বিকৃত খবরের জন্য অমর্ত্যের কাছে ক্ষমা

Published : 10 Nov 2012, 02:38 PM
Updated : 10 Nov 2012, 02:38 PM

গত ৮ নভেম্বর শেরেবাংলা নগরস্থ পরিকল্পনা কমিশনে ৬ষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার পর্যালোচনা, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন সম্বন্ধে একটি বৈঠক হয়। এই বৈঠকে প্রতিভাত হয় যে গত দুই বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি ছিল প্রশংসনীয়। বিশ্বমন্দার তিন বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি এক-চতুর্থাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু ৬ষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দুইটি দুর্বলতা অত্যন্ত প্রকট। প্রথমটি হচ্ছে যে, বিশ্বমন্দার কারণে বিনিয়োগ স্থবির হয়ে আছে এবং বৈদেশিক বিনিয়োগ অত্যন্ত নিম্নমানের। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে যে, মূল্যস্ফীতি প্রাক্কলনের তুলনায় বেশি, যদিও সেখানে প্রশমনের ইঙ্গিত ইতিবাচক। এখানে উল্লেখ্য যে, ত্বরান্বিত উন্নয়নে মুদ্রাস্ফীতি সচরাচর বেশি হয়।

আমি সেই সভায় অংশগ্রহণ করি এবং সভা শেষ হওয়ার আগেই অন্য কাজে চলে যাই। সে সময় আমি সাংবাদিকদের সঙ্গে কিছু মতবিনিময় করি। অর্থমন্ত্রী হিসেবে আমি সেখানে বিনিয়োগের স্থবিরতা নিয়ে আমার বক্তব্য রাখি। আমি বলি যে, বাংলাদেশে সম্পদের স্বল্পতাহেতু বিনিয়োগ আশাপ্রদ নয়। দুর্ভাগ্যবশত অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগও খুব কম হচ্ছে।

নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেনের উদ্ধৃতি দিয়ে বলি যে, আমার সঙ্গে কিছুদিন আগে একটি আলোচনায় অমর্ত্য সেন দুঃখ করেন যে, বাংলাদেশে নানাক্ষেত্রে লক্ষণীয় অগ্রগতি হচ্ছে কিন্তু সেই তথ্য আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে প্রাধান্য পাচ্ছে না। এই বিষয়ে কিছুদিন আগে জনকণ্ঠের নির্বাহী সম্পাদক স্বদেশ রায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। স্বদেশ রায় আমার সঙ্গে ব্যাংকক বিমানবন্দরে এই আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন।

আমি বলি যে, বৈদেশিক বিনিয়োগ যে বাংলাদেশে উচ্চহারে আসছে না তার বিভিন্ন কারণ রয়েছে, যদিও মুডি'স বা এস এন্ড পি বাংলাদেশের ক্রেডিট রেটিং ভাল বিবেচনা করে। বাংলাদেশে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা বেশি। বিভিন্ন সেবা পেতে অনেক সময় লাগে। দুর্নীতিও এর একটি প্রতিবন্ধক। সর্বোপরি, বাংলাদেশে ব্যবসা করা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। আমি সবসময়ই বলে যাচ্ছি যে জ্বালানী স্বল্পতা এবং বিদ্যুতের সংকট বিনিয়োগে প্রবৃদ্ধির পরিপন্থী। একই সঙ্গে বলেছি যে এই সমস্যাটি আপাতত নিয়ন্ত্রণে এসেছে এবং ২০১৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশের উৎপাদন ক্ষমতা ৯ হাজার মেগাওয়াটে পৌঁছবে। বাংলাদেশ ইতিমধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে এইটি হবে এই এলাকার ট্রানজিট দেশ। এবং তাতে এই এলাকাটি একটি অর্থনৈতিক কেন্দ্রস্থলে পরিণত হবে। সেই হিসেবে বর্তমানে বৈদেশিক বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশ অত্যন্ত আকর্ষণীয় এলাকা। মনে রাখা দরকার যে ২০০৮ সালে বিশ্বব্যাপি যে মন্দা দেখা দেয় তাতে তিনটি খাতই ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই খাতগুলো হচ্ছে বিনিয়োগ, রফতানি এবং কর্মসংস্থান। এই অবস্থা মোকাবেলা করে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৬%-এর ঊর্ধ্বে রাখা সম্ভব হয়েছে। বিনিয়োগের হার অন্তত ২৪-২৫%-এ ধরে রাখা গেছে। এবং কর্মসংস্থানেও কোন ধ্বস হতে দেওয়া হয়নি। এই পরিপ্রেক্ষিতে সরসারি বৈদেশিক বিনিয়োগে আরো জোর পাওয়া উচিত।

