কোন পথে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন?

জি এম আরিফুজ্জামান
Published : 8 July 2021, 05:18 PM
Updated : 8 July 2021, 05:18 PM

গত ১৮ জুন ২০২১ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে মিয়ানমার বিষয়ক গৃহীত রেজুলেশনে দেশটির গণতান্ত্রিক সমস্যা, জরুরী অবস্থা, রাজনৈতিক বন্দি, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা আসিয়ানের কেন্দ্রিয় ভূমিকার প্রতি নজর দেওয়া হলেও প্রায় চার বছর ধরে চলমান রোহিঙ্গা সংকট এবং তাদের প্রত্যাবর্তনের  বিষয়টি  সমাধানের জন্য কোন আলোচনা করা হয়নি। জাতিসংঘের উচ্চপর্যায় থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে এমন উদাসীনতা প্রশ্নের উদ্রেক তৈরি করে বটে।  

প্রায় চার বছর আগে ২০১৭ সালের ২৫ অগাস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দেশটির সামরিক বাহিনী এবং তাদের দোসরদের জেনোসাইড ও বর্বরতার শিকার হয়ে প্রায় ১ মিলিয়ন রোহিঙ্গা বাংলাদেশের কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়। তবে, রোহিঙ্গাদের উপর মায়ানমারের সামরিক বাহিনী এবং তাদের দোসরদের এ ধরনের বর্বরতা প্রথম নয়। ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে রোহিঙ্গাদেরকে তাদের আবাস থেকে উচ্ছেদের নানা প্রচেষ্টা চলমান ছিল। মিয়ানমার ১৯৪৮ সালে গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে স্বাধীনতা লাভ করলেও মাত্র ১৪ বছরের মাথায় ১৯৬২ সালে সামরিক শাসকের কবলে চলে যায়। ১৯৬২ সালের পর মিয়ানমার মাঝে মাঝে গণতন্ত্রের পথে হাঁটলেও, সেটি ছিল শুভংকরের ফাঁকি ! সরকার এবং সংসদে কর্তব্যরত সেনাসদস্যের জন্য সংরক্ষিত আসনের ব্যবস্থা ছিল। সরকার পরিচালনা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে  সেনাবাহিনীর সুবিধাসংবলিত বিভিন্ন শর্ত জুড়ে দেওয়া ছিল। ২০১১ সালের পর থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত মিয়ানমারের রাজনৈতিক পুনর্গঠনের ফলে ২০১৫-তে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।  নির্বাচনে অং সান সুচির নেতৃত্বাধীন দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএল ডি) বিজয় লাভ করে । তবে, সেনাবাহিনী সাংবিধানিকভাবে সংরক্ষিত সংসদের ২৫ শতাংশ আসন নিজেদের জন্য বরাদ্দ রাখে এবং ক্ষমতার বিরাট অংশ ধরে রাখে। এই অর্থে, ১৯৬২ সালের পরে মিয়ানমার কখনও পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্রের স্বাদ পায়নি। সর্বশেষ, ২০২০ সালে ৮ নভেম্বরের অনুষ্ঠিত মিয়ানমারের নির্বাচনে (অনেক বিশেষজ্ঞ এটাকে মিয়ানমারের মুক্ত নির্বাচন হিসেবে অবহিত করেন) সুচির রাজনৈতিক দল এনএলডি সংসদের ৪৭৬টি আসনের মধ্যে ৩৯৬টি আসনে জয়ী হয় । অপরদিকে, সেনাসমর্থিত দল ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি কেবল ৩৩টি আসনে জয় লাভ করে। এ  সামরিক বাহিনী সমর্থিত দলের ভরাডুবির পর দেশটির সামরিক বাহিনী নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তোলে এবং ২০২১ সালের পয়লা ফেব্রুয়ারি সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইয়ের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুথানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে। মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন দলের প্রধান অং সান সুচি, রাষ্ট্রপতি উইন মিন্ট এবং সুচির রাজনৈতিক দল এনএলডির অনেক নেতাকে গ্রেপ্তার হোন।

১৯৬২ সালের প্রথম সামরিক জান্তা ক্ষমতায় আসার পর রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী সেনাবাহিনীর রোষানলে পড়ে। এর চরম বহিঃপ্রকাশ প্রথম দেখা যায় ১৯৭৮ সালে "অপারেশন নাগামিন ( Operation Dragon King)" এর মাধ্যমে রোহিঙ্গাদেরকে মিয়ানমারের অবৈধ অভিবাসী আখ্যা দিয়ে হত্যা, ধর্ষণ, অমানুষিক নির্যাতনের নামে অমানবিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত করে জান্তা সরকার। ১৯৮২ সালে বার্মা নাগরিকত্ব আইনে ( Burma Citizenship Law 1982) ১৩৫টি সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে নাগরিক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করলেও বাদ দেওয়া হয় 'রোহিঙ্গা' জনগোষ্ঠীকে। 'রোহিঙ্গা' জনগোষ্ঠীকে ভিনদেশী বিশেষত বাঙালি অবৈধ অভিবাসী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। মিয়ানমারের সরকারের এ ধরনের ন্যাক্কারজনক পদক্ষেপের ফলে  রোহিঙ্গারা হয়ে যায় রাষ্ট্রহীন জনগোষ্ঠী। সবশেষ, ২০১৭ সালের ২৫ অগাস্ট মায়ানমার সেনাবাহিনী  লাখ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর হত্যা, শিশু ও নারী নির্যাতন, বেদম প্রহার,  ঘর, বাড়ি স্থাপনা পুড়িয়ে দেওয়াসহ বিভিন্ন ধরনের অমানবিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়। 

