ের প্রায় কিছুই শিখতে পারবে না। স্কুল বন্ধ থাকার কারণে যথাক্রমে ৯০ শতাংশ ৮২ শতাংশ শিশু ভাষা গণিত বিষয়ক সামর্থ্যের দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এমনিতেই একদুসপ্তাহ কামাই হয়ে গেলে বাচ্চারা অনেক কিছু ভুলে যায়, তাদের নতুন করে শেখাতে হয়। এখানে তো মাসের পর মাস পড়ার সঙ্গে তাদের যোগাযোগ নেই। অনেকে শিশু শ্রেণির বা প্রথম শ্রেণির ক্লাসে আসতেই পারেনি। তাদের অবস্থা তো আরও করুণ।

গোটা প্রজন্মটাই অন্ধকারে চলে যাচ্ছে। এটা যে কত বড় ক্ষতি, অনুমান করতেও ভয় লাগে। শুধু গণিত, বাংলা, ইংরেজি, পরিবেশের মতো পাঠ্য বিষয়ের ক্ষতি হলে একটা কথা ছিল। বাচ্চাদের মানুষ হয়ে ওঠার পথটাই যেন আটকে গেছে। তাদের মানসিক বিকাশের অনেকটাই ঘটে স্কুলে। এখন ওরা নিঃসঙ্গ। একেবারে একা। শিক্ষাবিজ্ঞান আমাদের জানায় যে ভাষা, গণিত, বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়গত সামর্থ্য যতটা জরুরি, ততটাই জরুরি শিশুদের সামাজিকআবেগগত শিক্ষা (সোশিয়োইমোশনাল লার্নিং) বিভিন্ন সমীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে, বন্ধুদের সঙ্গে দেখা না হওয়া, খেলতে না পারা, বাইরে বেরোতে না পারা, প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগ না থাকা ইত্যাদি কারণে শিশুরা বিষণ্ণতার শিকার হচ্ছে, ধনীদরিদ্র নির্বিশেষে সব পরিবারেই। বিত্তশালী বাড়ির বাচ্চারা হয়তো প্রযুক্তি, মাবাবা, প্রাইভেট টিউশন প্রভৃতির সাহায্যে পাঠ্য বিষয় শিখে উঠতে পারছে, এবং প্রতিযোগিতার বাজারে তাদের দরিদ্র সহপাঠীদের থেকে হাজার হাজার মাইল এগিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু মানুষ হওয়ার প্রক্রিয়ায় বঞ্চিত হচ্ছে তারাও। তাদের মধ্যেও বেড়ে উঠছে ফোন বা ইন্টারনেটকে সঙ্গী করে, ঘরের মধ্যেই এক বিচ্ছিন্ন বিশ্বে নিজেকে বন্দি করে রাখার ঝোঁক।

শিক্ষাদানের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িতরা জানেন, শিশুর শিক্ষালাভের পথে প্রত্যেকটি সোপান কী ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। ভিত পাকা হয়ে গেলে উঁচু ক্লাসের ছাত্রছাত্রীরা অনেকটা নিজে থেকে অনেক কিছুই জেনে নিতে বা সংগ্রহ করে নিতে পারে। কিন্তু বাড়ার সময়ে আলো জল না পেয়ে যে চারাগাছটি শুকিয়ে গেল, তার ভবিষ্যতে ফুলেফলে পল্লবিত হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। বাংলাদেশের বিপুল জনসংখ্যার কথা ভাবলে বলতে হয়, মানবসম্পদের এত বড় অপচয় সমাজের অপূরণীয় ক্ষতি। 

এমন পরিস্থিতিতে যেকোনো উপায়ে শিশুদের শিক্ষাকার্যক্রম চালু করার প্রক্রিয়া নিয়ে ভাবাটা অত্যন্ত জরুরী। কারণ করোনা কবে যাবে, আদৌ যাবে কি না, সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো ছবি আমাদের সামনে নেই। ইতোমধ্যে অনেক সময় অতিক্রান্ত। তাই দ্রুত একটি শিক্ষামানচিত্র প্রস্তুত করা প্রয়োজন। এর জন্য প্রত্যেক জেলার জেলাশিক্ষা অফিস থেকে একটি বিশেষ দল গঠন করতে হবে, যে দলে বিভিন্ন ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, উপজেলা, পৌরসভা/মিউনিসিপ্যালিটির প্রতিনিধিরা থাকবেন। তারা নিজের এলাকার স্কুলে যারা দারিদ্র্য বা প্রযুক্তিগত অসুবিধার জন্য অনলাইন শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে না, সেই ছাত্রদের একটা তালিকা তৈরি করবেন।  