আমি আমার ৮ তারিখের একটি বক্তব্যে বলি যে অধ্যাপক ইউনুসের নেতিবাচক অবস্থান এবং প্রচার বাংলাদেশে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের (DFI) পরিপন্থী। এবং তার প্রচারে পুরোপুরি সততা নেই। গত দুই বছর ধরে অধ্যাপক ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের ভবিষ্যত নিয়ে অনবরত আশংকা প্রকাশ করে যাচ্ছেন এবং প্রচার করছেন যে সরকার এই উদ্যোগটিকে ধ্বংস করতে চায়। এই প্রচারের সঙ্গে বাস্তবতার কোন সম্পর্ক নেই এবং এইটি দেশের জন্য বেশ ক্ষতিকারক। এই অভিমতটি আমার ব্যক্তিগত অভিমত এবং এ নিয়ে আমি অন্য কারো সংগে আলোচনা করি নি। এ সম্বন্ধে অমর্ত্য সেন কোনো মন্তব্য করেননি, তার বক্তব্য ছিল বাংলাদেশের দ্রুত উন্নয়ন নিয়ে। আমাদের সংবাদ মাধ্যমের কেউ কেউ বুঝে বা না বুঝে দুটো বিষয়কে সম্পৃক্ত করে এ সম্বন্ধে বিকৃত এবং বানোয়াট বক্তব্য রেখেছেন। পুরো বক্তব্যটি ভিডিওতে ধারণ করা হয় এবং সেইটি যথাযথভাবে ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ও অনেকগুলো সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। কেউ কেউ অহেতুক অমর্ত্য সেনের আলোচনার সঙ্গে অধ্যাপক ইউনূসের নাম সংযুক্ত করেছেন।

আমি বলি যে, অধ্যাপক ইউনূস-এর সমস্যা হচ্ছে তিনি কোনমতেই গ্রামীণ ব্যাংক ছাড়তে চান না। তিনি সেখানে তার প্রভাব এবং কর্তৃত্ব বহাল রাখতে সচেষ্ট। প্রশ্নোত্তরে আরও বলি যে অধ্যাপক ইউনূস-এর প্রচারযন্ত্র অত্যন্ত শক্তিশালী এবং অধ্যাপক ইউনূস-এর আন্তর্জাতিক খ্যাতি তার পক্ষে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। এ ছাড়া আমরা সকলেই তাকে নিয়ে গর্ববোধ করি, আন্তর্জাতিকভাবে তার গ্রহণযোগ্যতা অতি উচ্চমার্গের। ব্যক্তিগতভাবে আমি তাকে একজন বন্ধু ও শ্রদ্ধেয় মানুষ এবং দারিদ্র্য বিমোচনে নিবেদিত জনদরদী হিসেবে সম্মান করি।

আমি অত্যন্ত দুঃখিত যে অমর্ত্য সেনের বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রশংসাসূচক বক্তব্যে অহেতুক অধ্যাপক ইউনূসের নামটি সংযুক্ত হয়েছে এবং সেজন্য আমি অমর্ত্য সেনের কাছে বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমের বিকৃত খবর প্রচারের জন্য ক্ষমা চাইছি। আমি মনে করি যে অমর্ত্য সেন বাংলাদেশের একজন অত্যন্ত একনিষ্ঠ শুভানুধ্যায়ী এবং বাংলাদেশের কৃতিত্বের বিষয় তিনি সবসময়ই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সাগ্রহে তুলে ধরছেন।

