খালেদা জিয়ার ভারত সফর: দেশের স্বার্থে নাকি দলের স্বার্থে?

মোহাম্মদ সেলিম
Published : 10 Nov 2012, 01:56 PM
Updated : 10 Nov 2012, 01:56 PM

বাংলাদেশের রাজনীতিতে "ইন্ডিয়া ফ্যাক্টর" গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। তাই ছোট-বড় রাজনৈতিক দল, নেতা নেত্রী, সামরিক-বেসামরিক আমলা, নীতি নির্ধারক, প্রচার মাধ্যম সর্বত্র ভারত বিশেষ গুরুত্ব পেয়ে থাকে। বর্তমানে বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপি'র চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার ভারত সফরকে কেন্দ্র করে দু'দেশেই কৌতূহল দেখা গেছে। এই সফরের ফলাফল জানতে বা সুনির্দিষ্টভাবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের সঙ্গে বৈঠকের বিষয়বস্তু জানতে সবার মধ্যেই উৎসুক্য লক্ষ করা যাচ্ছে। এর পূর্বে সর্বশেষ ২০০৬ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে খালেদা জিয়া ভারত সফর করেন। সেই সফরের অভিজ্ঞতা প্রীতিকর কিছু ছিল না। তাঁর সময়ে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক শীতল ও চরম নেতিবাচক হয়ে পড়ে। দীর্ঘ ছয় বছর পর বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে এই প্রথম তিনি ভারত সরকারের আমন্ত্রণে সাতদিনের সফরে ভারত গেছেন। পরিবর্তিত আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে বিএনপির ভারত-নীতির হালহকিকত বাংলাদেশের রাজনীতিতে বেশ গুরুত্ব বহন করে। ইতোমধ্যে গণমাধ্যমের কল্যাণে খালেদা-মনমোহন বৈঠকের প্রকাশ্য অংশ (দু'জন একান্তে আলাপ করেছেন, যা পত্রিকায় আসেনি) আমাদের জানার সৌভাগ্য হয়েছে। এই আলোচনায় যাবার আগে দু'দেশের সম্পর্কের প্রকৃতি নিয়ে একটু জানা প্রয়োজন।

বাংলাদেশের প্রতিবেশী রাষ্ট্রের প্রসঙ্গ উঠলে ভারতের নামই প্রথম মনে আসে যদিও মিয়ানমারের সঙ্গেও আমাদের সীমান্ত আছে। উল্লেখ্য বাংলাদেশের মোট সীমান্তের ৭৮.৮৬ শতাংশ ভারতের সঙ্গে। বাস্তবতা হলো ভারতের ভূখন্ড, জনবল, অর্থনীতি ও সামরিক শক্তির বিবেচনায় কেবল দক্ষিণ এশিয়ায় নয় বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটেই ভারতীয় প্রভাব অনস্বীকার্য। কিন্তু ভারতের সঙ্গে নানা কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সম্পর্ক ভাল না। ভারত যখন বিশ্বশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে, তখন আঞ্চলিক পর্যায়ে তার অবস্থান আরও সংহত হওয়া প্রয়োজন। এছাড়া বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান এবং রণকৌশলগত গুরুত্ব অপরিসীম। ভারত বৃহৎ রাষ্ট্র হলেও বাংলাদেশ উপক্ষেনীয় নয়।

বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের প্রাচীনকাল থেকে রয়েছে ইতিহাস ঐতিহ্যগত সাদৃশ্য। এবং ভারতের ছয়টি রাজ্যের সঙ্গে ভূখন্ডগত সম্পর্ক। ভাষা, জাতিগত মিলের কারণে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষভাবে বাংলা ভাষাভাষি ভারতীয়দের সঙ্গে বাংলাদেশের অধিবাসীদের জাতিগত সহানুভূতি এবং সহমর্তিতার বন্ধন রয়েছে। এর প্রমাণ পাওয়া যায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, ভারতের সরকার ও জনগণের সাহায্য-সহানুভূতি ও অনন্যসাধারণ ভূমিকা আলোচনা ব্যতীত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।

মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে এই পর্যন্ত বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে আর্দশ ও ব্যক্তিগত ইমেজ বড় ভূমিকা পালন করেছে। দু'দেশের সম্পর্কের মাঝে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ছিলো একটা বড় বিভাজন রেখা। নিরেট জাতীয়তাবাদী হিসেবে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্বার্থে কারো সঙ্গে আপোষ করেন নি। সে কারণে ফারাক্কা, সমুদ্রসীমা এবং ওআইসিতে যোগদান বিষয়ে নিজ দেশের স্বার্থকে সম্মুন্নত রাখতে পেরেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সময়ে ১৯৭৪ সালের সীমান্ত চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ ৩১ বর্গমাইল এলাকা বেশী লাভ করে, বিনা ক্ষতিপূরণে। মিসেস গান্ধীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক ছাড়া এমন চুক্তি সম্পাদন সম্ভব হতো না। এর সঙ্গে বাংলাদেশ ও ভারতের রাষ্ট্রীয় আর্দশের সাযুজ্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

জিয়ার ক্ষমতা দখলের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে স্থবির যুগের সূচনা হয়। অবিশ্বাস, আস্থাহীনতা ও বৈরিতা হলো এর বৈশিষ্ট্য। এরশাদও খালেদার সময়ের একই নীতি অব্যাহত রাখেন। শেখ মুজিবের সরকারকে বিরোধী রাজনৈতিকদল "ভারতপন্থী" বলে দোষারোপ করতো। কিন্তু জিয়ার আমলে গুণগত যে-পরিবর্তন হয়েছে তা হলো , সরকারই 'ভারতবিরোধী' ভূমিকা গ্রহণ করে। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারতবিরোধী নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে মৌলবাদী ও চীনপন্থি বামদলগুলোকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সরকারি অনুকূল্য দেওয়া হয়। পাকিস্তানি ভাবধারায় সংবিধানও সংশোধন করা হয়, ইসলামি রূপ দেবার জন্য।

জিয়ার সময়ে অনুষ্ঠিত প্রতিটি নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) সভা-সমাবেশে বক্তৃতা বিবৃতিতে বড় জায়গা জুড়ে ভারত বিরোধিতা স্থান পায়। বিএনপি'র ইশতেহারে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয় যে, "দলটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিচারে রূশ-ভারত প্রভাব বলয়ের বাইরে অবস্থান করবে, কার্যত বিএপির লক্ষ/আদর্শ তিনটি। প্রথমতঃ সর্বাত্মকভাবে আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করা, দ্বিতীয়তঃ বাংলাদেশের যে কোন সমস্যা/অকল্যাণের জন্য ভারতকে দায়ী করা, তৃতীয়তঃ মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ও পাকিস্তানপন্থী মৌলবাদী, জঙ্গী গ্রুপ ও দলকে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া। এবার আসি খালেদা জিয়ার সাম্প্রতিক ভারত সফর প্রসঙ্গে। খালেদার ভারত সফরকে দু'দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন 'সূর্যোদয়' হিসেবে বলা হচ্ছে। খালেদা জিয়া ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, "ক্ষমতায় গেলে বাংলাদেশের ভূখন্ড ভারতের কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীকে ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না।" ভারতের নেতা-নেত্রী যার সঙ্গেই দেখা হচ্ছে খালেদা মৃদু হেসে বিনীত ভঙ্গীতে একই কথা বলছেন। ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে ভীষণ আগ্রহী। ভারতের মনে বিন্দুমাত্র আঘাত লাগে, বা ভারতের জন্য অকল্যাণকর কোনো কিছু করবেন না। ভারতের সদ্য নিয়োগ প্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদকে বলেছেন, "এই সফর নতুন দিনের সূচনা; পেছনে নয়, আমাদের তাকাতে হবে সামনের দিকে।" বেগম জিয়াকে সমর্থন করে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, "আমরাও গতকাল নয়, সামনের দিকে তাকাতে চাই।"

কেন অতীতের প্রতি খালেদার এই ভীতি? কেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খালেদার "গতকালের" ঘটনাও দেখতে চায় না? কিন্তু বললেই অতীত মুছে ফেলা যায়? ১৯৯১-১৯৯৬, ২০০১-২০০৬ সালেদার সময়ে দু'দেশের সম্পর্ক কোন অতল গহবরে পৌঁছে ছিল, হিন্দু-সংখ্যালঘু নির্যাতন কী ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল তা সবই ইতিহাস। ১০ ট্র্যাক অস্ত্র ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাতে তুলে দেওয়ার ষড়যন্ত্র, বিচ্ছিন্নতাবাদীরা খালেদার ভাষায় 'দেশপ্রেমিক', সবই অতীত, সবই ইতিহাস, এবং সে ইতিহাস কলঙ্কময়।