রাখাইন রাজ্যের সংকটের সময়ে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিলেও গত প্রায় চার বছরে একজন রোহিঙ্গাও তাদের দেশে ফেরত যেতে পারেননি। রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার সরকারের মধ্যে ২০১৭ সালের ২৩ নভেম্বর ১৯ দফা সংবলিত একটা সমঝোতা দলিল স্বাক্ষরিত হয়। এই দলিলের ৩ নং অনুচ্ছেদে নাগরিকত্বের ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। ১৪ নং অনুচ্ছেদে জাতিসংঘসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাকে প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়ায় সংযুক্তের বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। এছাড়া ১৮ নং অনুচ্ছেদে কফি আনান কমিশনের সুপারিশের মাধ্যমে রাখাইন রাজ্যে সমস্যার সমাধান করা হবে মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে। এ দলিলটি রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে অন্যতম মাইলফলক হলেও মিয়ানমার সরকার বরাবরই 'রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী' শব্দকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেছে। তবে, এ চুক্তির আলোকে ২০১৯ সালের ২২ অগাস্ট মায়ানমার বাংলাদেশ থেকে প্রথম পর্যায়ে সাত ভাগে বিভক্ত করে ৩ হাজার ৪৫০ জন রোহিঙ্গাদের নিজেদের দেশে ফেরত নেওয়ার কথা বললেও তা বাস্তবে হয়নি। ২০১৯ সালে গাম্বিয়ার পক্ষ থেকে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে আরোপিত মামলা- Application of the Convention on the Prevention and Punishment of  the  Crime  of  Genocide  (The  Gambia  v. Myanmar) করা হয়। ২০২০ সালের ২৩ জানুয়ারি ওই মামলার শুনানি শেষে অন্তর্বর্তীকালীন আদেশে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে সরাসরি কিছু বলা না হলেও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী যে, মিয়ানমারের অধিবাসী তা স্পষ্ট। 

বাংলাদেশ এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মহলের পক্ষ থেকে বারবার মিয়ানমার সরকারকে 'রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন' বিষয়ে বলা হলেও গত চার বছরে একজনও রোহিঙ্গা তাদের দেশে ফেরত যায়নি।  'রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের' বিষয়টি অনেক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অং সান সুচির শাসনামলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের বিষয়টি আলোর মুখ দেখেনি। বরং নানা সময়ে অং সান সুচির বৈপরীত্য আচরণ এ সংকটকে আরও ঘণীভূত করে তুলেছিল। ২০২১ সালের পয়লা ফেব্রুয়ারি সামরিক অভ্যূথানের মাধ্যমে রাজনৈতিকভাবে মিয়ানমারের পট পরিবর্তন হওয়ায় 'রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে'র বিষয়ে অস্পষ্টতা তৈরি হয়েছে। সরকারের পাশাপাশি রোহিঙ্গা বিরোধী কট্টর গোষ্ঠী ও তাদের অনুসারীদের নানামুখী পদক্ষেপের বিষয়টি  রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশেষত চীন, ভারত এবং জাপানের নীরবতা এ সংকটকে বেগবান করে তুলেছে। ১৯৮২ সালের বার্মার নাগরিকত্ব আইন, মায়ানমারের রাজনৈতিক পটের পরিবর্তন এবং চীন-ভারতের মত রাষ্ট্রের শক্তিশালী ভূমিকা না রাখা রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে বিরাট চ্যালেঞ্জ  হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

২০২১ সালের ৩১ মে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার, ইউএনএইচসিআরের দুই জন কর্মকর্তার ভাসানচরের সফরের পর রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে কোন সুস্পষ্ট বক্তব্য দেননি। এ বছরেরই ১৬ জুন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে জাতিসংঘের মিয়ানমার বিষয়ক ক্রিস্টিন এস বার্গনারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠককালে প্রত্যাবর্তন বিষয়ে জাতিসংঘ স্পষ্ট একটি রোডম্যাপ তৈরির বিষয়টি নজরে আনা হয়। কিন্তু, তা সত্ত্বেও মাত্র দুই দিনের ব্যবধানে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে মিয়ানমার বিষয়ক গৃহীত রেজুলেশনে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া সত্যিই হতাশাজনক। 

বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে 'রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন' এর বিষয়ে প্রচেষ্টা চলমান থাকলেও জাতিসংঘ এবং জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার (ইউএনএইচসিআর), চীন, ভারতের মত রাষ্ট্রের 'রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন' এর বিষয়ে নীরবতা, ১৯৮২ সালের বার্মার নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের কোন উদ্যোগ না নেওয়া, মিয়ানমারের বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের বিষয়াদির আলোকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের বিষয়কে জটিল করে তুলছে ।