আমি সবসময় বলে এসেছি যে অধ্যাপক ইউনূস আমাদের দেশের অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তি এবং তিনি এদেশের ক্ষুদ্রঋণের ব্যাপক প্রসার সাধন করেছেন। গরীব মানুষকে আত্মসম্মানে ভূষিত করেছেন এবং দারিদ্র্য বিমোচনে মূল্যবান অবদান রেখেছেন। তিনি নারীমুক্তিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। প্রায় ৩০ বছরের অক্লান্ত ও একনিষ্ঠ পরিশ্রমে গ্রামীণ ব্যাংককে তিনি একটি শক্ত অবস্থানে প্রতিষ্ঠা করেন। ব্যক্তিগতভাবে এই উগ্যোগকে নানাদেশে ছড়িয়ে দিতে আমি নিজেও সচেষ্ট ছিলাম। মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া এবং নেপালে গ্রামীণ মডেলের বিস্তৃতিতে আমি ব্যক্তিগতভাবে সহায়ক ভূমিকা রেখেছি। গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠার সঙ্গেও আমার কিছুটা সংশ্লিষ্টতা ছিলো।

গ্রামীণ ব্যাংক-এর নিজস্ব বিধি অনুযায়ী অধ্যাপক ইউনূস ৬০ বছর বয়সের পরে আর ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকতে পারেন না, এই বিধিমালা অধ্যাপক ইউনূসই প্রণয়ন ও প্রকাশ করেন। কিন্তু গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদ তাকে ১৯৯৯ সালে অনির্দিষ্টকালের জন্য ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োজিত করে। এই নিযুক্তি অবৈধ ছিল। এই অনিয়ম বাংলাদেশ ব্যাংক ২০০১ সালেই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। কিন্তু অধ্যাপক ইউনূস সম্মানিত ব্যক্তি ও বাংলাদেশের নয়নের মনি বলে এ ব্যাপারে পরবর্তী কোন পরিচালনা পর্ষদ বা সরকার এবিষয়ে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। তারা হয়তো ধারণা করেন যে, তিনি স্বতোপ্রবৃত্ত হয়ে অধ্যাপক ইউনূস আইনের শাসন বহাল করবেন।

২০১০ সালের নভেম্বরে গ্রামীণ ব্যাংক বিশ্ব সংবাদ মাধ্যমে নরওয়ে টেলিভিশনের এক প্রামাণ্যচিত্রের ফলে বিশ্বব্যাপি দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বাংলাদেশে তখন এই বিষয়ে একটা তদন্ত করার দাবি ওঠে এবং অধ্যাপক ইউনূসও তা সমর্থন করেন। এই বিষয়ে অর্থমন্ত্রী হিসেবে আমি আমার দায়িত্বের অংশ হিসেবে একটি পর্যালোচনা কমিটি (অধ্যাপক ইউনূসের প্রতি সম্মান দেখিয়ে তদন্ত কমিশনের পরিবর্তে 'পর্যালোচনা' কমিটি) গঠন করি এবং অধ্যাপক ইউনূস-এর সঙ্গে বিষয়টি আলোচনার মাধ্যমে সুরাহা করার উদ্যোগ নেই। আমি অধ্যাপক ইউনূসকে প্রস্তাব দেই যে, তিনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করলে তাকে গ্রামীণ ব্যাংকের সাথে আজীবন সম্পর্ক রাখার একটি সুযোগ সৃষ্টি করা যেতে পারে। অধ্যাপক ইউনূস সেই সুযোগটি গ্রহণ না করে বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।