পরবর্তী পদক্ষেপ স্কুল চালু। স্যানিটাইজ়েশন পরিচ্ছন্নতার ভার শুধু স্কুলগুলির উপর ছেড়ে না দিয়ে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যান, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের চেয়ারম্যান ও প্রতিনিধিরা ব্যাপারটির তত্ত্বাবধান করবেন। একটি শ্রেণিকক্ষে এক বারে ২০ জনের বেশি ছাত্র হলে পারষ্পরিক দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব নয়। তাই প্রতি ব্যাচকে সপ্তাহে তিন দিন আনা যাবে। অনেক স্কুলে একেকটি ক্লাসে ৬০৭০ জন শিক্ষার্থী থাকে। সে ক্ষেত্রে সপ্তাহে দুইদিন করে একএকটি ব্যাচ আসবে। এই শিশুরা প্রায় দেড় বছর পাঠ থেকে দূরে ছিল। ফলে আগে যাচাই করে নিতে হবে, কতটা দক্ষতা তারা ধরে রাখতে পেরেছে। হঠাৎ পাঠ্যক্রম অনেক কমিয়ে কোনওমতে একটা পরীক্ষা নিয়ে উপরের ক্লাসে তুলে দিলে সমস্যা বাড়বে বই কমবে না। শ্রেণির বিভাগটাও তাই নতুন করে করতে হবে। অর্থাৎ, যারা কিছুটা দক্ষতা ধরে রাখতে পেরেছে, তারা থাকবে এক ক্লাসে; আবার যারা প্রায় সবটাই বিস্মৃত হয়েছে, তারা থাকবে নিচের শ্রেণিতে। এতে তাদের মধ্যে যাতে ব্যর্থতার বোধ না জাগে, সে বিষয়ে কিছুটা কাউন্সেলিং করাও প্রয়োজন। 

কিন্তু স্কুল মানে তো শুধু ক্লাসে বসে পড়াশোনা নয়। স্কুল মানে ভাগ করে টিফিন খাওয়া, ভাগাভাগি করে গল্পের বই পড়া, হাতে হাত রেখে চলা। এই নতুন ব্যবস্থায় শিক্ষকদের দায়িত্ব অনেক বেড়ে যাবে, সন্দেহ নেই। শাসন নয়, সেই কাউন্সেলিংএর সাহায্যই নিতে হবে ক্ষেত্রেও। 

পাঠ্যক্রমের বিষয়টি নিয়ে একটু বিশদ আলোচনা প্রয়োজন। এই যে বলা হল পুরনো পাঠ্যক্রম চালু করার আগে পূর্বপাঠ ঝালিয়ে নেওয়া প্রয়োজন, ব্যাপারে একটি সুনির্দিষ্ট নির্দেশিকা প্রয়োজন। পঞ্চম শ্রেণিতে পূর্বপাঠ হবে চতুর্থ শ্রেণিতে অর্জিত দক্ষতার ভিত্তিতে। এবং শিক্ষকরা কী ফল পাচ্ছেন, তার একটা রিপোর্ট তারা এক মাসের মধ্যে জমা দেবেন। তার ভিত্তিতে উচ্চতর কমিটি স্থির করবে পূর্বপাঠ আরও নিম্নশ্রেণির ভিত্তিতে হবে, না যেমন প্রথমে স্থির ছিল, তেমনই থাকবে। 

এই নব পর্যায়ে শিক্ষকঅভিভাবক সম্পর্কের সমীকরণ নিয়েও নতুন করে ভাবা প্রয়োজন। মফস্বল বা গ্রামাঞ্চলের বাংলা মাধ্যমের স্কুলগুলোয় অভিভাবক-শিক্ষক মিটিং আদৌ হয় কি না, জানা নেই। না হলে সেটি নিশ্চিত করাও সরকারের দায়িত্ব। বহু সময় দেখা যায়, তারা যেন দুই যুযুধান প্রতিপক্ষ। কিন্তু তা তো হওয়ার কথা নয়। পারষ্পরিক শ্রদ্ধা এখানে অমোঘ শর্ত। শিক্ষককে মনে রাখতে হবে, তিনি যাকে শেখাচ্ছেন, তার শেকড় বাড়িতে। তাকে সমৃদ্ধ না করলে সবই ভস্মে ঘি ঢালা হবে। অভিভাবকেরও নিজের একটা কর্মক্ষেত্র আছে। আছে একটা ছোট জগৎ, যেখানে তিনি শ্রদ্ধার পাত্র। অভিভাবককেও মনে রাখতে হবে, তাকে সহমর্মী হতে হবে। সন্তানকে ঘিরে তার নিজস্ব বৃত্ত; আর রকম অনেক বৃত্ত নিয়ে এক জন শিক্ষকের সংসার। তিনিও মানুষ, অতিমানব নন।

মহামারী আমাদের সত্যি কোনও যুগান্তের দ্বারে পৌঁছে দিল কি না, তার বিচার হবে তখনই, যখন জীবনের সমস্ত দিক একে একে খুলতে শুরু করবে। আমরা কি তখনও এমন এক জীবন যাপন করব, যেখানে আগের মানুষকে ধাক্কা মেরে এগিয়ে যেতে হয়? যেখানে স্বেচ্ছাচারে বাধা পেলে নৃশংসতা দানবীয় পর্যায়ে পৌঁছয়? নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য বুক ফুলিয়ে অপরের, অর্থাৎ সমষ্টির ক্ষতি করা যায়

এই নব যুগের শিশুদের পথ দেখানোর জন্য শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত, সকলে কি আর একটু সদিচ্ছাসম্পন্ন, আর একটু দায়বদ্ধ, তৎপর হতে পারি না