প্রতিশ্রুতি দেওয়া সহজ। কিন্তু পালন করা কঠিন। খালেদা জিয়া, স্বামী জেনারেল জিয়া বা সন্তান তারেক কেউ কথা রাখেন নি। ১৯৭৮ সালে জিয়া ভারতকে ট্রানজিট প্রদানে সম্মত হন। ১৯৮০ সালে কলকাতায় গ্যাস সরবরাহের ঘোষণা দেন। কোনোটাই কার্যকর করেন নি। ২০০১ সালের নির্বাচনের পূর্বে ভারতের বিজেপি সরকারের নীতি নির্ধারকদের তারেক জিয়া প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে উত্তর ভারতে গ্যাস সঞ্চালনের পাইপলাইন বসাতে দেবে। তারেকও পিতার ন্যায় কথা রাখেন নি। এবার খালেদার পালা।

ভারত সরকার খালেদার প্রতিশ্রুতিতে আশ্বস্ত হবে কি না? এটি একান্ত ভারতীয় বিষয়। ভারত আপাতদৃষ্টিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যায় মনোভাব দেখাচ্ছে যেখানে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি এমনকি জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় এলে ভারতের কিছু যায় আসে না। অবশ্য ভারত পুরোপুরি মার্কিনীভাব রপ্ত করতে পারেনি। যে কারণে জামায়াত ইসলামীকে মার্কিন প্রশাসনের মতো 'মডারেট গণতান্ত্রিক দল' হিসেবে ভারত এখনও স্বীকৃতি দেয়নি। তবে দিলে আমরা খুব বিস্মিত হব না। কারণ মমতা বন্দোপাধ্যায়ের ভাষায় "ভারতের অসাংবিধানিক, সংখ্যালঘু সরকারের" প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বলেছেন, বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দল ও জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার প্রক্রিয়ায় বিশ্বাস করে ভারত। বিশেষ কোনো ব্যক্তি বা কোনো দলকে ভারত প্রাধান্য দেয়, এমনটা নয়।

তাহলে জাতীয় পার্টি, বিএনপির পর জামায়াতে ইসলামীও ভারত সরকারের আমন্ত্রণ পাচ্ছে। মনমোহনের বক্তব্যে সে রকম ইঙ্গিত পাচ্ছি। কোনো ব্যক্তি বা দলকে ভারত প্রাধ্যন্য দেয় না। এটা খালেদার মনোরঞ্জনের জন্য মনমোহনকে বলতে হলো! ভারী লজ্জার কথা। মহান ভারতের জন্য মোটেই সম্মানজনক হলো না। কারণ শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগকে গুরুত্বহীন বলার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে ভারতের মিত্রের সংখ্যা কী ডাবল হয়ে গেল?

আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের সব চেয়ে পুরোনো ও বড় দল। কিন্তু নানা কারণে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিল সব চেয়ে কম। সুতরাং আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না আসতে পারলে দলের বিপর্যয় হবার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু ভাবতে অবাক লাগে শুধুমাত্র ক্ষমতায় যাবার জন্য খালেদা জিয়া ভারতকে নানা রকম প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। এতে বিএনপির ইমেজ নাকি ইতিবাচক হচ্ছে। গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কী অবস্থা হতো যদি নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ একই কাজ করতো। দেশ বিক্রির অপরাধে মাসব্যাপী হরতাল হতো পারতো।

বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থে ভারতের সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্ক প্রয়োজন। অর্থনৈতিক উন্নয়ন, শান্তি, নিরাপত্তা-সকল রাষ্ট্রের কাম্য। গণতন্ত্রে বিশ্বাস করলে মানতে হবে জনগণের ভোটে সরকার গঠিত হবে। বাইরের শক্তির ইন্ধন বা জুজুর ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। বিএনপি ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে যা বলেছে তা বাংলাদেশের সংসদে বলা উচিত ছিল। বড় দলগুলোর একসঙ্গে বসে বাংলাদেশের 'ভারতনীতি' নির্ধারণ করা প্রয়োজন। তা কোনো দলীয় নীতি হবে না। বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থে প্রণীত হবে তা। খালেদা জিয়ার সফরের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে বিএনপি ও ভারতের মধ্যে অনাস্থা ও সন্দেহ দূর করা। তাহলে এটা বলা অসঙ্গত হবে না খালেদা দলের স্বার্থে ভারতে গেছেন, দেশের স্বার্থে নয়।