পরিবর্তে অধ্যাপক ইউনূস আমাকে বলেন যে তিনি গ্রামীণ ব্যাংক ছাড়লে প্রতিষ্ঠানটি ধ্বংস হয়ে যাবে ("Grameen Bank will collapse")। তার এই বক্তব্য আমাকে শুধু ব্যথিতই করেনি বরং গভীরভাবে হতাশ করে। আমি ভাবলাম যে আমার আদর্শ ও শ্রদ্ধেয় বন্ধু তিরিশ বছরে কী করলেন। আমি আমার হতাশা অধ্যাপক ইউনূসকে তখনি জানিয়ে দেই। অধ্যাপক ইউনূস তখন আদালতের আশ্রয় নেন এবং আদালতের রায় হওয়ার পর পদত্যাগ করেন। তারপরেই কিন্তু অধ্যাপক ইউনূস অনবরত বলে বেড়াচ্ছেন যে সরকার গ্রামীণ ব্যাংক দখল করতে চায়। যদিও সরকার থেকে বারবারই বলা হয়েছে যে গ্রামীণ ব্যাংক যেভাবে পরিচালিত হচ্ছে সেইভাবেই পরিচালিত হবে। গ্রামীণ ব্যাকের চালিকাশক্তি তার শাখা পর্যায়ে বিকেন্দ্রায়িত ব্যবস্থা, এবং এই ব্যবস্থাই এই প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। অধ্যাপক ইউনূস-এর সমর্থকদের প্রচারে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে এক সময় অনেক আমানত তুলে নেয়া হয় এবং গ্রামীণ ব্যাংক-এর কার্যক্রম পরিচালনায় অসুবিধা সৃষ্টি হয়। সেই অবস্থা উত্তরণে প্রায় এক বছর অতিবাহিত হয় এবং ২০১১ সালে গ্রামীণ ব্যাংক-এর কার্যক্রম ব্যাপকভাবে প্রসার লাভ করে, সদস্যদের সঞ্চয়ও বাড়ে এবং বাস্তবে ঋণ আদায়ও ভাল হয়। ক্ষুদ্রঋণ এখন শুধুমাত্র গ্রামীণ ব্যাংক এবং ব্র্যাক দেয় না অথবা আশা এবং প্রশিকাই জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান নয়। বিশেষ করে পল্লী-কর্মসহায়ক সংস্থার উদ্যোগে আরও অসংখ্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এই ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখছে। সরকারও ক্ষুদ্রঋণ প্রসারে বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছে এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও এই বিষয়ে সক্রিয় হয়েছে। ক্ষুদ্রঋণের জন্য যে আগাম প্রতিবছর দেয়া হয় এটা এখন তৃতীয় স্থানে, চলতি ঋণ এবং বানিজ্যিক ঋণের পরেই, অবস্থান করে। ২০১১-১২ অর্থবছরে প্রায় সাড়ে ৩৩ হাজার কোটি টাকার ক্ষুদ্রঋণ বাংলাদেশে বিতরিত হয়েছে, যাতে গ্রামীণ ব্যাংকের হিস্যা হলো ১১ হাজার কোটি টাকা। ক্ষুদ্রঋণকে গ্রামীণ ব্যাংক এবং ব্র্যাক এই দেশে একটি শক্ত অবস্থানে নিয়ে এসেছে এবং সরকার এই অবস্থানটিকে আরও শক্ত রাখতে বদ্ধপরিকর। একইসঙ্গে মহিলাদের উন্নয়নে গ্রামীণ ব্যাংক যে ভূমিকা রেখেছে সেই ভূমিকা এই সরকার আরও শক্তিশালী এবং বেগবান করছে। নারীশক্তির ক্ষমতায়নে অবদানের জন্য বাংলাদেশ বিশ্ব স্বীকৃতি লাভ করেছে।

গ্রামীণ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী গ্রামীণ পরিচালনা পর্ষদ ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিযুক্তির জন্য একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করে। এই কাজটি গত দেড় বছরে করা সম্ভব হয়নি। অধ্যাপক ইউনূস-এর সমর্থকরা দাবি করেন যে এই অনুসন্ধান কমিটির আহ্বায়ক হবেন অধ্যাপক ইউনূস। এই প্রস্তাবটি সরকারের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি এবং সরকার তাদেরকে এই দাবি থেকে সরিয়ে আনতে অনেক প্রচেষ্টা গ্রহণ করে। কিন্তু গ্রামীণ ব্যাংক-এর সুষ্ঠু পরিচালনার খাতিরে উপযুক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালকের আশু নিযুক্তিও অত্যন্ত জরুরি। এই উদ্দেশ্যে সরকার এই অনুসন্ধান কমিটি নিয়োগের জন্য পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যানকে ক্ষমতা প্রদান করে এবং তদনুযায়ী একটি অনুসন্ধান কমিটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং তারা তাদের কাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। তাদের কাজে সরকার কোন ধরনের প্রভাব বিস্তার করতে চেষ্টা করছে না এবং তাদের কাজ অত্যন্ত স্বচ্ছ এবং সুষ্ঠুভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা আশা করছি যে অচিরেই তাদের প্রস্তাব অনুযায়ী একজন উপযুক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক পাওয়া যাবে।

অধ্যাপক ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের নামে অনেক সামাজিক উদ্যোগ প্রায় দুই দশক আগে শুরু করেন, যদিও এই পালের হাওয়ায় জোর এসেছে গত এক দশকে। শুরুতে গ্রামীণ ব্যাংকের সম্পদ এবং সবসময় গ্রামীণ ব্যাংকের নামই এই উদ্যোগকে বিকশিত করেছে। কিন্তু এইসব উদ্যোগে গ্রামীণ ব্যাংকের কোন হিস্যা ছিল না। এমনকি গ্রামীণ টেলিফোনেও গ্রামীণ ব্যাংকের কোন শেয়ার নেই। এইসব সামাজিক উদ্যোগ সার্বিকভাবে গরীবের মঙ্গলের জন্য নিবেদিত। এইসব প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশ কোন পরিচালক পান না এবং শুধুমাত্র কার্যক্রম প্রসারের জন্য তা ব্যবহৃত হয়। বিশেষভাবে গ্রামীণ সদস্যদের মঙ্গলের জন্য এইসব প্রতিষ্ঠান নিবেদিত নয়। অবশ্যি, "গ্রামীণ কল্যাণ" সবসময়ই অধ্যাপক ইউনূস-এর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে সাহায্য পায় এবং তারা একান্তই গ্রামীণ সদস্যদের মঙ্গলে নিবেদিত।

সামাজিক উদ্যোগের যে ব্যাপক জাল অধ্যাপক ইউনূস ছড়িয়েছেন তাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে নানা ধরনের প্রশ্ন আছে। ইতিমধ্যে প্রায় ২০টি প্রতিষ্ঠান আর সামাজিক উদ্যোগ হিসেবে বহাল নয়। তারা হয় ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে, অথবা দেউলিয়া হয়েছে, অথবা লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। তাদের প্রত্যেকেই কিন্তু (মোট সংখ্যা হয়তো ৫৪) গ্রামীণ ব্যাংকের সুনাম (Goodwill)-এর উপর প্রতিষ্ঠিত। এবং তাদের অনেকগুলিতে গ্রামীণ ব্যাংককে কিছু পরিচালক নিযুক্ত করতে হয়। এই প্রতিষ্ঠানগুলির অবস্থান খুবই নাজুক এবং তাদের জন্য আমাদের কোম্পানি আইন অথবা সামাজিক প্রতিষ্ঠান আইনে কোন বিশেষ ব্যবস্থা নেই। সরকার কোন প্রতিষ্ঠানেরই কার্যক্রম আটকে রাখেনি অথবা তাতে কোন নতুন পরিচালক নিযুক্ত করে নি। এগুলোর সিংহভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ইউনূস যার পরিচয় গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নিবন্ধিত। অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে এই বিষয়টি আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করার উদ্দেশ্য নিয়েই সরকার এখনও কোন পদক্ষেপ নেয়নি। সরকার এই বিষয়টি সুরাহা করার জন্য বিশ্বব্যাংকের প্রতিষ্ঠান আইএফসি-কে (International Finance Corporation) অনুরোধ করে। কিন্তু তারা কোন কোন প্রতিষ্ঠানে সংশ্লিষ্ট বলে এই দায়িত্বটি নিতে অসম্মতি জ্ঞাপন করে। অতঃপর এই বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখবার জন্য একটি অত্যন্ত উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন সরকার গঠন করেছে। এতেও অধ্যাপক ইউনূস-এর ঘোর আপত্তি রয়েছে।

আমার ব্যক্তিগত অভিমত হচ্ছে যে অধ্যাপক ইউনূস কোনমতেই গ্রামীণের পরিচালনা তার হাত থেকে ছেড়ে দিতে রাজি নন। হয় তিনিই গ্রামীণ ব্যাংকের কোন পদে (ব্যবস্থাপনা পরিচালক না হলে পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি) অবস্থান করবেন নতুবা তার মনোনীত ব্যক্তি দায়িত্ব নেবেন। এইটিকে একটি সুস্থ, সবল এবং স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড় করানোর ব্রত আমি ১৯৮৩ সালে গ্রহণ করি। অধ্যাপক ইউনূস-এর গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠালগ্নে আমি (আমি তখনও অর্থ এবং পরিকল্পনা মন্ত্রী ছিলাম) তাকে পরামর্শ দেই যে তিনি যেন একটি টেকসই ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। আমি আরো বলি যে বাংলাদেশে একশ' বছরেরও বেশি সময় ধরে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান ব্যক্তি উদ্যোগে গঠিত হয়েছে কিন্তু সবক'টিই উদ্যোক্তাদের সঙ্গে সঙ্গে লোপ পেয়েছে। এই ঐতিহ্য থেকে বেরিয়ে এসে পরিধারণযোগ্য প্রতিষ্ঠান স্থাপনের চ্যালেঞ্জ আমি তখন তাকে দেই। এবং পরবর্তীকালে নিয়মিতভাবে এ বিষয়ে অধ্যাপক ইউনূসকে স্মরণ করিয়ে দেই। বর্তমানে অর্থমন্ত্রী হিসেবে এই উদ্দেশ্যটিই সফল করার উদ্যোগ নিয়েছি। ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান টিকে থাকবে, কোন ব্যক্তির উপর নির্ভর করবে না। এখানেই আমার সঙ্গে অধ্যাপক ইউনূস-এর মতপার্থক্য।

গত তিন বছর আমাকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়ক, চিন্তাবিদ এবং অন্যান্য গুণীজন বারবার প্রশ্ন করেছেন যে অধ্যাপক ইউনূস-এর সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার কেন ঝগড়া করছে এবং তার সঙ্গে একটা সমঝোতা কেন হচ্ছে না। আর্থিক খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান এবং এই খাতের নেতৃবৃন্দের কাছে অর্থমন্ত্রী হিসেবে আমি সবসময়ই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছি। তাদের প্রশ্ন ছিল যে অধ্যাপক ইউনূস-এর কারণে বাংলাদেশে বৈদেশিক সম্পদ প্রবাহ কি কোনভাবে বিঘ্নিত হয়েছে। আমি প্রত্যুত্তরে সবসময়ই বলেছি যে সহজশর্তে ঋণ এবং অনুদান পেতে কোথাও কোন ঘাটতি হয় নি বরং গত তিন বছরে সরকারি সহায়তা (Official Development Assistance) ব্যাপকভাবে বেড়েছে। (কিন্তু তুলনামূলকভাবে বাস্তবায়ন ক্ষমতা তত বাড়েনি যদিও সেখানে প্রবৃদ্ধির উচ্চমাত্রা লক্ষণীয়)। কিন্তু সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ বাংলাদেশে তেমন আগ্রহ দেখায় নি। অবশ্যি, গত বছর সর্বপ্রথম বৈদেশিক বিনিয়োগ ১.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে।

আমি বিশ্বাস করি যে অধুনা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কৃতিত্বের যে স্বীকৃতি পাওয়া যাচ্ছে (এমনকি Economist-এর প্রতিবেদনেও) তাতে বৈদেশিক বিনিয়োগ ভবিষ্যতে বাড়বে। বাংলাদেশে রাজস্ব আদায় এবং সরকারি ব্যয় তিন বছরে দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি মহাচীনের পরেই এই তিন বছরে সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি লাভ করেছে। বাংলাদেশে মানব-সম্পদ উন্নয়ন সূচক (HDI Index) রুয়ান্ডা ছাড়া যে কোন দেশ থেকে বেশি হারে বেড়েছে। (কতিপয় যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার ফলে, যেমন- তিমুর, অবশ্যি এই প্রবৃদ্ধির হার অনেক বেশি)। বাংলাদেশের মত একটি গরীব দেশে সব উন্নয়ন নিজস্ব সম্পদে সম্ভব নয়। বাংলাদেশে সরকারি ব্যয় এখনও জাতীয় আয়ের মাত্র ১৮.৫% (তিন বছরে ১৫.৮% থেকে ১৮.৫% হয়েছে)। এবং বাংলাদেশে মোট বিনিয়োগ মাত্র ২৫%। এই সম্ভাবনাময় দেশটিকে এগিয়ে নেয়ার জন্য সরকারি ব্যয় অচিরেই ২০%-এ পৌঁছা উচিত। রাজস্ব আদায় ১৫%-এ পৌঁছা উচিত। এবং বিনিয়োগ ৩২%-এ পৌঁছা উচিত। এই সম্ভাবনা আগামী দুই বছরের মধ্যে বাস্তবায়িত হবে বলে আমি বিশ্বাস করি।

আবুল মাল আবদুল মুহিত: গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রী।